somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বাধীনতার ৪০ বছর ও মমতাজ খান পাঠান

২০ শে ডিসেম্বর, ২০১১ সকাল ১০:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম

ডিসেম্বর এলেই মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় উত্সব নিয়ে সারা জাতি মাতোয়ারা হয়। সারা বছর হেলাফেলায় কাটলেও ডিসেম্বর মাসে সত্য-মিথ্যা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক কিছু আলোচনা হয়। আজ কিছুদিন ধরে মনটা বড় বিক্ষুব্ধ, ভারাক্রান্ত। পাকিস্তানি হানাদাররা আমাদের এত অত্যাচার করল, নির্যাতন করল, মা-বোনের ইজ্জত হরণ করল; কিন্তু আমরা তাদের ভুলতে পারলাম না। আমরা কেউ একে অপরকে সম্মান করি না। হুজুর মওলানা ভাসানীকে তাচ্ছিল্য করি। বঙ্গবন্ধুকে যা-তা বলি। বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানকে আওয়ামীপন্থীরা পাকিস্তানের এজেন্ট বলে। শেরেবাংলা নেই, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নেই। কিন্তু পাকিস্তানকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্মান কেউ ইচ্ছে করে, কেউ তালে তালে দিয়ে থাকি। ডিসেম্বর মাসজুড়ে যেমন মুক্তিযুদ্ধ আর স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা হয়, তেমনি পাকিস্তানি হানাদার নিয়ে কথা বলতে ‘পাক বাহিনী’, ‘পাক সরকার’ বলতে বলতে অনেকেই মুখে ফেনা তুলে ফেলে। বিশেষ করে ঘোষক-ঘোষিকা, পাঠক-পাঠিকাদের মুখে শত-সহস্র বার ‘পাক বাহিনী’ ‘পাক বাহিনী’ শুনে আর কিছইু করতে ইচ্ছে করে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, না চাইতেই হানদারদের ‘পাক’ বলে আখ্যায়িত করা মুক্তিযুদ্ধে হাজারবার আমাদের কাছে পরাজিত হওয়ার চেয়ে বড় বিজয়। পৃথিবীর কোথাও পাক বাহিনী নেই। তাদের নাম পাকিস্তান বাহিনী বা সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী। পৃথিবীতে কত সরকার আছে, দেশ আছে, পাক দেশ নেই, পাক সরকারও নেই। নাপাক কর্মকাণ্ডের হোতা পাকিস্তানিদের আমরা বলছি ‘পাক সরকার’, ‘পাক বাহিনী’। অনেক জায়গায় এসব নিয়ে অনেক বলেছি কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। একবার কোনো কিছু কারও মজ্জাগত হয়ে গেলে অস্থিমজ্জা ধ্বংস করে না ফেললে বদল হয় না। আমাদেরও তেমনি কোনো বদল নেই। রেডিও-টেলিভিশনে ‘পাক’ ‘পাক’ শুনতে শুনতে কেমন যেন নিজেকেই নাপাক মনে হয়। কী জাদুকরী বীজ তারা ফেলে গেল, ইরি ধানের মতো শত-সহস্র সংখ্যায় বেড়ে চলেছে। বঙ্গবন্ধু এক সময় বলেছিলেন, ‘চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী।’ আমাদের দশাও তাই হয়েছে। নারী ধর্ষণকারী, লুটেরা, খুনিদের বলছি পাক! এগুলো যারা তারস্বরে বলছে, তারা তথাকথিত শিক্ষিত এবং সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষ। কিন্তু ব্যাকরণগতভাবেও যে এটা মানানসই নয়। পাক শব্দের অর্থ যদি পবিত্র হয় তাহলে একবার হানাদার বলে, লুটেরা বলে তাদের বাহিনীর কর্মকাণ্ডকে পাক বললে বলা যায় না, বিপরীত অর্থ বহন করে। পাকিস্তানও নিজের সরকারকে পাক সরকার বলে না। বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ইংরেজি কিছু তো বুঝি। পাকিস্তান রেডিও-টেলিভিশনে পাক আর্মি শুনিনি, পাক সরকারও শুনিনি। আমরা যেমন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের প্রতি বড় বেশি নতজানু, পাকিস্তানের প্রতিও বড় বেশি আসক্ত। যাক এ প্রসঙ্গ।
কাজী নজরুল ইসলাম চট্টগ্রাম সফরে এসে জানালার পাশে সারি সারি সুপারি গাছ দেখে ‘বাতায়ন-পাশে গুবাক-তরুর সারি’ কবিতা লিখেছিলেন। সেই কবিতায় এক জায়গায় দারুণ ক্ষেদ ব্যক্ত করে বলেছিলেন—
‘মলিন মাটির বন্ধনে বাঁধা হায় অসহায় তরু,
পদতলে ধূলি, ঊর্ধ্বে তোমার শূন্য গগন-মরু।
দিবসে পুড়িছ রৌদ্রের দাহে, নিশীথে ভিজিছ হিমে,
কাঁদিবারও নাই শকতি, মৃত্যু-আফিমে পড়িছ ঝিমে!
তোমার দুঃখ তোমারেই যদি, বন্ধু ব্যথা না হানে,
কি হবে রিক্ত চিত্ত ভরিয়া আমার ব্যথার দানে!...’
সেরকম আমারও বলতে ইচ্ছে করে—জাতি যদি ঝিমিয়ে পড়ে, অত্যাচারী হানাদারদের যদি পাক-পবিত্র বলে আখ্যায়িত করে আমি আর কত কী করতে পারি? গত ৪০ বছর আমাকে অপছন্দ করে অনেকেই আমার সত্যকেও অপছন্দ করেছে। ’৯০-এ দেশে ফিরে দেখলাম ঢোল ডগর পিটিয়ে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু দিনে কাঙ্গালি ভোজ করা হচ্ছে। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন হলে নামের সঙ্গে যেমন বাস্তবের মিল থাকে না, তেমনি বঙ্গবন্ধুর শাহাদত্ দিনে তার আত্মার শান্তি কামনায় যে অন্নের ব্যবস্থা করা হয় সেটা কাঙ্গালি ভোজ হলে একই হয়। বললাম, ‘গণভোজ বললে কেমন হয়।’ দালালরা রে রে করে উঠল, ‘গণভোজ বললে সেটা মচ্ছবের মতো হবে। অনেকের বনভোজনও মনে হতে পারে।’ আমি বলেছিলাম, ‘কাঙ্গালি ভোজ নামে যত ভালো খাবারই পরিবেশন করা হোক; উকিল, মোক্তার, ডাক্তার, ব্যারিস্টার সর্বস্তরের মানুষই বঙ্গবন্ধুর শাহাদত্বার্ষিকীতে তার জন্য আল্লাহর উদ্দেশে খাবার আয়োজনে অংশ নিতে চায়। কিন্তু কাঙ্গালি ভোজ নাম হওয়ায় অনেকের খারাপ লাগে। গণভোজ হলে কারও কোনো দ্বিধা থাকবে না। হিন্দু সম্প্রদায় দরিদ্র নারায়ণ সেবা দেন। মুসলমানরা তো আর নারায়ণ সেবা দিতে পারেন না?’ না, কাঙ্গালি ভোজই থাকতে হবে। আমি বলেছিলাম, ‘পোলাও-কোরমা যা কিছুই করুন না কেন, খাবারের থালায় যদি লিখে দেয়া হয় এটা শুয়োরের খাবার তাহলে শুয়োরের খাবার কুকুরও খেতে চাইবে না। সেটা মানুষ কী করে খাবে? কিন্তু সেই একই খাবারের গায়ে যদি কিছুই লেখা না থাকে তাহলে মানুষ পশু কারও খেতেই বাধবে না। আর যদি লেখা থাকে বিশুদ্ধ খাবার, তাহলে তো আরও ভালো। কাঙ্গালি ভোজ যারা করেন ভোজ তো তাদের আছেই, প্রশ্নটা হলো গণ আর কাঙ্গাল নিয়ে। কাঙ্গাল হলে ভালো হয়, আমি গণভোজ নাম দিতে চেয়েছি তাই খারাপ। এটা অনেকের চোখে শুধু আমি খারাপ এই জন্য। আমার কর্মকাণ্ড খারাপ ছিল না। আমি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করার কয়েক বছর পর বর্তমান যোগাযোগমন্ত্রী ইদানীং বিবেক দ্বারা পরিচালিত কথা বলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকেরই আস্থাভাজন হয়েছেন। দোয়া করি তিনি মানুষের আস্থা রক্ষা করতে সফল হোন। জনাব ওবায়দুল কাদের বেশ কয়েকবার টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেছেন। সেখানে তিনি কিন্তু গণভোজ শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং তা আওয়ামী লীগ গ্রহণ করেছে। এখন আর ওতে কোনো সমস্যা নেই। যত সমস্যা ছিল আমি বলায়। ’৯৩-৯৪-৯৫ এ যখন সপ্তাহব্যাপী জাতির পিতার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করছিলাম, মৃত্যুবার্ষিকী পালনের হিসাব-কিতাব নিয়ে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে একবার কথা উঠেছিল। সেই সময় আমি আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক নম্বর সদস্য ছিলাম। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক কমিটির সভায় আমার কাছে হিসাব চেয়েছিলেন, লাখ লাখ টাকা কোথা থেকে খরচ করছি। সভানেত্রী ছাড়া যদিও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সবাই মিলে দশ-বিশ হাজার টাকা দিয়েও সাহায্য করেনি। তবু সাধারণ সম্পাদক জানতে চাচ্ছিলেন, পনের-ষোল লাখ টাকার একটা হিসাব দেয়াও হয়েছিল। তা নিয়ে বর্তমান মহামান্য রাষ্ট্রপতি তখনকার সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান কটূক্তি করেছিলেন যা আমার সহ্য হয়নি। বলেছিলাম, ‘আওয়ামী লীগ করি বলে জনাব জিল্লুর রহমান হিসাব চাওয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে পেরেছেন। আওয়ামী লীগ না করলে তিনি যে মাপের মানুষ তার সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাতের প্রয়োজনও হতো না।’ কেন যেন সেদিনের সে সভায় আমির হোসেন আমু, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, শেখ সেলিম, সুরঞ্জিত্ সেনগুপ্ত, আবদুল জলিল এমনকি মোহাম্মদ নাসিম সাধারণ সম্পাদকের আমার কাছে হিসাব চাওয়ার নিন্দা করেছিলেন এবং তারা সবাই আমার কর্মকাণ্ডের প্রতি যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে বলেছিলেন—‘আওয়ামী লীগের কত ছায়া সংগঠন আছে, বঙ্গবন্ধু পরিষদ নামে কত বছর ধরে দোকান খোলা হয়েছে, কোনোদিন তো ওয়ার্কিং কমিটিতে তাদের নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না? তাহলে কাদের সিদ্দিকীকে নিয়ে প্রশ্ন কেন?’ নেতাদের কথায় সেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একমত হয়েছিলেন। আমার মনে হয়েছিল, তখনকার সাধারণ সম্পাদক মনে করেছিলেন আমার কাছে হিসাব চাইলে নেত্রী খুশি হবেন। আওয়ামী লীগ নেত্রী আমার ভগ্নী খুশির বদলে বেজার হওয়ায় জনাব সাধারণ সম্পাদক পরক্ষণেই আমার কর্মকাণ্ডের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন এবং আমার কাছে হিসাব চাওয়ায় যে তার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না আমাকে বলিষ্ঠ করার জন্যই চেয়েছিলেন, সভায় সে কথা বলতেও ভুল বা দ্বিধা করেননি। যে কোনো কারণে সভানেত্রীর সঙ্গে আমার যত দূরত্বই থাকুক, টুঙ্গিপাড়ার প্রতিটি অনুষ্ঠানে তিনি আন্তরিক সমর্থন দিয়েছেন। গোপালগঞ্জ সার্কিট হাউস, টুঙ্গিপাড়ায় পৈতৃক বাড়ি কোনোখানে যাতে আমার অসুবিধা না হয় তার খেয়াল রেখেছেন। তিনি ঢাকায় থাকলেও আমার খাওয়া-দাওয়া, গোসল-আছলের সব খোঁজ নিয়েছেন। টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে আমি রাস্তায় খেয়েছি, খালে গোসল করেছি, নিজে হাতে রাস্তা ঝাড়ু দিয়েছি; তারপরও তিনি সব সময় আমার খোঁজ রেখেছেন। যে যে সময় মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা গেছে; তখন আত্মার আত্মীয়ের মতো তাদের সেবাযত্ন করতে টুঙ্গিপাড়ার বাড়ির ম্যানেজার বৈকুণ্ঠকে নির্দেশ দিয়েছেন। আমি মাঝে মাঝে অবাক হতাম। তখন টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে খাট-পালঙ্ক ভালো না থাকলেও আদর যত্ন ভীষণ ভালো ছিল। মনে হয় যে ক’দিন ওখানে থেকেছি, চাদর বালিশ একদিনের বেশি ব্যবহার করতে পারিনি। প্রতিদিনই সবকিছু ঝকঝকে-তকতকে পেয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে মায়ের পর কেউ আমার অতটা খেয়াল রাখেনি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমানের কটূক্তিতে সেই সময় বেগম সাজেদা চৌধুরীও ভীষণ অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। কোনো রাখঢাক না করে বলেছিলেন, ‘কাদের কোনো কিছু করলেই দোষ খোঁজেন, কাদেরের হিসাব চান, আপনারা ওয়ার্কিং কমিটিতে ক’টা হিসাব দিয়েছেন?’ আসলে কোনো রাজনৈতিক মানুষ যখন ধীরে ধীরে বড় হয় তখন অনেকে স্বার্থপরতাও দেখায় আবার সহমর্মিতাও দেখায়। আজ বিজয় দিবসে লিখতে গিয়ে কত কথা মনে পড়ে। কিন্তু সবাই যুদ্ধ নিয়ে আগ্রহী। যুদ্ধের কথা জানতে চায়। একটা যুদ্ধের কথাই এখানে বলি।
তখন কেবলই মুক্তিযুদ্ধের শুরু। আমাদের সব নেতা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। যাদের পালানোর দরকার তারা পালিয়েছেন, যাদের প্রতিরোধ করা উচিত তারাও পালিয়েছেন। আমরা দিশেহারা, বিহ্বল, কপর্দকহীন। কেবল আগের দিন বিকালে দশজনের একটি দল গঠন করেছি। সেই দশজনের আটজনই ভালোভাবে বন্দুক ধরতেও জানে না। গভীর পাহাড়ে কোথাও যাব ঠিক এরকম সময়ে খবর এলো, কে বা কারা গত রাতে সাননবান্দার মান্নান তালুকদারকে মেরে ফেলেছে। তার লাশ নিতে বাসাইল থেকে পুলিশ এসেছে। খবর পেয়ে মনে হলো এভাবে গভীর জঙ্গলে বিনা প্রতিরোধে যদি দারোগা-পুলিশ আসতে পারে, তাহলে তাদের সাহস বেড়ে যাবে। তাই ছুটলাম সখিপুরের দিকে। বহেরাতলীর ধোপার চালা পৌঁছলে খবর পেলাম, সংগ্রামপুরের অবাঙালি পাতার ব্যবসায়ীদের ক্যাম্পে লাইট মেশিনগানসহ বেশক’টি অস্ত্র আছে। অস্ত্রের খবর পেয়ে ভাবলাম, পেছনে শত্রু রেখে গভীর জঙ্গলে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। পেছন থেকে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। গুলি চালাতে জানি আমরা দু’জন। একজন পাকিস্তান নৌবাহিনীর মনিরুল ইসলাম, অন্যজন আমি। অভিযানের জন্য দল ভাগ করলাম তিনটি। যেভাবেই সাজাই এক দলে একজনও গুলি চালানোর থাকে না। অনেক ভেবে-চিন্তে তিন জনের দুটি এবং চারজনের একটি এভাবে তিন ভাগ করে অবাঙালি পাঠানদের ক্যাম্প আক্রমণে এগিয়ে গেলাম। যারা গুলি চালাতে জানে না তাদের দলকে খুব নিরাপদ জায়গায় রেখে আঘাতের জন্য আমি, প্রয়োজনে সমর্থনের জন্য কমান্ডার মনিরকে রাখা হলো। খুব সহজেই পাতার ক্যাম্প দখল হয়ে গেল। পাঠান ব্যবসায়ীদের পিঠমোড়া দিয়ে বেঁধে সারা ক্যাম্প তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো। তিন-চারশ’ বস্তা বিড়ির পাতা ছিল। তা তছনছ করে দেখা হলো। কোথাও কোনো অস্ত্র পাওয়া গেল না। পাঠানদের সর্দার টিকাদার বার বার বলছিল, ‘আমাদের কাছে যদি একটা চাকুও পান তাহলে যা খুশি শাস্তি দিন।’ সত্যিই খুঁজে কিছু পাওয়া গেল না। তাই তাদের বাঁধন খুলে দেয়া হলো। পাতার ক্যাম্প তল্লাশির সময় এ এলাকার সবচেয়ে বড় মুসলিম লীগার মোক্তার আলী চেয়ারম্যানকে গরুর দড়ি দিয়ে পিঠমোড়া করে বেঁধে আনা হয়। মান্নান তালুকদার ও মোক্তার আলী চেয়ারম্যান ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের প্রধান খুঁটি। ক’দিন আগে পশ্চিম পাকিস্তানি এডিসি মেজর জেনারেল পীরজাদার ভগ্নিপতিকে মিলিটারি এনে উদ্ধার করে দিয়ে সে পরিচয়ও তারা দিয়েছে। মান্নান তালুকদারের থেকে শওকত মোমেন শাজাহানের বাবা মোক্তার আলী ছিল বেশি চালাক। তাই কালমেঘা থেকে কয়েকজন ইপিআর এনে আগের রাতে তাকে মেরে বাসাইল থানায় যাচ্ছিল ঠিকঠাক করতে, সেই সময় আমাদের হাতে ধরা পড়ে। ঘটনাগুলো পরে জেনেছিলাম। সে সময় জানা গেলে সেও হয়তো বাঁচত না। তার সে সময় বেঁচে যাওয়ার মূল কারণ তার ছেলে শওকত মোমেন শাজাহান আয়ুববিরোধী আন্দোলনে আমাদের সঙ্গে ছিল। আমরা সবাই তখন ক্ষুধার্ত ছিলাম। তাই খাবার খাচ্ছিলাম। কিন্তু খাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি মিস্ফায়ারে ক্যাম্পের পাশে থাকা পুলিশ দল সবকিছু ফেলে পালিয়ে যায়। তাতে আমরা কয়েকটা অস্ত্র এবং অন্যান্য জিনিসপত্র পাই। সে এক মহা বিস্ময়কর ব্যাপার! পাতার ক্যাম্প দখলের কয়েক দিনের মধ্যে দল সুসংগঠিত হয়ে যায়। পাঠানদের নেতা মমতাজ খান পাঠান কাদেরিয়া বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে গিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের ইচ্ছে প্রকাশ করে। প্রথম প্রথম আমরা তাদের কাউকেই বিশ্বাস করিনি। কিন্তু সে বার বার পরম বিশ্বস্ততার পরিচয় দেয়। ঢাকা থেকে ওষুধপত্রসহ প্রয়োজনীয় মালামাল এমনকি কাদেরিয়া বাহিনীর সবচেয়ে বড় অভিযান হানাদার বাহিনীর অস্ত্র বোঝাই দুটি জাহাজ দখলের সব খবরাখবর ও প্রয়োজনীয় সহায়তা মমতাজ খান এবং তার পাঠান সহকর্মীরা জোগায়। আগস্টের চরম দুঃসময়ে কাদেরিয়া বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে ছত্রভঙ্গ বাহিনীকে আবার সুসংগঠিত করতে সে দারুণ ভূমিকা পালন করে। এসব করায় তার অতিরিক্ত সুবিধা ছিল যে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর এক কর্নেল তার আপন ভাই। সে পুরনো ঢাকা নিয়ন্ত্রণ করত। যাই হোক, পরম বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিয়ে সে এবং তার পাকিস্তানি পাঠানরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধে তাদের সহায়তার কি গোপন রহস্য ছিল কখনও বলেনি। কিন্তু যুদ্ধের সময় কখনও কথা বলার সুযোগ হলে বলার চেষ্টা করেছে, ‘আমরা উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মানুষ, আমরাও স্বাধীনতা চাই।’ হয়তো তাদের মনে আশা ছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তাদের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মুক্তি বা স্বাধীনতায় তারা সহযোগিতা পাবে। যদিও কথাটি কেউ কখনও মুখ ফুটে বলেনি। মমতাজ খানের ছিল বিরাট পাতার ব্যবসা। ঢাকা, কুষ্টিয়া এবং পশ্চিম পাকিস্তানে তারা গাদিলা পাতা সরবরাহ করত। তখন ভারতের টেণ্ডু পাতা আর পূর্ব পাকিস্তানের গাদিলা পাতা—এই দুই পাতায় বিড়ি তৈরি হতো। ’৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর ভারতের আসাম থেকে টেণ্ডু পাতা আসা বন্ধ হয়ে যায়। বিকল্প হিসেবে মধুপুর এবং ভাওয়ালে গাদিলা পাতা দিয়ে বিড়ি তৈরি শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তানে গাদিলা পাতার বিড়ি তেমন না চললেও পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক প্রচলন ছিল। আরও কয়েকটি ব্যবসার সঙ্গে এই বিড়ি পাতা এবং তামাকের একচেটিয়া ব্যবসা ছিল মমতাজের। প্রতি সপ্তাহে মমতাজ খানের কোম্পানি প্রায় অর্ধ কোটি টাকার পাতা পশ্চিম পাকিস্তানে সরবরাহ করত। লাভের পরিমাণ ছিল ব্যাপক। ৪০ ভাগ ব্যয়, ৬০ ভাগ লাভ। মুক্তিযুদ্ধ শেষে মমতাজ খানের পাতার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ। তার মূল ব্যবসাই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। টাকা-পয়সা সব পশ্চিম পাকিস্তানে। দীর্ঘদিনের ধনাঢ্য আমীর বাংলাদেশের স্বাধীনতায় হয় পথের কাঙাল। হাবিব ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা টাকা তোলার সুযোগও পায়নি। সংসার চালানোর অর্থে টান পড়ে। এর অনেক কিছুই তখন আমি জানতাম না। যা অনেক পরে জেনেছি। কয়েকবার সে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেছে। বঙ্গবন্ধু তাকে বেশ সম্মান দিয়েছেন, গুরুত্ব দিয়েছেন। সহায়তাও করেছেন। আমিও করেছি। ব্যবসা-বাণিজ্যে সে আবার দাঁড়িয়ে যাওয়ার পথে হঠাত্ করে বঙ্গবন্ধু নিহত হন। আবার সে সাগরে পড়ে। একবার বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাপ-দাদার পৈতৃক সম্পত্তি হারিয়ে সে হয় সর্বহারা, আবার বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সব হারিয়ে পথের ভিখারী। আশির দশকে একবার পশ্চিম পাকিস্তানে যায়। বাপ-দাদার বিশাল সম্পত্তি যা এখন ২-৩ হাজার কোটি টাকা হবে। নিজের এবং বাবার গড়া সম্পত্তিতে তার অধিকার নেই এখন। দেশে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাকিস্তানিরা বাংলাদেশকে সমর্থন করায় গাদ্দার বলে তিরস্কার করে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। সে আবার খালি হাতে বাংলাদেশে ফিরে আসে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তিতে কেন যেন আজ বার বার মমতাজ খানের এই অসহায়ত্বের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে দায়ী করতে ইচ্ছে করে। বাংলাদেশ না হলে আমি যেমন একেবারে নাম না জানা মানুষ জগদ্বিখ্যাত হয়ে বঙ্গবন্ধুর অত ভালবাসা পেয়ে ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নিঃস্ব হতাম না, তেমনি পাকিস্তান থাকলে টাটা বিরলার মতো না হোক, আম্বানীদের মতো না হোক, বাংলাদেশের নূর আলী, সালমান এফ রহমান, নুরুল ইসলাম, আহমেদ আকবর সোবহান, স্কয়ারের তপন চৌধুরী, নিটোলের মাতলুব আহমেদের চেয়ে হাজার গুণ উপরে থাকত। কারণ এদের কারোরই যখন লাখ টাকা ছিল না, তখন একমাত্র পাঠান বীর মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ খানের শত-কোটি টাকার ব্যবসা ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে জহুরুল ইসলাম, একে খান, এমআর খানসহ আরও দু’চারজন ধনী ছাড়া মমতাজ খানের চেয়ে বিত্তশালী আর কেউ ছিল না। তাই আজ সত্যিই মনে হয় কবি কাজী নজরুল যথার্থই লিখেছিলেন—‘সকাল বেলার আমীর রে ভাই, ফকীর সন্ধ্যা বেলা— নদীর একূল ভাঙ্গে ওকূল গড়ে এই তো নদীর খেলা।’ ইদানীং কিছু কিছু মিডিয়া মমতাজ খানের দুরবস্থা নিয়ে বাণিজ্য করছে। তার সাক্ষাত্কার নিয়ে প্রচার করে লাখ লাখ টাকার ফায়দা লুটছে। কিন্তু মমতাজ খানের বেলায় অষ্টরম্ভা। এ ব্যাপারটাও সিধেসাদা পাঠান মানুষটা বোঝে না। কেউ গেলে কথা বললে শিশুর মতো ঝরঝর করে কাঁদে আর সরল মনে বলে চলে। অমন সরলতার প্রতীক বাংলায় দ্বিতীয়টি আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। মমতাজ খান পরপারে চলে গেলে সরলতার প্রয়োজন হলে বাংলাদেশকে বাইরে থেকে তা আমদানি করতে হবে। তাই এই শুভদিনে মমতাজ খানকে জাতীয় সম্মান দিতে তার সম্পর্কে ভেবে দেখতে বিনীত নিবেদন জানাচ্ছি।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিজয় দিবসে বঙ্গভবনে দাওয়াত দিয়েছেন। যে বঙ্গভবনে স্বাধীনতার পর অনেক নেতানেত্রী, মন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতির আগে গেছি। কিন্তু মহামান্য রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের দাওয়াতে উপস্থিত হতে পারলাম না। জুন-জুলাইয়ের দিকে আওয়ামী লীগের গুণ্ডাপাণ্ডারা রাজাকার বলে গালাগাল করায় এমনিতেই কোনো সরকারি অনুষ্ঠানে যেতাম না। তার ওপর আবার গত ১৫ নভেম্বর ’৯৯ সখীপুর-বাসাইলে আওয়ামী সরকারের ভোট ডাকাতি দিবস উপলক্ষে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নলুয়ার মহাসমাবেশের পরদিন ১৬ নভেম্বর ভোট ডাকাতিতে বিশ্বরেকর্ড করা শওকত মোমেন শাজাহান আমাকে যুদ্ধাপরাধী বলে গালি দেয়ার পরও আওয়ামী লীগ এবং সরকার সেই জঘন্য কাজের জন্য শওকত মোমেন শাজাহান বা অন্যদের শাস্তি না দেয়ায় কিংবা নিন্দা না করায় মুক্তিযুদ্ধের বেদি সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং রাষ্ট্রপতি বা সরকারি কোনো দাওয়াতে প্রতিবাদ হিসেবে না যাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত বলে অন্তরের নির্দেশে বিরত থাকলাম। আসলে কোনো রাজাকার কিংবা যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যাওয়া স্বাধীনতার জন্য কলঙ্কের। তাই বিরত রইলাম।
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×