
বহুকাল আগে থেকেই শিল্প ও শিল্পীর জন্য উর্বর ভূমি এই বঙ্গ। বহু কবি, ভাস্কর, চিত্রকর, সংগীতশিল্পীর জন্ম এই ভূমিতে। বহিরাগত মুসলমান বিহার ও মন্দিরগুলো আগুনে পুড়িয়ে না দিলে চর্যাপদের মতো আরও অসংখ্য পদ কিংবা আরও গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যেতেও পারত। নেপালে না থাকলে চর্যাপদও হয়ত হারিয়ে যেত। শিল্পীরা কেবল এই অঞ্চলেই নয়, বাইরেও যেতেন শিল্প সৃষ্টির জন্য। ইন্দোনেশিয়ার বালি ও জাভার মন্দির আর ভাস্কর্যের প্রসার ঘটেছিল বাঙালি শিল্পীদের হাত ধরে। যা নিয়ে আমি একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করেছি, শেষ করতে হয়ত আরও চার-পাঁচ বছর লাগবে। ইসলামী আগ্রাসনের ফলে ইন্দোনেশিয়ার বালি ব্যতিত বিপুলসংখ্যক মানুষ ধর্মান্তরিত হয়, বালি এখনও হিন্দু অধ্যুসিত। ধর্মান্তরিত হলেও ইন্দোনেশিয়ার অধিকাংশ মুসলমান তাদের সংস্কৃতি ত্যাগ করেনি। তাদের জাতীয় গ্রন্থ রামায়ণ, জাতীয় পাখি রামায়ণের গড়ূর। অনেক পৌরাণিক চরিত্রের ভাস্কর্য তাদের রাস্তাঘাট, বিদেশের দূতাবাসে শোভাবর্ধন করছে। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের টাকায় ইন্দোনেশিয়ার পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে, ইসলামী উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
বালি ছাড়াও ইন্দোনেশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে অনেক ভাস্কর আছেন, যারা মুসলমান। গড়ছেন সরস্বতী, রাম, হনুমান এবং অন্যান্য পৌরাণিক চরিত্রের ভাস্কর্য। মানুষ ভাস্কর্য কিনে ঘরের শোভাবর্ধন করছে। এজন্য সেইসব ভাস্করকে পাশের বাড়ির কারো কটু কথা শুনতে হয় না, কেউ তাদেরকে পরকাল উচ্ছন্নে যাবার কথা বলে না।
কিন্তু আমাদের দেশের প্রতিমাশিল্পী ইসমাইলকে কটু কথা শুনতে হয়, মুসলমান হয়ে কেন তিনি হিন্দুদের পূজার প্রতিমা তৈরি করছেন! দশ বছর ধরে মূর্তি গড়ছেন ইসমাইল, এটাই তার পেশা, রুটি-রুজির অবলম্বন।
দুই বছর আগে নেত্রকোনা বাজারে এক চাচাকে দেখেছিলাম লক্ষ্মীর সরা বিক্রি করতে, তার কাছ থেকে একটা সরা কিনেছিলাম। গতকাল আবিষ্কার করলাম প্রতিমাশিল্পী ইসমাইলকে। অসাধারণ তার হাতের কাজ, পাল সম্প্রদায়ের আর পাঁচজন মৃৎশিল্পীর মতোই।
আজ কথায় কথায় আমাদের শুনতে হয়- ভাস্কর্য আমাদের দেশের সংস্কৃতি নয়, নাচ-গান আমাদের দেশের সংস্কৃতি নয়, ট্রেনে বাউলের গান গাওয়া আমাদের দেশের সংস্কৃতি নয়। হামলা চালিয়ে বাউল আখড়া ভাঙচুর করে, বাউলদের মারধর করে, ভাস্কর্য ভাঙে, ট্রেনে গান গাইলে গলা চেপে ধরে কোনো হায়েনা স্বভাবের মোল্লা। হতেও তো পারে যে এই মোল্লারই কোনো পূর্ব-পুরুষ বাউল ছিলেন, দোতারা বাজিয়ে অসাধারণ গান গাইতেন! গান-বাজনার বিরুদ্ধে হুঙ্কার ছাড়া মামুনুলের কোনো পূর্ব-পুরুষ হয়ত সেন রাজাদের রঙমহলে সেতার বাজাতেন, আজহারীর মায়ের দিকের পূর্বজ কোনো নারী হয়ত ভরা উঠোনে পালায় গাইতেন-
‘উঠ উঠ নদ্যাঠাকুর কত নিদ্রা যাও
অভাগী মহুয়া ডাকে আঁখি মেইল্যা চাও।।’
এই দেশে শিল্পীদের বিচরণক্ষেত্র ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে, শিল্পীরা এখন বিপন্ন, বিপন্ন হতে হতে একদিন হয়ত শিল্প ও শিল্পীরা হারিয়ে যাবে এই জনপদ থেকে, যেমন হারিয়ে গিয়েছে মক্কা-মদিনা থেকে। হারিয়ে গিয়েছে আরবের শিল্পী-কবিদের প্রাণের ‘ওকাজের মেলা’।
ইসমাইলও এই দেশের সংখ্যালঘু, ইসমাইল বিপন্ন, অথচ ইসমাইল-ই বঙ্গভূমির প্রকৃত সন্তান, জৈবিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে।
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ঢাকা
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:১৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


