যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে উড়াল সড়ক নির্মাণে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাই ডেভলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। ৬ মাসের মধ্যে কাজ শুরুর কথা থাকলেও চুক্তির ৩ মাসের মধ্যে কাজ শুরু করতে বলা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এ সরকারের মেয়াদকালে এর নির্মাণকাজ শেষ করে ঢাকাকে যানজটমুক্ত করা হবে বলে আশা ব্যক্ত করা হয়েছে। জানা গেছে, উড়াল সড়ক পর্যায়ক্রমে ঢাকার দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ পদ্মাসেতু ও উত্তরে জয়দেবপুর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হবে।
এই উড়াল সড়ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। নির্মাণকাজ ৪২ মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মোট ব্যয়ের ৭০ শতাংশ বিনিয়োগ করবে ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি। বাকি ৩০ শতাংশ করবে বাংলাদেশ সরকার। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান আগামী ২৫ বছর এটি রক্ষণাবেক্ষণসহ পরিচালনা করবে। তারা ২১ বছর এর টোল আদায় করবে। হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শনিরআখড়া পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার লম্বা এ সড়কের নির্মাণ কাজে শ্রমিক থেকে শুরু করে ৫০ শতাংশ বাংলাদেশি নির্মাণ সামগ্রী নেয়ার শর্ত রয়েছে।
চুক্তির মেয়াদ করা হয় ২৫ বছর। এই সময় পর্যন্ত উড়াল সড়কে গাড়ি চলাচলের জন্য টোল আদায় করতে পারবে প্রতিষ্ঠানটি। তবে টোল আদায় শুরু হবে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর থেকে। প্রায় ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ উড়াল সড়কটি হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি আন্তর্জাতিক থেকে শুরু হয়ে কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, সাতরাস্তা, মগবাজার, কমলাপুর, খিলগাঁও, গোলাপবাগ হয়ে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত হবে।
প্রতিটি প্রাইভেট কার, স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিক্যাল (এসইউভি) ও মাইক্রোবাসের জন্য ১২৫ টাকা। বাসের জন্য এর দ্বিগুণ এবং ট্রাকের জন্য কারের চার থেকে ছয়গুণ হারে টোল দিতে হবে। অর্থাৎ উড়াল সেতু যানবাহনের জন্যও অতিরিক্ত খরচের কারণ হচ্ছে।
সাম্প্রতিককালে পদ্মা সেতু, উড়াল সেতু, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর ইত্যাদি পরিকল্পনা ও কর্মসূচি গ্রহণ প্রতিভাত করে যে, গরিব দেশ বলা হলেও আসলে বাংলাদেশ সরকার যে কোনো বড় অঙ্কের টাকার কাজেই হাত দিতে পারে।
যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে সরকারের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য ছিলো এদেশের ক্ষুধার্ত, গৃহহীন, বস্ত্রহীন, চিকিৎসা ও শিক্ষাহীন লোকদের জন্য এসব মৌলিক অধিকার আগে পূরণ করা।
বলাবাহুল্য, এসব উন্নয়ন কাজগুলো একনেক বৈঠকে পাস হয় বলে বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ এ সম্পর্কে কমই জানে। তারা জানে শুধু রাজস্ব বাজেটে। কিন' একনেক বৈঠকে কী করে এগার হাজার কোটি টাকার পদ্মা সেতু বাইশ হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে নির্ধারিত- এ খবর তারা রাখে না।
তারা জানে না, হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর-এর অর্ধেকেরও কম ব্যবহৃত হবার পরও আবার কেন ষাট হাজার কোটি টাকা খরচ করে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে? চট্টগ্রাম বিশাল সমুদ্র বন্দর থাকার পরও কী দরকার অতিরিক্ত ষাট হাজার কোটি টাকা খরচ করে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর করার পরিকল্পনা নেয়ার?
সাধারণ মানুষ বুঝে যানজট নিরসনে দরকার রেল ও নৌপথের উন্নয়ন। কিন' দু’চারটা ওয়াটার বাস করে তারপরে আর কোনো উদ্যোগ না নেয়ার পাশাপাশি রেলকে স্তব্ধ করে উড়াল সেতু করে যানজট কতটুকু নিরসন হবে তা মহা প্রশ্নবিদ্ধ বিষয়। কারণ, এক সময় উড়াল সেতু থেকে নিচে নামতেই হবে; এবং নামার পথে হবে আরো দীর্ঘ যানজট। অপরদিকে প্রস্তাবিত উড়াল সড়কটি হযরত শাহজালাল রহমতুল্লাহি আলাইহি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রেললাইন ঘেঁষে বনানী-মহাখালী-মগবাজার, খিলগাঁও হয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে কুতুবখালীতে গিয়ে শেষ হবে।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এইপথে উড়াল সড়ক হলে রেলওয়ের পরিকল্পনাধীন কমলাপুর ও টঙ্গীর মধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। রেলওয়ে বিষয়টি সেতু বিভাগে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে উল্লেখও করেছে।
২০০৬ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় বলা আছে, বৃহত্তর ঢাকা এলাকায় রেলওয়ের যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের বাড়তি চাহিদা মেটানোর জন্য তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন এবং কমিউটার ট্রেন চালানোর মতো রেলের জমি সংরক্ষণ করতে হবে। তাতে আরও বলা হয়, আগামী ১০০ বছরের রেলপথ সমপ্রসারণ ও ট্রান্স-এশিয়ান রেলওয়ের জন্যও প্রয়োজনীয় জমি সংরক্ষণ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার উড়াল সড়কের যে পথ ঠিক করেছে, তা ওই গেজেটের মূল বক্তব্যের পুরো বিপরীত। টঙ্গী থেকে কমলাপুর পর্যন্ত দুটি লাইন আছে। একটি দিয়ে কমলাপুর থেকে ট্রেন যায়, অপরটি দিয়ে আসে।
উড়াল সড়কের নকশা ও এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এইকম কোম্পানিকে সরকার নিয়োগ দেয়। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটিকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা দেওয়া হয়। সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটি উড়াল সড়ক নির্মাণে ব্যয়ের হিসাব ও পথের যে নকশা দিয়েছে, তা অসম্পূর্ণ। এক কোটি টাকায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট) পুনরায় নকশা ও সমীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, এই রকম পদ্মা সেতুরও নকশা তৈরি করছে।প্রকল্পের পথ ঠিক করার পর সেতু বিভাগ জায়গা বরাদ্দ দেওয়ার জন্য রেলওয়েকে একটি চিঠি দেয়। জবাবে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কোথায় কোথায় তাদের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে, তা উল্লেখ করে সেতু বিভাগকে একটি প্রতিবেদন দেয় রেলওয়ে। প্রতিবেদনটির অনুলিপি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়েও দেওয়া হয়েছে। কিন' তারপরেও কাজ হয়নি। হবে বলে আশা করাও যায় না। কারণ, দেশে আজ স্বদেশপ্রেম বলতে কিছু নেই।
উল্লেখ্য, হাদীছ শরীফ-এ ইরশাদ হয়েছে, ‘স্বদেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ।’ আর স্বদেশ প্রেম বলতে শুধু স্বদেশ ভূমির মধ্যেই নয় বরং স্বদেশের মানুষ, নদী, পাখি প্রকৃতি খনিজ সব কিছুর প্রতিই সচেতনতা ও সক্রিয় ভূমিকা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আজ আমাদের মাঝে স্বদেশ প্রেম নেই বলেই আমরা স্বদেশের সম্পদ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে লাভবান হতে পারছি না।