বিয়েটা যদিও বছরখানেক আগেই হয়ে গেছে, আনুষ্ঠানিক গায়ে হলুদ আজ । প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, এমন সময় আমার কর্মস্থল থেকে একটা কল আসলো, তারিক ভাই কল দিয়েছে, ভাবলাম সে হয়তো আসতে পারবেনা তাই জানাতে কল দিয়েছে, কিন্তু সে যে কারনে কল দিয়েছে সেটা শূনে তো আমি অবাক, আমাকে সুইডিশ এম্বাসি খুজতেছে, আমার যে মোবাইল নাম্বার তাদের কাছে আছে, সেটাতে আমাকে পাওয়া যাচ্ছে না তাই অফিস এর নাম্বার এ কল দিয়েছে। কিভাবে পাবে, কাল রাত্রেই তো নাম্বার টা হারিয়ে গেছে। যাই হোক, হলুদের আনন্দে কোন মতে রাত্রিটা পাড় করে দিলাম, সকাল হতেই ছুটলাম সুইডিশ এম্বাসিতে, একটু ভয় কাজ করতেছিল, আল্লাহ্ জানেন, আমার গ্রীন কার্ড অ্যাপ্লিকেশান কি একসেপ্ট হল না রিজেকট হল । একটা কথা জানিয়ে রাখি, ডেনমার্ক গ্রীন কার্ড এর অ্যাপ্লিকেশান করতে হয় সুইডিশ এম্বাসীতে। এক বড় ভাই এর সহযোগিতায় অ্যাপ্লাই করেছিলাম, মাত্র ১৮০০০ টাকা অ্যাপ্লিকেশান ফি ছিল, আর কোন খরচ ছিলনা । ভেতরে ঢোকার পরেই আমাকে দেখে ভিসা অফিসার (বাংলাদেশী) একটা হাসি দিল। ৭ দিন আগে গিয়েছিলাম ঐ বেটার কাছে খোজ নিতে, বেটা আমাকে রীতিমত অপমান করে তারিয়ে দিয়েছিল। বেটা বলেছিল, ”Don’t waste your time as wel as our time”। যাই হোক, আমি আমার পাসপোর্ট দেখাতেই, সে আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলল congratulations, আপনার গ্রীন কার্ড হয়েছে, আপনি ভিসার আবেদন ফর্ম ফিলাপ করে, আপনার পাসপোর্ট জমা দিয়ে যান, এক সপ্তাহ পর এসে ভিসা নিএ যাবেন। আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে, আমার খুশি আর কে দেখে, আজ আমার বিয়ে, আজ আমার গ্রীন কার্ড হইছে, মুহূর্তেই মনে হল লাইফ টা চেঞ্জ হয়ে গেল। গত কয়েকটা মাস খুব খারাপ যাচ্ছিল, যে কাজ করতেছিলাম, সেটাতেই সমস্যা, অফিস এ সমস্যা হচ্ছিল, চাকরির পাশাপাশি একটা বিজনেস ছিল, সেখানে ও লস গুনতে হচ্ছিল । গ্রীন কার্ড পেয়ে মনে হল সব সমস্যার সমাধান আমার হাতের মুঠোতে চলে আসলো।
বিয়েটা শেষ হল, শ্বশুরকে জানালাম চলে যাব, কোন ভাবেই রাজি হচ্ছে না, কিন্তু আমি বুঝালাম, আমি যদি এখন যাই তাহলে আমার পি-এইচ-ডি করার যে ইচ্ছে আছে তা সহজেই পুরন করতে পারবো, আর তাছাড়া যেকোনো সময় আমার বউকে নিএ যেতে পারবো, একটা অ্যাপ্লিকেশন জমা দিলে ১ মাস এর মধ্যেই ভিসা হয়ে যাবে। আমি সেট হয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ে যাব। বউ এর সহযোগিতায় রাজি করাতে সমর্থ হলাম। আমার বাবা মা কোন আপত্তি করেনি।
সবাইকে রাজি করালাম কিন্তু ডেনমার্ক এ আমার পরিচিত কেউ নাই, সেখানে কোথায় উঠবো, কি করব এসব নিয়ে খোজাখুজি শুরু করলাম। কানাডা তে গ্রীন কার্ড অ্যাপ্লাই করেছি অনেকদিন আগে, এখনো কোন খবর নাই। যে কন্সালটিং ফার্ম এর মাধ্যমে অ্যাপ্লাই করেছি, তাদের কাছে গিয়েছিলাম জানাতে যে ডেনমার্ক চলে যাচ্ছি, যদি কোন খবর আসে, আমার সাথে ইমেইল এ যোগাযোগ করতে । তাদের কাছ থেকে ওমর ভাই নামের একজনের নাম্বার পেলাম, স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে ভাবি সহ ডেনমার্ক থাকেন, কানাডা তে অ্যাপ্লাই করেছেন গ্রীন কার্ড এর। ওমর ভাই এর সাথে যোগাযোগ করলাম, খুব ভালো মানুষ, আমার জন্য একটা বাসা ভাড়া করলেন, এক ফ্ল্যাট এ ২ রুম, প্রতি রুম এ ২ জন থাকতে হবে। আমি কনফার্ম করলাম, ফেব্রুয়ারী ০১, ২০১১ থেকে আমাকে ভাড়া দিতে হবে। ভাড়া ১৫০০ ক্রনার (১ ক্রনার = ১৩ টাকা), আমি ঐ বাসার এড্রেস ব্যাবহার করতে পারবনা, তাই অন্য জায়গাতে এড্রেস কিনতে হবে। সেটা আমি ডেনমার্ক গিয়ে কিনব ।
এই দিকে ফেসবুক এর সৌজন্যে আজিজ ভাই এর সাথে যোগাযোগ হল। তিনি ৬ মাস যাবৎ ডেনমার্ক আছেন, গ্রীন কার্ড নিয়ে গিয়েছেন দেশ থেকে, আমার মত। তার কাছে ডেনমার্ক সম্পর্কে শুনলাম, ভালো খারাপ, ২ দিকের কথাই সে বলল। এর আগেও যেহেতু স্টুডেন্ট হিসেবে বিদেশ থাকার অভিজ্ঞতা আছে, বিজনেস এর প্রয়োজনে অনেকবার দেশের বাহিরে যেতে হইছে, তাই খারাপ দিকগুলো সম্পর্কে আমি অবগত। বিশ্বাস আছে সেগুলো অতিক্রম করতে পারবো।
অফিস থেকে রিজাইন দিলাম, অফিসের সবাই পরামর্শ দিলেন কিছুদিনের ছুটি নিয়ে চলে যেতে, ডেনমার্ক এ যদি ভালো না লাগে তাহলে যেন অপশন খোলা থাকে, আমি এসে আবার জয়েন করতে পারি । আমার ইচ্ছে ছিলনা, কিন্তু সবাই খুব করে বলল, বস নিজে ও একি কথা বলাতে রিজাইন না দিয়ে ছুটির অ্যাপ্লাই করলাম। যথারীতি অফিস এর সব কাজ বুঝিয়ে দিলাম, জানুয়ারীর ১৫ তারিখ থেকে ছুটিতে চলে গেলাম, যদিও আমাকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত অফিস করতে হয়েছে।
টিকেট কাটলাম ফেব্রুয়ারীর ০৩ তারিখ । মাঝে ইন্ডিয়ার ভিসা লাগিয়ে নিলাম, ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে দিল্লী থেকে ফ্লাই করব, মাঝে মস্কো তে যাত্রা বিরতি দিতে হবে। এতে টাকা কিছুটা কম খরচ হবে। দেখতে দেখতে ০৩ ফেব্রুয়ারী চলে আসলো, দুপুরে ফ্লাইট কলকতার উদ্দ্যেেশ্য, কিংফিশার এয়ারলাইন্স এ । অবশেষে, আমার সোনার বাংলা ছেড়ে, আর কখনো ফিরে না আসার শপথ নিয়ে, বিদেশের মাটিতে নিজের বাকিটা জীবন কাটিয়ে দেবার আশায় যাত্রা শুরু করলম।
চলবে...............
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০২০ বিকাল ৩:২৬