somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইঁচড়ে পাকা ছেলেবেলা -২য় পর্ব ( ১৮ পিলাচ, বাচ্চারা দূরে থাকো )

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১২:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১ম পর্বের লিঙ্ক ইঁচড়ে পাকা ছেলেবেলা -১

বাল্যপ্রেম এবং একজন ব্যর্থ প্রেমিক পর্ব

ছোটবেলায় আমার মামা ছিল আমার কাছে মোটামুটি মহামানব সমতুল্য । আমার বাবা অবশ্য আমাদের পরিবারের সাথে থাকা তার এই একমাত্র শ্যালকটিকে মহানায়ক বলেই ডাকতেন । মামার ঘনঘন প্রেম করার কারণেই বোধকরি এই ধরণের নামকরণ । বেশ কয়েকটি প্রেমে অশেষ চেষ্টার পরও কামিয়াবি হাসিল করতে না পারার জন্য উনাকে এই খেতাব দেয়া হয়েছিল ।

পরাজয়ে ডরে না বীর । আমার মামাও না ডরিয়ে একের পর এক প্রেমে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলেন । এখন ব্যাপারটা এমন ছিল যে মামা যা করবে আমারও তাই করতে হবে । তাই আমিও হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল হয়ে উঠলাম । যে সময়ের কথা বলছি তখন আমি কেজিতে পড়ি,বয়স ছয় । মামার নাম ছিল মামুন আর উনার প্রেমিকার নাম ছিল শারমিন । তাই মামা সম্ভব অসম্ভব সব জায়গাতে M+S লিখে বেড়াতে লাগলেন ।

মামার হাতে এসিড পাতা দিয়ে M+S লিখা হল ( তখনকার দিনে প্রেম করাকে বলত ‘লাইন করা,ফিল্ডিং মারা ইত্যাদি’। আর প্রেম করতে হলে এসিড পাতা নামক একটি জিনিসের সহায়তায় নিজের হাতে প্রেমিকার নাম লেখার ব্যাপক চল ছিল তখন ) । এছাড়াও মামার সমস্ত বই,খাতা,স্কেল,ক্রিকেট ব্যাট এমনকি ক্যারম খেলার স্ট্রাইকারের ওপর M+S শোভা পেতে লাগল ।

আমি মন খারাপ করে ঘুরাঘুরি করতে লাগলাম । আমার নামের আদ্যাক্ষরের সাথে যোগ চিহ্ন দিয়ে কিছু লেখার বাসনা আমাকে দিন দিন উদাসী করে ফেলল । কার নাম লিখবো ?? আমি তো ছোট, কেউ সহজে আমার সাথে প্রেম করতে রাজি হবে না ।

অনেক ভেবে চিন্তে আমাদের ক্লাশের দিনা নামের একটা মেয়েকে খুব মনে ধরলো আমার । কি সুন্দর বেণী করে স্কুলে আসে । আবার নাম টাও বেশ সুন্দর । আমার নামের আদ্যাক্ষরের সাথে বেশ মানাবে I+D । ইয়েস,যা ভাবা তাই কাজ-একই বৃন্তে দুইটি ফুল- প্রেম কইরাছে ইউনুস নবি,তার প্রেমে জুলেখা বিবি ইত্যাদি মহান গানের বাণীতে অনুপ্রাণিত হয়ে আমার অন্তর প্রেমে একবারে ভরপুর হয়ে গেল । আমাদের বাড়ির নীল রঙের গেইটে ছোট করে I+D লিখে ফেললাম । বড় করে লিখতে সাহস পেলাম না,পাছে আবার কারো চোখে পরে যায় ।

এইবার চিন্তা শুরু করলাম কিভাবে দিনাকে প্রস্তাব দেয়া যায় । তখনকার দিনে স্কুলে টিফিনে আমরা প্লাস্টিকের টিফিন বক্সে করে রুটি,ডিম আর আলুভাজি নিয়ে যেতাম, টিফিনের পর সারা রুমে ডিম-আলুভাজির গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত । আমি চিন্তা করলাম যেহেতু আমাকে নায়কের ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে তাই অন্যদের থেকে আলাদা হতে হবে । তাই ইংরেজি কায়দা ধরলাম । তখন বাজারে ‘নসিলা’ নতুন এসেছে । আহমেদ কোম্পানির কমলালেবুর জেলি বেশ জনপ্রিয় ছিল তখন । কাজেই আমি টিফিনে রুটি-আলুভাজি বা রুটি-সুজির বদলে ব্রেড-বাটার-জেলি-নসিলা টাইপের খাবার নিয়ে যাওয়া শুরু করলাম । নতুন মডেলের পেন্সিল বক্স,স্কেল,পেন্সিল ইত্যাদি কিনলাম ।

আমার বড় চাচা কুয়েত থেকে একটা ঢাউস আকারের ক্যাসিও ঘড়ি এনেছিলেন আমার জন্য,বোতাম টিপলে ভেতরে সবুজ আলো জলত, ঘন্টায় ঘন্টায় টিট টিট করে আওয়াজ দিত, আর একটা মিনি ক্যালকুলেটরও সেট করা ছিল ঘড়ির সাথে । ঘড়িটা আমার হাতের তুলনায় বেমানান বলে আমার মা রেখে দিয়েছিলেন,বড় হলে পড়ব বলে । আমি প্রেমিকাকে মুগ্ধ করতে সেই ঘড়ি পড়ে স্কুলে যাতায়াত শুরু করলাম । স্কুলের মাঠে টিফিন পিরিয়ডে খেলার সময় অথবা ক্লাসমেটদের সাথে মারামারির সময় বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনা দেখাতে লাগলাম ।

কিন্তু হায়, এত চেস্টার পরও আমার প্রেয়সী তো আমার দিকে তাকায়ই না । সবচে সমস্যায় পড়লাম তার সখি পার্টিকে নিয়ে । তার সাথে সবসময়ই একদল সখি ঘুরাঘুরি করে । তাকে একা পাওয়াই যায় না । তাই আমিও কামিয়াবি হাসিল করতে পারছিলাম না ।

অবশেষে একদিন চিন্তা করলাম এভাবে আর চলতে দেয়া যায় না । কেজিতে পড়ি,যথেষ্ট বড় হয়েছি । জীবন থেকে ছয় ছয়টি বসন্ত চলে গেল । না,আর সহ্য করা যায় না । এবার প্রেয়সীকে বলতেই হবে আমার হৃদয়ের কথা । আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল ......। অবশেষে সু্যোগ এল । অঙ্ক মিস কি জন্য জানি ওইদিন আসেননি । পাশের ক্লাস থেকে মিস এসে আমাদের কয়েকটি অঙ্ক বোর্ডে লিখে দিয়ে চলে গেলেন । বললেন অঙ্ক গুলো করে চুপচাপ বসে থাকতে । আমি ভাবলাম এই তো তোফা সুযোগ ।

আমার দুই তিনজন বন্ধুকে নিয়ে ক্লাসের পেছন দিকে গেলাম । আমার বন্ধু আবিরের সাথে আমার প্রেয়সীর সখি রিতার বেশ ভাব ছিল । তাই প্রথমে আবির কে দিয়ে রিতাকে ডাকালাম । এরপর রিতাকে দিয়ে আমার প্রেয়সীকে । আমি মোটামুটি প্রস্তুত হয়েই ছিলাম । স্মার্টনেসের একটা ব্যাপার আছে না ?? দিনাকে ডেকে এনে তাকে সরাসরি বললাম, “ দিনা, আমি তোকে আই লাভ ইউ করি, আমি বড় হয়ে তোকে বিয়ে করব ” ।

এরপর তো বাংলা সিনেমার ফরমুলা অনু্যায়ী একটা গান হবার কথা, ফুলে ফুলে টোকাটুকি ইত্যাদি । কিন্তু আমার প্রেয়সীর মধ্যে এই সবের কোন নমুনা দেখলাম না । সে আমার দিকে বড় বড় চোখ করে অনেক্ষণ তাকিইয়ে থেকে হঠাত করে ভ্যা করে কেঁদে দিল । আর বলল আমি একটা কুত্তা,হাড় বজ্জাত আর পাজির পাঝাড়া । সে আরও হুমকি দিল যে অনতিবিলম্বে আমার এই বদমায়েশি সে টিচারকে জানাবে এবং তাকে যখন নিতে আসবে তখন তার আম্মা মানে আমার হবু শাশুড়িকে জানবে । ডাইনে বামে তাকিয়ে দেখি আমার বন্ধুবর অবস্থা বেগতিক দেখে পিঠটান দিয়েছে । কিন্তু তার সখি পার্টির কয়েকজন মারমুখো অবস্থায় যোগ দিয়েছে আমার প্রেয়সীর সাথে ।

আমি একবার মিনমিন করে বলার চেষ্টা করলাম যে, এত কান্নাকাটির কি আছে ? কিন্তু সখি পার্টির চিকন গলার সমবেত কলরবে আমার কথা চাপা পড়ে গেল । সখিরা আমার প্রতি গালিগালাজ বর্ষণ করতে করতে আমার নায়িকাকে নিয়ে বেঞ্চে বসিয়ে দিল এবং আমাকে হুমকি দিয়ে গেল যে তারা আমাকে দেখে নেবে ।

আমি বিফল মনোরথে আমার বেঞ্চে ফেরত যেতেই আমার পলাতক বন্ধু আবির এসে বলল “ আগেই কইছিলাম,এইসব মাইয়াগুলার কুনু ফিলিংস নাই,এইসব ঝামেলার মইদ্দে যাইসনা-বিচার দিলে কইলাম তোরে ইস্কুল থিকা বাইর কইরা দিব রে,তোর লগে থাইকা আমিও হালায় বিপদে পড়লাম ” । হায় আল্লাহ্‌ এ কি বিপদে পড়লাম । নির্দোষ ভালবাসার জন্য এত বড় শাস্তি—না না না,এ হতে পারে না । দম বন্ধ করে বসে থাকলাম আর মনে মনে তওবা করলাম যে জীবনে কখনও এই ভুল আর করবো না ।

এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত হলেও অত্যন্ত বেদনাদায়ক । লাইলি-মজনু করার জন্য আমাকে এক সীমাহীন দুর্ভোগ পোহানো লাগলো । এই ঘটনাটা স্কুলে এবং আমাদের এলাকায় ব্যাপক আলোড়ন তুলল । স্কুলে পড়া না পারলে বা ছোটাখাট কোন ঘাপলা করলে সবাই যেখানে পার পেয়ে যায়,সেখানে আমাকে টিচাররা দাঁত খিঁচিয়ে বলেন ‘ সারাদিন প্রেম ভালবাসা করলে তো এরকমই হবে । নাক টিপলে দুধ বেরোয়-লাইলি মজনু করা শুরু করেছে –বদমাইশ ’ ইত্যাদি ইত্যাদি ।

এলাকাবাসী বিশেষ করে আপু,ভাবি,আন্টি মহল এই ঘটনায় চরম বিনোদন পেল । আমাকে দেখলেই তারা হাসাহাসি করত । আব্বু আম্মুর কাছে আমার মান ইজ্জত আর কিছু রইল না । স্কুলে,ঘরে-বাইরে আমার জীবন পুরোপুরি দুর্বিষহ হয়ে উঠলো । আর আমার প্রেম ভালবাসার কাহিনীও সেই ছোটবেলাতেই পটল তুলল । এর পর অনেক বার অনেক সুন্দরীকে দেখে বুকের বামপাশে চিনচিন করে ব্যাথা অনুভুত হলেও সাহস করে আর কাউকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়া হয়ে ওঠেনি স্কুল বা কলেজে ।

এই ঘটনার পর আমি একমাত্র সমব্যাথী হিসেবে পেলাম প্রেমিক মামাকে । মামা পুরো ঘটনা শুনে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে গেলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন- “ভাগিনারে ,মেয়ে জাতিটাই একটা মরিচীকারে-সবই মরিচীকা ......”




সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ রাত ১:৫৮
৩১টি মন্তব্য ৩১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×