আজ ২১শে এপ্রিল সোমবার। ১৯৭১ সালের এই তারিখটিও ছিল সোমবার। এইদিন পাক হানাদার বর্বর বাহিনী কর্তৃক বৃহত্তর দক্ষিণবঙ্গের পতন ঘটে গোয়ালন্দ ঘাট দখলের মাধ্যমে। ২৬শে মার্চ থেকে এইদিন পর্যন্ত দক্ষিনবঙ্গ হানাদার মুক্ত থাকে। গোয়ালন্দ ঘাট তৎকালীন একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌবন্দর ছিল। পাকিস্তানীরা কৌশলগত কারণে এই ঘাট দখলের পাঁয়তার করতে থাকে। বিষয়টি স্থানীয় গোয়ালন্দবাসী আঁচ করতে পেরে কয়েকদিন আগ থেকেই বিশাল নদীর পাড় দিয়ে হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষ শুধু লাঠি-সোটা নিয়ে দিনরাত পাহারা দিতে থাকে। কিন্তু এদিনের পূর্বে রাতভর বৃষ্টি হয়। ক্লান্ত-অবসন্ন নিরস্ত্র মানুষ তাই ফিরে যায় রাতের বেলায়। অতি ভোরে সুযোগ বুঝে পাকিস্তানি বাহিনী প্রথমে বালুভর্তি ওয়েল ট্যাংকার পাঠায় গোয়ালন্দ ঘাটে। বিনা বাধায় এটি পৌঁছালে অতি ভোরে দানব নেমে আসে গোয়ালন্দ ঘাটে। আসা মাত্র তারা ভয়ংকর জানোয়ার হয়ে ওঠে। গুলি, আগুন, বোমা এমন কোন অস্ত্র নেই তারা ঐ দিন ব্যবহার করেনি। বাজার আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়, রাস্তা-ঘাটে নিরস্ত্র নারী-পুরুষ-শিশুকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়। গবাদি পশুও রক্ষা পায় নাই, এমনকি বড় কোন গাছ সামনে পড়লে তাও উড়িয়ে দেয়া হয়।
সবচেয়ে আক্রান্ত গ্রামের নাম বালিয়াডাঙা। অসংখ্য মানুষ হত্যার শিকার হয়, বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। শিশু ও নারী হত্যা আন্তর্জাতিক যুদ্ধ আইনে নিষিদ্ধ হলেও তারাও রক্ষা পায়নি ওদিন। মহাশশ্বান এক বিরান ভূমি পরিণত হয় বালিয়াডাঙা। বালিয়াডাঙার বালুর রঙ হয় লাল বর্ণ। এক সপ্তাহ পর্যন্ত এই গ্রামে কোন জনমানব ঢুকতে পারেনি। অসংখ্য লাশ শেয়াল কুকুরে ভাগাভাগি করে খেয়ে ফেলে।
প্রিয় পাঠক, এই গ্রামেরই এক শান্ত পরিবেশে বাস করতেন আহাম্মদ আলী মন্ডল। তিনি তার পিতাসহ একই পরিবারের সাতজন নিহত হন। হ্যাঁ, তিনি আমার জন্মদাতা। আমার মা চিরতরে মানসিক ভাসমাম্য হারিয়ে ফেলে বিনা চিকিৎসায়, অভাব-অনটনে তাঁরই কবরের পাশে ধুঁকে ধুঁকে মরণ ডাকের অপেক্ষায় আছেন এখনও। আর হ্যাঁ, তাঁর লাশ কিন্তু কয়েক দিন অক্ষত ছিল শেয়াল কুকুরের হাত থেকে। প্রিয় পোষা কুকুর নিজে তার মনিবের লাশ খায়নি, অন্য কোন শেয়াল কুকুরকেও খেতে দেয় নি। এমনকি নিজেও সম্পূর্ণ অভুক্ত অবস্থায় থেকে পাহাড়া দিয়ে রেখেছিল কয়েকদিন।
প্রিয় পাঠক, এমন কেউ আছেন এই ইতিহাস লেখার? মিডিয়ায় প্রকাশ করার? আমি একজন বন্ধু খুঁজছিলাম, যে আমার পিতৃশোক ভাগ করে নেবে।