somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ডা. মোহাম্মদ মোমিনুজ্জামান খান
আমি, নিতান্তই একজন সাধারণ বাংলাদেশি। এই ব্লগে আমি আমার গল্প বলি — আমার কথা, আমার ভাবনা, একজন সাধারণ মানুষের, যে তার আয়নায় অসাধারণ স্বপ্ন দেখে। চলুন, একসঙ্গে খুঁজে দেখি আমার আয়নার সেই প্রতিচ্ছবি, যেখানে আমি শুধু আমি নই, আমি আমার বাংলাদেশ।

ঢাকার বিভক্ত সিটি কর্পোরেশন: একটি ভুল সিদ্ধান্তের পরিণতি, অবকাঠামোগত জটিলতা ও পুনর্গঠনের পথ

২৯ শে নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক হৃৎপিণ্ড। প্রায় ২ কোটি জনসংখ্যার এই মহানগরী বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। তবে, ২০১১ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) গঠনের সিদ্ধান্তটি একটি মারাত্মক ভুল হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। এই বিভক্তি রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক, দাপ্তরিক, মানসিক, এবং অবকাঠামোগত দিক থেকে নগর ব্যবস্থাপনায় জটিলতা সৃষ্টি করেছে। ফলে, ঢাকাবাসী প্রতিনিয়ত ট্রাফিক জট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা, পানি নিষ্কাশনের সমস্যা, এবং সেবার অসমতার মাশুল দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এই লেখায় আমরা বিশ্লেষণ করব কেন এই বিভক্তি ভুল ছিল, এর বর্তমান প্রভাব, বিশেষ করে অবকাঠামোগত জটিলতা, এবং কীভাবে ঢাকাকে পুনরায় একীভূত করে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা যায়। পাশাপাশি, পুনর্গঠনের সম্ভাব্য সুফল, অবকাঠামোগত সমস্যার সমাধান, এবং করণীয় নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

বিভক্তির পটভূমি ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

২০১১ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনকে দুই ভাগে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নেওয়া হয়। এর পেছনে প্রধান যুক্তি ছিল ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং প্রশাসনিক চাপ কমানোর জন্য দুটি স্বতন্ত্র প্রশাসনিক কাঠামো গঠন। তবে, এই সিদ্ধান্তের পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল প্রধান। ঢাকার নিয়ন্ত্রণ বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে ভাগ করে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় নগর পরিকল্পনাবিদ, প্রশাসনিক বিশেষজ্ঞ, এবং স্থানীয় নাগরিকদের মতামত পর্যাপ্তভাবে বিবেচনা করা হয়নি। ফলে, এই বিভক্তি ঢাকার অবকাঠামো, প্রশাসন, এবং নগর পরিচিতির উপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

কেন বিভক্তি ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত?

ঢাকার বিভক্তির ফলে নগর প্রশাসন, অবকাঠামো, এবং নাগরিক জীবনে যে সমস্যাগুলো সৃষ্টি হয়েছে, তা নিম্নলিখিত দিক থেকে বিশ্লেষণ করা যায়:

১। রাজনৈতিক বিভেদ ও সমন্বয়হীনতা:
• দুটি সিটি কর্পোরেশন প্রায়ই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকে, যা নীতি ও পরিকল্পনায় সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, সড়ক নির্মাণ, পানি সরবরাহ, বা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ডিএনসিসি এবং ডিএসসিসি’র মধ্যে ঐকমত্যের অভাব রয়েছে।
• এই বিভেদ জনস্বার্থের পরিবর্তে দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়, যা নগর উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে।

২। প্রাতিষ্ঠানিক জটিলতা:
• দুটি পৃথক সিটি কর্পোরেশন মানে দুটি পৃথক প্রশাসনিক কাঠামো, বাজেট, এবং নীতি। এটি প্রশাসনিক ব্যয় বাড়িয়েছে এবং সম্পদের অপচয় ঘটিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, দুটি কর্পোরেশনের জন্য আলাদা কর্মচারী নিয়োগ, অফিস ব্যবস্থাপনা, এবং সুবিধাদি রক্ষণাবেক্ষণে অতিরিক্ত ব্যয় হয়।
• এলাকাগত সীমানা নিয়ে বিরোধ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটায়।

৩। দাপ্তরিক অদক্ষতা:
• নাগরিকদের দাপ্তরিক সেবা গ্রহণে জটিলতা বেড়েছে। অনেক সময় বাসিন্দারা বুঝতে পারেন না তাদের সমস্যার সমাধানের জন্য কোন কর্পোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
• তথ্য ও সম্পদ ভাগাভাগির অভাব প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং সেবা প্রদানে বাধা সৃষ্টি করে।

৪। মানসিক বিচ্ছিন্নতা:
• “উত্তর” এবং “দক্ষিণ” নামক কৃত্রিম বিভাজন ঢাকাবাসীর মধ্যে একটি মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। এটি শহরের ঐক্য ও সংহতির পরিপন্থী এবং ঢাকার সামগ্রিক পরিচিতিকে ক্ষুন্ন করে।
• এই বিভাজন স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সহযোগিতার পরিবর্তে প্রতিযোগিতা ও বিভেদকে উৎসাহিত করে।

৫। অবকাঠামোগত জটিলতা:
• ট্রাফিক ও পরিবহন ব্যবস্থা: বিভক্তির ফলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, ডিএনসিসি’র একটি সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প ডিএসসিসি’র এলাকায় ট্রাফিক জট সৃষ্টি করতে পারে, কারণ দুই কর্পোরেশনের মধ্যে সমন্বিত পরিকল্পনা নেই। ঢাকার ট্রাফিক জটিলতা বিশ্বে কুখ্যাত, এবং বিভক্ত প্রশাসন এই সমস্যাকে আরও তীব্র করেছে।
• পানি নিষ্কাশন ও বন্যা: ঢাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত, এবং দুটি কর্পোরেশনের পৃথক খাল ও নর্দমা রক্ষণাবেক্ষণ নীতি এই সমস্যাকে জটিল করেছে। ফলে, বর্ষাকালে নিম্নাঞ্চলে পানি জমে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ২০২৪ সালের বর্ষায় ঢাকার ৩০% এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়, যার একটি বড় কারণ ছিল খাল রক্ষণাবেক্ষণে সমন্বয়হীনতা।
• বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় ৭,০০০ মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার মাত্র ৫০% সঠিকভাবে সংগ্রহ ও নিষ্কাশন করা হয়। দুটি কর্পোরেশনের পৃথক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা সম্পদের অপচয় এবং অদক্ষতা সৃষ্টি করে।
• অবকাঠামোগত প্রকল্পে দীর্ঘসূত্রিতা: মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, এবং অন্যান্য বড় অবকাঠামো প্রকল্পে দুটি কর্পোরেশনের সমন্বয়হীনতার কারণে বিলম্ব ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, মেট্রোরেল লাইন-৬ এর কিছু অংশে ডিএনসিসি এবং ডিএসসিসি’র এলাকাগত দ্বন্দ্ব প্রকল্পের সময়সীমা বাড়িয়েছে।

বর্তমান পরিণতি: ঢাকাবাসীর মাশুল

বিভক্ত সিটি কর্পোরেশনের ফলে ঢাকাবাসী প্রতিনিয়ত নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

১। ট্রাফিক জটিলতা: ঢাকার ট্রাফিক সমস্যা বিশ্ববিখ্যাত। দুটি কর্পোরেশনের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে সড়ক নির্মাণ, ট্রাফিক সংকেত ব্যবস্থা, এবং গণপরিবহন উন্নয়নে বিলম্ব ঘটছে। ২০২৪ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকার বাসিন্দারা গড়ে প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা ট্রাফিক জটে আটকে থাকেন।

২। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা: বিভক্ত ব্যবস্থাপনার কারণে বর্জ্য সংগ্রহ ও নিষ্কাশন অদক্ষ। এটি পরিবেশ দূষণ এবং জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

৩। পানি নিষ্কাশন ও বন্যা: খাল ও নর্দমা রক্ষণাবেক্ষণে সমন্বয়হীনতার কারণে বর্ষায় ঢাকার বড় অংশ পানিতে তলিয়ে যায়, যা অর্থনৈতিক ক্ষতি ও জনদুর্ভোগ বাড়ায়।

৪। সেবার অসমতা: ডিএনসিসি এবং ডিএসসিসি’র মধ্যে বাজেট ও সম্পদ বণ্টনে অসমতা রয়েছে। ফলে, কিছু এলাকায় সেবার মান ভালো হলেও অন্যান্য এলাকায় তা অপর্যাপ্ত।

৫। নাগরিকদের হতাশা: ২০২৫ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার ৬৫% বাসিন্দা মনে করেন যে বিভক্ত সিটি কর্পোরেশন তাদের জীবনযাত্রার মানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

অবকাঠামোগত জটিলতা নিরসনে করণীয়

ঢাকার বিভক্ত সিটি কর্পোরেশনের ফলে সৃষ্ট অবকাঠামোগত জটিলতা নিরসনের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে:

১। সমন্বিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা:
• একীভূত ট্রাফিক প্ল্যান: একটি সমন্বিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা তৈরি করা, যেখানে সড়ক নির্মাণ, ট্রাফিক সংকেত, এবং গণপরিবহনের জন্য একক নীতি থাকবে। এটি ডিএনসিসি এবং ডিএসসিসি’র এলাকাগত সীমানা নির্বিশেষে কাজ করবে।
• গণপরিবহন উন্নয়ন: মেট্রোরেল, বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), এবং বৃত্তাকার জলপথের মতো গণপরিবহন ব্যবস্থা সম্প্রসারণে একক কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করা।
• স্মার্ট ট্রাফিক সিস্টেম: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং সেন্সর-ভিত্তিক ট্রাফিক সিগন্যাল সিস্টেম চালু করা, যা ট্রাফিক প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে।

২। পানি নিষ্কাশন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ:
• খাল পুনরুদ্ধার ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনা: ঢাকার খালগুলো (যেমন, হাতিরঝিল, বুড়িগঙ্গা) পুনরুদ্ধার এবং একটি সমন্বিত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এটি বর্ষাকালে পানি জমা রোধ করবে।
• নর্দমা আধুনিকীকরণ: পুরানো নর্দমা ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ এবং নতুন নর্দমা নির্মাণে একক কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করা।
• জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং পুনর্ব্যবহারের জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা।

৩। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকীকরণ:
• কেন্দ্রীভূত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা: একটি কেন্দ্রীভূত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ গঠন করা, যা বর্জ্য সংগ্রহ, পুনর্ব্যবহার, এবং নিষ্কাশনের জন্য সমন্বিত নীতি প্রণয়ন করবে।
• পুনর্ব্যবহার ও বর্জ্য থেকে শক্তি: বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ পৃথকীকরণের জন্য আধুনিক সুবিধা স্থাপন। সিঙ্গাপুরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মডেল এ ক্ষেত্রে অনুকরণীয় হতে পারে।
• নাগরিক সচেতনতা: বর্জ্য কমানো এবং পৃথকীকরণে নাগরিকদের সম্পৃক্ত করার জন্য প্রচারণা চালানো।

৪। অবকাঠামোগত প্রকল্পে সমন্বয়:
• একক প্রকল্প তত্ত্বাবধান কমিটি: মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, এবং অন্যান্য বড় অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য একটি কেন্দ্রীয় তত্ত্বাবধান কমিটি গঠন। এটি প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব এবং সমন্বয়হীনতা কমাবে।
• পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP): বেসরকারি খাতের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়নে গতি আনা। উদাহরণস্বরূপ, জাপানের জাইকা বা চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ থেকে অর্থায়ন সংগ্রহ করা যেতে পারে।

৫। সবুজ ও টেকসই অবকাঠামো:
• সবুজ স্থান বৃদ্ধি: ঢাকার সবুজ স্থান (বর্তমানে মাত্র ৮%) বাড়ানোর জন্য পার্ক, বৃক্ষরোপণ, এবং ছাদ বাগান প্রকল্প চালু করা।
• টেকসই শক্তি: সৌর প্যানেল এবং শক্তি-দক্ষ অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বাড়ানো, যা দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশ ও অর্থনীতির জন্য উপকারী।

কীভাবে ভুল শুধরে সঠিক পথে ফেরা যায়?

ঢাকার বিভক্ত সিটি কর্পোরেশনের সমস্যা সমাধান এবং অবকাঠামোগত জটিলতা নিরসনের জন্য একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে:

১। পুনরেকত্রীকরণ ও একক সিটি কর্পোরেশন গঠন:
• ডিএনসিসি এবং ডিএসসিসি’কে একীভূত করে “ঢাকা সিটি কর্পোরেশন” নামে একটি একক প্রশাসনিক কাঠামো গঠন। এটি প্রশাসনিক ও অবকাঠামোগত ব্যয় কমাবে এবং সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করবে।
• একত্রীকরণের জন্য একটি রোডম্যাপ তৈরি, যেখানে প্রশাসনিক কাঠামো, বাজেট, এবং কর্মচারী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে পর্যায়ক্রমিক পরিকল্পনা থাকবে।

২। সমন্বিত নগর পরিকল্পনা:
• ঢাকার জন্য একটি “মাস্টার প্ল্যান” তৈরি, যেখানে ট্রাফিক, পানি নিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, এবং গণপরিবহনের জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা থাকবে। এই পরিকল্পনা তৈরিতে নগর পরিকল্পনাবিদ, প্রকৌশলী, এবং নাগরিক প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা।
• বিশ্বের সফল শহরগুলোর মডেল (যেমন, সিঙ্গাপুরের Urban Redevelopment Authority) থেকে শিক্ষা নেওয়া।

৩। ডিজিটাল প্রশাসন ও স্বচ্ছতা:
• সিটি কর্পোরেশনের সেবা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা, যাতে নাগরিকরা সহজে ট্রেড লাইসেন্স, কর পরিশোধ, এবং অভিযোগ দাখিল করতে পারেন।
• বাজেট ও প্রকল্প বাস্তবায়নের তথ্য স্বচ্ছভাবে প্রকাশ, যাতে নাগরিকদের মধ্যে আস্থা বৃদ্ধি পায়।

৪। নাগরিক অংশগ্রহণ ও সচেতনতা:
• নাগরিকদের মতামত গ্রহণের জন্য নিয়মিত “টাউন হল মিটিং” এবং জনশুনানির আয়োজন।
• বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি নিষ্কাশন, এবং পরিবেশ সংরক্ষণে নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা।

৫। আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার:
• সিটি কর্পোরেশনের ক্ষমতা ও দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে একটি নতুন আইন প্রণয়ন। এই আইনে সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে রাজউক, ঢাকা ওয়াসা, এবং অন্যান্য সংস্থার সমন্বয়ের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকবে।
• নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য একটি স্বাধীন তদারকি কমিটি গঠন।

পুনর্গঠনের সম্ভাব্য সুফল

ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের পুনরেকীকরণ এবং অবকাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে নিম্নলিখিত সুফল অর্জন করা সম্ভব:

১। প্রশাসনিক ও অবকাঠামোগত দক্ষতা:
• একক প্রশাসনিক কাঠামো ব্যয় কমাবে এবং সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করবে।
• অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে।
• সমন্বিত নীতি সেবার মান উন্নত করবে।

২। নগরীর জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন:
• ট্রাফিক, বর্জ্য, এবং পানি নিষ্কাশন সমস্যার সমাধান ঢাকার বাসযোগ্যতা বাড়াবে। ২০২৪ সালের Mercer Quality of Living Index-এ ঢাকার অবস্থান ১৯৮, যা উন্নত করা সম্ভব।
• নাগরিকদের জন্য স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত হবে।

৩। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি:
• উন্নত নগর ব্যবস্থাপনা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করবে। ঢাকা বাংলাদেশের জিডিপি’র প্রায় ৪০% অবদান রাখে, এবং এই অবদান বৃদ্ধি পেতে পারে।
• ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার জন্য সহজ প্রশাসনিক সেবা নিশ্চিত হবে।

৪। সামাজিক ঐক্য ও পরিচিতি:
• মানসিক বিভাজন কমবে এবং ঢাকাবাসীর মধ্যে শক্তিশালী নগর পরিচিতি তৈরি হবে।
• স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সহযোগিতা ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে।

৫। টেকসই উন্নয়ন:
• সমন্বিত পরিকল্পনা ঢাকাকে জলবায়ু পরিবর্তন ও নগরায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম করবে। এটি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) অর্জনে সহায়ক হবে।
• সবুজ স্থান, পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি, এবং পরিবেশবান্ধব নীতি বাস্তবায়ন সহজ হবে।

চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

পুনরেকত্রীকরণ ও অবকাঠামোগত সংস্কারের পথে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকবে:

১। রাজনৈতিক প্রতিরোধ: রাজনৈতিক গোষ্ঠী পুনরেকত্রীকরণের বিরোধিতা করতে পারে। এটি মোকাবিলায় সকল দলের সঙ্গে সংলাপ ও জাতীয় ঐকমত্য গঠন জরুরি।

২। প্রশাসনিক ও অবকাঠামোগত জটিলতা: দুটি কর্পোরেশনের কাঠামো ও অবকাঠামো একীভূত করতে সময় ও সম্পদ প্রয়োজন। একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে পারে।

৩। নাগরিকদের প্রত্যাশা ব্যবস্থাপনা: দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান নাও হতে পারে। নাগরিকদের ধৈর্য ধরার জন্য সচেতনতা প্রচারণা চালানো দরকার।

ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের বিভক্তি ছিল একটি ভুল সিদ্ধান্ত, যা রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক, দাপ্তরিক, মানসিক, এবং অবকাঠামোগত জটিলতা সৃষ্টি করেছে। ট্রাফিক জট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা, এবং পানি নিষ্কাশনের সমস্যা ঢাকাবাসীর জীবনযাত্রার মানকে ক্ষুণ্ন করছে। তবে, পুনরেকত্রীকরণ, সমন্বিত নগর পরিকল্পনা, অবকাঠামোগত সংস্কার, এবং নাগরিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই ভুল শুধরে ঢাকাকে একটি বাসযোগ্য, টেকসই, এবং সমৃদ্ধশালী মহানগরীতে রূপান্তরিত করা সম্ভব। ঢাকার ঐক্য ও সম্ভাবনার প্রতি আস্থা রেখে, এখনই সময় এই সংস্কারের সূচনা করার। একটি সমন্বিত ঢাকা শুধু নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে না, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে একটি নতুন অধ্যায়ের দ্বার উন্মোচন করবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:৪৪
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×