প্রাক ইসলামী যুগের সমাজ ব্যবস্থায় “আসাবিয়্যাহ” (গোত্রবাদ) নামে একটি আদর্শ ভয়াবহ ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই আসাবিয়্যাহ হলো এমন একটা আদর্শ যেটা উগ্র জাতীয়তাবাদের সাথে অনেকাংশে মিল রাখে যেহেতু এটা গোত্র বা দলের প্রতি নিঃশর্ত ও বন্ধনহীন আনুগত্য দাবী করে।
এই উভয়ের মধ্যকার আশ্চর্যজনক মিল হলো যে, আসাবিয়্যাহ হলো গোত্রের প্রতি চুড়ান্ত আনুগত্য, আর উগ্র জাতীয়তাবাদ হলো নিজ জাতি বা দলের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্য। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, ষষ্ঠ শতাব্দীর আরবদের মূলমন্ত্র ছিল” নিজের ভাই (গোত্র সদস্য) এর পক্ষ নাও, তা সে অন্যায় করুক আর ন্যায় করুক”। বর্তমান শতাব্দীর উগ্র জাতীয়তাবাদীদের মূলমন্ত্র হলো আমার দল বা জাতি ন্যায় করুক আর অন্যায় করুক তার পক্ষ নাও।
আসাবিয়্যাহ বা উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী গোষ্ঠি, নিজেদের প্রগতিবাদী জ্ঞান করে কিন্তু তারা বাস্তবতা মানতে নারাজ। তারা নিজেদের কে আধুনিক মনে করে অথচ আধুনিক সময়ে অন্য সকল জাতি থেকে তারা বিচ্ছিন্ন। তারা নিজেদের অসম্প্রাদায়িক মনে করে কিন্তু নিজেদের দল বা জাতির বাইরে তারা কোন কিছুই চিন্তা করতে পারে না। কেউ চিন্তা করলেও তাদের কে বিভিন্ন ভাবে বাধা প্রদান করে। তারা নিজেদের মানবিক গুণ সম্পন্ন মনে করে কিন্ত তারা তাদের দল বা জাতির অন্যায় কর্মকান্ড কে নিঃশর্ত সমর্থন ও আনুগত্য করে। তারা নিজেদের কে মুক্তির দূত মনে করে কিন্তু স্বাধীনতা কে বিপন্ন করে দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের ক্রিড়ানকে পরিনত করে। তারা বাক স্বাধীনতার কথা বলে কিন্তু তাদের তোষামোদী না করলে অপবাদ দিতে কুন্ঠাবোধ করে না।
এই দেশের মানুষ এই আসাবিয়্যাহ বা উগ্র জাতীয়তাবাদ চরমভাবে প্রত্যক্ষ করেছিল ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের মাধ্যমে বিভক্ত হওয়া পশ্চিম পাকিস্থানি শাসকগোষ্ঠির কাছ থেকে। তাদের জাতীয়তাবাদ এতই বেশী উগ্র ছিল যে এই পাকিস্থানি শাসক গোষ্টি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান তথা বর্তমান বাংলাদেশের জনগণকে মানুষের মর্যাদা দিতেও নারাজ ছিল। পাকিস্থানি শাসকগোষ্টি উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শের কারনে তাদের সকল অন্যায় কে তাদের অধিকার মনে করতো। এই উগ্রতার প্রভাবে তাদের জনগণ তাদের কে চোখ বন্ধ করে সমর্থন করতো।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পরপরেই প্রথমে তারা আঘাত করতে চাইলো এই দেশের মানুষের ভাষার উপর। তারপর থেকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সবক্ষেত্রেই বৈষম্য সংস্কৃতি চালু করে এই দেশের মানুষ কে নিষ্পেষণ করা শুরু করলো। এদেশের মানুষ বারবার তাদের উগ্রতাবাদের প্রতি আন্দোলন করেছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৬ সালের নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত রায় দিয়েছিল। এই রায়কে পাকিস্থানি শাসক গোষ্ঠী অস্বীকার করে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে নিরীহ বাঙ্গালীদের উপর ঝাপিয়ে পরে। শুরু করে নির্মম হত্যাকান্ড। এর পর তাদের অসাম্য, মানবিক মর্যাদাহীন সমাজ ব্যবস্থা, অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার নিয়ে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষনা পত্রের মাধ্যমে সর্বাত্মক মুক্তিযুদ্ধের জন্য ঝাপিয়ে পরে। একটানা ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা পত্র অনুযায়ী আমাদের মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হয় নি। কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদি প্রেতাত্মা এখনো বাংলাদেশের আকাশে বিরাজ করে। পাকিস্থানি শাসকদের মতো ক্ষমতার লোভে জনগণের অধিকার কে অস্বীকার করে ছিন্নভিন্ন করা হয়েছে কষ্টার্জিত গণতন্ত্র, ভুলন্ঠিত করা হয়েছে মানুষের মানবিক মর্যাদা। সামাজিক ন্যায়বিচার সূদুর পরাহত।
আজ আমরা ভাবতে পারি, শুধু শাসক, মানচিত্র ও পতাকার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু পাকিস্থানি উগ্র জাতীয়তাবাদী শাসক গোষ্টির শাসনের পরিবর্তন হয়নি।
আমরা বাঁচতে চাই সুখে ও আনন্দে। আমাদের স্বদেশপ্রেম বিকশিত হয়ে বিশ্বপ্রেমে রূপান্তরিত হোক। আমরা নিজের দেশ এবং মানুষ কে ভালবাসতে চাই। এই সার্বজনীন ভালবাসার মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবী ও পৃথিবীর সকল মানুষ কে ভালবাসতে চাই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ন্যায় কে বলবো অন্যায় কে অন্যায় বলবো। প্রাচীন বর্বর আরবদের মতো আসাবিয়্যাহ বা গোত্রবাদ কিংবা আধুনিক সময়ের বর্বর উগ্র জাতীয়তাবাদীদের বর্জন করবো। জাগ্রত করবো বিবেক। তবেই আমাদের স্বাধীনতা স্বার্থক হবে।
পরিশেষে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলা যায়, ছোটদের বড়দের সকলের-গরীবের নিঃস্বের ফকিরের- আমার দেশ সব মানুষের।