somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবিতা বিষয়ে একটি মনোলগ - মুহম্মদ ইমদাদ

০৮ ই ডিসেম্বর, ২০০৮ বিকাল ৩:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(এইমাত্র আমার অতিপ্রিয় এক কবির একটা লেখা ইমেইলের মাধ্যমে পেলাম। কবি মুহম্মদ ইমদাদ। সম্ভবত তিনি প্রযুক্তিবান্ধব নন। আমাদের আরেক কবিবন্ধু পালশ দত্ত তেমনটিই বলেন। আমার জানামতে তিনি নিরবেই লিখতে পছন্দ করেন। জানিনা এই লেখাটি অন্য কোথাও ছাপা হয়েছে কিনা । তবুও আমার ব্লগের পাঠকদের সাথে লেখাটি শেয়ার করলাম।)

কবিতা বিষয়ে একটি মনোলগ
মুহম্মদ ইমদাদ

১. কবিতার আত্মপরিচয়
সৌন্দর্য সৃষ্টি করে পাঠককে আনন্দে অভিভূত বা শোকাভিভূত কারাই কবিতার কাজ? নাকি কোনো শ্বাশত সত্য উপলব্ধিতে পৌঁছে দেওয়া পাঠকের বোধ? জীবনের এমন কোনো অভিজ্ঞতাকে পাঠকের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া, যা প্রতিমুহূর্তের যাপনে যাপিত অথচ পাঠক সেইভাবে ভেবে উঠতে পারেননি কখনও? অভিজ্ঞতার অভিনবত্বে পাঠককে স্তম্ভিত, বাকরুদ্ধ করা আর জীবনের আরও একটি মুখরেখা উন্মোচন? এমন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করা এবং তার অভিঘাতে কি উপলব্ধি হয়, কি অভিব্যক্তি জন্ম নিতে পারে, তার একটা চমৎকার উপস্থাপন? যাতে পাঠক কবিকে ভাবতে পারেন কবি; মহৎ কবি?
কবিতা কি ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা? কবির কন্ঠস্বরকে একটি আলাদা মাত্রা প্রদানের বা নিজস্ব কাব্যভাষার জন্য প্র্যাকটিস? সেই প্র্যাকটিস জরুরি একজন কবির পক্ষে? পাঠকের চাই কবিতা, চিরকালের কবিতা? কবির গবেষণাগারে কবিতার কি রূপ-গন্ধ-বর্ণ সেটা পাঠকের না-জানাই থাক? কবিতা লিখতে না-পারার বা কবিতা দিয়ে পাঠকচিত্তকে আলোড়িত করতে না-পারার অসফলতা যদি পরীক্ষা নিরীক্ষার অজুহাত দিয়ে ঢেকে ফেলতে চান, তাহলে এটা কি এমন একধরনের জালিয়াতি হয়ে গেলো না, যা পাঠকের বন্ধুত্ব অস্বীকারের মতই দুঃখজনক?
পাঠকের কাছে চলে আসার পূর্বে কবিতাকে কবিতাই হতে হবে! অন্যতায় না-আসাই শ্রেয়! বাংলা কবিতার ঐতিহ্যধারায় আজকে যারা কাব্য করছেন, তারা কি বাংলা কবিতার শুধু ছন্দের/বাকভঙ্গির ইতিহাস মুখস্ত করেছেন? নাকি জেনেছেন কবিতার ভেতরের কথা বলবার বিষয়? সময়-সময় মানুষের জীবনাচরণে পরিবর্তন আসে, আসে দৈশিক এবং বৈশ্বিকভাবে; পরিবর্তন আসে কথা বলায়, শব্দে-ভাষায়? একজন কবিকে তার সময়ে বা সময়-অতীত কোনো ভাষার সন্ধান করতে হয়, করতে মানুষের, পাঠকের মুখে-বলা-ভাষার কাছাকাছি থাকবার জন্য, কিছুটা জীবন ঘনিষ্টতার প্রয়োজনে, কবিতাকে কোনো সীমায়, গন্তব্যে পৌঁছে দেবার মানসে? একজন কবিকে আপন সময়প্রবণতাকে ধরতে হয়, জানতে হয় এবং নিজস্ব বাকভঙ্গির ভেতর দিয়ে, পাঠকের হাতে তুলে দিতে হয় এক অচেনা অতীত এবং সঙ্গে-সঙ্গে একটি ভবিষ্যত-ইঙ্গিত? তা না-হলে কবিতার আপন ভূমিটি হারিয়ে যায়? কবিতা দাঁড়িয়ে পড়ে এমন একটি এলাকায়, যে-এলাকাটিকে আমরা মোটেও কবিতার ভূমি বলে ভাবতে পারি না? কবিতার আত্মপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, আমরা কবিতার পাঠক, কবিকে ভুলে যেতে থাকি, ভুলতে থাকি কবির শ্বাশত পরিচয়??

২. সমকালে গড়ে ওঠা মিথের কাছে সে পরাহত হতে ভালবাসে
কবিতা নিয়ে পরীক্ষাকারী কবিসম্প্রদায়, সমকালে কবিযশোপ্রার্থীদের কাছে কিছুটুকু আদৃত, সমাদৃত হতে পারেন; কবিতার পাঠক কবিতাকে মনে রাখে; পাঠ করে; ভুলে যায় কবিকে? হাতে নিয়ে কোনও দরকারি দ্রব্যের গন্ধ পায়না পরীক্ষা-কবিতায়? যদি নতুন ভাষা/আঙ্গিক দিতে না পারে নতুন কোনো দিন ও আয়ুদিগন্তের সবুজ রেখা? রবীন্দ্রনাথ এখনও কিভাবে টিকে আছেন বাংলা কবিতায়? মানুষ পড়ে তার সমকালকে? সমকালে গড়ে ওঠা মিথের কাছে সে পরাহত হতে ভালবাসে? রবীন্দ্রনাথের গড়ে তোলা মিথকে অতিক্রম করতে পেরেছি? পারিনি বলেই মানুষের সাধারণ মন সেখানেই খঁজে তার আত্মার সঠিক সংস্থান?
তিরিশের দশকের পরে বাংলা কবিতার যে-ঐতিহ্যসৃষ্টি আজকের নতুন কবিদের মাঝে এসে থমকে আছে, সে-ঐতিহ্য কি বিচ্ছন্ন দু একটি ঘটনা ছাড়া, পেরেছে কোনো নতুন কোনো কবিতা-ঐতিহ্য বা সমগ্র ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে? মানুষের জীবনের তিল পরিমাণ দরকারে যদি কবিতা লিখিত হয়, মানে মহৎ কবির রুচিমাফিক, তাহলে তাকে হতে হবে সমকলে মিথিক্যাল? জনতার, মানে কবিতার সামান্য পাঠক বিশ্বও চায় ধর্মের মতো কোনো শক্তির কাছে জীবনদিন ঢেলে দিতে, চায় বিনাশ সাধন করতে তার নিজস্ব বিশ্ব? কোথাও দেখিনি আমরা আমাদের আত্মার সঠিক বাস্তুসংস্থান?
দেখিছি কবি হবার, কবিতা লিখে অমরতার জন্য নির্লজ্জ আকুলতা; রাজার হস্ত করেকবির অহং? কবিদের বিখ্যাতির কাঙালপনা দেখে আমরা কি মনে-মনে বলি না কাঙালের ধন চুরি?

৩. তাই বলে কবিতা কল্পনালতা নয়
কবিতার ইতিহাসে, দশকে-শতকে, যেসব বাঁক পরিবর্তন ঘটেছে, তা ভাষায় বা বলার ভঙ্গির জন্য ততটা নয়, যতটা জীবনকে, পৃথিবীকে উপলব্ধির নতুন কোনো বোধে? সংস্কার ভেঙে শ্বাশত কবিতা দেখতে চেয়েছে মানবাস্থিত্বকে অন্যকোনো রূপে, ডাকতে চেয়েছে সাহসী কোনো নাম ধরে; শ্বাশত কবিতা বিষয় করে নিয়েছে চেনা পৃথিবীর বাইরে আরেক রঙিন পৃথিবীকে? তলে তলে সেরকম একটি জগতসৃষ্টির মানবীয় ক্ষমতাকে ইঙ্গিতই করছে! তাই বলে কবিতা কল্পনালতা? মানুষের ইমাজিনেশনশক্তির একটি যথার্থ সদ্ব্যবহার করতে চেয়েছে সেসব কবিতাবলী!? কবিতা হৃদয়ের ভালোবাসবার ধারনার অনুরূপ হৃদয়ের বিষাদাচ্ছন্ন হবার প্রবণতাকে আবিষ্কার করেছে; আবিষ্কার করেছে, মানুষের জীবনকাল ফিরে যাচ্ছে অতীতে; এমন এক অতীতমুখী সে যে-পিছনে কোনো বনভূমি থাকছে না, থাকছেনা কোনো ঈশ্বর! মানুষ বিনষ্ট করছে তার বাড়ি, পৃথিবী। এবং ছুটে যাচ্ছে কেবলই অন্ধকারের দিকে; সূর্যের আলোকে অস্বীকার করে রচয়িতা হতে যাচ্ছে আপনসৃষ্ট আলোর? কবিতা তখন নির্জনস্বরে কথা বলে আর জানাতে চায় সে-খবর: ঈশ্বর যেমন ঈশ্বর নন, তেমনি মানুষও ঈশ্বর নয় কারও; এমন কি তার নিজের জন্যও সে গ্রহণ করতে পারে না কোনো আচানক দায়িত্ব? সে কেবলই পাখির উড়ন্ত ডানায় একটি পালক?
কবিতা তাই বিষয় করে নিয়েছে রক্তের লালকে গোলাপের মহিমায়?
কবিতা কৌতুক করেছে মানুষের জীবনের দিকে চেয়ে; নির্জন রাতে ইনসম্নিয়ায় আক্রান্ত থেকে, বিষকে কন্ঠে তুলে নিয়ে পাচ্ছে অমৃতের আরাম; সিজফ্রেনিক মানুষের উপমা হয়ে বকে যাচ্ছে আবোল তাবোল? ধ্বংস¯ত’পের পাশে দাঁড়িয়ে কখনও সে গাইতে পারছে সুললিত সঙ্গীত; কর্কশ এবং কালো স্বরে কোনো সত্যের প্রতি সে প্রকাশ করেনি তার আস্থা; বরং একটি কোনো মিথ্যার জন্য রাত্রিপাত করেছে অবিরল? যেমন আমরা মানুষের মুখের দিকে চেয়ে নিজেকে একটু সুন্দর ভাবতে ভালোসাসি; ভালোবাসি মানুষের সুন্দর বিকেল-উদ্যাপন?

৪. কবিতা স্মৃতির অতল থেকে তুলে আনা অস্থিত্বের ঘ্রাণ

অন্য এক চেতনার আঘাতে-আঘাতে মানুষের অন্তঃকরণের রহস্যময়
জগতকে দেখতে চেয়েছে কবিতা? কবিতা দিনযাপন মনে রেখে রেখে শোকবিহ্বল হওয়া? কবিতা স্মৃতির অতল থেকে তুলে আনা অস্থিত্বের ঘ্রাণ, যা কিনা মধুর রজনীগন্ধার আত্মপ্রকাশ; যা কিনা পচে যাওয়া ক’টগন্ধের কাছে বর্তমান-আত্মার আশ্রয়?
সময়ের চাপে জীবনের গড়নে যে-পরিবর্তন, সেটার একটি সাহসী জার্নালিজম কবিতা? কবিতা করে দেখিয়েছে সে সাহস? মাটিতে দাঁড়িয়ে? জঙ্গলের নতুন পাতার ফাঁকে ফাঁকে নতুন রোদনকশার মতো অভিনব; সত্য? জীবনকে প্রভাবিত, বিচলিত এবং অনুপ্রাণিত করার মতো শক্তিমান উপায়ে, কৌশলে!
এলিয়ট যে-কারণে গুরুত্বপূর্ণ, রিলকে বা বোদলেয়ার সে-কারণে গুরুত্বপূর্ণ? তারা প্রত্যেকেই লিখেছেন কবিতা লেখেননি; জীবনের দেখেননি নতুন কোনো মুখ? অথবা অন্যকোনো রূপ, পাইয়ে দেননি অন্যকোনো ঘ্রাণ? এসব কবিদের সামনে আমরা থমকে গিয়েছি; বুকে হাত রেখে নিজেকে আরও একবার পৃথিবীর জীব বলে সন্দেহ করেছি; নিজের প্রতিভাকে পাখির প্রতিভার সঙ্গে মেলাতে চেয়েছি; মুখ থুবড়ে পড়ে থেকেছি নিজের মূখার্মি ও বি-জ্ঞানের কাছে?

৫. পাঠক একাত্ম হতে চান কবিতায়
পাঠক তো একাত্ম হতে চান কবিতায়? একাত্মবোধের আনন্দ পেতে চান; কবিতায় খুঁজে পেতে চান নিজেকে; কবিতাকে দেখতে চান নিজেকে উদ্যাপনের একটি সম্পূর্ন সঙ্গীত হিসাবে? কবিতায় একাত্মবোধ করা, নিজেকে খুঁজে পাওয়া, নিজেরই সত্তার একটি চলচ্ছবি দেখতে পাবার জন্য পাঠকে পাঠকই হতে হয়, যেভবে কবিকে শুধু কবিই হতে হয়?
নরনারীর ভালবাসায় মগ্ন অস্থিত্ব যেমন পৃথিবীকে দেখতে পায় তাদের নিজেদের স্বপ্নবিহ্বল চোখে, পরিচিত জগতসীমার কিছুই তাদের মনপূত হয় না; তারা দেখতে চান একে অন্যের প্রতি প্রকাশিত আপার্থিব অভিব্যক্তির মতন বিশ্বলোক; তেমনি কবিতও এক রকমের ভালোবাসা, যার সংস্পর্শে কেউ একজন চেনা দেশ ও কালের ওপর বিছিয়ে দিতে পারে অন্য আরেক দেশকাল, যার সংস্পর্শে দুঃখও হতে পারে আত্মউদ্যাপনের কোনো মহৎ সুন্দর? হৈ হৈ আনন্দের রাতে কবিতা বাজাতে পারে নির্জন হৃদয়ে বিষাদসঙ্গীত? পাঠককে টের পেতে হয় সে-কবিতার আত্মব্যথা এবং জগতের অন্তরে লুক্কায়িত আরও আরও চেতনার খুঁজে মগ্ন হতে হয়, নিজের আনন্দ-বেদনার মাঝে বিরাজিত স্তব্ধতায়?

৬. অনেক রণসঙ্গীত কবিরা লিখেছেন
কবিতা কি আনন্দকে দান করে কোনও মহিমময় উজ্জল? কেননা একজন সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্রে শত্র“পক্ষের সৈনিক হত্যা করে অবধারিতভাবে লাভ করে আনন্দ। অর্থাৎ মানুষের মৃত্যুর ওপর অন্য মানুষের হাসি; এবং সেক্ষেত্রে নিজের নিরাপত্তা ও বিজয়ের জন্যও মানুষ হাসে, সুখী হয়। একজন বিজেতার আনন্দকে কবিতা কেমন চোখে দেখে? পৃথিবীর অনেক রণসঙ্গীত কবিরা লিখেছেন! কবিরা কি স্বীকার করে নিয়েছেন রণ রলোরোল? হত্যা প্রক্রিয়া? হিংসাময় জগত? প্রকৃত কবিতা কোনো জাতীয় অহং থেকে, জাতিকে উজ্জিবীত করতে রচিত হওয়া উচিত? কবিতা বিশ্বমানবের জন্য শান্তিসংবিধান না? কবিতা কখনও স্বীকার করবে না কোনো জাতিত্ব; হিংসাক্ত আনন্দের জন্য কবিতা উদ্গার করবে ঘৃণা? সেই ঘৃণার ঘুঙুর বাজাবে মানুষের অন্তরে কবিতা; কবিতার সবুজ নারীত্বময় অবয়বে, কবিকন্ঠের চ্ছলচ্ছল নদীর মতন?

৭. নির্জনতার থেকে উদ্ভিন্ন যে-ফুলগাছ, কবি তারই জন্মদায়ক
একজনের আনন্দ-উপভোগ উদ্গার করতে পারে বহুর ঘৃণা, বহুজন নিজেদের জীবনদিন নিয়ে শঙ্কিত থাকতে পারেন, অন্য আরেকজনের আনন্দসম্ভোগ’র নিষ্ঠুরতা দেখে-দেখে। ধর্ষিত শিশু যেমন ভয়ে হার্ট এ্যাটাক করে; মরে যায় আর কেউ কোনো জন্তু লাভ করে যৌন-আনন্দ! কলঙ্কিত হয় মানুষের প্রতিভা; বিজ্ঞান ও আলোকপ্রাপ্তি। কবিতা সেই কলঙ্কের কালো বর্নণা করে আর আমাদের জাগিয়ে দিতে চায় সঠিক কোনো ভোরের আলোয়? শত্র“বাড়িতে আগুন দিয়ে শত্র“মানুষ গাইতে থাকে যদি গান সে-গানও কি লিখতে হবে কবিকে? দাউদাউ অগ্নিলালের কাছে কবি পুড়ে কালো কয়লা হয়ে যান! হয়ে যান নির্জন, নির্বাক! নির্জনতার থেকে উদ্ভিন্ন যে-ফুলগাছ, কবি তারই জন্মদায়ক?

৮. কবিতার পাঠক, একটি কসমিক প্রতিভা
মানুষের আত্মাকে খুশি ও তৃপ্ত করা; উদ্বেলিত করা; আবেগাচ্ছন্ন করা কবিতার কাজ? মানুষকে এমন এক তীরভূমে দাঁড় করিয়ে দেয়া যার দেখা সে পায়নি আগে? যাতে সে শ্বাস নিতে পারে অভিনব কোনো নদীর শরীর ধোওয়া বাতাসে আর শোধরে নিতে পারে একজীবন, একটি কোনো স্বপ্নের হাতছানিতে?
কিন্তু মানুষের জীবনে আনন্দ কী নেই একেবারে? সে কী উদ্বেলিত হচ্ছে না? অন্য কোনো মুহূর্তকে যাপন করে-করে? কবিতাই তো একমাত্র আনন্দের উৎস নয়? অন্য সকল আনন্দের উৎসগুলোকে আত্মা দিয়ে; সমগ্র মানুষ-সত্তা দিয়ে গ্রহণ করার জন্য কবিতা পাঠ করা, কবিতার নৈকট্যে কিছু জীবনক্ষণ অপব্যয় করা অনুচিত নয়? কবিতাকে প্যাশন করে নেয়ার জন্য অন্য এক রুচিবোধ দরকার? সেটা কি কসমিক প্রতিভা? এমন সে-প্রতিভা, যা মানুষের সকল প্রকার আয়ুক্ষয়ী শ্রমকে, জীবনকে যাপনের হাড়ভাঙা মগ্নতাকে, পৃথিবীর মাটিতে নিজের ক্লান্ত প্রতিভাকে রাখবার জন্য সবুজ বাড়ির স্বপ্ন ইত্যাদি হৃদয় দিয়ে মেনে নেয়ার মতো প্রতিভা? সম্রাটকে জানতে হবে ক্রিতদাসের জামার সত্য আভিজাত্য। জানতে হবে নিজের জীবনকে জানবার মতো করে? চারদিকে এত এত ব্যস্ত হবার মত বিষয় মানুষের হাতে, কবিতার সুন্দরে মগ্ন হবার মতো সময় মানুষ পাচ্ছে/আছে?

৯. কবিতা প্রকৃতিরই কোনো অদৃশ্য মেধার শিক্ষকতায় রচিত
জীবনের সৌন্দর্যগুলোকে ডিসকভার করা কবিতার কাজ? জীবনের কোনো মহিমাকে ইনভেন্ট করা? যাতে পুরাতন মানবজীবন জগতের আকাশপানে চেয়ে বোধ করে জীবের আনন্দ? সৃষ্টির আনন্দে আপ্লুত করা মানবহৃদয়? শূন্যতায় গড়ে তোলা কোনো অপূর্ব স্থাপনার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে পরাহত করা মানুষের কল্পনাকে? যাতে পৃথিবীর আকাশের তলে দাঁড়িয়ে মেঘের আনন্দভ্রমণ, প্রতিমুহূর্তের মেঘ-উৎসবযাপন দেখে মানুষ; যাতে মাটিতে মাখামাখি করে জানতে চেষ্টা করে উদ্ভিদের জন্য গোপন মাটিপ্রতিভা; জানতে পারে মাটিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম পয়েটিক জিনিয়াস?
মাটিকে বুঝতে পারার অন্য নামই পৃথিবীকে চিনতে পারা; নিজেকেও বুঝতে পারা? ‘আমি’-কে নিয়ে ভাবতে পারার অবকাশ যদি মানুষের থাকে, তবেই ‘আমি’ আবিষ্কার করা যেতে পারে বহু রূপে, গড়নে, অবয়বে? নিজেকে আবিষ্কারের আনন্দই শ্রেষ্ঠতম আনন্দ? নিজের ব্যবহৃত, ক্লান্ত জীবন হয়ে উঠতে পারে সজীব, অক্লান্ত; যদি নিজেকে নতুনভাবে চেনার প্রক্রিয়া চলমান থাকে প্রতিদিন, প্রতিরাতে! আর তার জন্য প্রয়োজন নিজেকে প্রকৃতির সহোদর বা অংশ হিসেবে ভাবতে পারা? এলোমেলো অথচ সুন্দর প্রকৃতির রহস্যময় বিস্তারকে অনুভব করতে পারার টেলেন্টহীন মানুষ কখনই জীবনের গোপন সুন্দরকে টের পাবে না; টের পাবে না নেহাৎ জীব হয়ে বেঁচে থাকার চেও বেশি কিছু রয়েছে মানুষের? যা কিনা মানুষেরই জীবনদিনকে এগিয়ে দিতে পারে/চায় আরও আরও দৃষ্টিনন্দন জীবনমুখ-রেখায়। কবিতা প্রকৃতিরই কোনো অদৃশ্য মেধার শিক্ষকতায়, তারই সন্তান/ছাত্রের হাতে লেখা একটি সৃষ্টিস্থাপনা/ সৃষ্টিসংরাগ? মানুষের সংস্পর্শে এসে সেই কবিতা উদ্বোধন করে দিতে চায় মানুষেরই আরও কোনো স্মৃতিসম্পদ; আরও কোনো প্রকার অনুরাগবোধ?

১০.পাঠককে তাহলে কবিতার জন্য একটু অন্যরকম
পাঠককে তাহলে কবিতার জন্য একটু অন্যরকম প্রস্তুত হতে হয়; অথবা রক্তেই থাকতে হয় কবিতার পাঠক হবার অনুপ্রাণনা! প্রকৃতির গভীর রহস্যের সঙ্গে থাকতে হয় মানুষ/পাঠকের পরিচিতি? পাখির উড়ে যাবার পেছনে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকাবার অবকাশ থাকা চাই পাঠকের? যে-লোক ফুলের গাছে পাখির দোল খাওয়া, মেঘে-আকাশের দৈনিক বিন্যাস নিয়ে ভাবিত হতে পারে না, ভাবিত হতে পারে না শিশুর ভুলভরা জীবনের সুন্দরে; সে-লোক কবিতার সুন্দরে আনন্দিত হওয়া কষ্টকর? বরং কবিতার প্রতি জন্ম নিতে পারে তার মূর্খ বিবমিষা?

অবশেষে: কবিতা তাহলে নিঃসঙ্গ মেয়েটির প্রেমিকও হতে পারে
আমাদের মনে হয়, মানুষজন্মের সেটিসফেকশনই হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে নিজেকে আবিষ্কারের করার আনন্দ; সে-আনন্দ মানুষ অবচেতনেই লাভ করে বেশি? ‘জীবনে কোনো আনন্দ নেই’ Ñকথাটির অর্থই হচ্ছে ক্ষণে-ক্ষণে নিজের জগতবাসকে আবিষ্কারের প্রতিভা মানুষ হারিয়ে ফেলেছে অথবা নেই সে-ক্ষমতা? কবিতা কী সে-আবিষ্কারের কোনও সহায়ক? ছেলেমেয়েরা প্রেমের সন্নিকটে এসে, নিজেকে প্রেমিক/প্রেমিকা ভেবে যে-আনন্দ পায়, সবকিছু সুন্দর মনে করে; সে-আনন্দ কারও প্রেমিকসত্তা আবিষ্কারেরই আনন্দ? একজন মোটেও তার জীবনকে একা একা আবিষ্কার করে নিতে পারে না? দরকার হয় আরেকজন মানুষের, অর্থাৎ একজনের মধ্যে অন্যের অস্থিত্ব অবলোকন! কবিতা, প্রেমিকের হাতে একজন অদৃশ্য প্রেমিকার চিঠি; প্রেমিকার হাতে একজন অদৃশ্য প্রেমিকের চিঠি? জগতের মিথ্যাসমাজ আর অপ্রতিভ বোধের আঘাতে যে-দূরত্ব মানুষের হৃদয়ের থেকে হৃদয়ে, কবিতা সেইখানে একটি কোনো আকাশ; সকলের মাথার উপর ভেসে বেড়ানো রঙিন পাখি; সকলেরই ফুসফুসে বাতাসের প্রয়োজনের মতন কবিতার সর্বগ্রাসী নিঃশব্দ উপনিবেশ এখানে? অত্যাচারী রাজার কাছেও কবিতা হতে পারে না দাসের থরোথরো লিপি; মানুষের ইতিহাসজলে ভাসিয়ে দেয়া একটি ভালোবাসার আবেদন কবিতা; ভবিষ্যতের মানুষের বেদনার কাছে একটি প্রেসক্রিপশন; একটি বীজ, একটি বৃক্ষের জন্য প্রার্থনা; একটি শব্দ, একটি গানের জন্য ব্যকুল আত্মা।?

১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×