আমি একজন মানুষ। এটাই আমার প্রথম ও প্রধান পরিচয় হওয়া উচিত। কিন্তু বিশ্বের কোনো দেশেই এ পরিচয়টাকে সম্পূর্ণ পরিচয় বলে ধরা হয় না। যে প্রশ্ন প্রথম ওঠে, তা হলো আমি পুরুষ না নারী? আমি পুরুষ মানুষ। কিন্তু তারও পর আছে। আমি সাদা না কালো না বাদামি? আমি কালো ঘেঁষা বাদামি পুরুষ মানুষ। এখানেই শেষ নয়। আমি উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত না বিত্তহীন? আমি নিম্নবিত্ত কালচে বাদামি পুরুষ মানুষ। তারপর? নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের সূত্র ধরে আমি কী? আমি বাঙালি। আমি কোন দেশের বাঙালি? বাংলাদেশের। আমার ধর্মীয় পরিচয় কী? আমি মুসলমান। আরও বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রশ্ন আছে। আপাতত এটুকুই থাক। এ পর্যন্ত এসে আমার পরিচয় কী দাঁড়ালো? আমি একজন নিম্নবিত্ত-কালচে বাদামি বাংলাদেশী বাঙালি মুসলমান পুরুষ মানুষ। কিন্তু এখানে একটা বড় ঘোঁট আছে। তা ওই বাংলাদেশী শব্দটি নিয়ে। ঘোটটা জাতীয়তার প্রশ্নে। বাঙালি বললেই কেন শেষ হয়ে যাচ্ছে না? কেন আবার বাংলাদেশী বলতে হচ্ছে? মনে আছে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে উপজাতীয় সর্বমান্য এক নেতাকে বলেছিলেন, বাঙালি হয়ে যেতে। তার নির্দেশ যদি পালিত হতো, তাহলে তাদের একটি শব্দ বদলে পরিচয় দিতে হতো। তাদের বলতে হতো, আমি একজন উচ্চবিত্ত/মধ্যবিত্ত/নিম্নবিত্ত/বিত্তহীন, বাদামি/কালচে বাদামি, মগ/ মারমা/ চাকমা/ তংচঙ্গা/ ম্রো/ গারো/ মণিপুরী/ খাসিয়া/ সাঁওতাল ইত্যাদি ইত্যাদি, বাঙালি, মুসলমান/হিন্দু/বৌদ্ধ/খ্রিস্টান, পুরুষ/মহিলা মানুষ। আমি আমার পরিচয় যেভাব বলেছি, ধনবৈষম্য, ধর্মীয় ভিন্নতা এবং লিঙ্গ ভেদানুসারে সেভাবেও পরিচয় বিভিন্নতা বাঙালিদের মধ্যেও আছে। সে যাই হোক, বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাব বা নির্দেশ মেনে নেয়নি কোনো উপজাতীয় সম্প্রদায়। ফলে নিরসন না হয়ে ঘোটটা আরো পাকিয়েছে। ১৯৪৭-এ উপজাতীয়দের যারা ভারতীয় বা বার্মিজ পতাকা উড়িয়েছিল ’৪৭-পরবর্তী পাকিস্তান সরকার যেমন, তেমনি ’৭১ পরবর্তী বাংলাদেশ সরকারও তাদের দেশের ভৌগোলিক সীমানা থেকে বের করে দেয়নি। পাকিস্তান আমলে তাদের পাকিস্তানি বলা হতো। কিন্তু বাংলাদেশ আমলে তাদের বাঙালি বলা গেল না। বলতে হলো ‘বাংলাদেশী’। ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ শব্দটিকে অবশ্য শুধুমাত্র এই কারণেই নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের সমন্বয়সহ আরও বহু উপাদানের কথা ভেবেই শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তত্ত্ব হিসেবে দাঁড় করান। এটাই হলো সবচেয়ে বড় বিপত্তি। কথায় আছে, ‘যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা।’ তাই ১৯৯৬-পরবর্তী সময়ে জাতীয়তার প্রশ্নে তো নয়ই, অন্যান্য ক্ষেত্রেও বাংলাদেশী শব্দটি উচ্চারণ করাও প্রায় গুনাহের সমতুল্য হয়ে দাঁড়ালো। এই সময়ে সীমান্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে চরে বেড়ানো কিছু গরু চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় বিডিআরের হাতে আটক হলো গরুসহ ক’জন ভারতীয় গরু চোর। বিএসএফ এলো। বিএসএফসহ চোরের দল দাবি করল ওগুলো ভারতীয় গরু। বিডিআর প্রতিবাদ করতে গিয়ে থমকে গেল। কী বলবে তারা? বাঙালি গরু? ‘বাংলাদেশী’ তো জিয়া দোষে দুষ্ট শব্দ! এদিকে ‘বাঙালি গরু’ বলতেও কেমন যেন বাধো বাধো লাগে। অতএব, গরুর দাবি ছেড়ে দেয়াটাই অনেক বেশি নির্ঝঞ্ঝাট কাজ বলে মনে হলো তাদের কাছে। এটা হয়তো ঘটনা নয়। ওই সময়ে তৈরি হওয়া একটি গল্পমাত্র। কিন্তু গল্পের মধ্যেও অল্পবিস্তর তাত্পর্য থাকে। বাংলাদেশের ভূমিকে যেমন বাঙালি ভূমি, নদী মাত্রকেই যেমন বাঙালি নদী, বনাঞ্চলকে যেমন বাঙালি বনাঞ্চল বলা যায় না, তেমনি বাংলাদেশের উপজাতীয়দেরও বাঙালি চাকমা-বাঙালিগারো-বাঙালি খাসিয়া ইত্যাদি বলা গেল না। ফলে জাতীয়তা হিসেবে বহিরাঙ্গে অন্তত ‘বাংলাদেশি’ শব্দটাই দাঁড়িয়ে গেল।বাংলায় একটি প্রবাদ আছে—‘জিদের ভাত কুত্তারে খাওয়াই’। অর্থাত্ নিজে খেয়ে হাঁড়ির ভাত এমন জায়গায় রাখব যাতে সহজেই কুকুরে মুখ দিতে পারে। তাতে স্বামীর খাওয়া হোক বা না হোক—সতীনকে তো উপোস রাখা গেল! কোনো কারণে জিদ রক্ষা করা না গেলে—জিদের আগুন দ্বিগুন হয়। যেমন : এবার শুরু হয়েছে ‘জিয়া’ শব্দটি মুঝে ফেলা। দেশের যেখানে যা কিছুর সঙ্গে জিয়ার নাম যুক্ত আছে—তার নাম বদলে দেয়া হচ্ছে। এখন এ প্রক্রিয়ায়, ’৭১ এ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাকারী, বেতারে স্বাধীনতার ঘোষণাদানকারী, বীরউত্তম মুক্তিযোদ্ধা, জেড ফোর্সের অধিনায়ক, ’৭৫-এর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যম উদিত জননায়ক, গণতন্ত্রের পুনর্মুক্তিদানকারী রাষ্ট্রপতির নাম বদল করে কোনো আউলিয়ার নাম দেয়া হবে কিনা, হলে তা কার নাম তা অবশ্য এখনো জানা যায়নি। একটি চিরন্তন সত্য সবার জানা, তা হলো ক্ষুদ্র যখন কোনো ভাবেই বৃহত্-মহতের উচ্চতা স্পর্শ করতে পারে না—তখন তাকে কেটে-ছেঁটে নিজের নাগালে আনবার বৃথা চেষ্টায় লিপ্ত হয়। আসলে নাম বদলাবদলির অতি-অকারণ চপলতা, জনগণের অর্থে চালিত সংসদে বসে, যখন থেকে শুরু হয়েছে এবং যখন যে সরকার তা করেছে, দেখা গেছে জনগণ তা ভালোচোখে দেখেনি। এতে করে গণমনে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা থেকেই নানা বিদ্রূপাত্মক গল্পের জন্ম হয়। তেমনই একটি সাম্প্রতিক গল্প—এক স্কুলের ক্লাস পরীক্ষায় সুলতানা রাজিয়া সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এক ছাত্র খাতায় ‘সুলতানা রা’ পর্যন্ত লিখে বাকিটুকু ডটডট দিয়ে গেছে। খাতা দেখে শিক্ষক তাকে ডেকে পাঠিয়ে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। ছাত্র বলল,—“রা-এর পরে তো ‘জিয়া’ আছে। ‘জিয়া’র বদলে ওখানে কী পড়তে বা লিখতে হবে সে সম্পর্কে কোনো সরকারি নির্দেশ তো এখনও পাইনি... তাই....”
লেখক -- মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান : গীতিকার, নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




