উপরে খোলা আকাশ, শূন্য, মহা শন্য, নিচে মেঘের ভেলা, মাঝে আমরা কয়েকজন মানুষ একটা লোহার খাঁচায় বন্দি হয়ে উড়ে চলছি পৃথিবী থেকে ৩৫০০০ ফুট উপর দিয়ে । আমাদের এই উড়ে চলার কারিগর কয়েকজন পাইলট, সাথে রয়েছে অপূর্ব সুন্দরি কয়েকজন বিমান বালা, যারা আমাদের সেবায় সর্বক্ষণ নিয়োজিত। সবাই রাশিয়ান, রাশিয়ান মেয়েদের সৌন্দর্যের প্রশংসা না করলে অন্যায় হয়ে যাবে। এক মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় এক রাশিয়ান প্রতিযোগী তার সৌন্দর্যের জাদুতে প্রথম হতে না পারলেও ঐ প্রতিযোগিতার আয়জক কমিটির প্রধানের সুখের সংসারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল তার রুপের মায়াজালে, প্রেমের জাদুতে।
রাইট ভ্রাত্তিদয় যদি সেদিন স্বপ্ন না দেখত পাখির মত আকাশে উড়ার, আজ আমরা হয়ত সৃষ্টি কর্তার অসম্ভব সুন্দর এক সৃষ্টি দেখা থেকে বঞ্চিত হতাম। আকাশে থেকে আকাশ না দেখলে বুঝা যাবেনা আকাশের বিশালতা কত। শূন্যের মাঝে ও যে সৌন্দর্য থাকতে পারে এই ধারনাটাই আমার ছিল না। আকাশে থেকে পৃথিবীটাকে অনেক ছোট মনে হয়, সৃষ্টিকর্তা তো আরও অনেক উপরে, তার কাছে এই পৃথিবীটা কিছুইনা, আমাদের কাছে একটা সরিষা যেমন অতি ক্ষুদ্র, তার কাছে এই পৃথিবীটা মনে হয় তেমন। অবাক লাগে যখন ভাবি ছোট্ট এই পৃথিবীতে মানুষে মানুষে কত দ্বন্দ্ব, কত সংঘাত। সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে দখলের খেলা। তারা কি ভাবেনা ছোট্ট এই পৃথিবী ছেড়ে তাদের ও একদিন চলে যেতে হবে অজানা দেশে। আজ ফেব্রুয়ারীর ৪ তারিখ। দিনের হিসেবে ২ দিন হয়ে গেল বাড়ি থেকে বের হয়েছি। বউ এর কথা খুব মনে পড়ছে। ইস, আমাদের যদি পাখা থাকতো, আমরা যদি পাখির মত উড়তে পারতাম, যদি শূন্যের মাঝে বসতি গড়তে পারতাম, ২ জনে মিলে সুখের সংসার গড়তে পারতাম। এসব ভাবতে ভাবতেই দেখি অনেক দূরে একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে। এত উপরে পাখি আসলো কোথা থেকে, একটু পরেই পরিষ্কার হলো এটা পাখি না, আরেকটা বিমান যাচ্ছে। অদ্ভুত বেপার, এমনটা আগে কখন দেখিনি।
মস্কো এয়ারপোর্ট এ বিমান অবতরন করল, চারিদিক ধবধবে সাদা, বরফ পরেছে, দেখতে খুব সুন্দর লাগছে। যখন ইউক্রেন ছিলাম তখন অনেকবার মস্কো আসতে চেয়েছিলাম, আসা হয়নি। এইবার ও এয়ারপোর্ট এর বাহিরে যাওয়া হবেনা, দেরঘন্টা পরেই ফ্লাইট। সময় খুব কম, তাই তাড়াহুড়ো করতেছিলাম, কিন্তু বাঁধ হয়ে দাড়াল সিকুরিটি চেকিং। বেল্ট থেকে শুরু করে পায়ের জুতা পর্যন্ত খুলতে হয়েছে এখানে। একটা মেয়ে বার বার বলার চেষ্টা করছে তার নেক্সট ফ্লাইট কিছুক্ষণ পরেই, তাকে তাড়াতাড়ি ছাড়তে হবে, কিন্তু তারা কোন কথাই শুনতেছেনা। মেয়েটার হাতে একটা বড় ব্যাগ ছিল, সেটা খুলতেই হবে। কি আর করা, যেমন কথা তেমন কাজ। বাহিরে এসে দাড়াতেই দেখি মেয়েটা আমার পাশে এসে দাঁড়াল, গেট নাম্বার ৭৯ খুজতেছে। আমি খুজতেছি গেট নাম্বার ৭৮। এত বড় এয়ারপোর্ট, কোথায় যে কোন গেট, খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বিদেশিদের জন্য খুব বাজে অবস্থা, বেশিরভাগ সাইন রাশান ভাষায় লেখা, যেহেতু কিছুটা রাশান ভাষা জানি ইউক্রেন থাকার সুবাদ, আমার জন্য কাজটা সহজ হল।
মেয়েটাকে নিয়ে রিতিমত দৌড়াচ্ছি। অনেক বড় মস্কো এয়ারপোর্ট। মনে হয় ১০ টা ঢাকা এয়ারপোর্ট এর সমান হবে। ডিউটি ফ্রী শপের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, এরই ফাঁকে জেনে নিলাম মেয়েটা ইন্ডিয়ান, ইউক্রেন যাচ্ছে মেডিকেলে পড়তে। অনেক ইন্ডিয়ান আছে যারা দেশে সুযোগ পায়না, তাদের অনেকেই ইউক্রেনে মেডিকেলে পড়ে। যাই হোক, সময় মত মেয়েটাকে ৭৯ নাম্বার গেইটে পৌঁছে দিলাম। বিদায় নিলাম, জীবনে প্রথম এবং শেষ বারের মত। সিনেমা হলে হয়ত এই মেয়েটার সাথেই কোননা কোন ভাবে আবার দেখা হত, হয়ত আমি ইউক্রেন গেছি অথবা সে ডেনমার্ক এসেছে, নয়ত ফেসবুক এ দেখা, আবার এই এয়ারপোর্টে ও দেখা হয়ে যেতে পারত। কিন্তু বাস্তব জীবন তো আর সিনেমা না!
এবার ৭৮ নাম্বার গেইট এ গিয়ে বোর্ডিং পাস জমা দিলাম, আমাকে আমার পাসপোর্ট বের করতে বলল, পাসপোর্ট বের করে দিলাম, পাসপোর্ট দেখে তার সন্দেহ হল ভিসা জাল কিনা, মোবাইল দিয়ে ছবি তুলে কোথায় যেন পাঠিয়ে দিল, একটু পড়ে টেলিফোনে কথা বলে সিওর হয়ে আমাকে ছেড়ে দিল। টেকনোলজি আমাদের কোথায় নিয়ে গেছে। কত সহজ হয়ে গেছে আমাদের জীবন। তা না হলে আমাকে আরও ৩০ মিনিট অপেক্ষা করতে হত। অবশেষে স্বপ্নের দেশ ডেনমার্ক এর উদ্দেশে উড়াল দিলাম।
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৩৯