সামিরা ও তার শেষ কথা
আমি চুপচাপ বসে থাকি আজকাল। শুধু ভাবি আর ভাবি। মাথার ভেতরে চিন্তাগুলো ঘুরপাক খায়। কখনও ঘুম ভেঙ্গে উঠে বিছানাতেই বসে বসে ভাবি। প্রহর গড়ায়, খেয়াল থাকেনা আমার। কখনও বা জানালার ধারে দিগন্তে দৃষ্টি মেলে চলে যাই সুদূর অতীত ভাবনায়। কখনও বারান্দার ইজি চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকি, একা একা, চোখ বুজে নিশ্চুপ, ভাবি ফেলে আসা ৯ টি বছর। সাত পাঁচ, নয় ছয় আমার ভাবনাগুলোর কোনো মাথা নেই, মুন্ডু নেই। আমি আজকাল আর কিচ্ছু করিনা। কিচ্ছু পারিনা আমি। আমার একটাই কাজ শুধু আমার ভাবনাদের নিয়ে ভাবা। ভাবনাগুলো ছিড়ে ছিড়ে যায়। কোনোভাবেই তাদেরকে আমি এক সুতোয় আর গাঁথতে পারিনা। বিছিন্ন ভাবনায় ভাসতে থাকি আমি খড়কুটোর মত।
আমার ভাবনায় পুরোটা জুড়েই শুধু পার্থ। আমার মাথাতে আজ আর কিছুই নেই। বোধ বুদ্ধি জ্ঞান, সবই হারিয়েছি আমি। পার্থ আমাকে হারিয়ে দিয়েছে। আমার সকল আনন্দ, ভালোলাগা, ভালোবাসা এবং অভিমান ও জিদের খেলায় হেরে গেছি আমি আজ। আমি ভাবি। আমার সামনে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব একাকার হয়ে যায়। কি চেয়েছিলাম আমি আর কি হলো! আসলে দুঃখ যাদের জন্ম লিখন তাদের কখনও সুখের মুখ দেখা হয়না। বা সুখ তাদেরকে কখনও ধরা দেয় না।
পার্থ এমন করে ভেঙ্গে পড়বে বা সে ভেঙ্গে পড়তে পারে আমি স্বপ্নেও কখনও ভাবিনি। আসলে পার্থকে আমি জীবনের প্রতি উদাসীন, জগতের প্রতি হেলা ফেলায় কাটিয়ে দেওয়া এক চির সন্যাসী বালকই ভেবেছিলাম। কিন্তু জানা ছিলোনা তার দুর্বোধ্য অভিমানের বলয়রেখা। কোন গোপন তুনে সে লুকিয়ে রেখেছিলো নির্মম অদৃশ্য সেই অস্ত্র, ৯ টি বছরে কখনও বুঝিনি আমি। যে অস্ত্রে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলা যায় এক নিমেষেই যে কোনো পাথর হৃদয়। আসলে পার্থের মত করে আমার জন্য আগে কেউই কখনও এমন করে ভাবেনি। আমার কষ্টগুলোকে আমার ভালোলাগা ভালোবাসা বা আমার আনন্দগুলো যে ওর কাছে এত দামী ছিলো আমি কখনও তা বুঝিনি। নিজের ভালোলাগা বা আনন্দের কোনো মূল্য ছিলোনা তার নিজের কাছে কিন্তু আমার আনন্দগুলো, ভালোলাগাগুলোকে সে সবার আগে স্থান দিয়েছিলো। আমি নির্বোধ পার্থের জটিল মনস্তত্বের কাছে পরাজিত হয়েছি আমি।
একদিন অনেক আগে আমাদের ডিপার্টমেন্টের রন্টি এক আড্ডায় বলতে গেলে অকারনেই গায়ে পড়ে লাগতে এসেছিলো পার্থের সাথে। আমার ভীষন রাগ হয়েছিলো কিন্তু পার্থ আমাকে তাকে কিছুই বলতে দিলো না। আমাকে টেনে নিয়ে আসলো সেখান থেকে। সে এমটা করলো কেনো, তাকে আমি জিগাসা করতেই সে বললো, রন্টি তোমাকে পছন্দ করে খুব তাই আমি চাইনা যে তুমি তাকে হার্ট করো। আমার চোখ তো ছানাবড়া। বলে কি সে? আমি বললাম, আমাকে পছন্দ করে বলে তোমাকে হার্ট করে সে পার পেয়ে যাবে পার্থ? সে কিছুতেই হতে পারেনা। সে বললো, আমাকে কে কি করলো আমার কিছু যায় আসেনা। তুমি জানোনা? আমি যে এসবের উর্ধে থাকতে শিখেছি। তবে যারা তোমাকে লাইক করে আমি তাদেরকে লাইক করি সামিরা।
আর একদিন, আমি বললাম, তুমি যদি ঐ গাঞ্জাখোর ইফতির সাথে আর কোনোদিন মিশবা তো আমি তোমাকে মজা দেখাবো। সে বললো ওকে মজা দেখাও, আমি বার বার তোমার কাছে হেরে যাবো। আমি অবাক হয়ে জিগাসা করলাম, মানে কি? সে বললো তোমাকে আমি সব সময় জয়ী দেখতে চাই সামিরা। তোমার বিজয় আমার ভালো লাগে।আমি আমাকে নিয়ে ভাবি না। প্রতিযোগীতায় অংশ নেবার কোনো মানষিকতাই নেই আমার । তবে আমি তোমাকে সাকসেসফুল দেখতে চাই। তোমার প্রতিটি কাজেই। সামিরা তুমি সবখানেই জয়ী হও। সেই আমার ভালো লাগা। কবিগুরুর মত বলতে চাই, তোমার জয় যে আমারই জয়। এসব শুনে খুব হেসেছিলাম সেদিন। কিন্তু সেই পার্থই আমাকে হারিয়ে দিলো। পার্থকে আমার বলতে ইচ্ছে করে খুব, সবার কাছে তুমি আমাকে বিজয়ী করেছিলে পার্থ শুধু নিজের কাছেই হারিয়ে দিলে আমাকে। কিন্তু পার্থকে আর বলা হয় না সে কথা।
পার্থ আমাকে নিয়ে চরম উৎকন্ঠিত ছিলো। আমার এই মানষিক বৈকল্য ও স্মৃতি হারিয়ে যাবার দোলাচলের খেলায় ডক্টরের দেওয়া সেই খটমট রোগের বিভ্রান্তিতে পার্থ নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে উঠলো একটা সময়। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলোনা রোগটা আমার নিজের। তাতে তার তেমন কোনো দায় নেই। সে নিজেকে অপরাধী ভাবছিলো। ভাবছিলো সব দোষ তার। তার প্রতি আমার তীব্র ভালোবাসার ঔদাসীন্যতা,অবহেলা ও সবার উপরে সিলভিয়ার সাথে সেদিনের সেই ঘটনাটা দেখে ফেলা। সে ভেবেছিলো, এই বিশ্বাসঘাতকতাটা বুঝি আমি সহ্য করতে পারিনি আর এসব মিলিয়েই ঐ স্মৃতি হারানো রোগ এ্যলঝেইমারের জন্ম হয়েছিলো আমার মাঝে।
আসলে পার্থ জানতোনা, সে ঘুর্নাক্ষরেও সপ্নেও বুঝতে পারেনি যে আমাকে সে মাথার উপরে তুলে রেখেছিলো , যে আমাকে সে তার জীবনের সবটুকু ভালোবাসা দিয়েছিলো সেই আমি প্রতিশোধের নেশায় পাগল হয়ে উঠেছিলাম সেদিন। পার্থের যেই উদাসীন চরিত্রকে একদিন ভালোবেসেছিলাম আমি সেই উদাসীনতাই আমার কাল হলো। পার্থের উদাসীনতা, বিশ্বাসঘাতকতা আমার ভালোবাসাকে মূল্যহীন করে তুলেছে এই ভাবনাটা কুরে কুরে খাচ্ছিলো আমাকে। আমি তো পার্থকে জীবনের চাইতেও ভালোবেসেছিলাম তাহলে কেনো সেদিন পার্থ আমাকে মিথ্যে বলে সিলভিয়ার সাথে সেই বিকেলে দেখা করতে গিয়েছিলো?
এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। পার্থ এমনকি সিলভিয়াও বার বার বলতে এসেছিলো ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে। কিন্তু আমি তাদের কোনো কথা শুনিনি। আসলে আমি শুনতে চাইনি। ভুলে যাবার অভিনয় করেছিলাম। হেসে উড়িয়ে দিয়েছি যেন আমার কিচ্ছু মনে নেই। আমি একের পর এক ঘটনাগুলো ভুলে যাবার অভিনয় করেছিলাম পার্থের কাছে। আমার জন্মদিন ভুলে যাবার প্রতিশোধ নিতে, আমার পছন্দ, অপছন্দের কোনো মূল্য না দিয়ে কিছু ব্যাপারে নিজের মতামতের গুরুত্ব দেবার কারণে। আমাকে মিথ্যে বলে সিলভিয়ার সাথে সেদিন দেখা করতে গিয়ে পার্থ আমার ভালোবাসার যে চরম অপমান করেছিলো সেই প্রতিদান তাকে দিতেই হবে এমন এক ভয়ংকর নেশায় মত্ত হয়ে উঠেছিলাম আমি। কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি আমার ভালোবাসার অবমূল্যায়ন।
পার্থ ভুল করেছিলো। এমনকি সাইকিয়াট্রিস্ট জহিরুল হকের সাথেও আমি নিখুঁত অভিনয় করেছিলাম। ভুলে যাবার অভিনয়। ডক্টর থেকে শুরু করে পার্থ ও আমার আশে পাশের মানুষগুলোকে সেই বিভ্রান্তির জালে জড়িয়ে নিষ্ঠুর প্রতিশোধের ক্রুঢ় হাসি হাসতে চেয়েছিলাম আমি। আমার কখনও স্মৃতি হারাবার রোগ হয়নি। এ্যালঝেইমার অসুখটার নাম আমি শুনিনি পর্যন্ত আগে। আমি শুধু প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম। আমি জিততে চেয়েছিলাম।
কিন্তু হেরে গেলাম আমি। আমার স্মৃতি হারাবার ক্রম অধঃগতীতে বা আমার নিখুঁত অভিনয়ে পার্থের সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। আমি প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলাম বটে কিন্তু এতটা আশা করিনি। আমি পাগল হয়ে উঠেছিলাম আমার ভালোবাসার অপমানে কিন্তু আমি তো সত্যিই পার্থকে ভালোবাসি। আমি তোমার বুকের গভীরে শুধু একটু গভীরতর জায়গা করে নিতে চেয়েছিলাম পার্থ । আমি তোমাকে হারাতে চাইনি।
সেই তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে......
চিরতরে.....
না ফেরার দেশে......
সকল সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে .........
অপার শান্তির দেশে.........
আমি যখন খবরটা শুনলাম। তখন থেকেই ভাষা হারালাম আমি। এবারে কোনো নির্ভেজাল অভিনয় ছিলোনা। অনেক চেষ্টা করেও আমার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছিলো না । আমি আজও ভাষা ফিরে পাইনি। বাবা এ ক'বছরের দেশে বিদেশে অনেক বড় বড় ডক্টর দেখিয়েছেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এখন আমার দুঃখ বা কষ্টের প্রবলতর মোহনায় আমার দুচোখে ঝরে শুধু গ্লানিময় স্রোতধারা। আমি বসে থাকি তেপান্তরের মাঠে। আশা ও নিরাশায়.....
যদি কোনোদিন ফিরে আসো তুমি.....
পার্থ......
আমি অপেক্ষায় থাকবো......
তোমার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকবো পার্থ...
অনন্ত কাল..............কিংবা পরকালেও....
যদি কোনোদিন ফিরে আসো তুমি ........
আমরা গড়বো আবারও কোনো রচনা সমগ্র
কিংবা আমাদের দুঃখ বা কষ্টগুলোর অজানা উপাখ্যান......
যেমনটা কথা ছিলো .....
১১টা বছর ধরে....
গুনে গুনে ১১টা বছর......
চাষ করবো আমরা একটি পূর্নাঙ্গ বড় গল্প
কিংবা কোনো মায়াবী উপন্যাস....
হতে পারে কোনো মায়াবী জ্যোসনায়
সে গল্পের শুরু....
শেষ হবে কোথায় তার ....
জানা নেই .......
জানা নেই তার, ভূত- ভবিষ্যৎ কিংবা ভালো মন্দের...
এ অর্ধ সমাপ্ত উপন্যাসটি স্থগিত রইলো....
কিংবা এখানেই তার শেষ.....
পার্থ আর সামিরার উপাখ্যান
এখানেই শেষ কিংবা শুরুই
ছিলো না যার কোনোদিন ......
পার্থ......তুমি যেখানেই থাকো .... অনেক ভালো থেকো........
এক্সট্রা ইনহেলার সঙ্গে রাখতে কখনও ভুলো না তুমি .......
আমার এই একটা কথা অন্তত রেখো......
আর বাকী সব ভুলে যেও.......
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩৫