পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শোক " পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ"
এ শোকের মাত্রার তীব্রতা বোধহয় তুলনা আর কিছু হয় না কখন হবেও না । মৃত্যুর দায় বর্তালে এ শোকের মাত্রা আরো কয়েকগুন বৃদ্ধি পায় ।
আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে অসম্ভব কিছু ভাল মানুষের সাথে সবুজ ভাইয়া, অনি ভাইয়া ,পলিট ভাইয়া , পাভেল ভাইয়া ,রনি , ফাহাদ। অসম্ভব মেধাবি সবাই , সময় এবং সুযোগের অভাবে সবার মাঝে দূরত্বের
সৃষ্টি হলেও, একই পরিবারের বর্ধিত অংশ বইকি অন্য কিছু নয়।
শুক্রবারে বড় মাঠে খেলা হত আমাদের , একবার সবাই মিলে ঠিক করলাম টেস্ট খেলব , সবাই আউট হয়ে গেলেও সবুজ ভাইয়েকে আউট করা যাচ্ছিল না । ভাইয়া স্বেচ্ছা রিটায়ার হলেন , তারপর কিছু হলেই
বলতেন "মাঠ না ছাড়লে কিন্তু এখন আসতে পারতে না" । বাল্যকালের এই অসবয়সী এবং সমবয়সী বন্ধুদের সাথে আমার অসম্ভব শুখ স্মৃতি, বিষাদ খুব কম । সবার মধ্যে শহররান্তরি হয়েছিলাম আমি , রংপুর মেডিকেল
কলেজে পড়ালেখার সুবাদে।
প্রথম বছরের শেষের দিকে সবুজ ভাইয়ার আম্মু হঠাত অসুস্থ হয়ে পরলেন, অনেক চেষ্টা করেও যমকে ফাকি দেয়া যায় নি । আন্টির অসম্ভব আদর পেয়ে বড় হয়েছি আমরা সবাই , শেষবার যখন বিএস এম ইউতে দেখতে গিয়েছি
মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ দিতে ভুলেন নি ।
বছর খানেক পরেই হয়ত সবুজ ভাইয়া বিয়ে করলেন , রংপুরে থাকার সুবাদে বাল্যকালের সঙ্গির ব্যাচেলর খেতাব মোচনের অংশ গ্রহন করতে পারেনি । রংপুরের ছেলে রংপুরেই বিয়ে করেছেন ।মাঝে অনেকদিন ভাইয়ের
সাথে আমার যোগাযোগ ছিলনা ।
দু সপ্তাহ আগে দুপুর দেড় টা বাজে , ক্লাশে পেডি সার্জারি লেকচার হচ্ছে আমি মনযোগ দিয়ে ২৯ খেলছিলুম । হঠাত ফোন , জরুনি না হলে পরিচিত কেউ এই সময়ে ফোন দেয় না । রিসিভ করতেই একটি 'শুকনো কন্ঠ
বলে উঠল ' সোহান , আমি তোমার সবুজ ভাইয়া , বাসাবোর, তোমাদের স্কানু ( স্পেসাল বেবি কেয়ার ইউনিট) আছি , আসতে পারবে ?? আমি আমার এক বন্ধু কে নিয়ে হসাপাতালে গেলাম এই ভাবতে যে ভাইয়া আজকে
ধরতে হবে "এত কিপটা কেম্নে হইল , বাচ্চা হইল অথচ মিষ্টি খাওনোর ভয়ে জানায়নি পর্যন্ত"। অনেকদিন পর দেখা উচ্ছশিত আমি হাসি মুখে ভাইয়ার দিকে এগিয়ে গেলাম , সবুজ ভাইয়া বলে ঢাক দেওয়া মাত্রই
ভাইয়া "সোহান' বলে ঝর ঝর করে কেদে দিয়ে বল্লেন "দেখ তো, ভাই আমার বাচ্চাটার কি হয়েছে ? এইসব স্পেশাল ইউনিটে আমার করার কিছু নেই জেনেই তড়িঘড়ি করে ঢুকলাম , ঢুকেই অধিক শোকে পাথর
হয়ে গেলুম , বাচ্চার ঠোট কাল হয়ে গেছে , রেস্পাইরেশনের সাইন নেই , কোন মুভমেন্ট নেই , সিনিওর ভাই চেক করে জানালেন হার্ট বিট ও নেই আমার উপর দায়িত্ব বর্তাল এই খবর পৌঁছাবার ।
বাল্যকালের খেলার সাথি কে তার সর্বাধিক প্রিয় জনের মৃত্যুর খবর দেয়া কত হৃদয়বিদারক হতে পারে , তারপর যদি আপনি জানেন যে তার অর্ধাঙ্গী ও মৃত্যুর আশংকায় , যতদিন পর্যন্ত আপনি ব্যাপারটির সম্মুক্ষিন না হবেন
অনুভব করতে পারবনে না ভাতিজার জানাজ, দাফন, কাফন শেষ করে চলে আসার মুহূর্তে ভাইয়া জড়িয়ে ধরে বললেন "সোহান, তোমাকে আমার সাথে তোমার ভাবির কাছে যাতে হবে , আমি একা ওর সামনে দাড়াতে
পারবনা।" ভাবির সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখে কেদে দু চোখ ফুলিয়ে ফেলেছেন , মায়ের মন , কোলছাড়া হলে আর কি না বুঝে থাকে । পোকার ফেস নিয়ে ভাবিরে সামনে রিহারসেল করা ডায়ালগ গুলো
বলে গেলাম " আরে ভাবি টেনশন নিয়েন , বাচ্চা ভাল আছে " অনেক দিন কাদেনি , হোস্টেলের রুমে একা হয়ে অশ্রু বর্ষণ হয়েছে কোন শব্দ হয় নি
আগে বাসায় গেলে , নিয়ম করে পাভেল ভাইয়াদের বাসায় যাওয়া হত আন্টি-আঙ্কেলের অসম্ভব আদর আর আঙ্কলের সর্বদা অনুপ্রেরণা সবুজ জীবনের স্বপ্নদায়িনী। শেষ বার ভাইয়াদের বাসায় গিয়েছিলাম
পলিট ভাইয়া বাহিরে চলে যাবার কথা স্কলারশিপ নিয়ে । ভাইয়াদের বাসায় যতক্ষন ছিলাম , মনে হচ্ছিল আঙ্কেল এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলবেন "ভাল করে পড়বা, ভাল ডাক্তার হওয়া লাগবে বুজ্জনি ? কিন্তু
আঙ্কেল আসেনি , আল্লাহর প্রিয় হয়ে তার কাছে চলে গেছেন অনেকদিন আগেই ।এরপর আরও বেশ কয়েকবার বাসায় গিয়েছি , আম্মুর অনেক জোরাজুরি সত্ত্বেও আর যাওয়া হয় নি ভাইয়াদের বাসায়, ঐ অনুভূতি সহ্য করার মত শক্তি ছিলনা হয়ত
ধীরে ধীরে বয়স বাড়ছে , কমছে নির্ভরতার -ভাল লাগার , ভালবাসা আর আবেগের জায়গা গুলো
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ৮:৫৭