যুদ্ধ মানেই হত্যা, রক্ত, বীভৎসতা। যুদ্ধ কখনোই কাম্য নয়। কিন্তু যখন নিজের অস্তিত্ব, মানবাধিকার, ভাষা, সংস্কৃতি, জাতি হুমকির মুখে পড়ে; তখন যুদ্ধ আবশ্যক হয়ে ওঠে। আর একবার যদি আপনি যুদ্ধে নেমেই পড়েন, তখন আর মায়া-মমতা দেখানোর সুযোগ নেই। হয় আপনি বাঁচবেন, শত্রু মরবে। অথবা আপনি মরবেন, শত্রু বাঁচবে। শ্রীকৃষ্ণ চাননি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ হোক। তিনি পাণ্ডবদের হয়ে ছয় মাস দূতিয়ালি করেছেন কৌরবদের সঙ্গে, যাতে যুদ্ধটা রোধ করা যায়। কৌরবদেরকে বারবার বুঝিয়েছেন পাণ্ডবদেরকে রাজ্যভাগ দিতে, কিন্তু কৌরবরা পাণ্ডবদের রাজ্যের ভাগ দিতে রাজি হয়নি। বরং কৌরবরা বারবারই কৃষ্ণকে অপমান করেছে, তাকে নিয়ে উপহাস করেছে। অপমান সহ্য করেও কৃষ্ণ চেষ্টা করেছেন যাতে যুদ্ধ এড়িয়ে কোনোভাবে সমঝোতা হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি পাণ্ডবদের পাঁচ ভাইয়ের জন্য পাঁচটি জন্মন বা গ্রাম চেয়েছিলেন, যাতে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকতে পারেন। কিন্তু পাণ্ডবদের পাঁচ ভাইকে পাঁচটি গ্রাম দিতেও অপারগতা প্রকাশ করেন দূর্যোধন। ফলে যুদ্ধটা আবশ্যক হয়ে ওঠে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের যুদ্ধ। যে কৃষ্ণ যুদ্ধ রোধ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, সেই কৃষ্ণ-ই যুদ্ধ শুরুর পর আর পিছনে ফিরে তাকাননি, কোনো মায়া-মমতা দেখাননি। কুরুক্ষেত্র ময়দানে বিপক্ষে স্বজন, গুরুদেব, গুরুভাইদের দেখে অর্জনের হৃদয় আর্দ্র হয়ে উঠেছিল, স্বজনের বুকে অস্ত্রনিক্ষেপ করতে হবে বলে তিনি অস্ত্র ত্যাগ করে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকতে চেয়েছিলেন। তখন কুরুক্ষেত্র ময়দানে অর্জুনের রথের সারথী কৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিয়ে তিরষ্কার করে তাতিয়ে দেন যাতে অর্জন যুদ্ধ থেকে বিরত না হন। অর্জুনকে দেওয়া কৃষ্ণের সেই বিশদ উপদেশ গীতায় লিপিবদ্ধ আছে। অত্যাচারীকে বিনাশ করে ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যই কৃষ্ণ অর্জনকে বলেছিলেন- ‘ক্ষত্রিয়রূপে তোমার স্বধর্ম বিবেচনা করে তোমার জানা উচিত যে, ধর্ম রক্ষার্থে যুদ্ধ করার থেকে ক্ষত্রিয়ের পক্ষে মঙ্গলকর আর কিছুই নেই। তাই, তোমার দ্বিধাগ্রস্থ হওয়া উচিত নয়।’
কৃষ্ণের উপদেশে সন্তুষ্ট হয়ে অর্জুন পুনরায় হাতে তুলে নেন গাণ্ডীব। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ, স্বজনঘাতী যুদ্ধ। কৃষ্ণের কাছে যুদ্ধে মানে ছিল- জয় অথবা মৃত্যু। ফলে যুদ্ধের ময়দানে কোনো আবেগ তাকে স্পর্শ করেনি। যুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য যতরকম কৌশল অবলম্বন করা দরকার তিনি করেছেন। এমনকি ছলনার আশ্রয় নিয়ে পাণ্ডব-কৌরবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য এবং কুন্তীর জ্যেষ্ঠপুত্র কর্ণকে হত্যা করিয়েছেন। যুদ্ধের ময়দানে জয়-ই মূলকথা, ছলনাও সেখানে যুদ্ধকৌশল। কৃষ্ণের দক্ষ যুদ্ধনীতির কাছে একের পর এক ধরাশায়ী হয়েছে কৌরবরা। ভারতবর্ষের অধিকাংশ বীর এবং রাজারা কৌরবদের পক্ষে থাকা সত্ত্বেও কৃষ্ণের যুদ্ধনীতির কাছে হেরে গেছে কৌরবরা। যে কৃষ্ণ যুদ্ধ রোধ করতে ছয়মাস দূতিয়ালি করেছেন অপমান সয়েও, সেই কৃষ্ণই যুদ্ধের ময়দানে কৃষ্ণ এক ইঞ্চি মাটিও ছাড় দেননি কৌরবদের।
যুদ্ধ ঠাট্টা মশকরার বিষয় নয়, হালকাভাবে নেবার বিষয়ও নয়। আপনার যদি দূরদর্শিতা না থাকে, তাহলে আপনি যুদ্ধে জেতার পরও আপনার বিজয় ভূলুণ্ঠিত হতে পারে।
১১৯১ সালে মোহাম্মদ ঘোরী দিল্লী দখলের জন্য অগ্রসর হন। দিল্লীর শাসক তখন পৃথ্বীরাজ চৌহান। পৃথ্বীরাজ ঘোরীর বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন বর্তমানের হরিয়ানার তরাইন নামক স্থানে। দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজিত হয় ঘোরীবাহিনী এবং মোহাম্মদ ঘোরী বন্দী হন পৃথ্বীরাজের বাহিনীর হাতে। ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি ও প্রাণহানি সত্ত্বেও পৃথ্বীরাজ সসম্মানে মুক্তি দেন ঘোরীকে। ক্ষমা-ঔদার্য ভারতবর্ষের প্রাচীন সংস্কৃতি। আর এই সংস্কৃতি-ই ভারতবর্ষকে বারবার বিপদে ফেলেছে। কেননা মধ্যপ্রাচ্যের লুণ্ঠনকারী ডাকাতেরা ক্ষমা-ঔদার্যের মর্ম বোঝে না। মোহাম্মদ ঘোরী তার বাহিনীকে সংগঠিত করে পরের বছর আবার দিল্লী আক্রমণ করেন। এবার পরাজিত হন পৃথ্বীরাজ। ঘোরী পৃথ্বীরাজের চোখ উপড়ে ফেলে তাকে হত্যা করেন। একবছর আগের ক্ষমার বিপরীতে হত্যা! ভুল করেছিলেন পৃথ্বীরাজ চৌহান, যুদ্ধের অভিধানে ক্ষমা নামক শব্দের স্থান দিতে নেই। তার ভুলের মাশুল তিনি দিয়েছিলেন নিজের জীবন দিয়ে।
উল্লেখ্য যে মুহাম্মদ ঘোরীর বাহিনীর সাথে ভারতে এসেছিলেন সুফিসাধক খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি। এই জিহাদী সুফিসাধক খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি অস্ত্রহাতে ঘোরীর পক্ষে জিহাদে অংশগ্রহণ করেন। এরপর তিনি আজমীরের আনাসাগর সরোবরের কাছে আস্তানা গড়ে তোলেন এবং আশপাশের প্রচুর হিন্দুকে জোরপূর্বক ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন এবং মন্দির ধ্বংস করতে যোদ্ধাদের প্ররোচিত করেন।
যাইহোক, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আল শামস। যুদ্ধে জেতার পর আমরা ভাবলাম কাজ শেষ। স্বাধীন দেশে এবার খাউ-দাউ আর বগল বাজিয়ে স্ফুর্তি করো! অথচ আরও কাজ তখন বাকি ছিল। ত্রিশ লক্ষ শহীদের বিপরীতে কমপক্ষে দুই লক্ষ রাজাকার, আলবদর, আল-শামস এবং পাকিস্তানপন্থী সেনা ও পুলিশ সদস্যকে হত্যা করার দরকার ছিল। আমি স্বজ্ঞানে আবারও বলছি- কমপক্ষে দুই লক্ষ দেশদ্রোহী হত্যা করার দরকার ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেটা করেননি। আর করেননি বলেই স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরেই নিজের জীবন দিয়ে তাকে সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্য করতে হয়েছে। তার ভুলের মাশু দিতে হয়েছে জাতীয় চার নেতাকেও। তার ভুলের মাশুল এখন দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে মানুষকে। কোনো কোনো রাজাকারের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে বঙ্গবন্ধুর ভালো সম্পর্ক ছিল, দেশ স্বাধীনের পরও সেই রাজাকারদের কারো কারো প্রতি তার কেমন দরদ ছিল তা অনেকেই জানেন, কিন্তু কেউ মুখ খোলেন না। কেবল ব্যক্তিগত আড্ডায় এসব আলোচনা হয়। নিশ্চয় সেই ইতিহাস কোনো একদিন সামনে আসবে।
আজকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনাবিরোধী অমানুষে ছয়লাব সারা বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক পরিবার, যারা দেশের বিরোধিতা করেনি, তাদের আজকের প্রজন্মও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী হয়ে উঠেছে। এটা কেমন করে সম্ভব হলো? সম্ভব হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের পর রাজাকার-আল-বদর নামক বিষবৃক্ষ বাঁচিয়ে রাখার কারণে। ঢাল হিসেবে ইসলাম ধর্মকে সামনে রেখে অবিরাম দেশবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে রাজাকার আর তাদের ছানাপোনারা। আজকে দেশের সব সেক্টরে স্বাধীনতাবিরোধীদের রমরমা। তাহলে ক্রিকেট-ফুটবল আর বাদ যাবে কেন? ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তেভেজা বাংলাদেশে আমাদের দেখতে হয় রাজাকার, খুনী, ধর্ষক দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর জানাজায় লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল! আমাদের দেখতে হয় আমাদের কোনো কোনো ক্রিকেটরা আমাদের গৌরবের প্রতীক বিসিবির লোগোর বাঘের মুখ ঢেকে রাখে! আমাদের দেখতে হয় আমাদের একজন ক্রিকেটার বিজয় দিবস-স্বাধীনতা দিবসকে কটাক্ষ করে পোস্ট দেয়, আর খেলতে নেমে জাতীয় সংগীত গাওয়া থেকে বিরত থাকে!
যুদ্ধপোরাধীদের বিচার হোক, শাহবাগের গণজাগরণ হোক, ব্লগার হত্যা হোক কিংবা হোক নারী স্বাধীনতার কথা। কতজন মানুষ এসবের পক্ষে থাকেন? কতজন মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসবের পক্ষে কথা বলেন? তার চেয়ে হাজার হাজার গুণ বেশি লোক এসবের বিপক্ষে কথা বলে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের শাহাবাগী, চেতনাবাদী ইত্যাদি বলে কটাক্ষ করে! অশালীন ভাষায় গালাগালি করে। আজ গালি দিচ্ছে, আগামীতে গলা কাটবে! গলা তো ইতোমধ্যে কেটেছেই কতজনের।
বিফলে গেছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, ত্রিশ লক্ষ মানুষের প্রাণ, দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রম! বেহাত হয়ে গেছে আমাদের সাধের বাংলাদেশ! মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের চূড়ান্ত মৃত্যু এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা!
ঢাকা
সেপ্টেম্বর, ২০২৩
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ভোর ৫:২১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




