somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীঃ পলিনড্রোম

১০ ই মে, ২০১৮ রাত ৯:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক
সুন্দরী ওয়েট্রেস মেয়েটার মধ্যে কিছু একটা সমস্যা ছিল, আমি চট করে ধরতে পারছিলাম না সেটা। আপাত দৃষ্টিতে মোটেও অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে না তাকে, কিন্তু কিছু একটা দৃষ্টিকটু ব্যাপার কিংবা কোন অসামঞ্জস্য নিশ্চয়ই ছিল!
আমি চারিদিকে তাকালাম। একটা মস্ত রেস্টুরেন্টের মাঝখানের একটা টেবিলে বসে আছি আমি। আমার ডান দিকের টেবিলটাতে একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক বার বার নিজের হাতঘড়ি দেখছিল আর ওয়েটারদের দিকে তাকাচ্ছিল অধৈর্য চোখে। না, কোন তাড়া নেই তার দৃষ্টিতে, সম্ভবত নিজেকে একজন ব্যস্ত, গুরুত্বপূর্ণ মানুষ প্রমাণ করার জন্যই বার বার সে ঘড়ি দেখছে।
আর বাম পাশের টেবিলে এক কপোত-কপোতী ডিনার করছিল। ছুরি-চামচ দিয়ে কেটে কেটে মুরগীর রানের মাংস হার থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছিল মেয়েটা; চোখ মুখ স্বাভাবিক থাকলেও তার হাতে ধরা চামচ এবং মুরগীর রানের কৌণিক অবস্থান দেখে বুঝলাম সে এভাবে খেতে অভ্যস্ত নয়। ছেলেটাও ছুরি চামচ দিয়ে খাচ্ছে, তবে অনেক সাবলীল ভাবে। বড়লোক প্রেমিকের সঙ্গে প্রথম ডিনার? হতে পারে!
ওয়েট্রেস মেয়েটার কথায় ধ্যান ভাঙল আমার। “স্যার, কি অর্ডার নেবেন আপনি?”
এবার আমি ধরতে পারলাম মেয়েটার মধ্যে অস্বাভাবিকতাটা কোথায়! প্রথমত, সে আমার অনেক কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। একজন অপরিচিত মানুষের কাছে দাঁড়ানোর সময় আমাদের মস্তিষ্ক সবসময় কিছু ন্যুনতম দূরত্ব রক্ষা করে চলে। মেয়েটার শরীর সেই দূরত্ব লঙ্ঘন করে আমার বেশ কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মানে মেয়েটা আমার পরিচিত, আগে থেকে চেনে আমায়। আমি কি প্রায়ই আসি এখানে?
কেউ আমাকে চিনলে, আমিও তাকে চিনলে আমি বিষয়টা জানব, জানাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমি এমনেশিয়ার শিকার। অর্থাৎ সাময়িক বিস্মৃতির শিকার আমি। প্রায়ই এই ধরনের রোগ হয় কি না আমার, সেটাও আমার মনে পড়ছে না, বোধহয় হয় না, কিংবা হয়। আমি এই মুহূর্তে বুঝতে পারছি না ঠিক কোথায় আছি, কি করে এখানে এলাম। শুধু মনে আছে, আমি একজন পদার্থ বিজ্ঞানী। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের উপর আমার লেখা কিছু বইও রয়েছে। তবে, এটা ছাড়া, নিজের নামটাও আমি মনে করতে পারছি না। একটা কাজই করা যেতে পারে এখন, নিজের প্রখর মস্তিষ্ক কাজে লাগিয়ে ঠান্ডা মাথায় এই সমস্যার সমাধান করা। স্বাভাবিক ভাবে ঘরে ফেরা। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো।
মেয়েটা আবার করল প্রশ্নটা, “স্যার, আপনার অর্ডার?”
চট করে একটা বুদ্ধি এলো মাথায়। সে আমাকে চেনে কিনা, সেটা একভাবে পরীক্ষা করা যায় তার মধ্যে কোন সন্দেহ না জাগিয়েই। আমি তাকে হাসিমুখে বললাম, “সবসময় যা খাই, তাই আনো।”
মেয়েটাও হাসল সুন্দর করে। বলল-“নিশ্চয়ই স্যার। একটু অপেক্ষা করুন!”
যাক, আমার ন্যুনতম দূরত্বের থিওরি সঠিক ছিল। মেয়েটা চেনে আমায়। স্মৃতি দুর্বল হলেও মস্তিষ্কের প্রখরতা নিয়ে আর সন্দেহ রইল না মনে।
মেয়েটা মেন্যু কার্ড হাতে নিয়ে চলে যেতেই দ্বিতীয় খটকাটা উঁকি দিল মাথায়। সাদা জামা আর কালো স্কার্ট পড়েছিল সে। শার্টের উপর এখানকার ওয়েটার, ওয়েট্রেসদের নাম লেখা থাকে। পুরো নাম নয়, শুধু নামের প্রথম অংশ। মেয়েটারও আছে। সুডৌল বক্ষের উপর টানটান-ভাঁজহীন শার্টে ধূসর রঙে লেখা একটা নাম- অরোরা। নামটাই বিরক্ত করছে আমাকে!
কারো নাম অরোরা হতেই পারে; প্রশ্ন হলো, আমার মস্তিষ্ক খটকা খুঁজে পাচ্ছে কেন এই নামের মধ্যে? অরোরা নামের কি পরিচিত কেউ আছে আমার? আমার প্রেমিকা কিংবা স্ত্রীর নাম কি অরোরা? নাকি অন্য কোন কারণে? উহু মনে পড়ছে না!
তবে নামের প্রসঙ্গ মাথায় আসতে আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম, একটু আগে অরোরার হাতে মেন্যু কার্ডে লেখা রেস্টুরেন্টের নাম ছিল-ক্যাসিয়া। ক্যাসিয়া নামটির মধ্যে মনে হচ্ছে কোন তাৎপর্য আছে। কি হতে পারে সেটা?
ক্যাসিয়া আর অরোরা, দু’টো নাম, দু’টো নামেই অদ্ভুত কিছু আছে বলে মনে হলো। প্রখর মগজকে কাজে লাগাতে হবে। ভাবতে লাগলাম। ক্যাসিয়া...অরোরা...ক্যাসিয়া...অরোরা...
এই তো, ধরতে পেরেছি! অরোরা নামটা একটা পেলিনড্রোম। পেলিনড্রোম হলো এমন কিছু শব্দ, যেগুলোকে শুরু কিংবা শেষ, যেদিক থেকেই পড়া হোক না কেন, অবিকৃত থাকে। অরোরা নামটাও তাই। বানান হলো A-R-O-R-A; শেষ থেকে পড়লেও অরোরা।
না হয় অরোরা নামটা একটা পেলিনড্রোম, তাতেই বা কি হলো? যাক, সে প্রশ্ন নিয়ে পরে ভাবব। তার আগে দ্বিতীয় শব্দের রহস্যটা নিয়ে ভাবি; ক্যাসিয়া। বানান হলো C-A-S-I-A; না, এটা পেলিনড্রোম নয়। এটা একটা এনাগ্রাম। এনাগ্রাম মানে এমন একটা শব্দ, যেটার অক্ষরগুলোকে আগে পরে করে সাজালে নতুন কোন অর্থবোধক শব্দ পাওয়া যায়। Casia শব্দটাকে আগে পরে সাজালে পাওয়া যায়- Isaac , আইজক! আইজক হতে পারে কারো নাম, অরোরাও একটি নাম। প্রশ্ন হলো নাম দু’টোর মধ্যে সম্পর্ক কি?
মাথার মধ্যে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলাম আমি। দু’ আঙুলে চেপে ধরলাম কপালের দু’পাশ। কেমন যেন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে মাথার মধ্যে সবকিছু। আসছে...আসছে...হ্যা, আমার স্মৃতি ফেরত আসা শুরু হয়েছে। স্পষ্ট টের পাচ্ছি ব্যাপারটা! মনে পড়ল আমার নিজের নাম- সাঈদ, আবু সাঈদ। আমি একজন বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী। জন্ম থেকেই এদেশে থাকি, বিজ্ঞান একাডেমির একটি উঁচু পদে কাজ করি।
এই মুহূর্তে আমার মস্তিষ্কের একটা অংশ হারানো স্মৃতিশক্তি ফেরত আনার চেষ্টা করছে, আরেকটা অংশ খুঁজে যাচ্ছে প্রশ্নের উত্তর। হ্যা, আমার প্রশ্নটা ভুল ছিল। আইজক এবং অরোরা, নাম দু’টোর মধ্যে কোন সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক রয়েছে আইজক এবং পেলিনড্রোম শব্দ দু’টোর মধ্যে। বিজ্ঞানী আইজকের পেলিনড্রোম থিওরি। পেলিনড্রোম থিওরি এক ধরনের কম্পিউটার সিমুলেশন মতবাদ। মতবাদটা কি এই মুহূর্তে এমনেশিয়ার কারণে আমার মনে পড়ছে না। তবে বিজ্ঞানী আইজক প্রসঙ্গ থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য মনে পড়ে গেল আমার, মনে পড়ে গেল নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু, আমার অতীত, আমার পরিবার এবং কর্মক্ষেত্রের কথা।

দুই
আমি কাজ করি বিজ্ঞান একাডেমির সিমুলেশন ডিপার্টমেন্টে, যেটা প্রতিষ্ঠাই হয়েছে বিজ্ঞানী আইজকের কিছু মতবাদের উপর ভিত্তি করে। সিমুলেশন ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠিত হবার পেছনে একটি ইতিহাস রয়েছে।
সাল ২০৩০। পৃথিবীর জলবায়ু বিজ্ঞানীরা জলবায়ু পরিবর্তনকে মানব জাতির অস্তিত্বের জন্য একটি ভয়ংকর হুমকি হিসেবে দেখাতে চাইলেও সাধারণ মানুষ এবং প্রভাবশালী সরকারগুলো কখনোই তা আমলে নেয়নি সেভাবে। তার চেয়েও শঙ্কার ব্যাপার হলো, অনেক রাষ্ট্র এবং সমাজবিজ্ঞানীরা ব্যাপারটাকে রীতিমতো অস্বীকার করল। বলতে লাগল, জলবায়ুর পরিবর্তন আসলে অর্থনীতিকে থামিয়ে দেবার একটি মিথ্যে প্রোপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই নয়।
এসবই একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের কথা। মানুষের টনক নড়ল কয়েক বছর আগে, যখন দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশের কিছু শহর হাঁটু পানিতে সয়লাব হয়ে গেল। ব্যাপারটা ঘটছিল ক’বছর ধরেই। ধীরে ধীরে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছিল। টের পাওয়া গেল শেষ ক’টা বছরে। জলবায়ু পরিবর্তনকে অস্বীকার করার উপায় রইল না আর তখন।
আমি একটা বাড়ি কিনেছিলাম দেশে, কক্সবাজার সৈকত থেকে একদম কাছেই। খবর পেলাম, ঐ এলাকায় এখন আর মানুষই থাকে না। কোমর পানিতে তলিয়ে গেছে জায়গাটা, দিন দিন তা আরও বাড়ছে।
ঐ সময় প্রতিষ্ঠিত হয় বিজ্ঞানীর একাডেমির সিমুলেশন ডিপার্টমেন্ট। না, জলবায়ু আমাদের গবেষণার বিষয় নয়। আমরা কেউ ওখানে জলবায়ু বিজ্ঞানী ছিলাম না। সিমুলেশন ডিপার্টমেন্টের কাজ ছিল ভবিষ্যতের অনাগত সমস্যার সমাধান করা। বিজ্ঞান একাডেমির কিছু কিছু প্রজেক্ট রয়েছে, যেগুলো শত শত বছর পরের অনাগত সমস্যার সমাধান করার কাজে নিয়োজিত থাকে। সিমুলেশন ডিপার্টমেন্টও তেমনি একটা প্রজেক্ট।
একসময় পৃথিবী আর বসবাসযোগ্য থাকবে না। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ থাকলেও বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ যে বিরূপ প্রকৃতিতে টিকে থাকবে না, সেটা আমরা নিশ্চিত ছিলাম। সত্যিকারের পৃথিবী যদি টিকে না থাকে, তাহলে কম্পিউটার সিমুলেশনে মানুষের মস্তিষ্ক এবং ভার্চুয়াল অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য। অর্থাৎ মানব সভ্যতা রক্ষার সর্বশেষ পদক্ষেপটা গ্রহণ করবে সিমুলেশন ডিপার্টমেন্ট।
সিমুলেশন মানে হলো কম্পিউটারে তৈরি একটি কৃত্রিম পৃথিবী, যেখানে বাস্তব পৃথিবীর মতো সবকিছুই থাকবে। এমনকি আমাদের প্রযুক্তি এতই উন্নত যে, যে কারো মস্তিষ্ক ইন্সটল করে তাকে সিমুলেশন পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভব।
সিমুলেশন ডিপার্টমেন্টের অন্যতম একজন গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী হলেও ব্যক্তিগত ভাবে আমি ছিলাম একা, সাদাসিধে মানুষ। পরিবার বলতে কেউ ছিল না, তাই ঘরে ফেরারও তাড়া ছিল না। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতাম আমি একাডেমিতে। একাডেমির সবাই আমাকে শ্রদ্ধা করলেও সেভাবে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল না তেমন, টিনা ছাড়া। টিনা ছিল আমার ল্যাব সহকর্মী। দীর্ঘদিন একসাথে দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে করতে ওর সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল ভালোই। বেশ সুন্দরী সে, সাথে আকর্ষণীয় শারীরিক গঠন। একাডেমিতে নতুন আসা ছোকরা বিজ্ঞানীরা টিনার আশেপাশে ঘুরঘুর করত, টিনা ওদের চেয়ে বয়সে বড় এটা জেনেও। টিনা ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে কাজের বাইরে কোন কথা হতো না আমার। বাসা-একাডেমি-বাসা করে কাটিয়ে দিতাম আমি। গত রাতেও কাজ শেষে বাসায় এসেছি মনে আছে, তারপর আর কিছু মনে নেই।
একটু আগে নিজেকে করা প্রশ্নটা আবার মাথায় এলো- আইজক এবং পেলিনড্রোম শব্দ দু’টোর মধ্যে সম্পর্ক কি? বিজ্ঞানী আইজকের কিছু সূত্র দিয়েই সিমুলেশন ডিপার্টমেন্টের মৌলিক কাজগুলো করা হয়। সিমুলেশনের মৌলিক সূত্রগুলো তিনিই দিয়েছেন। তার আরেকটা বিখ্যাত সূত্র আছে, যেটাকে বিজ্ঞানীরা বলে পেলিনড্রোম থিওরি। আইজক সাহেব পেলিনড্রোম খুব পছন্দ করতেন। পেলিনড্রোম ব্যবহার করতেন অনেক কাজেই। নিজের ছেলেমেয়েরও নাম রেখেছিলেন তিনি পেলিনড্রোমে; যেমন ছেলের নাম বব (Bob) এবং মেয়ের নাম অ্যানা (Anna)। ছাত্রজীবনে একটা রম্য গল্প লিখেছিলেন তিনি কলেজ ম্যাগাজিনে। গল্পটার নাম ছিল- Madam, I’m Adam! উল্টো করে পড়লেও বাক্যটা অভিন্ন থাকে। এ কারণেই তার দেওয়া তত্ত্বকে বিজ্ঞানীরা পেলিনড্রোম থিওরি বলে চেনে। তবে এমনেশিয়ার কারণে আমি একদমই মনে করতে পারলাম না পেলিনড্রোম থিওরিটা আসলে কি ছিল!
আইজক এবং পেলিনড্রোম অর্থাৎ ক্যাসিয়া এবং অরোরা শব্দ দু’টোর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা করতে গিয়েই পেটের ভেতর একরকম সুড়সুড়ি টের পেলাম, ভয় পেলে যেমনটা হয়। একটু আগে ভাবা কথাগুলো মনে পড়ে গেল-
... সিমুলেশন মানে হলো কম্পিউটারে তৈরি একটি কৃত্রিম পৃথিবী, যেখানে বাস্তব পৃথিবীর মতো সবকিছুই থাকবে। এমনকি আমাদের প্রযুক্তি এতই উন্নত যে, যে কারো মস্তিষ্ক ইন্সটল করে তাকে সিমুলেশন পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেওয়া সম্ভব...
শুনেছি সিমুলেশনের ডিজাইন করার সময় বিজ্ঞানী আইজকের সম্মানে অনেক পেলিনড্রোম নাম, অনেক এনাগ্রাম তৈরি করেছিল সিমুলেশন ইঞ্জিনিয়াররা, সিমুলেশন পৃথিবীর জন্য। অরোরা এবং ক্যাসিয়া কি তেমনই কিছু নাম? তার উপর আমার এই অপ্রত্যাশিত এমনেশিয়া। একা থাকি, পরিবার নেই, আমাকে পরীক্ষামূলকভাবে সিমুলেশনে যদি পাঠাতে চায় বিজ্ঞান একাডেমি, অবাক হবার কিছু নেই।
ভাবতেই ঘেমে উঠলাম। ভীষণ অস্বস্তি হতে লাগল। তবে কি আমি সিমুলেশনে আছি? এটা সত্যিকার পৃথিবী নয়? কম্পিউটার সিমুলেশন মাত্র? এমনেশিয়াটা যদি ন্যাচারাল না হয়, এটাই গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা। বিজ্ঞান একাডেমি নিজেদের তৈরি সিমুলেশনে আমাকে পাঠাতেই পারে, সিমুলেশনে মানুষের কি প্রতিক্রিয়া হবে জানার জন্য। বিজ্ঞান একাডেমি এমন অনেক নির্দয় কিন্তু যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
আমি দ্রুত উঠে দাঁড়ালাম। ভূতগ্রস্তের মতো ছুটে রেস্টুরেন্টের বাইরে বেরিয়ে এলাম। রাস্তায় দাড়াতেই একটা গাড়ি ছুটে এলো আমার দিকে। পিষেই ফেলত ঠিক সময়ে ব্রেক না করলে। আমি দেখলাম গাড়িটাকে, একটা কালো রঙের ট্যাক্সিক্যাব। গাড়ির ড্রাইভার বড় বড় চোখে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। হতভম্ব ড্রাইভারকে ভাবার সময় না দিয়ে দরজা খুলেই ঢুকে পড়লাম ভেতরে। বললাম-“সেন্ট্রাল পার্কের দিকে চলো, বিজ্ঞান একাডেমি ভবনে!”

তিন
টিনা কম্পিউটার মনিটরের দিকে তাকিয়ে কিছু এলগরিদম লিখছিল, টের পায়নি যে আমি পেছনে এসে দাঁড়িয়েছি। আমি ওর কাঁধে হাত রাখলাম। চমকাল না সে। চোখের কোণ দিয়ে আমাকে দেখে বলল, “আমার না হয় নাইট ডিউটি আজ সাঈদ, তবে তুমি ডিনার সেরে আবার ফিরে এলে যে? এত কাজ করে কি হবে বলো! মাঝে মধ্যে ছুটিছাটা নাও!!”
আমি শান্ত গলায় বললাম, “কিছু কথা আছে, জরুরী!”
আমার ভীষণ শীতল কণ্ঠ শুনে রিভলভিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল টিনা। বিস্মিত চেহারা ওর। বলল- “কি হয়েছে সাঈদ? কোন সমস্যা?”
আমি ওকে বললাম আজকের পুরো ঘটনা। বললাম, রেস্টুরেন্টে গিয়ে কিভাবে স্মৃতিশক্তি হারালাম, ফিরেও পেলাম। আমরা বাস্তব পৃথিবীতে নেই, সিমুলেশনে আছি, এই সন্দেহের কথাও জানালাম তাকে। কেন এটা সন্দেহ করছি, ব্যাখ্যা করলাম। টিনা শুনে গেল সব শান্তভাবে। আমার বলা শেষ হতেই সে বলল, “সবার প্রথমে তোমার উচিত ডাক্তারের কাছে যাওয়া। সব সন্দেহ, এলোমেলো চিন্তা... বোধহয় এমনেশিয়া থেকেই এসেছে। আমার পরিচিত এক সাইকিয়াট্রিস্ট...”
“উহু, সাইকিয়াট্রিস্টের প্রয়োজন পড়বে না, যদি তুমি সাহায্য করো।”
“আমি? আমি কি সাহায্য করতে পারি এ ব্যাপারে সাঈদ?”
“তুমি তো সিমুলেশন ইঞ্জিনিয়ারদের টিমে ছিলে, তাই না?”
“হ্যা, ছিলাম। আমার পড়াশোনার ফিল্ডও সিমুলেশন ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড মডেলিং নিয়ে। কেন বলো তো!”
“আচ্ছা, তুমি কি তোমার কম্পিউটার থেকে একাডেমির নেটওয়ার্কে গিয়ে সিমুলেশন মডেলটা চেক করতে পারো? আমরা যদি সিমুলেশনে থাকি, তাহলে মেইন কম্পিউটারে আলাদা কোন সিমুলেশন নেটওয়ার্ক পাবার কথা না। আমরা বাস্তব জগতের কম্পিউটার নেটওয়ার্ক দেখতে পাব শুধু।”
“উহু, এত সহজ নয়। সিমুলেশন আর বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য করা যদি এতই সহজ হতো, তাহলে বিজ্ঞান একাডেমি এত এত টাকা খরচ করে এত উন্নত সিমুলেশন প্রোগ্রাম তৈরি করত না। বিজ্ঞান একাডেমির মেইন নেটওয়ার্ক কয়েক শো হোক্স সিমুলেশন, মানে নকল সিমুলেশন নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত। তুমি বাস্তব সিমুলেশন এবং হোক্স সিমুলেশনের মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পাবে না। অতি উৎসাহী কেউ যাতে সিমুলেশন প্রোগ্রামটা ধরে ফেলতে না পারে, তাই এ ব্যবস্থা।”
“কোন উপায় কি নেই?”
টিনা একটু ভাবল। গভীরভাবে আমাকে দেখল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “একটা উপায় আছে। আমাদের ইঞ্জিনিয়ারদের একটা সিক্রেট। তবে এটা যদি তোমাকে জানাই, তাহলে আমার চাকরি চলে যেতে পারে। যদি কথা দাও আমাদের আজকের কথোপকথন গোপন রাখবে, তাহলেই জানাতে পারি।”
“কথা দিলাম টিনা!”
টিনা একটু হাসল। বলল, “সিমুলেশন প্রোগ্রামে অনেক অপ্রয়োজনীয় বাইনারি কোডিং রয়েছে। যেগুলো আসলে সহজ কিছু প্রোগ্রামকে জটিল ভাবে দেখানোর জন্য ব্যবহার করা হয়, যাতে করে সাধারণ কোন মানুষ সিমুলেশনের কোডিংগুলো বুঝতে না পারে। অবশ্য এটা তেমন কার্যকরী কোন উপায় নয়। যে কোন বুদ্ধিমান প্রোগ্রামার বিষয়টা ধরে ফেলতে পারবে...”
আমি অধৈর্য ভাবে বললাম, “এই বাইনারি কোডিং থেকে তুমি সিমুলেশন থেকে বাস্তবকে আলাদা করে শনাক্ত করতে পারবে?”
“হ্যা, পারব। শুধু মেইন কম্পিউটার নেটওয়ার্কে একটা বিশেষ কোডিং পাওয়া যায়, সিমুলেশন নেটওয়ার্কে নয়।”
টিনা নিজের কম্পিউটার থেকে কিছু একটা বের করে দেখাল। অসংখ্য বাইনারি সংখ্যা এবং দুর্বোধ্য কোডিং থেকে একটা লাইন দেখিয়ে বলল-“...এই যে লাইনটা দেখছ, এটা আমরা সিমুলেশন ইঞ্জিনিয়াররা মেইন কম্পিউটার নেটওয়ার্কে যুক্ত করেছি। লাইনটা দেখে কিছু বুঝতে পারছ?”
আমি সংখ্যাগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। লাইনটা এমন-
01001101 01100001 01100100 01100001 01101101 00100000 01001001 01101101 00100000 01000001 01100100 01100001 01101101

কি যেন একটা মিল পাচ্ছি সংখ্যাগুলোর মধ্যে। কিছুক্ষণ ভাবতেই বুঝে ফেললাম। এটা আসলে এনক্রিপশন করা একটা বাক্য। সাধারণ একটা বাক্যকে বাইনারি কোডে রূপান্তর করা হয়েছে। ইংরেজি লেটারে প্রকাশে করলে সংখ্যাগুলো দাঁড়ায়- Madam Im Adam ; অর্থাৎ বিজ্ঞানী পেলিনড্রোমের ছাত্রজীবনে লেখা সেই বিখ্যাত গল্প।
টিনা বলে যেতে লাগল-“তোমার মুখের হাসি দেখে বুঝতে পারছি বাক্যটা ধরতে পেরেছ তুমি। এবার অন্যান্য সিমুলেশন নেটওয়ার্কগুলো দেখো। এই কোডিং পাও কিনা!”
টিনা বেশ কয়েক সিমুলেশনে সংখ্যাগুলো খুঁজে বের করার প্রোগ্রাম লঞ্চ করল। না, অন্য কোন নেটওয়ার্কে নেই এই সংখ্যাগুলো।
আমার মুখে হাসি ফুটল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি। “অনেক ধন্যবাদ তোমাকে টিনা। বাঁচালে আমাকে। কাল সকালেই সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাব আমি।”

চার
মধ্যরাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। সেই সাথে হালকা মাথাব্যথা। বিছানা ছেড়ে কাঁচ দিয়ে তৈরি মস্ত দেওয়ালের সামনে দাঁড়ালাম আমি। একটি বহুতল ভবনের ৮৫ তলায় থাকি। কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে আলো ঝলমলে পৃথিবী দেখা যাচ্ছে ওপারে। ঘুম ভাঙার কারণ বুঝতে পারলাম না আমি। সেই চিনচিনে মাথাব্যথাটাও ফিরে এসেছে আবার।
বিদ্যুৎ চমকের মনে পড়ে গেল একটা কথা। হ্যা, স্মৃতির আরও কিছু অংশ ফেরত এসেছে আমার। এখন মনে করতে পারছি বিজ্ঞানী আইজকের পেলিনড্রোম থিওরি কি।
আইজক সাহেব সিমুলেশন পৃথিবীর একটি অন্যতম মৌলিক সূত্র দিয়েছিলেন, পেলিনড্রোম নামে যেটা পরিচিত। সূত্রটা বলছে, সিমুলেশনে থাকা কোন মানুষ, কম্পিউটার, রোবট কিংবা অন্য কোন বুদ্ধিমত্তা কখনোই, কোনভাবেই বুঝতে পারবে না যে তারা সিমুলেশনে রয়েছে। ঠিক যেভাবে একটা পেলিনড্রোম শব্দ শুরু বা শেষ যেদিক থেকেই পড়া হোক না, শ্রোতা কখনো বুঝতে পারবে না বক্তা শব্দটা শেষ থেকে না শুরু থেকে পড়ছে। সিমুলেশনে থেকেও কখনোই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয় যে এটি সিমুলেশন, বাস্তব পৃথিবী নয়।
টিনা আমাকে কিছু কোডিং দেখিয়ে শান্ত করেছে বটে, তবে আমি নিশ্চিত যে, যেই সিমুলেশনে যারা আছে, সেই সিমুলেশনের কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ‘ম্যাডাম আয়াম অ্যাডাম’ এর কোডিং দেখা যাবে। সবার কাছেই মনে হবে, সেই বাস্তবে আছে, বাকীরা সিমুলেশন।
নিশ্ছিদ্র বিষণ্ণতা আমাকে গ্রাস করে নিল বিষয়টা ধরতে পারায়। আমি কখনোই জানতে পারব না আমি একজন রক্ত মাংসের মানুষ, নাকি একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম মাত্র!
আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। অনেক নিচে পিঁপড়ের মতো ছোট ছোট কিছু মানুষ হেটে বেড়াচ্ছে। যদি লাফ দেই এখান থেকে, কি হবে? দু’টো ব্যাপার ঘটতে পারে। আমি সত্যিকার মানুষ হলে মারা যাব, আর যদি কম্পিউটার প্রোগ্রাম হই, তাহলে হয়তো কয়েক মিনিটের জন্য প্রোগ্রাম বন্ধ থাকবে, রিস্টার্ট নেবে।
যেটাই হোক, কোনটাই মন্দ হয় না। আমার পরিবার নেই, পিছুটান নেই। মরে গেলেই বা কি!
দু’পা রেলিঙে তুলে দিলাম। চোখ বন্ধ করে মেলে ধরলাম দু’হাত। এখন শরীরটা ছেড়ে দিলেই নিচে পড়ে যাব।
ডোরবেলের আওয়াজ পেলাম সেই সময়ে। ইন্টারকমে একটা মিষ্টি রিনরিনে কণ্ঠ বলে উঠল, “সাঈদ, তুমি ফোন ধরছিলে না আমার, তাই ছুটে এলাম। ঠিক আছো তো তুমি?”
উহু, ভুল ভেবেছিলাম। এখনও টিনা আছে আমার জন্য। আছে ওর সবুজ দু’টো চোখ, সোনালী চুল, আর শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ!
আমি নেমে এলাম রেলিঙ থেকে। সিমুলেশনে হলেও কাউকে ভালোবাসি, বেঁচে থাকি কারো জন্য।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মে, ২০১৮ রাত ৯:৪৭
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×