somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বীওন-লীটো কাম উপখ্যান কিংবা প্রেমাভিনয়

১৩ ই জুন, ২০১৩ রাত ৯:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জীবন সম্পর্কে আমার স্বচ্ছ ধারনা ছিল বলেই আশেপাশের সবার কাছ থেকে জেনে এসেছি , এ ধারনা কত অস্বচ্ছ ছিল তা হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছি নতুন শহরে এসে । সময়ের পরিক্রমায় এ শহরের অলিতে –গলিতে পরিভ্রমনে জেনেছি নিজের ক্ষুদ্রতার কথা , নিজের মেধার তুচ্ছতার কথা ।
ভাবলেই হাসি পায় একসময় নিজেকে রং-তুলির ঈশ্বর মনে করতাম , ছোট্ট শহরের গন্ডিতে
আমার প্রশংসা সাইক্লোনের ঘূর্ণি ছুটাতো , স্বপ্ন দেখতান পিকাসো , গিয়েত্তো , ভিঞ্চি , এঞ্জেলোর মাস্টার পিসের সাথে স্থান করে নিচ্ছে আমার কাজ । আলোর যুগের বাসিন্দা হয়ে দাম্ভিকতার দর্প চূর্ণ হবার নিমিত্তেই যেন আমার এখানে আসা । Académie des Beaux-Arts ঐতিহাসিক এক নাম যার যাত্রা শুরু হয়েছিল Cardinal Mazarin হাত ধরে, ফ্রান্সের সবচেয়ে ভালো-আকিয়েরা এখানের ডিপার্টমেন্টগুলোর শোভা বর্ধন করে । আবেদন করে কখনি ভাবিনি আমার স্বপ্ন সত্যি হতে যাচ্ছে , আমাদের ডাকবক্সের এরিয়েন
যখন আমন্ত্রনপত্র হাতে দিয়েছিল , আবেগে জড়ীয়ে ধরে কেদে ফেলেছিলাম , বুড়ো এরিয়েন মনে হয়েছিল পৃথিবির সবচেয়ে আপন , বিকেলের মাঝে আমাদের
ছোট্ট গ্রামে চাউর হয়ে গেল বীওন বড় শিল্পী হতে যাচ্ছে , ন্যাড়া পাহাড়ের পাদদেশের গম্ভিরমুখো মিসেস গিভসন বিরক্তিকর বলিরেখা নিয়ে হাজির হয়েছ , সাথে ছিল তার বাগানের সেরা এক ঝুড়ি আপেল আর
এক বয়াম স্ট্রবেরির জেলি , অবাক হয়েছিল এই দুর্মুখ আমায় পছন্দ করে তা কখনি মনে হয় নি , এসেছিল পাশের বাড়ির যুবতী স্ত্রী রায়ান , অপূর্ব সৌন্দর্যের সাথে এনেছিলেন হাতে তৈরি রুটি , বর্ণে-গন্ধে
অতুলনীয় রায়ানের মতই অপূর্ব।


প্যারিসের মাটিতে নেমে মুগ্ধতা কাটতেই লেগে গেল তিন মাস , ততদিনে সকল দর্শনীয় স্থান আর ক্যাফেগুলতে ঢু মারা হয়ে গেছে । এক বিকেলের স্নিগ্ধতাকে বন্দি করতে ক্যানভাস আর ব্রাস নিয়ে হাজির
আইফেল টাওয়ারের তলায় । ধাতব কাঠামোর অবর্ণনীয় যান্ত্রিক দৈত্য সুলভ মুগ্ধতা , আমার ক্ষুদ্র ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলাই ছিল আকাঙ্খা । আপনার আকাঙ্ক্ষা সর্বদা বাস্তবে রুপ নেবে তা কিন্তু নয় বরঞ্চ শিল্পির খেয়ালিপনায় অধিকাংশ সময় চিন্তার বৃত্তে বন্দি থাকে । আমি একাগ্রতা নিয়ে এক কোনে বসে গেলাম আমাকে আঁকতেই হবে , কভু অদৃষ্টের লেখন সম্পর্কে আমার ন্যুনতম ধারনা
থাকলেও আমি প্যারিসের আশেপাশে আমার অবস্থান অনিশ্চিত করার সুনিশ্চিত প্রয়াস চালাতাম ।


কেবল পেন্সিলের স্ক্যাচে ধাতব কাঠামোর মুগ্ধতা নিয়ে দুটো আচড় দিয়েছি , আমার কর্ণ-কুহরে কোকিলের কন্ঠের শ্রুতিমধুরতা নিয়ে আঘাত করল বেহালার ঝঙ্কার , আমি বাধ্য হলাম শব্দের উৎসের খোজে তাকাতে , একটু সামনেই দেখতে পেলাম গ্রিক মিথের সুন্দরি শ্রেষ্ঠা আফ্রোদিতিকে , সুরের ঝঙ্কারের সাথে সাথে রুপের আগুনেও মজে গেলাম , ধাতব সৌন্দর্যের বদৌলে স্বর্গের কমনীয়তা ফুটে
উঠল আমার ক্যানভাসে ,লীটো আমার লীটো। কখন বেহালার সুর থেমে নিস্তব্দতার সৃষ্টি করেছে আমি টের পাই নি , যতক্ষন না স্বর্গের দেবি আমার কানের কাছে এস বলল আপনি তো অসাধারণ আকেন ।


কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে যখন আমার আফ্রোদিতিকে খুজতে যাব ,আবিষ্কার করলাম আমার পাশে , সেই অপরিচিত কণ্ঠস্বরের মালিক । লজ্জাবনত মুখে তার দিকে তাকাতেই অদ্ভুত সারল্যমাখা হাসি উপচে পড়ল তার চখে-মুখে , স্বর্গীয় সুধার নিরাবরণ বহিপ্রকাশ ।
ক্যানভাসটি মুড়িয়ে তার হাতে দিতেই , এক অদ্ভুত ভালো লাগায় মন ভরে উঠল । আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে গেল ক্যাফে ডি ভেলে তে , তার স্পর্শে আন্দোলিত হল আমার সমগ্র দেহ , প্রচন্ড ভাল-লাগার আবেশে নির্বাক হয়ে তার যাত্রার সঙ্গী হলাম । কফির সাথে আলোচনার ঝড় উঠল।



Conservatoire national supérieur de musique et de danse de Paris (CNSMDP) শিক্ষনবিশ ভবিষ্যৎ মোজার্ট ।
মোজার্টের সিম্পফনি , ভলতেয়ারের দর্শন , কিংবা এঞ্জেলোর স্কাল্পচার সবকিছুতেই দুজনের সমান আগ্রহ বিদ্যমান , সপ্তাহান্ত গুল কেটে যাচ্ছিল বসন্তের সবুজের ন্যায়। দুমাসেই বুঝে গিয়েছিলাম আমার জীবনে লীটোর অবস্থান দেবী সম , অদ্ভুত অস্থিরতায় একগুচ্ছ ক্রিসামথিমাম
নিয়ে হাজির হলাম লীটোর ডারমাটরিতে , হৃদয়ের সব ব্যাথা উজার করে দিয়ে জানিয়ে দিলাম
তার অবস্থান ।


আমি তীব্র প্রতীক্ষার অপেক্ষায় চোখ বন্ধ করে ছিলাম , হঠাত করে কারো নিশ্বাস আমায় স্পর্শ করল , সাটিনের ছোয়া পেলাম রুক্ষ গালে , চোখ খুলতেই মৃদু ভৎসনা “এত দেরি হল” । চিতার ক্ষিপ্রতায় কাছে টেনে নিলাম , কোবরার হিংস্রতায় তার শিল্পিত ঠোটে ছোবল বসালাম। অনাসাধিত সুধা আহারনে তীব্রতা দেখে লীটো শুধু হেসে ছিল , একটুও বাধা দেয় নি ।একে-অপরকে উজার করে ভালবেসে ছিলাম । মরুর বুকে বৃষ্টির ছোঁয়া যেমন তৃপ্ততার উদ্রেককারী , আমার একাকীত্বে লীটো ছিল তদ্রূপ। একসাথে ছবি আকা , পছন্দ গুলো একে অপরের সাথে বিনিময়ে আমরা হয়ে উঠেছিলাম রাজযোটক । ছয়টি মাস কেটেছে নিরঝঞ্চাট ।


ঝামেলার শুরু ফ্রেব্রুয়ারির সেই পাঁচ তারিখ , এক পথের কোনে পাইনের ঝাড়ের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলছিলাম ক্যানভাসে , এক নচ্ছার মাতাল গাড়ী নিয়ে সোজা তুলে দিল আমার ক্যানভাসে , ক্যানভাসকে বাচাতে গিয়ে মাথা ঠুকে গেল পিচের রাস্তায় । জ্ঞান ফিরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম সফেদ বিছানায় , পাশে আমার লাস্যময়ী লিটো , কান্নাসিক্ত চোখে ।
ডান হাত ঊঠাতে গিয়ে ব্যাথ্য জ্ঞান হারালাম, আবার জ্ঞান ফিরতেই লিটোর সাথে ডাক্তার কে দেখতে পেলাম সফেদ আপ্রোনে মৃত্যদূত, হেসে হেসে বলছে এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন
শুধু হাতের উপর দিয়ে গেল আপানার , মোটর সাপ্লাই ডিস্ট্রাক্টেড , কোন সূক্ষ্ম কাজ আপনি করতে পারবেন না । এ ডাক্তার নিজেও হয়ত বুঝতে পারেনি হাসতে হাসতে আমার মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করল , একজন শিল্পীর জীবনে আরেকটি ছবি আকা হবেনা , এই ভাবনার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয় , কম বেদনাদায়ক । বুঝতে পারবেই বা কিভাবে এদের কাছে ব্যাথা মানেইতো মরফিন পুশ মনের ব্যাথের ওষুধ এরা কি জানবে ।
জীবনের এই ক্রান্তিলগ্নে , লীটো ছায়া হয়ে ছিল আমার পাশে , আমি অভিনয় করে গেছি হতাশা কাটাবার প্রতিনিয়ত , পারিনি , ধীরে অবক্ষয় হয়েছে চেতনার ।

লীটো একদিন হঠাত আমায় আবিষ্কার করল প্রফেসর মিস হেসবারগের বাসায় , দুজনে মদে চ্যুর হয়ে উদ্দাম আদিম খেলা রত অবস্থায় । ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নীল লীটো , আমার লীটো ।
আমি তার কাছে অনুনয় করিনি , যাবার বেলায় তার ছলছল চোখে তাকিয়ে সান্ত্বনা দেই না , জানতাম দুটো কথায় গলে যাবে সব অবিশ্বাসের বরফ , তবু কিছু বলতে পারিনি
, আমার মুক্তি বড় প্রয়োজন , তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন লীটোর মুক্তি আমার কাছ থেকে ।এই হতদ্যোম বীওনের কাছে থাকলে লীটো ও হয়ে ঊঠবে আমার মতই প্যারানয়েড।

নিজের ভালবাসাকে তিলে তিলে এভাবে ক্ষয়ে যাওয়ার দর্শক হবার মানসিক শক্তি আমার ছিল না ।ভাল থেক তুমি লীটো , আমি আজীবন তোমার।
২৩টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×