somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় - বন্ধুত্বের দিনগুলো : পর্ব ৩

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০০৮ সন্ধ্যা ৬:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(আগের পর্বগুলো: শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়: প্রারম্ভিকা / বন্ধুত্বের দিনগুলো:পর্ব ১ / বন্ধুত্বের দিনগুলো:পর্ব ২)

এক
কিছু কিছু জিনিশ আছে বারবার দেখার পরেও দেখার সাধ পূরণ হয় না। নাম শুনলেই কেমন জানি একটা মন-উথালপাতাল ভাব শুরু হয়। নস্টালজিয়ায় ঘিরে ধরে। আবার দেখতে ইচ্ছে হয়। চাবাগানের সৌন্দর্য্য কারণে-অকারণে আমাকে বারবার টানে। মুগ্ধ করে। আনন্দ দেয়। আন্দোলিত করে। এই সখ্যতা আমার অনেক ছোটবেলা থেকেই। যখন আমি ক্লাস সেভেনে পড়ি, স্কুল পালিয়ে পাড়ার লাইব্রেরীতে সমরেশ শীর্যেন্দু পড়তাম সেই সময় থেকে। এমদাদ প্লেন করলো এবার সবাইকে নিয়ে শমসেরনগর যাবে। তার বাবা শমসেরনগর চাবাগানে চাকরি করেন। মা-বাবা-বোন ওখানেই থাকেন। গত একমাসে পত্রিকা নিয়ে থাকায় যাওয়া হয়নি। তাকে না দেখে তার মা বেশীদিন থাকতে পরেন না। ইউনির প্রথম দিকে এই অতিভালোবাসায় শিকার হয়ে বেচারা এমদাদকে প্রতি সপ্তাহে একবার সিলেট-শমসেরনগর করতে হতো। তাও এখন ১৫ দিনে বা মাসে একবার করতে হয়। তবে এইবার মা-ছেলের সাক্ষাতের চেয়ে টাকার প্রয়োজনটাই বেশী । তার হাতে কোনো টাকা নেই।
শমসেরনগর যাওয়াটা অবশ্য তেমন কোন কষ্টকর ট্রাভেল না। ঢাকাগামী পারাবত, জয়ন্তিকা, উপবনে উঠে বসলেই মাইজগাঁও স্টেশান। বিনাটিকিটে জার্নি। টিটি ধরলে উল্টো ভাব ধরে বলা, টিকিট করিনি সাস্টে পড়ি। তেমন কোনো ঝামেলা হয় না। টিটি আইকার মতো পেছনে লাগার আগেই মাইজগাঁও স্টেশান এসে যায়। সিলেট হতে মাত্র ৩০ মিনিটের দুরত্ব। সেখান থেকে মুড়িরটিন বাস ধরে শমসেরনগর। লক্কর ঝক্কর বাস। হেলেদুলে চলে। ধুলো উড়িয়ে, মাইলে ৪/৫ বার থেমে থেমে, নামকরণের সার্থকতা সফল করে। ভাবটা যেন, বাবা তোমাদের যদি এতোই তাড়া থাকে তাইলে আমায় উঠেছো ক্যান? অন্যপথে যাইতা। আমি তো তোমাদের জোড় করে তুলিনি। উঠেছো যখন তখন আমার মাতলামিতো সহ্য করে রয়ে সয়েই যেতে হবে। অবশ্য পারাবত অথবা জয়ন্তিকা অথবা উপবনে আর মুড়িরটিন মাতলামিপর্ব ছাড়াও সিলেট-শমসনগর করার আরেকটি সহজ অপশন আছে। সিলেট থেকে লোকাল ট্রেনে সরাসরি শমসেরনগর স্টেশান যাওয়া যায়।
আমরা দলবেধে শমসেরনগর রওয়ানা দিলাম। ইউনি বন্ধ। নামকরণ আন্দোলন চলছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশিষ্ট বাঙালীদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ভবনের নামকরণ করেছেন। সিন্ডিকেটে সেটা পাশ হয়েও এসেছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জি সি দেব এমনসব মহান ব্যক্তিদের নামে নামকরণ হয়েছে। আমরা সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা খুশী হলাম। কিন্তু ইসলামী মৌলবাদী এবং তাদের বাচ্চারা সেটা সহ্য করতে পারেনি। তারা শহীদ রুমির মাকে সিলেটে চায় না। কিছু স্বার্থান্বেষী পলিটিশিয়ান তাদের সাথে যোগ দিলো। নামকরণের প্রতিবাদ উঠলো। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও নামকরণ করেই ছাড়বে। জাফর স্যার খুব কড়াকরে ভোরেরকাগজে কলাম লিখলেন। নামকরণের পক্ষে ইখতিয়ার উদ্দিন একের পর এক লেখা ভোরের কাগজে লিখে চললেন। শেষমেষ বিএনপিও মৌলবাদী এবং তাদের বাচ্চাদের সাথে জড়ো হলো। দ্বন্ধ আরো জটিল হতে থাকলো। সেই দ্বন্ধে আমাদের মতো হাজার হাজার সাধারণ ছেলে মেয়ে তখন আট মাস বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে ছিলাম।
আমার কোচিং এবং টিউশানী অবশ্য সেমসয়টায় বন্ধ না। কিন্তু ব্যাপার না। সবাই যাচ্ছে আর আমি যাবো না, তাতো হয় না। একটা উৎসব উৎসব ভাব নিয়ে রওয়ানা দিলাম। পারাবতে যথারীতি মাইজগাঁও নামলাম এবং মুড়িরটিন ধরলাম। সালামটা পারেও বটে। কিভাবে যেন বাসের হেল্পারকে পটিয়ে কয়েকটা পাতার বিড়ি জোগাড় করে ফেলল। নাসিরুদ্দিন বিড়ি। ব্লেকে পাওয়া যায়। ২৫ টার প্যাকেট ৫ টাকায়। এই জিনিশ খাওয়াটা কিন্তু জটিল একটা কাজ। অনেক উস্তাদি লাগে। মিনিটে অন্তত একবার টানতে হয়। বিশ্রি গন্ধ বেড়োয়। অবশ্য গন্ধওয়ালা এই বিড়ি দিয়েই ক্লাস এইটে পড়ার সময় বিড়ি খাওয়ার তালিম নিয়েছিলাম। আমার এক তালতোভাই এর কাছ থেকে। কৃষক মানুষ। ওদের কাছে এই বিড়ি অমৃতের মতো। তো আমারা মনের আনন্দে বিড়ি খেয়ে যাচ্ছি। বাসভর্তি মানুষ দেখছে। দিনমজুর টাইপের কিছু মানুষ বাক্স-ঝোলা সহ কোথাও যাচ্ছিলো। সাথে বোরখা পরিহিত রমণীরাও ছিলো। বাস থেকে নেমেই খেয়াল করলাম মুখ আর কাপড়-চোপড় থেকে বিড়ির গন্ধ ছড়াচ্ছে। একেকজন যেন নাসিরুদ্দিন বিড়ির একেকটা জীবন্ত ফ্যাক্টরী । চাবাগানের টিউবওয়েলে অনেকক্ষণ ধরে হাত-মুখ ধুলাম। ওয়াক ওয়াক করলাম। গন্ধ যেন আরো বাড়ছিলো। মনে হচ্ছিলো, বিড়িরগন্ধওয়ালা সাবান দিয়ে এইমাত্র যেন আমরা গোসল করে এসেছি। মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। এমদাদ সালামকে বকতে থাকলো। দূর মিয়া তুমি আর মানুষ হইলা না, কই থাইক্যা যে এইসব জোগাড় করো। তোমারে মিয়া পিএল দেওয়া উচিত। সালাম সাথে সাথে মাথাটা মাটির দিকে নিচু করে পাছাটা আকাশের দিকে তোলে বলল, জ্বি দেন। আফটার অল আপনার বাড়ি যাচ্ছি। আপনাকে খুশী রাখতে হবে, নইলে নাখাইয়ে রাখার সম্ভাবনা আছে।
এখানকার চাবাগান গুলো অন্যরকম সুন্দর। পাহাড়ের গায়ে স্তরে স্তরে সাজানো। নতুন কুঁড়ি এসেছিলো তখন। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। বড়ো বড়ো ছায়াগাছ। ঠিক মাঝদিয়ে চাবাগানকে দুইফালি করে চলেছে ঢাকা-সিলেট রেলেররাস্তা। রাস্তার ওপাড়ে চাকুলিদের বস্তি। কুলিবস্তি থেকে অনেকটা দূরে, রেলের এপাড়ে এমদাদের বাড়ি। ওখানে অনেকগুলো পরিবার থাকে। সবাই চাবাগানের কমর্চারী। কেউবা ফ্যাক্টরির কেউবা বাগানের। ছোট একটি হাসপাতাল। একটি এম্বুলেন্সও আছে ।
প্রতিটা বাড়ির সামনে একটা মোটা লাইলনের রশি। শাড়ি লুঙ্গি পেটিকোট গামছা হাফপেন্ট শার্ট ঝুলছে। ঝটকা হাওয়ায় পতপত করছে। বাচ্চাদের অনেকগুলো তেনাকাপড়ও আছে। কেউ হয়ত কদিন আগেই মা হয়েছেন। এমদাদের মা-বাবা-বোনের সাথে আমাদের পরিচয় হলো। খুব সহজ সরল সাধারণ একটা পরিবার। সরলতা আর নিমর্লতায় একেকজন অনন্য। এমদাদের ঠিক ফটোকপি।
পলাশ বলল কি শামিম ভাই, চাবাগান দ্যাখতে এসে এখানে ঝিমানোর মানেটা কি? পলাশকে ক্ষেপানোর জন্য ইমদাদ আস্তে আস্তে বলল পলাশদা, ঝিমধরে তো আপনিই বসে আছেন। আমরাতো কবে থেকেই বেরুবো বেরুবো করছি। পলাশ বলল ফাজলামু করোনা, আমি রেডি। চলো, বাগানে চলো। সালামকে পাওয়া যাচ্ছে না। লাপাত্তা । এমদাদ বললো আসার পর থেকেই নাকি ওকে সে দেখতেছে না। আমরা যা বুঝার বুঝলাম, ফুয়েল সংগ্রহে বেরিয়েছে। সিগারেট ছাড়া ও বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। তখনও বিকেল হয়নি। মাথাধরা রোদ পড়ছিলো। ঝিমধরা দুপুর । প্রচন্ড গরম। ঘন্টাখানেকের মাঝেই সালামের দেখা মিলল। কয়েকটা কোকের বোতল হাতে চাবাগান ফুঁড়ে যেন হঠাৎ উদয় হলো। চা বাগানজুড়ে ছোট ছোট পথ। জালের মতো। পথধরে হাটলে বুঝা যায় চাগাছগুলো মাথাউচ্চতার সমান। সেইসব পথধরে অনেকক্ষণ হাটলাম। এমদাদের বাবা সাপের উৎপাতের কথা আমাদের বলে দিয়েছিলেন। আমরা খুব সাবধাণে একটা টিলার চুড়ায় দিকে এগুচ্ছিলাম। সবার হাতে আবার একটি করে লাঠিও ছিলো। গাছের ডালের। ভাবটা এমন যেন হিলারী তেনজিং এর মতো পৃথিবীর আরেকটি চুড়া জয় করতে চলেছি। কোনো সাপের দেখা আমরা পাইনি। তবে ভয়টা মনে ছিলো। এমদাদ বলল হুদাই সাপ কেন আপনাকে ছোবল দিতে আসবে। জান বাচাঁতেই সাপ ছোবল দেয়। টিলার ঐ পাশটা থেকে রেলরাস্তারটাকে দেখতে একটা প্রবাহমান জলনালার শরীরের মতো লাগছিলো। মরীচিকা। তেজী সূর্যের আলো স্লিপারের উপর প্রতিবিম্বিত হয়ে এমনটা হয়েছিলো। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। মনমাতানো সৌন্দর্য্য । অনেক দূরে চাশ্রমিকেরা চাপাতা তুলছে। পলাশ কবিতার কথা, কবির কথা বললো। কবিতার কথা বলতে বসলেই পলাশের চোখ ঝিকমিক করে উঠে। সেদিনো হলো। আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর কথা শুনছিলাম। এমদাদ কি জানি একটা গল্প পড়েলো। শাহাদুজ্জামানের একটা গল্প। ইমদাদ কয়েকটা কবিতা পড়লো। সম্ভবত জীবনানন্দ দাশ এর কবিতা থেকে। তার নিজের কবিতাও পড়লো কয়েকটা। কবিতা গল্প আর চাবাগানের ঝিমধরা সৌন্দর্য্যে মাতাল হয়ে সিগারেটের শেষফিল্টারটি পালাক্রমে টানতে টানতে আমরা চুড়া থেকে নামলাম।
এই ছোট্ট টিলাপাড়াটিতে আশ্চর্যরকম সুন্দর একটা পুকুর আছে। পলাশ আবার সাঁতার জানতো না। সে কি ভয়! পুকুরের পানিতে পা লাগিয়েই আগুণে ছেঁকা খাওয়ার মতো ছিটকে দূরে সরে গেলো। এখন আর সালামকে কে থামায়? এতোদিন পর পলাশকে কাবু করার একটা (কুট !) কৌশল পেয়েছে। জোরকরে এনে পানিতে নামালো। সাঁতার শেখাবে বলে। আমরা মেতে উঠলাম পলাশকে নিয়ে। বেশীদূর করতে পারলাম না। বেচারার ভয়ার্ত চোখমুখ দেখে আমাদেরই ভয় লেগে গেলো। ঐ পুকুরে আবার জোঁকের ভয়ও ছিলো। আমি আবার জোঁক ভয় পাই। ছোটবেলায় আমরা দলবেধে খালের উপরের বাঁশের সাঁকো থেকে বা ওয়াবদার অর্ধনির্মিত ব্রিজের উপর থেকে যেরকম লাফিয়ে পড়তাম, লাই খেলতাম, ডুব সাঁতারে প্রতিযোগিতা করতাম সেরকম মজা করলাম। চোখলালকরা গোসল করলাম।
সন্ধ্যার হতে না হতেই কুলিবস্তি হতে ঢাকঢোলের বেতাল শব্দ আসতে থাকলো। আমরা স্থির করলাম হাসপাতালের রোগীদের বেডে ঘুমাবো। সিগারেট আর আড্ডাবাজির সুবিধার্থে এই ব্যবস্থা করা হলো। সালামকে আবার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । কোথায় গেল কোথায় গেল করতে করতে জানা গেলো কুলিবস্তিতে সস্তা মদ আর গানের উৎসব দেখতে গিয়েছে । ওখানে নাকি সন্ধ্যার পরেই ফ্রিতে ড্রামভর্তি বাংলা মদ দেওয়া হয়। গ্লাসভর্তি করে যতপার খাও। বড়ো গ্লাস, একগ্লাস খেলেই নাকি কাইত। কুলিরা খায়। বোধবুদ্ধি হারায়। নাচে। গায়। বুঝলাম এটা শোষণের উদার কৌশল। কুলিদের কুলিকরে রাখার সনাতন এবং বিশ্বস্ত একটা পদ্ধতি। পদ্ধতিটি এই যুগেও এখানে চলছে! বাবুরা এঁদের বোধবুদ্ধিহীনই রাখতে চায়। আধুনিক পৃথিবীর দূরে রাখতে চায়। এঁদের ভেতরে যে বেশামাল আগুণ। দপকরে জ্বলে উঠলেই উনাদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। ব্যবসায় লালবাত্তি জ্বলবে। কে চায় রিস্ক নিতে? ফ্রিতে মদ দাও। যত চায় তত দাও। খাক, টাল হোক। পরদিন সকালে টিলাবাবুরা লাঠিতে গুতিয়ে গুতিয়ে ঘুম ভাঙাক, হুইসেলের রুটিনে কাজে নিক, আবার সারাদিন খাটুক, সন্ধ্যায় খাক, টাল হোক। আমাদের মন খারাপ হলো।
দুই
মনু নদীর ভাঙন ফিবছর আমাদের প্লাবিত করে। পত্রিকার পাতা জুড়ে আকমল হোসেন নিপু লিখে চলেন মনুর ভাঙনের বর্ণনা, প্লাবণের বৃত্তান্ত। আমরা পড়ি। মন খারাপ করি। প্লাবিত হই। এই মনু তীরেই ইমদাদ বেড়ে উঠেছে। আমাদের এইবারের জার্নি বাই ট্রেন টু মনুতীর। ইমদাদের ফুফাতো ভাইয়ের বিয়ে, মনুর গতি প্লাবণ ভাঙন দেখতে এমন সুযোগ আমি, সালাম, পালাশ এমদাদ ছাড়লাম না।
একদুপুরে পারাবত ধরতে এসে, না পেয়ে, লোকাল ট্রেনে রওয়ানা দিলাম মনুতীরে। আমি ইমদাদ আবশ্য পারাবতে ঠিকই চলে যেতে পারতাম। যথাসময়েই আমরা স্টেশনে এসেছিলাম। পালাশ, সালাম আর এমদাদ গেলো সিগারেট কিনতে। আমাদের করো কাছে সিগারেট ছিলো না। পালাশ বলল ফুয়েল ছাড়া এতোগুলো মানুষ চলবো কিভাবে? আমি আর ইমদাদ ট্রেনের শেষ কামরার দরজাধরে ওদের অপেক্ষায় আছি। ইতিমধ্যে ট্রেন চলতে শুরু করলো। দেখলাম ওরাও চলে এসেছে। একদম কাছাকাছি। সেকেন্ড তিনেক দুরত্ব। তিন জনেই দৌড়াচ্ছে। ট্রেনও চলছে। গতি বাড়ছে। ওঁরাও দৌড়াচ্ছে। ট্রেন আর ওঁদের মাঝে দূরত্ব বাড়তে থাকলো। বুঝলাম ওঁদের পক্ষে ট্রেনে উঠা সম্ভব না। কিছু বুঝে উঠার আগেই দেখি ইমদাদ লাফিয়ে প্লাটফর্মে নেমে পড়লো। শেষমেষ নিলাম রিস্ক। চোখবুঝে দিলাম ব্যাঙলাফ। ঠেংঠুং সে যাত্রায় অবশ্য ভাঙেনি।
লোকাল ট্রেন। হ-য-ব-র-ল অবস্থা। নারী পুরুষ শিশু বাচ্চাশিশু চাওয়ালা পানওয়ালা চানাচুরওয়ালা সব একাকার। কেউ ঝুলছে। কেউ দুলছে। একটি শিশু প্রশ্রাব করে দিয়েছে। অনবরত এ্যাঁ এ্যাঁ করে যাচ্ছে আর সেই প্রশ্রাবে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাবা মা পাশেই। বাপটা নির্বিকার। দ্বিতীয় বাচ্চাশিশুটিকে কোলে নিয়ে আয়েশে বিড়িটানছে। আমরা ঐপাশটার দখলনিলাম। আমাদেরকে অনেকেই আবার বেশসমীহের চোখেই দেখছে। জায়গা টায়গা দিচ্ছে। সালাম শুরু করলো সুরে বেসুরে ভুপেনের গান। ট্রেন শম্বুককগতিতে একেকটা স্টেশনে যাচ্ছে আর আধঘন্টা করে থামছে। মাঝে মাঝে আবার ইন্টারসিটিকেও পাস দিতে হচ্ছে। যত স্টেশন সামনে আসছে ততই লোক বাড়ছে। কেউ নামছে বলে মনে হচ্ছে না। শুধু উঠছে আর উঠছেই। পিনপিন মানুষ। দাড়ানোর জায়গা পযর্ন্ত নেই। চারপাশে মানুষ ঝুলে আছে। ট্রেনটি বাইরে থেকে দেখতে ভীযণ ইচ্ছে হচ্ছিলো। নিশ্চয় এটি তখন আখেরী মোনাজাত শেষে তাবলীগজামাত ফেরৎ মানুষ বোঝাই ট্রেনের মতোই দেখাচ্ছিলো । একজন আবার কয়েকটা ছাগল নিয়েও উঠে বসেছিলো। যাক বাবা এক স্টেশান পরেই ছাগলবাহিনীর যাত্রাসমাপ্তি হয়েছিলো। ছাগল যেভাবে হাগামুতা শুরু করেছিলো, আরকিছুক্ষণ থাকলেই খবর ছিলো। ছাগলের ফেলে যাওয়া গন্ধ। মানুযের গন্ধ-ঘাম । হাউমাও । বিড়ির ধোঁয় । বাচ্চাদের চিল্লাচিল্লি। বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।
এক ইন্টারসিটিকে পাসদিতে গিয়ে বসে আছি, লোকজন তখন কিছুটা কমেছে। কুলাউড়া ছাড়িয়ে এসেছি। সন্ধ্যা হবে হবে করছে। পলাশের মাথায় কিছু একটা খেলার আইডিয়া এলো, সিগারেট-সিগারেট খেলা। যদিও তা নতুন কোনো খেলা না। আমরা ক্যাম্পাসে অনেকবার এই খেলা খেলেছি। তবুও আমাদের আবার খেলতে ইচ্ছে হলো। সময় নষ্ট করা আর কি। আমরা পালাক্রমে একএককরে একটা সিগারেট টানবো,যার কাছে এসে সিগারেটের সোহাগা পরে যাবে সে নেক্সট স্টেশানে ১০টি গোল্ডলীফ কিনবে। শুরু হলো টানা পর্ব। একপাক শেষকরে সোহাগার আধিক্যতায় সিগারেট তার দ্বিতীয়পাক শুরু করলো। তখন তামাকের অজ্বালা অংশ সিগারেটের তলানিতে চলে এসেছে। সালামের কৌশলেই এমনটা হয়েছে। এমন লম্বা একটান দিয়েছে, এক টানেই প্রায় সিগারেটেই ৩০% সাবার করে সবাইকে রিস্কে ফেলে দিয়েছে। এখন একেকজনের হাতে যায় আর কম্পন বাড়তে থাকে। ইমদাদের হাতে গিয়েই সোহাগা পড়ে গেলো। আমরা একসাথে চিৎকার করে উঠলাম। আবার নতুন কিস্তি শুরু হলো। দেখলাম ট্রেনের অবশিষ্ট লোকেরাও বেশমজা পাচ্ছে। নড়েচড়ে বসেছে অনেকেই । হাসহাসি মুখকরে খেলায় মেতে উঠেছে। কেউ কেউ আমাদের সাথে সাথে এই পড়লো এই পড়লো করছে। প্রথমপাক ভালো মতোই ঘুরলো। দ্বিতীয়পাক চলার সময় পলাশের হাত থেকে এমদাদের হাতে ট্রান্সপারের মুহূর্তে সোহাগা পড়ে গেল। খেলা পরিত্যক্ত হলো। তৃতীয় কিস্তি শুরু করলাম। টানা চলছে; একপাক হয়েছে। দ্বিতীয়পাক হচ্ছে। এইবার আমার পালায় আসার মুহূর্তে বুঝলাম আবার ইমদাদের কপালেই পড়বে। কারণ আমি আস্তে করে কৌশলে একটা টান পার করে দিতে পারবো। কিন্তু ইমদাদ। আমার পরেই তাঁর টানার পালা। আমি শিওর ছিলাম ওঁর এখানে গিয়ে পড়বেই পড়বে। তাকে ২০টি সিগারেটের বোঝা দিতে ইচ্ছে হলো না। একটু জোড়েই টান দিলাম। সোহাগা পড়ে গেলো। আমি হারলাম।
মনু স্টেশানে পৌছলাম রাত ১২টারও কিছু পরে। ভয়াবহ বিরক্তি ক্ষুধা আর ঘুটঘুটে অন্ধকার মাথায় নিয়ে। ইমদাদের বাবা আমাদের জন্য টর্চ হাতে অপেক্ষা করেছিলেন। তিনি মনু বাজারে ছোট একটা ব্যাবসা করেন। একটু বাউলা টাইপের মানুষ। দিলখোলা। ইমদাদের সাথে বন্ধুর মতো সম্পর্ক। ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিড়ে বেড়িয়ে আসা আমাদের দিকে টর্চের আলো ফেলে বললেন, “কিথা বেঠা ইমদাদ, এথো রাইত ওইলো খেনরে বা? আমি হেই নয়ডা থাইখ্যা ওফেখ্যা খরথাচি।”
আমরা হাটছি মনু-তীর ধরে। পানির তোড়ের শব্দকে যাপন করে করে। দূরের বাজারের একটা বিজলিবাতির প্রতিবিম্ব এসে পড়ছে চলমান স্রোতে। আতঁকে উঠার মতো তোড়।
প্রতুলের গান- “আলু বেচো ছোলা বেচো বেচো বাঁখরখানি, বেচো না বেচো না বন্ধু তোমার চোখের মনি” - শুনতে শুনতে সেই রাতগভীরে সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার আমরা খেয়েছিলাম। দেশী মোরগ । সদ্যতোলা লাললাল আলুতে রেধেঁছিলেন ইমাদাদের মা। অনেক ঝাল হয়েছিলো। আমরা খাচ্ছিলাম। ইমদাদের বাবা আমাদেরকে বাতাস করছিলেন। কথা বলছিলেন সরল মনে। নিজের স্বপ্ন। কবি ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন । খুব স্বপ্নবিলাসী মানুষ। এলাকার ভবিয্যৎ । সংসদ ইলেকশান। সুলতান মনসুর- এম এস শাহীন কিছুই বাদ যায়নি। কিছু কিছু দৃশ্য যেমন কখনোই হারাবার নয়, আমার কাছে সেই দৃশ্যটা তেমনিই একটা দৃশ্য । এই দৃশ্যটা মাঝে মাঝেই আমাকে আনন্দ দেয়। নস্টালজিয়ায় ঘিরে ধরে। গভীর রাতে এক কবিরবাবা তার ছেলের বন্ধুদের পরম যত্নে খাওয়াচ্ছেন। কথা বলছেন। স্বপ্ন বলছেন।
প্রলয়ঙ্কারী শব্দটার সাথে পরিচয় আমার জন্মসূত্রে। সুনামগঞ্জের ভাটির মানুষ আমি। ঝড় আর পানির সাথে লড়াই দেখতে দেখতেই বড়ো হয়েছি। মনুর স্রোত আর ভাঙনের এমনরূপ আমি আগে কখনোই দ্যাখেনি। বাজার বরাবর একটা বাঁশের পুল। খুটিগুলোর সাথে স্রোতের বিদ্রোহী ঘর্ষণে পুলটা থরথর করে কাঁপছে। আমরা সাকোঁর উপর দাড়িয়ে মনুর কীর্তিকলাপ দেখছি। চোখের সামনে যুবতী ধানক্ষেতের বিশাল বিশাল খন্ডাংশ ধপাস ধপাস করে মনুতে পড়ে যেতে দেখছি। অসম্ভব স্রোত। একটা নৌকা উজানথেকে স্রোতের অনুকূলে নামছে। মাঝি শুধু হাল ধরে বসে আছে। এতেই দেখলাম সাই করে নৌকাটা আমাদের নীচ দিয়ে চলে গেলো।
আমার কোচিং এর পরিচালক বার বার ফোন করে যাচ্ছিলেন। গতকালের একটা ক্লাস মিস করেছি। আগামীকাল আবার আমকে দুইটা ক্লাস নিতে হবে। সেগুলো মিস করা ঠিক হবে না। সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে মনুর ভাঙনের দৃশ্য চোখে নিয়ে আমি সিলেটের উদ্দশ্যে বাসে উঠেছিলাম। ইমদাদ তখনো পুলের উপর দাঁড়িয়ে মনুর ধ্বংসলীলা দেখছিলো। (চলবে)

জহিরুল সিদ্দিকী (শামিম)
২রা ডিসেম্ভর ২০০৮
মনাশ ইউনির (মেলবোর্ন, ভিক্টোরিয়া) রসায়ন বিভাগে ইলেকট্টোকেমেস্ট্রিতে গবেষণারত।
(পরের পর্ব: শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় - বন্ধুত্বের দিনগুলো: পর্ব ৪)

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০০৮ ভোর ৪:৫৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×