সাগরের পানি ছুঁই ছুঁই করছে বিমানটা, এক্ষুনি মনে হয় সাগরে ডুবে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখি একটা ব্রিজ, ব্রিজটা আমার অনেক পরিচিত। যতবার নেট-এ কোপেনহাগেন খুঁজেছি ততবার এই ব্রিজটাকে দেখেছি । এটা কোপেনহেগেন এর সাথে সুইডেন এর মালমো শহরের সংযোগ ব্রিজ। কয়েক সেকেন্ড এর মধ্যে কোপেনহেগেন বিমানবন্দর অবতরন করলাম। ডেনমার্ক সময় দুপুর ২ টা। কোন ঝামেলা ছাড়াই ইমিগ্রেশন পাড় হলাম।
বাহিরে ওমর ভাই অপেক্ষা করতেছে । দেখা হল ওমর ভাই এর সাথে। ফোনে কথা বলে ওমর ভাই কে যতটা ভাল মানুষ মনে হয়েছে বাস্তবে তার চেয়ে ও অনেক ভাল মানুষ সে। আমার নিষেধ সত্ত্বেও আমার একটা লাগেজ নিজের কাছে নিয়ে নিল। খুব লজ্জা হচ্ছিল যে তার মাংস, শুটকি আমি ফেলে এসেছি। সে আমাকে বলল এটা নিয়ে লজ্জা না পেতে, ভ্রমনে এমনটা হতেই পারে।
এয়ারপোর্ট থেকে মেইন শহর কয়েক কিলোমিটার দূরে। তার কাছে টিকেট ছিল আমার জন্য। মেট্রোতে চড়ে আমার রওয়ানা দিলাম। ক্রিসচিনা হেভেন নামক স্থানে এসে আমরা মেট্রো থেকে নেমে পড়লাম। শহরের ভেতর চলে এসেছি। মেট্রো থেকে বের হয়ে দেখি খুব ঠাণ্ডা আবহাওয়া । ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা। খুব একটা সমস্যা হচ্ছেনা। এর চেয়ে অনেক কম তাপমাত্রায় থাকার অভ্যাস আছে। মনে পড়ে ইউক্রেনে একবার -১৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা পেয়েছিলাম। হোস্টেল থেকে বের হয়েছিলাম বাজার করার জন্য। বাতাস এসে চোখে লাগার সাথে সাথে চোখ থেকে পানি বের হতে লাগলো, সেই পানি মুখের কাছে আসার আগেই বরফ হয়ে গিয়েছিল।
৬৬ নাম্বার বাসে চড়ে রওয়ানা দিলাম বাসার দিকে। অসম্ভব পরিপাটি, খুব চমৎকার একটা শহর। প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গেলাম। কিন্তু একটা জিনিস আমাকে অবাক করল। কোথাও কোন মানুষ দেখতেছিনা। অনেক্ষন পর পর ২/৩ টা মানুষ দেখা যাচ্ছে। ভাবলাম শহরের আরেকটু ভেতরে গেলে হয়তো দেখা যাবে। কিছুক্ষন পর ওমর ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম সেন্ট্রাল কোথায়। ওমর ভাই বলল একটু পেছনে কয়েকটা মানুষকে বাস এর জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে একটা বড় বিল্ডিং এর বাহিরে, ওইটা কোপেনহেগেন সেন্ট্রাল স্টেশন। ঐটাই কোপেনহেগেন সেন্ট্রাল।
অবাক লাগলো। কোথায় আসলাম রে বাবা, এটা দেখি মৃত শহর। একটা শহরে সেন্ট্রাল যদি এমন হয়, বাকি শহরে তো আরও লোকজন খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
৫২ stefensgade, ৪র্থ তলায় আমার বাসা ঠিক করেছেন ওমর ভাই। সাথে আরও ২ জন থাকবেন। একজন দেবু ভাই, আরেকজন আসিফ ভাই। আসিফ ভাই আবার ইউক্রেন লেখাপড়া করেছেন। ইউক্রেন এর একসময়ের রাজধানী শহর ছিল খারকভ । সেখানে লেখা পড়া করতেন তিনি। আমি পরতাম ইউক্রেন এর দানেস্ক শহরে। দুই শহরের দূরত্ব প্রায় ৭০০ কিমি। আমি একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম সেখানে। ভার্সিটি থেকে পারমিশন নিয়ে যাই নাই, পাসপোর্ট ভার্সিটিতে জমা ছিল। তাই অবৈধ ভেবে পুলিশ আটক ও করেছিল। পরে ভার্সিটির সহায়তায় ছাড়া পেয়েছিলাম।
তারা কেউ এখন বাসায় নাই, কাজে গেছে, রাত্রে আসবে। ওমর ভাই এর কাছে চাবি ছিল। সেটা দিয়েই ভেতরে ঢুকলাম। ২ রুমের বাসা, এক রুমে দেবু ভাই একা থাকবে, আরেক রুমে একটা খাট আছে সেখানে আসিফ ভাই ঘুমাবে আর আমাকে ফ্লোরে বিছানা করে থাকতে হবে। ভাবতে খুব কষ্ট লাগতেছিল, দেশে কত আরামে থাকতাম, ইউক্রেনে যখন থাকতাম তখনও একটা খাট আমার জন্য ছিল, কিন্তু জীবনে এই প্রথম ফ্লোরে ঘুমাতে হবে। কিছুই করার নাই, এটার নামই বিদেশ, এটা মেনে নিতেই হবে। কয়েকদিন পর যখন ভাল একটা কাজ পেয়ে যাব তখন একটা খাট কিনে নিব, এই ভেবে নিজেকে সান্তনা দিলাম। ৪৮ ঘণ্টা ঘুমাই নাই। খুব টায়ার্ড লাগতেছে। ওমর ভাই চলে যাবে, বিকেলে কাজে যেতে হবে, তাই আমাকে বলল তার সাথে যেতে, ডলার চেঞ্জ করতে আর একটা মোবাইল সিম কিনতে। আমি তার সাথে হেটে হেটে চলে গেলাম norrebro নামক স্থানে, বেশ খানিকটা পথ।
ইচ্ছে করেই পায়ে হেটে নিয়ে এসেছেন ওমর ভাই, যেন আমি পরবর্তীতে একাই আসতে পারি। এই norebbro হল ঢাকা শহরের ফার্মগেট এর মত, এখান থেকে সব জায়গায় যাওয়া যায়। আরেকটা জায়গা আছে norreport (পড়ে জেনেছি), এটা হল গুলিস্থান এর মত, কোপেনহেগেন এর প্রান। norrebro-norreport এর দূরত্ব ও ফার্মগেট- গুলিস্থান এর সমানই হবে। ৫০ ডলার চেঞ্জ করলাম (১ ডলার = ৫.৪০ ডেনিশ ক্রনার)।
মোবাইল সিম কিনলাম একটা, দেশে কল দিলাম। মনে হল অনেক বছর পর কথা বললাম, সবার কণ্ঠ ভেজা, বুজতে সমস্যা হল না যে সবাই খুব কান্না কাটি করেছে। বাসায় চলে আসলাম। এত টায়ার্ড লাগতেছিল যে খাবার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বাসায় এসে দেবু ভাই এর রুমের ফ্লোরে বিছানা করে ঘুমিয়ে পরলাম
চলবে...