কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার হিন্দুদেরকে মদমুক্ত পূজা করতে বলেছেন। মদমুক্ত পূজা করলে নাকি এত পূজামণ্ডপ হবে না। তার কথার অর্থ এই দাঁড়ায় যে হিন্দুরা মদ খাওয়ার জন্য পূজা করে। মদ কি দূর্গাপূজার উপকরণ! পূজার নৈবদ্য!
২০২২-২৩ অর্থবছরে রেকর্ড পরিমাণ মদ উৎপাদন ও বিক্রি করেছে বাংলাদেশের কেরু এ্যান্ড কোম্পানি। এ সময় ৫৭ লাখ ৭৩ হাজার প্রুফ লিটার মদ বিক্রি করে কোম্পানিটি আয় করেছে প্রায় ৪৩৯ কোটি টাকা। অন্যান্য পণ্যের আয়-ব্যয় মিলিয়ে ও রাজস্ব দেওয়ার পর গত অর্থবছরে কেরুর নিট মুনাফা দাঁড়ায় প্রায় ৫৮ কোটি টাকা। এর বাইরে প্রতিবছর বিপুল পরিমান মদ আমদানী করা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে মদ আমদানি হয় ২৮ লাখ লিটার। এর মাত্র ৪ শতাংশ বা ১ লাখ লিটার শুল্ক দিয়ে আমদানি করা হয়। বাকি ২৭ লাখ লিটার আমদানি হয় শুল্কমুক্ত বন্ডেড ওয়্যারহাউজের মাধ্যমে। ২০১৬-১৭ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত দেশে ২ কোটি ১৮ লাখ লিটার বিদেশি মদ আমদানি হয়। এর মধ্যে মাত্র ১১ লাখ লিটার বাণিজ্যিকভাবে আমদানি করা হয়। বাকি মদ আমদানি করে ছয়টি ডিপ্লোম্যাটিক বন্ডেড ওয়্যারহাউজ। এই হিসাবের বাইরেও দেশীয় পদ্ধতিতে দেশে প্রচুর মদ উৎপাদিত হয়।
এই বিপুল পরিমান মদ কারা পান করে? হিন্দুরা? ছিঃ ছিঃ হিন্দুরা কত খারাপ, মদ খাওয়ার জন্য পূজা করে! এই যে ঢাকার অভিজাত এবং মধ্যম মানের যত বার, এখানে কারা মদ পান করে? ধুতি পরে, তিলক কেটে সব হিন্দুরা দলে দলে এইসব বারে যায় পান করতে, তাই না! আর বিপুল পরিমান ইয়াবা, আইস, সীষা ইত্যাদি মাদকের যেসব চালান আসে দেশে, সেসবও কেবল হিন্দুরা খায়! কত খারাপ হিন্দুরা!
আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার বলেছেন, ‘পূজায় সকল মেয়েরা ঘর থেকে বের হয়, তারা যদি ফ্রি মুভ না করতে পারে, তাহলে পূজা করে লাভটা কী।’
কেন মেয়েরা ফ্রি মুভ করতে পারে না? এই প্রসঙ্গে আমি আমার শৈশব-কৈশোর-যৌবনের অভিজ্ঞতা বলি। এখনকার কথা বলছি না, কেননা এখন পূজা-পার্বণে গ্রামে যাওয়া হয় না। আমাদের বাজারে কাত্যায়নী পূজা হতো, রাত হয়ে গেলে ছেলেরা মেয়েদের চারপাশে কর্ডন দিয়ে বাড়ি ফিরতো। তারপরও অসতর্কতায় মাঝে মাঝে দু-একটি অঘটন ঘটত। এই অঘটনগুলো কোনো হিন্দু ছেলে ঘটাতো না। সন্ধ্যার পর আমাদের গ্রামের মন্দিরের সামনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। বাইরে থেকে কিছু যুবক আসতো, উশৃঙ্খল আচরণ করত। তাদেরকে বারবার অনুরোধ করা হতো শান্ত থাকার জন্য। তাদের পাশে গ্রামের ছেলেদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো, যাতে তারা মেয়েদের দিকে ঘেঁষতে না পারে। বাজারের পাশের যে মাঠে আমি ক্রিকেট খেলতে যেতাম, সেখানে আট-নয়টি গ্রামের ছেলেরা থাকতো, অই যুবকদের কেউ কেউ ছিল আমারই ক্রিকেট খেলার সঙ্গী। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যেত মন্দিরের সামনে ওদের আচরণ দেখে! আমাদেরই গ্রামের পূজায় একবার একটা বারো-তেরো বছরের মেয়ের গায়ে বিছুটি দেওয়া হয়েছিল। কোনো হিন্দু ছেলের সাহস ছিল না কোনো মেয়ের গায়ে বিছুটি দেওয়ার, সে যদি পাঁড় মাতালও হলেও না।
অবশ্যই পূজার সময় কিছু ছেলে মদ পান করে, অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু মদ খাওয়ার জন্য পূজামণ্ডপের সংখ্যা বেড়েছে, এই উক্তি ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক! ২০২১ সালে কুমিল্লায় দূর্গাপূজার সময় মন্দিরে কোরান রেখে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে হিন্দুদের মন্দির এবং বাড়িতে হামলা চালানো হয়। পরে সেই নাশকতা ছড়িয়ে পড়ে আরও পনেরটি জেলায়। হিন্দুদের অসংখ্য ঘরবাড়ি, মন্দির, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো মুসলমান মৌলবাদীরা। হামলায় প্রায় ১৫ জন নিহত হয়। কুমিল্লার আওয়ামী লীগ নেতারা এই হামলার দায় এড়াতে পারেন না এবং তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের সাম্প্রতিক মন্তব্যে মৌলবাদী শক্তি হিন্দুদের ওপর হামলা চালাতে আরও উৎসাহ পাবে।
হিন্দু ছেলেরা মদ পান করলেও এদেরকেই আবার মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে হয়। কেন, কাদের ভয়ে? কারা পূজামন্দিরের ভিড়ের মধ্যে যুবতীর স্তনে হাত দেবার সুযোগ খোঁজে এবং হাত ছোঁয়াতে পারলে কুৎসিত আনন্দ পায়? এইসব প্রশ্নের উত্তর সামনে আসা জরুরি এবং এই সঙ্কট সমাধানের দায়িত্ব আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মতো রাজনীতিকদের এবং প্রশাসনের।
আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের ভাষ্য অনুযায়ী হিন্দুরা যদি এত মাদকসেবী, এত মনুষ্যত্বহীন-ই হবে, তাহলে একটু তথ্য নিজেরাই যাচাই করে দেখুন যে বাংলাদেশে হিন্দু ধর্ষক এবং খুনির সংখ্যা আনুপাতিক হারে কত। অভিযোগ করা হয় যে আদিবাসীরা সারাদিন মদের নেশায় থাকে। আমি একজন কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স সাংবাদিক হয়ে, নিউজের মধ্যে থেকে, দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি যে বাংলাদেশে আদিবাসীদের মধ্যে অপরাধীদের সংখ্যা সবচেয় কম। আজ পর্যন্ত আমার চোখে পড়েনি যে কোনো আদিবাসী ধর্ষণ করেছে। হয়ত থাকতে পারে কিছু নিউজ, হয়ত আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু থাকলেও সেটা খুবই নগন্য সংখ্যক। অথচ যারা মদকে হারাম বলে, দ্বীনের ছবক দেয়, সেই হুজুর কর্তৃক বালক এবং বালিকদের ধর্ষণের শিকার হবার খবরে ছয়লাব থাকে নিউজ পোর্টালগুলো!
মুন্সীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব এমপি মৃণাল কান্তি দাসকে ‘মালাউন’ বলে অকথ্য ভাষায় ভর্ৎসনা ও সাম্প্রদায়িক আক্রমণ করেছেন। ভাবা যায়, একজন মেয়ে একজন এমপিকে মালাউন বলছেন! একজন এমপি’র যখন এই অবস্থা, তাহলে সাধারণ হিন্দুদের কথা চিন্তা করে দেখুন যে তারা কতটা অসহায়, কতটা নিরাপত্তাহীনতায় বেঁচে থাকে এই দেশে!
আবার ফিরি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের প্রসঙ্গে। একেবারে নুরানী চেহারা। তার কন্যা তাহসিন বাহারও ঈমানী ছবক দিয়ে থাকেন। গত কয়েকদিন ধরে পিতার পক্ষে নানা ছবক দিচ্ছেন। একটা স্ক্রীণ শর্ট দিলাম, যেখানে তিনি- ধর্ম যার যার উৎসব সবার হয় না বিষয়ক ছবক দিয়েছেন! তাহসিনের স্বামী সাইফুল আলম রনির একটা পোস্টের স্ক্রীণ শর্ট দিলাম, যেটা তিনি দিয়েছিলেন কুখ্যাত রাজাকার দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মৃত্যুর পর। আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় সন্দেহজনক! পুরো পরিবার মৌলবাদী ভাবাদর্শের, কখনোই আ্ওয়ামী লীগের আদর্শের নয়। যদিও আওয়ামী লীগের চরিত্রের স্খলন ঘটেছে! মৌলবাদের পুরু মেদ জমেছে আওয়ামী লীগের শরীরে!
আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার মদমুক্ত পূজার ছবক দেন, তাহসিন বাহারও ঈমানী ছকব দেন। একটা ভিডিওতে দেখলাম তাহসিন বাহার নাইটক্লাবের লাল-নীল আলোর মধ্যে গানের তালে তালে অমন স্থুল শরীরে নর্তন-কুর্দন করছেন! তিনি কি নাইটক্লবে রুহ আফজা খেয়ে অমন নর্তন-কুর্দন করেছেন! তাহসিন নাইটক্লাবে কিভাবে নাচবেন, কি খেয়ে নাচবেন, কি পরে নাচবেন, এটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। এই বিষয়টি আমি সামনে উল্লেখই করতাম না যদি না তিনি তার পিতার পক্ষে ঈমানী ছবক দিতেন। যাইহোক, নৃত্য অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের একটি শিল্প মাধ্যম, আমার খুবই পছন্দের। কিন্তু অমন থলথলে শরীরের নর্তন-কুর্দন দেখলে আমার চোখের ও চিত্তের পীড়া হয়! তবু দেখতেই হলো, রুহ আফজা খেয়ে ঈমানী ছবকওয়ালীর নর্তন-কুর্দন যে!
ভারতে বেশিরভাগ রাজ্যে মুসলমানদের ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দল আছে। যারা তাদের অধিকার নিয়ে সরব। আছে সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীও। কিন্তু বাংলাদেশের দেড়কোটি হিন্দুদের মধ্যে সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী দূরের কথা, একটা রাজনৈতিক দলও নেই। ফলে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো দাবার ঘুঁটির মতো তাদের ব্যবহার করে! সুযোগ বুঝে নির্যাতন-ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে। ১৯৪৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত এই ভূ-খণ্ডে হিন্দুরা যে পরিমান নির্যাতনের শিকার হয়েছে, যে পরিমান ভূমি তারা হারিয়েছে, এইরকম নির্যাতনের শিকার যদি মুসলমানরা কোনো দেশে হতো আর তাদের জনসংখ্যা যদি দেড় কোটি হতো, তাহলে তারা কমপক্ষে পাঁচটা রাজনৈতিক দল এবং একশোটা সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি করত।
হিন্দুদের ভাবতে হবে ভোট এবং রাজনীতি নিয়ে। তারা কাকে ভোট দিচ্ছে, কাদের ভোট দিচ্ছে, কেন দিচ্ছে, কী পাচ্ছে, কী পাচ্ছে না; এই হিসাব করে একতাবদ্ধ হতে হবে। এই দেশের বাস্তবতায় হিন্দুদের ন্যায্য পাওনা কোনো রাজনৈতিক দলই দেবে না, হিন্দুদের আদায় করে নিতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দল গঠন করা। কিন্তু রাজনীতি অসচেতন, আত্মকেন্দ্রিক, ঈর্ষাপরায়ণ, নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে লিপ্ত হিন্দুরা কি পারবে একতাবদ্ধ হয়ে নিজেদের মুষ্টিবদ্ধ হাত মাথার উপরে তুলতে?
ঢাকা।
অক্টোবর, ২০২৩
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই অক্টোবর, ২০২৩ রাত ৮:০৯