ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে অথবা ব্যস্ত না থেকেও মানুষ যেভাবে স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে পড়ে আছে, সে ক্ষেত্রে স্রষ্টা, জীবনবিধান এসব কিছু নিয়ে চিন্তা গবেষণা, পড়শোনা তার কাছে একটা বাড়তি ব্যাপার বৈকি, কিন্তু মানুষের এ বিষয়টি ভাবা দরকার যে, তার নিয়ন্ত্রণের রিমোট কন্ট্রোল এক মহামহিমের হাতে। যিনি শুধু মানুষেরই নন, যিনি সারা পৃথিবী, আসমান, জমীন, গ্রহ, উপগ্রহ সমস্ত সৃষ্টির পরিচালনার দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করছেন। তিনি মানুষের জন্য দিয়েছেন কল্যাণময় পথ-জীবনবিধান মহাগ্রন্থ আল কুরআন। যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ, তাদের অনুসারীরা মানুষকে আহ্বান করেছেন স্রষ্টা প্রদত্ত সে পথের দিকে। যে পথ মুক্তির, যে পথ কল্যাণময় ও শান্তির পথ, মানুষ যখন এই মুক্তির পথকে এড়িয়ে চলে, পাশ কাটায়ে এগিয়ে যায়, স্বেচ্ছাচারিতার দিকে, তখন গর্ব, অহংবোধ-আত্মম্ভরিতা তার মধ্যে বাসা বাঁধে। সে নিজে আইন প্রণেতা সাজে লংঘন করে স্রষ্টার বিধানকে, যখনই সে স্রষ্টার বিধানকে লংঘন করে, তখনই তিনি সেসব জাতির উপর বিভিন্ন ধরনের দুর্যোগ চাপিয়ে দেন। আদ, সামুদ, জাতি, লুতজাতি, আইকাবাসী, নমরুদ, ফেরাউনদের এসব জাতির নির্মম পরিণামের কথা অনেক পাঠকের অজানা থাকার কথা নয়। আল্লাহ এসবের মাধ্যমে স্মরণ করিয়ে দেন শিক্ষা, শাস্তি ও তিনিই সব শাসকের বড় শাসক, তাঁর চেয়ে আর কেউ শক্তিমান নয়। ইতিহাস কথা বলে কিন্তু তারপরও মানুষের বোধোদয় হয় না, শাসনের দন্ডভার নিজেরা হাতে তুলে নেয়, শোষিত হয় একশ্রেণী। প্রণয়ন করে বিভিন্ন আইন, তখন সে আইন মানুষের জীবনের স্বাভাবিকতাকে ব্যাহত করে, স্রষ্টা ও প্রদত্ত মানুষের জীবনের সকল স্বাভাবিক চাওয়া-পাওয়ার উপর, আর একশ্রেণীর মানুষ যখন আইন ও শাসনের নামে জুলুমের ছড়ি ঘোরায়, তার ফলশ্রুতি যে, কত ভয়াবহ হতে পারে বর্তমানে চীনের হাজার হাজার পিতা-মাতা তা হাড়ে হাড়ে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন, অসহনীয় যন্ত্রণায় জীবন কাটাচ্ছে তারা। তাদের এই দু:সহ যন্ত্রণা কাতর জীবনের কারণ সে দেশের কম্যুনিস্ট সরকারের বিতর্কিত “এক সন্তান নীতি”- সম্প্রতি, চীনে এক ভয়াবহ ১২ মে ২০০৮ সোমবার এই ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। পরবর্তী খবরে বলা হয় মৃতের সংখ্যা ৮০ হাজারে ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই ভূমিকম্পে ধসে যাওয়া স্কুলগুলোতে যে সকল শিশু নিহত হয়, তাদের বেশির ভাগই পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান।
এএফপির খবরে প্রকাশ “গত সোমবারের ভয়াবহ ভূমিকম্পে সবচেয়ে হৃদয় দিারক পরিস্খিতি সৃষ্টি করেছে ধসে যাওয়া স্কুলগুলো ধ্বংসাবশেষের বাইরে উদ্বিগ্ন বাবা মায়ের চিন্তাক্লিষ্ট চেহারা। কিছুক্ষণ পরপরই ধসে যাওয়া স্কুল ভবন থেকে বের করে আনা হচ্ছে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া ছোট ছোট শরীর। এদের বেশির ভাগই বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, সন্তান হারানোর যন্ত্রণা সব সময়ই অসহনীয়, তবে চীনের ভূমিকম্পদুর্গত এলাকার বহু বাবা মায়ের দু:খ আরো অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে সরকারের বিতর্কিত এক সন্তান নীতি। খবরে আরো বলা হয়, গত সোমবার ভূমিকম্পের সময় ক্লাসরুমগুলো বিকেলের পড়া তৈরির জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। এই ভূমিকম্পে নিহত অথবা চাপা পড়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, চাপা পড়াদের বেশির ভাগই শিশু, হাংওয়াং নামের ৭০ হাজার অধিবাসীর একটি শহর পুরোটাই মাটির সাথে মিশে গেছে। সময় পার হবার সাথে সাথে ধসে পড়া স্কুলগুলোর ভেতর থেকে শিশুদের আওয়াজও ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। (দৈনিক নয়া দিগন্ত শনিবার ১৭ মে ২০০৮, ৩ জ্যৈষ্ঠ, ১৪১৫) এই ভূমিকম্পে কোল খালি হয়ে গিয়েছে হাজার হাজার পিতামাতার। সন্তানের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে তারা সরকারের এক সন্তান নীতিকে অভিশাপ দিচ্ছে।
উফু বেই চুয়ান (চীন) থেকে এপি'র খবরে আরো বলা হয়, “এক সন্তান সুখের চাবিকাঠি”। কম্পিউনিস্ট চীনের ঘোষিত এই নীতিই এখন অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। বাইকাইউই ও তার স্ত্রী মেইলিনের মতো ভূমিকম্প পীড়িত সিচুয়ান প্রদেশের হাজার হাজার দম্পতি একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন। বাড়িঘর চাষের জমি মাথার ছাদসহ সবই গিয়েছে, আর ধ্বংসস্তূপে চিরশয্যা নিয়েছে তাদের একমাত্র সন্তান। চারদিকে ধ্বংসলীলার মধ্যে সন্তান হারানোর হাহাকার এদের বাঁচার স্বপ্নটাকেও চুরমার করে দিয়েছে। এক সরকারি বিবৃতিতে চীন জানায়, মধ্য চীন জুড়ে এই বিপর্যয়ের জেরে ৫০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। এদের মধ্যে ২২ হাজার হলো স্কুল পড়ুয়া, ৬৯০০টি শ্রেণী কক্ষ ধ্বংস হয়েছে। স্কুলপড়ুয়ারা বেশির ভাগই ছিলো তাদের মা বাবার একমাত্র সন্তান। দেশে প্রবল জন বিস্ফোরণ ও খাদ্য সংকট রুখতে ১৯৭০ সালে ‘একসন্তান” নীতি সংক্রান্ত কড়া আইন চালু করেছিল কমিউনিস্ট সরকার। সেটাই এখন কাল হয়ে দেখা দিয়েছে ভূমিকম্পে সর্বহারা দম্পতিদের কাছে। এত স্কুলবাড়ি এভাবে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়লো কেন? তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সন্তানহারা মা বাবাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে এই প্রশ্ন।
সারা বিশ্বজাহানের যিনি স্রষ্টা, তিনি এই পৃথিবীতে মানুষকে কিছু স্বাধীনতা দিয়েছেন। যার প্রেক্ষিতে মানুষ কোন বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। আর যখন কোন মানুষ সিদ্ধান্ত নেয়, সে সংকীর্ণ স্বার্থ চিন্তা ও বাহ্যিক সুখ শান্তি দেখেই সিদ্ধান্ত নেয়, নিজেদের জন্য নীতি-নির্ধারণ করে যা অনেক ক্ষেত্রেই স্বেচ্ছাচারিতার রূপ পরিগ্রহ করে। সে ভেবেও দেখে না এই স্বেচ্ছাচারিতা তার জন্যই বুমেরাং হতে পারে। যিনি আহকামুল হাকেমীন, যিন অতীত, বর্তমান ভবিষ্যৎ সব জানেন তিনি তার সৃষ্টির কল্যাণের জন্যই সমস্ত নীতি-নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার নীতির বাইরে যখন মানুষ স্বেচ্ছাচারিতায় মেতে উঠে, সীমা লঙ্ঘন করা শুরু করে। তখন তিনি সেসব মানুষের উপর, সে জাতির উপর গযব পাঠান। কুরআনের জ্ঞানে দৃঢ় বিশ্বাসী কোন মানুষের নিকট এ ধরনের আজাব-গযবের কেন'র উত্তর সুস্পষ্ট। কিন্তু যারা স্রষ্টাকে বিশ্বাস করে না, তাকে নিযে চিন্তা করার মতো সময়টুকু ব্যয় করতে নারাজ, তাদের কাছে এ ধরনের ভয়াবহ আযাব কোন শিক্ষাই নিয়ে আসে না, বরং রবের বিধানের কথা বললে তারা তাকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে উড়িয়ে দেয়। শুধু তাই নয় যারা স্রষ্টা নির্ধারিত পথে চলছেন, মানুষ ও মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছেন, স্রষ্টা প্রদত্ত নিয়ম-নীতিতে সমাজ রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা চালাচ্ছেন, বিশ্বের নানা জায়গায় তারা আজ নির্যাতিত হচ্ছেন, মৌলবাদী, সন্ত্রাসী, জঙ্গী আখ্যা লাভ করছেন; ভয়াবহ ষড়যন্ত্র, জেল-জুলুমের স্বীকার হচ্ছেন, আজ এই পরাশক্তিরা ক্ষমতার দাপটে এই ধরনের কার্যকলাপ চাপিয়ে গেলেও দুনিয়া ও আখেরাতে সব শাসকের বড় শাসক যিনি তার নিকট নানা ধলনের আজাব-গযবের সম্মুখীন হতেই হবে। মহান আল্লাহ বলেন; “তোমার পূর্বেও বহু নবী রাসূলকে (সা
আল্লাহ পাক আরো বলেন, “তারপর লক্ষ্য করো, শেষ পর্যন্ত আমরা তাদের সাথে কৃত ওয়াদাপূর্ণ করেছি। আর তাদেরকে এবং আর যাকে যাকে আমরা চেয়েছি বাঁচিয়েছি, আর সীমা লঙ্ঘনকারীদের ধ্বংস করে দিয়েছি।” (আল আম্বিয়া : ৯)
(যে মানুষ) আমরা তোমাদের প্রতি এমন একখানি কিতাব পাঠিয়েছি, যাতে তোমাদেরই উল্লেখ রয়েছে, তোমরা কি বুঝতে পার না? (সূরা আল আম্বিয়া : ১০)
“কত অত্যাচারী জনবসতিই এমন আছে যেগুলোকে আমরা পিষে চূর্ণ-বিচুর্ণ করে দিয়েছি এবং তাদের পরে আমরা অন্য কোন জাতিকে উথিত করেছি।” (সূরা আল আম্বিয়া : ১১)
“তারা যখন আমাদের আযাব অনুভব করতে পারলো তখন তারা সেখান হতে পালাতে লাগলো ” (আল আম্বিয়া : ১২)
“(বলা হলো) পালিও না, তোমরা যাও তোমাদের সে সব ঘর বাড়িতে ও আরাম-আয়েশের সরঞ্জামে যা নিয়ে তোমরা মহা আরামে নিমগ্ন হয়েছিলে;” (আম্বিয়া : ১৩)
“তারা বলতে লাগলো : হায়! আমাদের দুর্ভাগ্য। নি:সন্দেহে আমরা অপরাধী ছিলাম” (আল আম্বিয়া : ১৪)
“তারা এই চিৎকারই করতে থাকলো ততদিন যখন আমরা তাদেরকে চূর্ণ ভস্মে পরিণত করে দিয়েছি, জীবনের সামান্যতম স্ফূরণও তাদের মধ্যে অবশিষ্ট ছিলো না” ( আল আম্বিয়া : ১৫)
এই ধরনের লোকদের জন্য দুনিয়ার জীবনেই আযাব রয়েছে, আর পরকালীন আযাব তো তা হতেও কঠিন ও কঠোর। এমন কেও নাই যে, তাদেরকে আল্লাহর আজাব হতে রক্ষা করবে।” (আর রাদ : ৩৪)
এই পৃথিবীতে, মানুষের জীবনে, সমাজে, রাষ্ট্রে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা বিপদ-আপদ, মুসিবত, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছðাস, ভূমিকম্প ও নানা দুর্যোগ আসে। কিন্তু মানুষ সেসব দুর্যোগ মুসিবত, ঘটনা, দুর্ঘটনা হতে কোন শিক্ষাগ্রহণ না করে পুনরায় বল্গাহীন স্বেচ্ছাচারী জীবনের দিকে এগিয়ে যায়। কামাই করে নিজের জন্য অকল্যাণের ফসল। যা তার জন্যই সৃষ্টি করে বিপর্যয় ও বিশৃকôখলা, অশান্তি ও হাহাকার, যা পরে আফসোস ও আক্ষেপে রূপান্তরিত হয়। যেটা আজ চীনের হাজার হাজার পিতা-মাতার ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে। মহান আল্লাহ বলেন, “মানুষের কৃতকর্মের দরুন জলে স্খলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, যার ফলে তাদেরকে তাদের কিছু কৃতকর্মের স্বাদ-আস্বাদন করানো যায় হয়তো তারা বিরত হবে।” (সূরা আর রুম : ৪১)
তাই, লেখার শুরুতে উপস্খাপন করেছিলাম যে কথা, মানুষ যতই ব্যস্ততা ও আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যাক না কেন, তার এই স্বনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন কতটা অভিশপ্ত ধ্বংসাত্মক ও অশান্তিপূর্ণ তার চারপাশেই সে সাক্ষ্য বিরাজমান। প্রশান্তির অমিয় স্বাদ পেতে স্রষ্টা নিয়ন্ত্রিত পথই একমাত্র অবলম্বন। বিবেক বোধকে শাণিত করে, এ পথে প্রত্যাবর্তনের গুরুত্ব নিজেকেই উপলব্ধি করতে হবে। মহামুক্তির পথে প্রত্যাবর্তনের অবকাশ বার বার আসে না; কেননা পৃথিবীর জীবন খুবই সংক্ষিপ্ত।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




