somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ শয়তানবিদ্যা

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বৃষ্টির রাতে ভরপেট বিরিয়ানি খাওয়ার পর বেশ ঘুম ঘুম ভাব চলে এসেছিল জিব্রানের‚ ইচ্ছে হচ্ছিল শিয়রের কাছের জানালাটা খুলে বৃষ্টির ছাঁট গায়ে মাখতে মাখতে ঘুমিয়ে পড়ে‚ কিন্তু বন্ধু পূরব এবং তার স্ত্রী মেহজাবিন বাঁধ সাধল।
মেহজাবিন ভালো বিরিয়ানি রাঁধে। সিলেটে যখনই আসে‚ তখনই ওদের বাসা থেকে ঘুরে যায় জিব্রান‚ বলা চলে অনেকটা বিরিয়ানির লোভেই। তাছাড়া চা বাগানের পাশে ওদের সুন্দর দোতলা বাড়িটাও জিব্রানের খুব পছন্দ। তাই এবার একটা বিশেষ কাজে সিলেটে আসতেই এই বাড়িটাতে ঢুঁ মারার লোভ সামলাতে পারেনি। তারপর রাতে ভরপেট খাওয়া দাওয়ার পর যেই না একটু গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পায়তারা করছে‚ অমনি স্বামী-স্ত্রী ওকে চেপে ধরল। মেহজবিন বলল-
"জিব্রান ভাই‚ অনেকদিন আপনার কোন কেসের গল্প শুনি না। এবার শুনব। কোন একটা রোমহর্ষক কেসের গল্প বলেন প্লীজ!"
জিব্রান পেশায় সাইকিয়াট্রিস্ট‚ তার জীবনে বেশ কিছু অদ্ভুত এবং গা ছমছম করা‚ গায়ে কাঁটা দেয়া কেস পেয়েছে সে। যখনই ওদের বাসায় আসে‚ তেমন কোন কেসের গল্প বলে।
"না মেহজাবিন‚ আজ নয়। ঘুম পাচ্ছে খুব।"
"আরে‚ এত কষ্ট করে আপনাকে বিরিয়ানি রেঁধে খাওয়ালাম‚ এখন একটা গল্প শোনাতে পারবেন না?"
"গল্প শোনার লোভে বিরিয়ানি খাইয়েছ বুঝি?"
"হ্যা। আপনি যেমন বিরিয়ানির লোভে আমাদের বাড়িতে আসেন‚ আমি তেমনি গল্প শোনার লোভে বিরিয়ানি রাঁধি।"
"আচ্ছা। দাড়াও‚ মনে করি কোন গল্পটা বলব।"
পূরব পাশ থেকে বলে উঠল-
"ভূতের গল্প বল জিব্রান। বৃষ্টির রাতে ভূতের গল্প ভালো জমবে।"
"ভূতের গল্প? ভূতের গল্প তো জানি না।"
"একটাও না!"
"নাহ।"
"আধিভৌতিক কিছু?"
জিব্রান একটু ভাবল। তারপর বলল-"ভৌতিক কোন কিছু আমি বিশ্বাস করি না। ভৌতিক কোন বিষয় ঘটতে দেখিনি জীবনে। তবে একবার একটা কেস পেয়েছিলাম‚ ঠিক কেসও বলা যায় না‚ আনপ্রফেশনাল হেল্প আরকি! তবে খুব অদ্ভুত কিছু ঘটনা সামনে এসেছিল।"
পূরব এবং তার স্ত্রী দু'জনেরই চোখ চকচক করে উঠল আগ্রহে। বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার যুগেও মানুষের ভূত-প্রেত-পিশাচ নিয়ে আগ্রহ এতটুকু কমেনি। কেন কমেনি সেটা গবেষণার বিষয়।
পূরব বলল- "বল‚ বল!! সেটাই বল।"
জিব্রান লম্বা দম নিল। বলতে লাগল ঘটনাটা।
“চাকরী জীবনে ঢোকার পর আমার ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেল। গ্রামের বাড়িতে তেমন যাওয়া হয় না‚ গেলেও বছর-দু'বছরে একবার মাত্র।
তখন আমি ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির উপর ইংরেজিতে দু'টো বই লিখেছিলাম। বই দু'টো বেশ সমাদৃত হয়েছিল দেশে-বিদেশে। মোটামুটি নামডাক হয়েছে‚ পসার বেড়েছে। তখনকার কথা।
সেবার শীতকালে বাড়িতে গিয়েছি। আমাদের বাড়ি বরিশালের খুবই প্রত্যন্ত অঞ্চলে। জায়গার নাম চাঁদপাশা। খাল পেরিয়ে যেতে হয়‚ সেখানকার অনেক গ্রামে ইলেকট্রিসিটি আসেনি এখনও।
বাবা মা এবং পরিবার পরিজনকে এতদিন পর কাছে পেয়ে বেশ আনন্দ হচ্ছিল আমার। শহরের ধোঁয়াটে বাতাস থেকে মুক্তি পেয়ে মন-প্রাণ ঝরঝরে লাগছিল খুব।
গ্রামে আসার পরদিনই পাশের বাড়ির মনসুর চাচা বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে ডেকে নিলেন আমাকে। দেশি মুরগি ভুনা করে জম্পেশ আয়োজন করে বসলেন।
বাড়িতে চাচার দুই মেয়ে‚ এক ছেলে এবং চাচী থাকে। মেয়ে দু'টোর বয়স একজনের ১৮ আরেকজনের ২০‚ ছোট ছেলের বয়স ১৬; বড় মেয়েটার বিয়ে হবো হবো করছে‚ পরের বার যখন আসব তখন হয়তো চাচার নাতিপুতিও দেখতে পাব।
যাই হোক‚ খাওয়া দাওয়া শেষে চাচা আমায় নিয়ে উঠোনে দু'টো চেয়ার পেতে বসলেন। ভাব সাব দেখে মনে হলো কিছু বলতে চান তিনি।
আমার ধারণা সত্য হল। চাচা একটা পান চিবাতে চিবাতে বললেন-
"শুনছি তুমি নাকি পাগলের ডাক্তার হইছ? রোগী টোগী দেখ?"
"জী চাচা ঠিক শুনেছেন। সাইকিয়াট্রিস্ট হয়েছি। কনসাল্টিং করি।"
"সেইটা কি জিনিস?"
"মনের রোগ ভালো করার একটা উপায়!"
"আচ্ছা! ভালো! তোমারে একটা কথা কইতে চাইছিলাম।"
"বলুন চাচা।"
"সমস্যাটা হইল মোর ছোড পোলারে লইয়া।"
"আপনার ছোট ছেলের কি হয়েছে?"
"সেইদিন কি দেইখ্যা জানি ডরাইছে!"
"কি দেখে ভয় পেয়েছে?"
"ওর মুখ হইতেই শোন।" বলেই তিনি হাঁক ছাড়লেন- "ছালাম‚ বাইরে আয় তো!"
ছালাম নামের কিশোরটি বাইরে বেরিয়ে এল। হার জিরজিরে শরীর তার‚ দেখে মনে হচ্ছে অপুষ্টিতে ভুগছে। গায়ে সবুজ রঙের একটা পুরনো জরাজীর্ণ পাঞ্জাবি‚ নোংরা লুঙ্গী। গালে অল্প দাড়ি-গোঁফ গজিয়েছে। সে সসংকোচে আমাদের সামনে দাড়াল। চাচা বললেন-
"ওর নাম ছালাম। পাশের গ্রামে আমার দোয়ান চালায়। হেইদিন রাইতে কি দেইখ্যা জানি ডরাইছিল। ডরাইছে ঠিকই‚ কিন্তু কি দেইখ্যা ডরাইছে হ্যা কয় না। ওই ছালাইম্যা‚ তোর ভাইজানরে ঘটনা খুইল্যা ক'‚ উনি ডাক্তার।"
কিশোর ছেলেটা যেন লজ্জা পেয়ে আরো গুটিয়ে গেল। তার মধ্যে অস্বস্তি‚ বিব্রতবোধ এবং দ্বিধা দেখতে পেয়ে চাচাকে বললাম-
"চাচা‚ আপনি ঘরে যান‚ আমার মনে হয় ছালাম আপনার সামনে কথা বলতে চাচ্ছে না।"
আমার ধারণাই ঠিক‚ চাচা চলে যেতেই ছালাম নামের ছেলেটার মুখে একটু কথা ফুটল। সে লাজুক লাজুক গলায় তার ভয় পাওয়ার ঘটনাটি বলতে লাগল আমাকে। গুছিয়ে কথা বলতে পারে না সে‚ উচ্চারণ আড়ষ্ট‚ গলায় বরিশালের তীব্র আঞ্চলিক টান‚ তারপরও আমি তার কথাগুলো বুঝতে পারলাম। শুদ্ধ বাংলায় তার কথাগুলো অনুবাদ করলে অনেকটা এমন হয়-
"জিব্রান ভাই‚ আমি ভয় পেয়েছিলাম পরশুদিন রাতে। আমি পাশের গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করি। স্কুল শেষে হিসেব-নিকেশের কাজ করি একটা মুদির দোকানে। দোকানে কাজ শেষ হবার পর আমি মসজিদে আছরের নামাজ পরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করি‚ কখনো কখনো গ্রামের ছেলেদের সাথে আড্ডা দিই । তারপর মাগরিবের নামাজ পড়ে ঘরে ফিরি।
সেদিনও ফিরছিলাম। সন্ধ্যার পর খালপার ঘেঁষে রাস্তাটা একদম নির্জন হয়ে যায়। একপাশে খাল‚ আরেকপাশে ধানক্ষেত‚ রাস্তার দু' ধারে উঁচু উঁচু গাছ। জনবসতি তেমন নেই বললেই চলে। কয়েকটা চায়ের দোকান আছে খালপারে। মাগরিবের আযানের পর বন্ধ হয়ে যায় সেগুলোও।
শীতের সন্ধ্যা। সেদিন জোছনা ছিল। জোছনার আলোতেও পথঘাট তেমন পরিষ্কার নয়। ঘন কুয়াশায় তিন চার হাতের বেশি দৃষ্টি চলে না। আমি প্রতিদিনই এ রাস্তা ধরে হাঁটি‚ তাই ভয় পাচ্ছিলাম না মোটেও।
পনের-বিশ মিনিটের মতো সময় হেঁটেছি‚ তখন হঠাৎ শুনি‚ আমার আশে পাশে কে যেন জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে‚ ঘন‚ দ্রুত এবং গভীর নিঃশ্বাস। আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে পেলাম না কাউকেই। একটু ভয় ভয় করতে লাগল। পাত্তা না দিয়ে হেঁটে যেতে লাগলাম। তিন কদম সামনে এগোতেই শরীর হিম হয়ে গেল।
একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে পথ আগলে। প্রচন্ড সুন্দরী‚ ভরাট শরীর। মেয়েটার শরীর থেকে উজ্জ্বল দ্যুতি ঠিকরে বেরোচ্ছে। পুরো শরীরে একটা সুতোও নেই তার‚ পুরোপুরি নগ্ন। ঘন এবং দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলছে মেয়েটা। নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঢেউ তুলছে শরীরে।
প্রথমে আমি ভয় পেলাম। তারপর বোঝার চেষ্টা করলাম মেয়েটা কে এবং এখানে‚ এই অবস্থায় কি করে এসেছে। ভাবলাম‚ কোন পাগল টাগল না তো! হয়তো গ্রামের কোন বাড়ির মেয়ে‚ মাথায় সমস্যা আছে‚ তাই রাত বিরেতে নগ্ন হয়ে চলে এসেছে বাইরে।
আমি ভয়ে ভয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম-
"আপনি কে? বাড়ি কোথায় আপনার?"
মেয়েটা কেমন যেন অস্থির চোখে তাকাল আমার দিকে তাকাল। তারপর বিরক্ত গলায় বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় বলল-
"কথা কইস না‚ তুই এইহান দা ভাগ। বিরক্ত করিস না মোরে। এহন মোর নাগর আইব। নাগরের লগে পিরিত করমু।"
"কে আসবে?"
"কানে হুনছে না? মোর নাগর‚ মোর ভাতার।"
বরিশালে ভাতার মানে স্বামী। মেয়েটার স্বামী আসবে? আসলেই ভালো। পাগল বউকে ঘরে ফিরিয়ে নেবে। তখন হঠাৎ মনে হলো‚ গ্রামের প্রায় সবাইকে তো আমি চিনি। মেয়েটার স্বামীকেও চিনব হয়তো। জিজ্ঞেস করলাম-
"আপনার স্বামীর নাম কি?"
মেয়েটা রাগী চোখে তাকিয়ে বলল-
"তুই এহনো খাড়াইয়া আছস? যা ভাগ। মোর নাগর আইলে তোরে মাটির তলে পুইত্যা থুইবে।"
"কি নাম আপনার স্বামীর?"
"বেলায়েত। বেলায়েত‚ নাম হুনছস?"
"বেলায়েত? না তো। কোথায় থাকেন তিনি?"
"জাহান্নামে থাকে। যা ভাগ!"
এমন সময় হঠাৎ ঘোড়ার খুঁড়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। কোন একটা ঘোড়া তীব্র গতিতে ছুটে আসছে। এবার আমি সত্যিকারের ভয় পেলাম। বুঝলাম‚ ঘটনা স্বাভাবিক নয়‚ অতিপ্রাকৃত কোন ঘটনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমি।
কাছাকাছি আসতে ঘোড়া আর ঘোড়সওয়ারকে দেখতে পেলাম। ঘোড়াটার গায়ের রং ধূসর‚ কেমন যেন ঝাপসা। মনে হচ্ছিল ঘোড়া ভেদ করে কুয়াশা দেখা যাচ্ছে।
এরপর যা ঘটল‚ তাতে আমার জ্ঞান হারানো খুব স্বাভাবিক ছিল। কি করে অতক্ষণ টিকেছিলাম জানি না। তবে‚ জ্ঞান হারানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ভয়ংকর কিছু দৃশ্য দেখলাম আমি।
ঘোড়াটা কাছে আসতে অশ্বারোহী লোকটাকে দেখতে পেলাম ভালো করে‚ এই পৃথিবীর কোন সৃষ্টি নয় সে‚ অন্য কোন জগতের‚ অন্য কোন পৃথিবীর প্রাণী।
তার শরীরটা মানুষের‚ পা দু'টো ইঁদুরের মতো। শরীরের পেছন থেকে সাপের মতো দেখতে একটা লম্বা লেজ বেড়িয়ে এসেছে। ঘাড়ের উপর মাথাটা ঠিক যেন বিড়ালের মাথা; রোমশ মুখমণ্ডল‚ লম্বা কান‚ কিন্তু ঠোঁটটা গরুর ঠোঁটের মতো সুচালো এবং পুরু।
সে আসতেই নগ্ন মেয়েটা "বেলায়েত! বেলায়েত!!" বলে চেঁচাতে লাগল। জবাবে গোঙাতে গোঙাতে মোটা-জান্তব কন্ঠে কি যেন বলল প্রাণীটা। অনেকটা গরুর হাম্বা ডাকের কাছাকাছি শব্দ‚ "উম্বু! ঊম্বব্বু!!" এমন।
ঘোড়া থেকে নেমেই মেয়েটার উপর ঝাপ দিল সে‚ মেয়েটাকে নিয়ে মাটির উপর শুয়ে পড়ল। শুয়ে পড়ার ভঙ্গীটাও অদ্ভুত‚ কেমন যেন কাত হয়ে‚ পা গুলো বিদঘুটে ভাবে ছড়িয়ে শোয়া।
মেয়েটাকে চুমু খেল সে ভয়ংকর প্রাণীটি। গরুর মতো ঠোঁট-জিভ দিয়ে ভয়ংকর ভাবে চুমু খেতে লাগল। মেয়েটা হাসতে লাগল খিলখিল করে। প্রচন্ড বিদঘুটে‚ পঁচা একটা গন্ধ আমার নাকে এসে ঝাপটা মারল। হয়তো প্রাণীটার মুখ থেকে আসছিল সে গন্ধ। অপার্থিব দুর্গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে‚ নাড়ি ভুঁড়ি বের হয়ে আসার যোগার। এরপর মেয়েটার গলার বামদিকটা কামড়ে ধরে ধরল বেলায়েত নামের প্রাণীটি। জান্তব আওয়াজ করতে করতে প্রচন্ড কামড় বসাল। ফিনকি দিয়ে বের হতে লাগল রক্ত। কিন্তু মেয়েটার মুখে কষ্ট পাওয়ার কোন চিহ্ন নেই‚ বরং খিলখিল হাসি আর আর গভীর পরিতৃপ্তির ছাপ তার চেহারায়।
ঠিক তখন সেই ভয়ালদর্শন প্রাণীটি জ্বলজ্বলে চোখ মেলে তাকাল আমার দিকে। প্রচন্ড আতঙ্কে জ্ঞান হারালাম আমি।
জ্ঞান যখন ফিরল‚ তখন গভীর রাত। আমি তখনও সেই খালপারেই পরে আছি। জ্ঞান ফিরতেই বাড়ি চলে এলাম দৌড়ে। রাস্তা কম ছিল না‚ কিন্তু পুরো রাস্তায় একবারও থামিনি আমি। বাড়ির উঠোনে এসে প্রচন্ড চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হলাম ফের।"
এ পর্যন্ত বলে হাঁপাতে লাগল ছালাম। একই সাথে ভয় এবং লজ্জা দেখতে পেলাম তার চেহারায়।
ছালামের সাথে কথা বলার পর আমি সারারাত ধরে ভাবলাম। বেশ কিছু হাইপোথিসিস মাথায় আসল‚ কোনটাই তেমন শক্ত কিংবা যুক্তিযুক্ত মনে হলো না। তবে একটা বিষয় পরিস্কার‚ ছালামের হ্যালুসিনেশন হয়েছিল‚ পুরো ব্যাপারটাই ছিল তার ভ্রম। কারণ‚ ঘটনার পরদিন সে খালপারে গিয়েছিল‚ সেখানকার মাটিতে কোন ঘোড়ার খুড়ের দাগ পায়নি সে। রাতে সেই মেয়েটার গলা হতে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে দেখেছে‚ কিন্তু পরদিন সেখানে গিয়ে কোন ধরনের রক্তের দাগ-ছোপ পায়নি। এ থেকেই প্রমাণ হয়‚ সে যা দেখেছিল তা ছিল তার বিভ্রান্তি! কিন্তু এমন অদ্ভুত বিভ্রান্তিই বা হবে কেন তার!
আমি সারারাত ভেবে অনেকগুলো সম্ভাবনা যাচাই বাছাই করার পর একটা একটা মোটামুটি স্ট্রং হাইপোথিসিস দাড় করালাম। সেটা অনেকটা এমন-
মানুষ যখন একা কোথাও থাকে‚ হতে পারে খালি বাসায়‚ হতে পারে নির্জন কোন জায়গায়‚ তখন সে কি করে? খুব কমন একটা কাজ হলো ভয় পাওয়া। একা থাকলে অনেকেরই নানা রকম ভয় কাজ করে। ভূত-প্রেত প্রভৃতি বিষয় নিয়ে হ্যালুসিনেশন হওয়ার আদর্শ সময় ওটা।
কিন্তু সাইকোলজিতে কোন মানসিক অবস্থাকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তাই এটাও উপেক্ষা করা যায় না যে‚ একা থাকা মানুষের‚ বিশেষ করে উঠতি বয়সী কিশোর-তরুণদের একটা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলো‚ নারী সংক্রান্ত চিন্তা করা।
ছালাম দীর্ঘদিন ধরে একা একা ঐ নির্জন রাস্তা ধরে বাড়ি ফিরত। তার বয়স মাত্র পনের-ষোল বছর‚ এ বয়সী একটা ছেলের মধ্যে অনুভূতির তীব্রতা থাকার কথা। কাজেই একা নির্জন রাস্তা ধরে ঘরে ফেরার সময়টুকুতে তার মাথায় নারী-চিন্তা আসাটা মোটেও অস্বাভাবিক নয় এবং অস্বাভাবিক নয় ভৌতিক বা অতিপ্রাকৃত বিষয় নিয়ে চিন্তা করাটাও। দু'য়ে দু'য়ে যোগ করলে যেটা দাড়ায়‚ তা হলো- পুরো ঘটনাটা ছিল তার ফিমেইল ফ্যান্টাসি এবং হরর ফ্যান্টাসি জনিত হ্যালুসিনেশন; একটি সুন্দরী নগ্ন মেয়ে এবং ভয়ালদর্শন এক পিশাচ! মানুষের মনের অবদমিত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ কোন না কোন ভাবে ঘটবেই‚ ছালামের ক্ষেত্রেও ঘটেছে তাই।
তবে এটা একটা সার্বজনীন এবং সহজ হাইপোথিসিস। আমি যেটা করতে চেয়েছিলাম‚ তা হলো-ছালাম নামের কিশোরটির মনের ভিতরকার ভয় এবং ফ্যান্টাসির উৎস খুঁজে বের করা। সেই উদ্দেশ্যেই পরদিন ছালামকে নিয়ে আবার বসলাম। জিজ্ঞেস করলাম-
"ছালাম‚ তুমি যে প্রাণীটি দেখেছিলে সেটা ছিল গরু‚ ইঁদুর এবং বিড়ালের সংমিশ্রণ! তুমি কি এই তিনটা প্রাণীকে ভয় পাও?"
"জে না। মুই ছোডকাল হইতে গেরামে থাহি। ইন্দুর-বিলয়রে ডরামু ক্যা?"
আমি নানা ভাবে প্রশ্ন করে বের করার চেষ্টা করতে লাগলাম যে সে কি কি ভয় পায় এবং সেই ভয় পাওয়া বস্তুগুলোর মধ্যে এমন কোন উপাদান আছে কি না‚ যা থেকে সে রাতের সেই ভয়ংকর প্রাণীটাকে সৃষ্টি করতে পারে তার মস্তিষ্ক। আমি ক্ষান্ত দিলাম তেমন কোন উল্লেখযোগ্য তথ্য বের করতে না পেরে।
আমি যেদিন ঢাকা ফিরব‚ সেদিন মনসুর চাচাকে বললাম‚ "চাচা‚ একটা অনুরোধ করলে রাখবেন?"
"অবশ্যই রাখব। তুমি এই গ্রামের সবচেয়ে মেধাবী পোলা। তোমার অনুরোধ কি ফেলতে পারি! কি অনুরোধ কও বাবা?"
"ছালামকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসে শহরের কোন একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিন। ওর কিছু মানসিক সমস্যা আছে। এই গ্রামে পড়ে থাকলে সেটা আরও বাড়বে। শহরে থাকলে অনেক বন্ধু-বান্ধব হবে। জীবনের নানা দিক দেখবে‚ ভালো পড়াশোনা করবে। ওর জন্য এসব খুব জরুরি।"
চাচা আমার অনুরোধ ফেলেননি‚ কয়েক মাস পর ছালামকে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। আমিই ছালামকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলাম‚ হোস্টেলে তুলে দিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে বাসায় এনে ওর কাউন্সেলিং করাতাম। ছালাম এখন কলেজের ছাত্র। বেশ ভালো আছে সে।”
স্তব্ধ হয়ে গল্প শুনছিল মেহজাবিন এবং পূরব। জিব্রান শেষ করতেই পূরব চিন্তিত মুখে বলল-
“গল্প এখানেই শেষ? তুই না বললি কিছু অমীমাংসীত ব্যাপার আছে গল্পে।”
জিব্রান করুণ হাসি হেসে বলল-"হ্যা। এ গল্পে দু'টো অমিমাংসিত বিষয় আছে। প্রথমত‚ সেই ভয়ানক প্রাণীটার চিন্তা কি করে ছালামের মাথায় এসেছিল‚ সেটা আমি বের করতে পারিনি। দ্বিতীয় বিষয় হলো‚ সেই নগ্ন মেয়েটা ভয়াল দর্শন প্রাণীটাকে ডাকছিল বেলায়েত বলে।"
"তো?"
"Demonology বুঝিস? ডেমনোলজি মানে শয়তান বিদ্যা। গ্রীক-রোমান বিভিন্ন পুরাণে বিভিন্ন ডেমন বা শয়তানের গল্প রয়েছে; মাইথোলজিক্যাল চরিত্র সব। তেমনি এক শয়তানের নাম ছিল বাইলেথ (Byleth) বা বেলেথ (Beleth)। বেলেথ ছিল নরকের এক রাজা। সে একটা ধূসর ঘোড়ায় চড়ত। তার মুখমণ্ডল ছিল বিড়ালের মত। সে তার সঙ্গিনীদের গলার বামদিকে কামড়ে ধরে মেরে ফেলত।
ছালাম যে প্রাণীটার কথা বলেছিল তার সাথে কিন্তু বেলেথের মিল আছে। আবার মেয়েটাও তাকে ডাকছিল বেলায়েত নাম ধরে। বেলেথ আর বেলায়েত শব্দ দু'টো কাছাকাছি নয়? ছালামের মতো এক গেঁয়ো কিশোরের পক্ষে রোমান মাইথোলজি সম্পর্কে জ্ঞান থাকার কথা নয়। তাহলে এই বেলায়েত নাম এবং বেলায়েতের বর্ণনা কি নেহায়েত কাকতালীয়?"
"মাই গড!"
মেহজাবিন বলল‚ "বেলেথের সাথে বেলায়েতের এই অদ্ভুত মিলের বিষয়টা কি সাইকোলজিক্যালি ব্যখ্যা করা যায় না জিব্রান ভাই?"
"যায় আবার যায় না। জলপরীর কথা ধরো। পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার মানুষ‚ বিভিন্ন দেশের অনেক নাবিক জলপরী দেখেছে বলে দাবী করেছে। তবে জলপরী বা মার্মেইড এর কোন অস্তিত্ব বিজ্ঞানীরা পাননি। কিন্তু মজার বিষয়‚ জলপরী সংক্রান্ত বেশির ভাগ মানুষের ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা পরস্পরের সাথে মিলে যায়। আমি বলছি না যে জলপরী আছে‚ আমি বলতে চাচ্ছি যে একই রকম কল্পনা‚ ফ্যান্টাসি কিংবা বিভ্রান্তি অনেক মানুষের মধ্যে হয়ে থাকে। কেন হয়ে থাকে সেটা সঠিক ভাবে আজও জানা যায়নি। মানুষের মন কোন সহজ বস্তু নয়!"
বলতে বলতে জিব্রান হাই তুলল। ঘুম পাচ্ছে তার। কিন্তু পূরব-দম্পতি স্তব্ধ হয়ে কি যেন ভাবছে‚ তাদের বোধহয় গল্পটা এখনও হজম হয়নি। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি!

কিছু কথাঃ এই গল্পের পেছনের গল্পটা বলি, আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম যে, গ্রামের রাস্তায় এক তরুণী আর একটি অল্পবয়সী ছেলে একটা গরুর মতো দেখতে কিম্ভূত প্রাণীর সামনে দাড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। প্রাণীটা মেয়েটার উপর ঝাপিয়ে পড়ে ভয়ংকর বিদ্ঘূটে ভঙ্গিতে চুমু খেতে থাকে এবং এই দৃশ্য দেখে ছেলেটা অজ্ঞান হয়ে যায়। সেই স্বপ্ন থেকে আমি চমৎকার একটা সাইকোলজিক্যাল প্লট পেয়ে যাই, গল্প লিখেও ফেলি; কিছু ট্যাবু ব্যাপারকে মনোবিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করতে চেয়েছিলাম সেই গল্পে। তারপর ব্লগে দিয়েছিলাম, সেটা প্রায় এক বছর আগের কথা। পরে গল্পের একটা অংশ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ট্যাবু যে কোন বিষয় নিয়েই বিতর্ক সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু কিছু কিছু মন্তব্য খুব বেশি আক্রমণাত্মক হবার পর আমি গল্পটা মুছে দিয়েছিলাম। এখন আবার নতুন করে, বিতর্কের অংশটা বাদ দিয়ে, নতুন করে লিখলাম গল্পটা।

এই সিরিজের অন্য গল্পগুলোঃ
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ অবসেশন
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ আয়না-ভীতি
দুঃস্বপ্ন থেকে গল্পঃ কুকুরের ডাক
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:১৫
২৫টি মন্তব্য ২৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×