ভেবেছিলাম সোহানী'র লেখা তো ব্লগে অনেক পড়েছি - সময় পেলে বইটি পড়ে নেবো। তার স্টাইল ও লেখার বিষয় আমার অনেকটাই জানা। বইটির প্রকাশককে আগেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, বইটি কেমন? আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজেই উত্তর দিলাম, সোহানীর লেখা শুধু যদি তার ব্লগপোস্ট গুলোর মতোও হয়, তবু অনেক ভালো একটি গ্রন্থ হবে সেটি। বইটি সংগ্রহে রাখার জন্য যথাস্থানে আগ্রহ প্রকাশ করলাম। চাইলাম মেঘ, হয়ে আসলো ঝড় - প্রকাশক অনেক দয়ার্দ্র হয়ে আমার জন্য একটি কপি নিয়ে হাজির হলেন একদম আমার আস্তানায়!
কিন্তু তার বই পড়ে পাঠক হিসেবে আমার পূর্বধারণা পাল্টেছে। বলতে পারেন আপগ্রেড হয়েছে। বন্ধুর লেখা বই তো পড়তেই হবে - ব্যাপারটি এমন নয়। মনে হলো, এই লেখক তো আমার কাছে নতুন! প্রবাসী লেখক সোহানী'র লেখা বইটি বন্ধুর বই বলে চালিয়ে দেওয়া যায় না। বই পড়ে সোহানীর লেখক সত্ত্বার সাথে পরিচিত হবার সুযোগ হলো।
বলে রাখছি যে, এটি কোন রিভিউ নয় - পাঠক প্রতিক্রিয়া*। লেখার ভেতরের গল্প এখানে নেই (দুঃখিত!)।
ছোট ছোট গল্প দিয়ে সাজানো রঙ্গিন মোড়কের একটি বই। প্রচ্ছদ এমন করে আঁকা, এমন রঙে রঞ্জিত - মনে হবে একটি উপহার। পাঠকের জন্য প্রবাসীর লেখা জীবিকার গল্প। আমার মতে, এটি লেখার গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ। প্রথমেই দেখা হলো সহব্লগার আহমেদ জী এস-এর সাথে। শুরুতেই আছে তার লেখা পরিমার্জিত একটি মুখবন্ধ, যা না পড়ে বইয়ে প্রবেশ করা হবে ভুল।
পাঁচ-সাত মিনিট লাগবে একেকটি গল্প পড়তে। প্রথম পড়ায় আমি তিনটি গল্প পড়ে ফেলেছিলাম। এর কারণ হলো, প্রথমটিতে দারুণ হোচট খেয়েছি, যার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। সেটি সামলে নেবার জন্য ব্যাক-টু-ব্যাক বাকি দু'টো পড়া! সময় করে শেষ করলাম জীবন ও জীবিকার গল্প। হোচট খাবার মতো গল্প প্রায় সবগুলোই। বিভিন্ন কারণে। পরিশ্রমী লেখা। কাল অতিক্রম করলে এটি গবেষণার বিষয় হতে পারে।
একেকটি গল্প একেকটি জীবন টুকরো। লেখক সোহানীই, কিন্তু থিমগুলো ভিন্ন ভিন্ন। বিষয়ের বিন্যাস আলাদা, কিন্তু লক্ষ্য এক - জীবন ও জীবিকা।
কিছু গল্প এদেশের; কিছু গল্প এদেশ ছাড়িয়ে - দেশান্তরের; কিছু গল্প একদমই বিদেশের। একটি অসম্ভব সুন্দর এনথোলজি, যা শুধু দেশ-পাড়ি-দেওয়া লেখকের পক্ষেই সম্ভব।
যোগাযোগ প্রচুক্তির কল্যানে পাঠক হয়তো পশ্চিমা জীবনের ধারণা পেয়েই থাকবেন, কিন্তু সেখানে জীবনের অভিজ্ঞতা না থাকলে সবই মূল্যহীন।
স্বাভাবিক ধারায় লেখা গল্পগুলো পড়ে পাঠক আমার মতো হোচট খাবেন বারবার। একটিই কারণ, সত্য বড়ই 'অনাবৃত'। জীবিকা আর জীবন পরিক্রমায় চাওয়া-না-চাওয়া বেআব্রু বিষয়গুলো সামনে আনার কাজটি লেখক করেছেন। প্রশ্ন তৈরি হবে প্রচলিত জীবন ও জীবনবোধ সম্পর্কে। বারবার মলাট উল্টিয়ে লেখককে পড়ার ইচ্ছে জাগবে পাঠকের।
আধুনিক সময়ের সবজান্তা নির্লিপ্ত পাঠক অপ্রত্যাশিতকে পেতে চায় 'প্রত্যাশিত রূপে'। সোহানীর গল্পে সাসপেন্স অনুপস্থিত, ঘটনাগুলোর পরম্পরা অনেকটাই প্রত্যাশিত। প্রতীকের ব্যবহার নেই তেমন, চরিত্র আর ঘটনাগুলো প্রায় অনাবৃত। অপ্রাসঙ্গিকতাও আছে কিছু জায়গায়। গল্পে নেই অপ্রত্যাশিত মোড়, কেউ বলেন মোচড়, ইংরেজিতে বলি টুইস্ট। এসব বিষয় আহমেদ জী এস আরো পরিষ্কার করে বলেছেন।
কিন্তু লেখার মধ্যে যত্রতত্র 'ফিগারস অভ্ স্পিচ' প্রয়োগ করার পক্ষে আমি নই। যা হোক স্বস্তির বিষয় যে, সিম্বল-সিমিলি-মেটাফরের অভাবে 'জীবন ও জীবিকার গল্প' পাঠকের মনে অতৃপ্তি জাগাতে পারে নি - এটি আমার অভিমত। গল্প তো জীবনের প্রতিচ্ছবি (তাই আমি ঠিক জানি না গল্পের জন্য ওসব প্যারামিটার কতটুকু সার্বজনীন)।
জীবন ও জীবিকার গল্পে এসেছে পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা, পৈশাচিকতা, কিশোর জীবনের দ্বন্দ্ব, পরিবার-কেন্দ্রিক নৃশংসতা, পুরুষতান্ত্রিকতা, ব্রোকেন ফেমিলির ক্যাসকেডিং প্রভাব, ক্ষণিক সুখের জন্য চিরস্থায়ি প্রতারণা, অবিশ্বাস আর আস্থাহীনতার কথা। বিষয় অনেক। কিন্তু একটি জায়গায় লেখাগুলোকে গ্রন্থ বলা যায়, সেটি হলো: পারিবারিক বন্ধন; অথবা অবন্ধন। এটি ছিলো মূল উপজীব্য। তথাকথিত উন্নত সমাজ, আধুনিক জীবন ও প্রযুক্তির সহজলভ্যতা - এসব অবসেশনে আপনার জীবনকে কতটুকু বিলিয়ে দেবেন, মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। হ্যাপি রিডিং!
-------------------------------
*ব্লগার লেখকদের লেখা নিয়ে এরকম প্রতিক্রিয়া সুযোগ পেলেই করে যাবো।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০২১ রাত ৮:৩৬