somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ মুখোশটাও হাসে

২৮ শে আগস্ট, ২০০৯ দুপুর ১২:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
[গল্পে ট্যাগ দেয়া লাগে কী না জানি না, তবে এটা বোধহয় ১৮+ । ]



গাড়ির সামনের কাঁচে যখন বৃষ্টি গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে, সামনের দৃশ্যগুলোকে গাড়ির ভেতর থেকে কেমন যেন অস্পষ্ট লাগে। সবই বোঝা যায়, অবয়ব আর রঙ। আর বাকী থাকল কি! তবুও, আসলে কিছু চেনা যায়না। চোখের সামনে সেরকম লাগছিল। গাছটার দিকে তাকিয়ে আছি অনেকক্ষণ। অস্পষ্ট ভাবটা কাটাতে পারছিলাম না। চোখ খুললাম আর বন্ধ করলাম অনেকক্ষণ। তবুও দৃশ্যটা পরিষ্কার হল না।

একদম হঠাৎ করে সব পরিষ্কার। নিখুঁত। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। মনে হল, চোখের মাঝে একটা আরাম খেলা করছে। চোখের পাতার উপর কেউ যেন একটা ময়ূরের পালক ভিজিয়ে সেটা দিয়ে আদর করে দিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে থাকলাম অনেকক্ষণ। আবার খুললাম। নিখুঁত ছবি সামনে। একটা আপেল গাছ। খুব সুন্দর। কিন্তু, হঠাৎ করেই মনে হল, বাংলাদেশে আপেল গাছ কেন !
বুঝতে পারি কোথাও কোন একটা সমস্যা হচ্ছে। এই বয়সেও আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে। খুব সুন্দর একটা আপেল গাছের সামনে একটা হুইল চেয়ারে আমি বসে। আমার পড়া আমাশো রঙের এপ্রন। কিন্তু, পুরো ব্যাপারটায় কোথাও ভুল আছে। আমি হতভম্ব হয়ে বসে থাকলাম। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। এটা নিশ্চয়ই স্বপ্ন।

আমি টানা ভাবছি সমস্যাটা কোথায়। কিছুক্ষণ পরে একটা হাসিখুশি মেয়ে এগিয়ে আসল। নার্সদের পোশাক পড়া। খুব উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ হোয়াট হেপেনড হানি? ইউ আর লুকিং কনফিউজড। ইজ দেয়ার এনি প্রবস ? টেল ইউর মম্মি। ” আমি বুঝতে পারলাম না, টেল ইউর মম্মি ? মানে কী ! আমি বললাম, “ আমি কোথায়? আপনি আমার মম্মি মানে কী? আপনি জানেন আপনার চেয়ে আমি বয়সে কত বড় হব? ” মেয়েটা মনে হয় আমার কথার কিছুই বুঝল না। অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে রইল। একটু পরে হঠাৎ বলে উঠল, “ ওউ মাই গড,হাউ স্ট্রেঞ্জ। হোয়াট আর ইউ টকিং এবাউট?” আমি মেয়েটার কথা পাত্তা দিলাম না। আবারও আনমনা হয়ে গেলাম। একটা স্বপ্ন, একটা ঘোরের মাঝে আছি আমি। ঘুমটা যখন শেষ হবে, তখনই আমি জেগে উঠব। তবুও কেমন যেন সন্দেহ লাগছে। সবকিছু এত বাস্তব লাগছে কেন? মানে, এই যে গাছের ছায়াটা, এই যে মেয়েটা, পেছনে ছবির মত সুন্দর একটা বিল্ডিং আরও কত কিছু। মেয়েটা উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে আছে। আমি উনাকে পরিষ্কার করে জিজ্ঞাসা করলাম, “ এম আই ফার এওয়েই ফ্রম হোম ? ” মেয়েটা হঠাৎ হেসে ফেলল। বলল, “ ওয়েইট হানি। জাস্ট আ মিনিট।” আমি এবার নিশ্চিত হলাম। এটা স্বপ্ন না। মেয়েটার চোখের ভেতর খুশি দেখছি, উৎকন্ঠা দেখছি। আমি চোখ বুজে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

ভদ্রলোক আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। বললেন, “ ক্যান ইউ রিকগনাইজ মি? ” আমি উত্তর দিলাম না। বড় বেশি ক্লান্ত লাগছে। “ হেই ম্যান, প্লিজ এনসার মি। ডু ইউ নো মি? ”, উনি আবার বললেন। আমি এবার উনার দিকে বিরক্ত চোখে তাকালাম। বললাম, “ কেন বিরক্ত করছেন ? আমি কী করে আপনাকে চিনব? ”। ভদ্রলোক মনে হল যেন খুশিই হলেন। কিছু বুঝলাম না। উনি হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে খুব ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় জবাব দিলেন। বললেন, “ হাই, আমি ডক্টর ডিলান। টুমি আমার পেশেন্ট আছ তিন আর আধা বছর ফর আ মেমোরি ডেমেইজড কেইস। টুমি ফেলেছ হারিয়ে সকল স্মৃতি তোমার। তাই টুমি আছ অস্ট্রিয়ায়, ডিলানের হসপিটালে। এখানে এসব রুগিদের নিয়ে কাজ করি। এরা নার্সদের মা ডাকে। কারণ, মেমোরি হারিয়ে টুমরা একটা হয়ে যাও একদম বাচ্চা। ” উনার ভাঙ্গা বাংলার কিছু বুঝি কিছু বুঝি না। এত বুঝার অবস্থা ছিল না। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল। বিশ্রীভাবে বমি করে ঘুমিয়ে গেলাম। নাকি এটাকে অজ্ঞান হওয়া বলে ? আমার কাছে ত মনে হল যেন ঘুমালাম।
এভাবেই শুরু আমার কাহিনী।


কিচির মিচির একটা শব্দ হচ্ছে। কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। মেজাজটা খারাপ করে জানালার বাইরে তাকালাম। পেয়ারা গাছের ফাঁক দিয়ে মিষ্টি রোদের আলো আসছে। আর আসছে শত শত না আসলে বোধহয় কোটি কোটি কাকের চিৎকার। মেজাজটা খারাপ করে কাকদের উদ্দেশ্যে একটা বাজে গালি দিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালাম। পেয়ারা গাছটা আসলেই খুব সুন্দর। পেয়ারাগুলো পেকে লাল হয়ে গেছে। যেন একটা আপেল গাছ। খুব ভেতর থেকে যেন একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে আসল। কতটা দিন, কীভাবে যে কেঁটে গেল। ডিলান’স হসপিটাল,নিউ হর্স টাউন, কেন্টাকি, আমেরিকা। শুধু এই জন্যই কি দেশে আসা ? এটুকুই কী প্রাপ্তি ছিল আমার? খুব চাই এটাও যেন একটা স্বপ্ন হয়। আমার ঘুম ভাঙ্গেনা কেন? এই বিশ্রী স্বপ্ন থেকে জেগে উঠতে চাই। খুব দরকার।

জানিনা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। পেছন থেকে খুঁট করে একটা শব্দ হল। তাকিয়ে দেখি মিলি। চাবি দিয়ে দরজার তালা খুলে ভেতরে ঢুকল। ভাবছি, এখন ত এ বাসার উপর ওর আর অধিকার নেই। ওর থেকে চাবিটা আজকেই নিয়ে নিতে হবে। ডাইনিং টেবিলের সামনের চেয়ারটায় মিলি বসল। আমার দিকে তাকিয়ে আছে, যেমনটা প্রতিদিন করে। চাবিটা চাইতে যেয়েও চাইতে পারলাম না। চাওয়ার কথা ভেবে সংকোচ হল। চেয়ে কী লাভ! ও ত আসবেই। শার্টটা পড়ে নিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে গেলাম। আজকে ভোরের মহাখালি দেখব। আনমনে হাঁটতে থাকলাম।

হঠাৎ একটা ছোট ছেলের কথায় সতবিৎ ফিরল। বলতেছিল,“ স্যার একটা টাকা দ্যান স্যার। আল্লাহর কাছে দুয়া করুম। দ্যান না স্যার”, পারলে যেন গায়ের উপর পড়ে। মেজাজটা এমন খারাপ হয়ে গেল, ইচ্ছা হল জোরে একোটা থাপ্পড় দেই। এই ফকিরের আবার আল্লাহ কী? ওর দুয়া কবুল হএ ওর এই অবস্থা থাকত? মেজাজ দেখিয়ে বললাম,“ ওই, তোর মত খুনী পাপী কোন হিসেবে টাকা চাস? থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দিব।” ছেলেটা বেশ অবাক হয়। বস্তিতে থাকে। পিচ্চি একটা ছেলে। কালো হাফপ্যান্ট আর ময়লা জিরজিরে শরীর। আমার প্রশ্নের উত্তরে বলল, “ স্যার, আমি কারে খুন করলাম? আমিত এখনও ছোড মানুষ। আমার বড় কোন দোষ নাই স্যার। ” “ বড় কোন দোষ করছ নাই, মানুষ মারছ নাই, ঘুস খাছ নাই, সন্ত্রাসী করছ নাই, তাইলে আল্লাহ তোরে গরীব বানাইল কেন? তুই আবার আল্লাহর কাছে আমার জন্য কী দুয়া করবি? ” বলে ছেলেটার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকালাম। “ ও বুঝছি, আপনি হিন্দু ”, বলেই ছেলেটা দৌড় দিয়ে পালাল। কিছু বললাম না। বাসায় ফিরে চললাম। আমার কথা ও এখন বুঝবে না। একদিন যখন বড় হবে, সেদিন হয়ত বুঝবে, যদি কথাগুলো তখনও মনে থাকে।

এই রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করা ছেলে গুলা দেখলে মনে হয় এই দেশে জন্মে কী লাভ ? কী লাভটাই বা কি আবার আমার দেশে এসে ! নিজের কথা ভেবে দিনের দ্বিতীয় দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ইদানীং এটা একটা অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। মনকে সতর্ক করলাম। কোন অভ্যাসই ভাল না।


মনে পড়ে নিজের দ্বিতীয় জীবনের জন্মের শুরুটা। একটা আপেল গাছ, মমতাময়ী নার্স মিস মারিনো আর ডঃ ডিলান। মনে পড়ে পুলিশের কাছে দেয়া একের পর এক জবানবন্দী, “আমার কিছু মনে নেই। আমি শুধু দেশে যেতে চাই। আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিন।” প্লেন ভাড়া নেই, দেশে এসে কী করব কিছুই জানি না। আমেরিকার পুলিশও ছাড়ছিল না। কত শত জিজ্ঞাসা। দেশে ডঃ ডিলানের গাড়িতে এক্সিডেন্ট করি। সমস্ত স্মৃতি হারিয়ে ফেলি। স্মৃতি হারিয়ে তখন আমি একটা বাচ্চার মত। মানুষের চেহারা ভুলে গেছি। চিনতে পারিনা। ভাষা ভুলে গেছি। কথা বলতে পারি না। ডঃ ডিলান আমার সব কিছু খুঁজে বের করেছিলেন। আমার বৃদ্ধ মা, বোন রূপা আর মিলি। সেই মিলি যাকে সে সময়ের আরও দুই বছর আগে বিয়ে করেছিলাম। খুশি ভরা জীবন, সুখের সংসার। আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ডঃ ডিলানের হাসপাতালে, অস্ট্রিয়ার সিগুডবার্গে চিকিৎসার জন্য। মিলি নাকি দেখতে এসেছিল সেখানে একবার। আমার মা যে মারা গেছেন সেটা জানাতে। জানিয়েছিল বোধহয়, বুঝিনি। ওকেও চিনি নি। আমার মা তো তখন একুশ বছর বয়েসী মিস মারিনো।

মিলির কথা ভাবতেই বুকটা মোচড় দেয়। এই মুহূর্তে বাসাতে রেখে এসেছি ভাবতে যেয়ে হঠাৎ হাসি পায়। কিন্তু সে সময় অন্য ব্যাপার ছিল। সারাদিন টেনশন হত। ফোন নাম্বারও ত জানি না। ডঃডিলানের কাছেও ছিল না। দরকার লাগলে উনি চিঠি পাঠাবেন বলে জানান। দেশে আসতে অনেক খাঁটতে হয়েছে। প্লেনের ভাড়া জোগানোর জন্য। ডঃ ডিলানের কাছেও তেমন কিছু ছিলনা। পুঁজিবাদের দেশে রোগীদের চিকিৎসা করতেন বিনা পয়সায়। আমাকেই খাঁটতে হয়। প্লেনের ভাড়াটা শুধু উঠানোর জন্য। সারাদিন পাগলের মত খাঁটতাম আর সারারাত ভাবতাম, আমি আসলে কে? ডঃ ডিলানের কাছ থেকে পাওয়া আমার পরিবারের ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, ভাবতাম এদের মনে পড়ে না কেন? পরিবারের সবাইকে অল্প অল্প মনে পড়ত। চিঠি দিয়ে জানানর মত কিছু না।

হাঁটতে হাঁটতে বাসায় এসে গেছি। ছয়তলায় উঠতে হবে এখন। ঢুকে দেখি মিলি তখনও বসে। তীক্ষ্ণ চোখে বললাম, “ বেরিয়ে যাও। লজ্জা হয় না আবার আস? ” মিলি আস্তে করে বেরিয়ে গেল। কোন কথা না বলে। আগেও এমনই করত। প্রতিদিন এসে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থেকে বেরিয়ে যেত।

মনে আছে, একদিন হঠাৎ রাতেই আবার সেই অনুভূতি। অস্পষ্ট সব দৃশ্য আর হঠাৎ করেই সব পরিষ্কার। সব মনে আসল। সব। মা, রূপা আর মিলি এবং মহাখালীর বাড়িটা। বুকে এত জোরে একটা মোচড় লাগে, আর কিছু ভাবতে পারিনি। রাত দিন খেঁটে গেছি শুধু। প্রতিদিন। প্রতিটা দিন।

মনে আছে হুট করে দেশে আসি। প্লেনে কেমন বোকার মত হাপুস হুপুস করে কাঁদছিলাম। সবাই খালি ঘুরে ঘুরে দেখছিল।। এয়ারপোর্টে নেমে উত্তেজনায় বাসার দিকে ছুটলাম। সেই যে উত্তেজনা, বুকের মাঝে প্রচণ্ড বাড়ি। বেশি করে ভাবলে সেদিনটার কথা এখনও মনে পড়ে।

এত ভোরে কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে গর্ডন বেরিয়ে আসে। অনেক পরে জেনেছিলাম ও আমেরিকার সাংবাদিক। মাঝে মাঝেই ইন্ডিয়া আর বাংলাদেশে কিছু ফিচারের কাজে আসে। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, “ হু আর ইউ ম্যান? ” তার পিছে বেড়িয়ে আসে নাইটড্রেস পড়া মিলি। এটা আমার বাসা ছিল। এখনও আমার নামে।
আমি থমকে যাই। মিলিও। অবাক হয়ে বলে, “ আমি বুঝিনি যে তুমি কোনদিন সুস্থ হবে। তুমি এত তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে আমি বুঝিনি। স্যরি।” গর্ডনকে কিছু বলিনি। মিলিকে বলেছিলাম, “ ছিঃ ।” ওরা বেড়িয়ে যায়। মিলি অনেক কেঁদেছিল। আমি কিছুটা অবাক হই সেদিন।

প্রতিদিন সকালে আসত ও। কিছু বলত না। চুপ করে বসে থাকত। আমাকে দেখত। বিরক্ত হয়ে যদি কখনও বেরিয়ে যেতে বলতাম, চুপচাপ চলে যেত। কেমন যেন মায়া লাগত। দুটো বছর একসাথে কাটিয়েছি একসময়। সিগুডবার্গে ওর কথা মনে করে কত অসহায় লাগত নিজেকে। মাঝে মাঝে অল্প এক দুই লাইন বলত। একদিন জানলাম, মার মৃত্যু সংবাদ আমাকে যেদিন জানাতে এসেছিল সেদিনই বুঝে নেয় আমি কোনদিন সুস্থ হব না। ফেরত আসার সময় ওর কান্না দেখে এগিয়ে আসে গর্ডন। সেও আসছিল বাংলাদেশে। হঠাৎ করে সব হয়ে যায়। যদিও মনে মনে চাইত ও সবসময় আমাকেই। গর্ডন এই দেশে আসত বছরে দুবার করে। তিনদিন থাকত।

এসব কথা শুনতে ইচ্ছা করে না। ব্যাখ্যাও জানতে ইচ্ছা করে না। এসব নিয়ে কাউকে কোন কথা বলিনি। একটা কথাও না। আমি যে দেশে ফিরে এসেছি কাউকে জানাইনি। কোন আত্মীয়ের কথাও মনে নেই। রূপাকে অনেক খুঁজেছিলাম। ও নাকি আমেরিকার কেন্টাকিতে। কেন যেন যোগাযোগ করিনি। যাক, একাকী অভ্যস্ত করছিলাম নিজেকে। তবুও প্রতিদিন আসত মিলি। ওর কাছে চাবি ছিল এক্সট্রা। এসে কিছু করতনা। চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকত। শুধু এটুকুই। চাবি চাইতে যেয়েও চাইনি। লজ্জা লাগত। একদিন ত আমিই দিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে ওর নিজে থেকে চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারতাম না। ওকে এক কথায় বের করে দিতাম। আসলে প্রায়ই করতাম। মিলি কান্না চেপে বের হত।

মিলির ভাই একদিন আমার কাছে এসে অনেক তোড়জোড় করে। “ আপনারা সব মূর্খ। মেয়েদের কী ভাবেন, কোলবালিশ? মুখে মুখে খালি নৈতিকতা? মনের কোন দাম নেই শুধু শরীর? খালি মূল্যবোধের ফাঁকা বুলি। যৌনতা কী এতই ফেলনা? তাহলে বিয়ে করেছিলেন কেন? চার বছর স্বামী ছাড়া থাকা এতই সোজা? প্রতিদিন আপনার এখানে আসে, ফিরে যেয়ে কাঁদে। ওর মনের দাম নেই কোন? আপনাদের মত মৌলবাদরাই দেশটাকে এত পিছিয়ে দিয়েছে। শরীরটাই সব, মন কিছু না? ওর মনে আপনার অবস্থান আপনি বুঝেন না? এক-দুইটা রাত এত বছরকে মাটি করে দিল? বিধবাদের মানুষ বিয়ে করেনা? চার বছরে যদি কেউ শুধু মাত্র শারীরিক কারণে দৈহিক মিলন করে তার দোষ কতটুকু? এখন তাকে আপনি ফেরত নেবেন না? তার মনটা দেখবেন না? ”, গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল রবিন।

কথার মাঝে কথা বলিনি একটাও। ওর কথা যখন শেষ হল, আমার রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেছে, এতগুলো দিন শান্ত ছিলাম। মিলিকেও এসব নিয়ে একটা ধমকও দেইনি। শকড ছিলাম এত। রবিনকে খুব ঠান্ডা গলায় উত্তর দেই, “ মোড়ে মোড়ে লাগিয়ে বেড়াও নাকি, নইলে বুঝনা আমি কেন ওরে তালাক দিছি? দৈহিক মিলন মানে কী বুঝ তুমি? শুধু ফুটা আর ডান্ডা? স্টুপিট কোথাকার। তোমার কী মনে হয়, গর্ডন প্রথম দিন মিলিকে কী বলেছিল? ওই মাগী তোর জামা খুল নাকি বলেছিল যে কাছে আস? ” রবিন মাথা নিচু করে ফেলল। ও বোধ হয় কিছুটা বুঝছে। আমি অতক্ষণে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি।
টানা বলতে লাগলাম, “ গর্ডনের কাছে ও যখন এগিয়ে এসেছিল তখন আমার কথা মনে হয় নি? প্রতি সন্ধ্যায় অফিস থেকে এসে জড়িয়ে ধরতাম, সেগুলো মনে পড়েনি? কাছে আসার পর গর্ডন কী বলল মনে কর ? ওই মাগী শাড়ি উঁচা নাকি ওরা ঠোটে ঠোট ঘষল? দুটো ধাপেই গর্ডনের প্রথম কথাটা যদি সত্য হয়, তাহলে সেই মেয়েকে নিয়ে আমি ব্যাবসা করতে পারি, বউ বানাতে পারিনা। শেষেরটা যদি হয়, তাহলেও কী তুমি বলবা একটা অবিশ্বস্ত দৈহিক মিলন শুধু মাত্র যৌনতা, শুধু ফুটা আর ডান্ডা? সেখানে মনের টানের, মনের আকুতির কোন স্থান নেই? গর্ডনের কোলে উঠে যখন বসেছিল খাটের উপর, পাশে রাখা আমার আর ওর ছবিটার উপর চোখ পড়েনি? মনে হয়নি আমি কেমন আছি? আমার জন্য আমার বউ দেহের কুড়কুড়ানিটা সামাল দিতে পারল না আর এখন মনের অবস্থা দেখাইতে প্রতিদিন কান্দে? বিধবাদের কথা এখানে আসে না।” টানা বলতে থাকি, “ আমার জন্য অপেক্ষা করতে না পেরে মিলি যদি গর্ডনকে বিয়ে করত, ওরা যদি একসাথে থাকত, আমি কষ্ট পেলেও মিলিকে কিছু বলতামনা। ওর উপর রাগ করতাম না। কিন্তু ও যেটা করল সেটা বেইমানী। এখন অতি আধুনিক সেজে যৌনতার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে আমাকে বুঝাতে এসনা। কয়দিন পরে চাকরীতে তিনদিন বাইরে গেলেও ত শরীরের কুড়কুড়ানিতে ফ্রি ফ্রি পড়শীদের এন্টারটেইন করবে। তখন? ” টানা বলে হাঁপাতে থাকি।
রবিন আমার কথা ধরতে পেরেছে পুরোটাই। কী জানি, ওর প্রেমিকাকে দিয়ে ভেবেছে হয়ত। ও নিজে কয়েক বছরের জন্য বাইরে থাকলে ওর প্রেমিকা শুধু যৌনতার খাতিরে গর্ডনের সাথে থাকলে ও কী করত? রবিন মাথা নিচু করে ফেলল। ওকে বললাম, “অন্য কেউ হলে গর্ডনকে খুন করে ফেলত হয়ত। কিন্তু, গর্ডনের উপর আমার কোন রাগ নেই। আমার সাথে ত ও কোন চুক্তিবধ্য ছিলনা। ছিল আমার বউ। তোমার ভাষায় যৌনতার জন্য যে অন্যের সাথে শুয়ে পড়াটাকে খারাপ চোখে দেখেনা।”

মিলি যে কখন রবিনের পিছে এসে দাঁড়িয়ে ছিল খেয়াল করিনি। মিলি হঠাৎ সামনে এসে আমাকে ঠাস একটা থাপ্পড় দেয়। ছুটে বেড়িয়ে যায়। আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি। যদিও আমি যা বলেছি, তাই বিশ্বাস করি, তবুও মিলি আছে জানলে এভাবে কখনও কথা বলতাম না।

মিলি আত্মহত্যা করে পরের দিনই। আমাকে খুন করতে চেয়েছিল রবিন।সবাই ধরে ফেলায় পারে নি। ওর সব রাগ পড়ে আমার উপর।আমার কথার জন্যই ত সব। গর্ডন আসেনি ওখানে। শান্ত মুখ পড়ে থাকা মিলির লাশটার উপর কেন যেন অনেক চেয়েও রাগ করতে পারলাম না। তাহলে হয়ত মায়াটা একটু কমত।

ফিরে আসি বাসায়। পুরোনো চাকরীটাই আবার ফিরে পেয়েছিলাম। খাটের পাশে রাখা আমার আর মিলির ছবিটার দিকে তাকাই। ও এভাবে এতদিন এসে বসে থাকত কেন? আমার চিন্তায় কী কোন ভুল ছিল? ভাবতে চাইনা এসব। হঠাৎ মনে পড়ল, মিলির শুধু এই রূপটাই ত না চার বছর আগের স্মৃতিতেও ত মিলি ছিল। দুট বছর একসাথে ছিলাম। প্রতি সন্ধ্যায় জড়িয়ে ধরতাম। সারাদিন কত গল্প কত আবদার। আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। ঘরের দরজায় মনে হল খুট করে কী একটা শব্দ হল যেন। সামনে এসে দেখি মিলি দাঁড়িয়ে। হাতে দরজার চাবি।

অবাক হইনি। মুখে বিরক্ত ভাব দেখালেও মনে মনে যেন খুশিই হলাম। ওকে বললাম, “আসছ কেন? বেরিয়ে যাও।” মিলি কোন কথা না বলে বেরিয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তখন থেকেই এই অভ্যাসটা শুরু হয়েছে। সারাটা দিন যাই-ই ভাবি ভাবনার মোড় গুলো ঘুরে শেষে এসে হতাশ হই। চিন্হ হিসেবে রেখে যাই কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস। এখন বাসায় ঢুকে নিজের কথা ভেবে দিনের তৃতীয় দীর্ঘশ্বাসটা ফেললাম। ইদানীং এটা একটা অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। মনকে আমারও সতর্ক করলাম। কোন অভ্যাসই ভাল না।

কিছুক্ষণের মধ্যে আবার অফিসে রওনা দিব। যাওয়ার আগে হঠাৎ মিলিকে দেখতে ইচ্ছা করছে।

[এইসব লেখালিখির লাইনে নতুন। ভুল ত্রুটি দেখিয়ে দিলে কৃতজ্ঞ থাকব।]
১২টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাদিকে গুলি করলো কে?

লিখেছেন নতুন নকিব, ১২ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:২৬

হাদিকে গুলি করলো কে?

ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী রাজপথের অকুতোভয় লড়াকু সৈনিক ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানুষের জীবনের চেয়ে তরকারিতে আলুর সংখ্যা গণনা বেশি জরুরি !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:১৭


বিজিবির সাবেক মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দেশবাসী একটা নতুন শব্দ শিখেছে: রুট ভেজিটেবল ডিপ্লোম্যাসি। জুলাই আন্দোলনের পর যখন সবাই ভাবছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইতিহাসের সেরা ম‍্যাটিকুলাস ডিজাইনের নির্বাচনের কর্মযজ্ঞ চলছে। দলে দলে সব সন্ত্রাসীরা যোগদান করুন‼️

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৪:৪৪



বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ব নিকৃষ্ট দখলদার দেশ পরিচালনা করছে । ২০২৪-এর পর যারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী দিয়ে দেশ পরিচালনা করছে । তাদের প্রত‍্যেকের বিচার হবে এই বাংলার মাটিতে। আর শুধুমাত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির হত্যাচেষ্টা: কার রাজনৈতিক ফায়দা সবচেয়ে বেশি?

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:১৮


হাদির হত্যাচেষ্টা আমাদের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে একটি অশনি সংকেত। জুলাই ২০২৪ আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের দ্বিধাবিভক্ত সমাজে যখন নানামুখী চক্রান্ত এবং রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অন্তর্কলহে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও আয়-উন্নতির গুরুত্বপূর্ন প্রশ্নগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি আর এমন কে

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৩


যখন আমি থাকব না কী হবে আর?
থামবে মুহূর্তকাল কিছু দুনিয়ার?
আলো-বাতাস থাকবে এখন যেমন
তুষ্ট করছে গৌরবে সকলের মন।
নদী বয়ে যাবে চিরদিনের মতন,
জোয়ার-ভাটা চলবে সময় যখন।
দিনে সূর্য, আর রাতের আকাশে চাঁদ-
জোছনা ভোলাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×