somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ নাৎসিদের উত্থান(শেষ পর্ব) নাটকীয় বিজয়

২০ শে অক্টোবর, ২০১২ দুপুর ২:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৩২ সালের ১০ এপ্রিল, জার্মানিতে দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম দফা নির্বাচনের মত, এতেও প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের কাছে অ্যাডলফ হিটলার পরাজিত হন। পূর্বের নির্বাচনের তুলনায় যদিও তিনি প্রায় ২০ লাখ ভোট বেশী পেয়েছিলেন, কিন্তু তবুও প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গকে হারানোর সামর্থ্য তার ছিল না।



হিটলারের পরাজয়ে তার বিরোধিরা উল্লসিত হন। তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, চ্যান্সেলর হেইনরিখ ব্রুনিং(Heinreich Bruening)। হিটলার নামক পাগলা ঘোড়াটিকে টানা দ্বিতীয়বারের মত আটকানো গেল, এই ভেবে তিনি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। তার পরবর্তী লক্ষ্য, নাৎসিদের পঙ্গু করে দেওয়া।

নাৎসি পার্টির একটি শক্তিশালী প্যারামিলিটারি শাখা ছিল। নাম S.A(Storm Abteilung, Eng: Storm Troopers)। ১৯২০ সালে, S.A প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৩২ সালের মধ্যে S.A এর সৈন্যসংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়ে যায়। ভয়ঙ্কর সত্য হল এই যে, ১৯৩২ সালে S.A এর সৈন্য সংখ্যা, জার্মান আর্মি "রাইখস্‌ওয়ের(Reichswehr)" থেকে বেশী ছিল। S.A এর এইরূপ ক্রমাগত উত্থানে অনেকেই ভীত হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে চ্যান্সেলর হেইন্রিখ ব্রুনিংও ছিলেন।

ব্রুনিং

১৯৩২ সালে বিভিন্ন মহল থেকে খবর আসতে থাকে যে, নাৎসিরা S.A এর সাহায্যে একটি সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়ে ক্ষমতা দখলের মতলব করছে। ক্ষমতা দখলের পর তারা S.A কে সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করবে। এরূপ সশস্ত্র বিপ্লব ঘটলে, দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। এই কারণে S.A কে থামানো দরকার।

তবে এটি ছিল নিতান্তই একটি গুজব। এর কোন শক্ত ভিত্তি ছিল না। কিন্তু নাৎসিদের থামাতে, চ্যান্সেলর ব্রুনিং এই গুজবকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন।

এছাড়া S.A কে থামিয়ে দিতে পারলে, হিটলারের দর্প অনেকাংশে কমে যাবে। নখ দন্তহীন নাৎসি বাঘ ব্রুনিং এর স্বপ্নের জার্মান গণতন্ত্রের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

১৯৩২ সালের ১০ এপ্রিল, নির্বাচনের দিনেই ব্রুনিং আঘাত হানেন। ওই দিনেই, তিনি S.A কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

দিনের শেষে হিটলারের কাছে দুটি খারাপ খবর আসে। একটি হল, নির্বাচনে হিন্ডেনবার্গের কাছে তার পরাজয়ের খবর। আরেকটি হল, ব্রুনিং কর্তৃক S.Aকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করার খবর।

***

S.A কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ফলে হিটলার মহা ফাঁপরে পড়েন। কিন্তু তিনি বিচলিত হননি। নাৎসিদের মধ্যে অনেকেই তাকে নিষিদ্ধঘোষিত S.A কে নিয়ে সশস্ত্র বিদ্রোহ করার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি তা আমলে নেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, নাৎসিদের জয় সময়ের ব্যপার মাত্র। সশস্ত্র বিপ্লবের মত বোকামি করে অপেক্ষার পালা দীর্ঘ করার কোনো দরকার নেই।

এই সম্পর্কে নাৎসিদের প্রোপাগান্ডা চীফ যোসেফ গোয়েবলস(Joseph Goebbels) তার ডায়েরীতে লিখেন, "ফুয়েরার সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছেন। এখন পাগলামি করার সময় নয়। আর তাছাড়া, সরকার আমাদের আর কতদিন আটকে রাখতে পারবে? ন্যাশনাল সোশিয়ালিজ্‌মের জোয়াড় একবার শুরু হয়ে গিয়েছে। তাকে আর থামানো যাবে না।"

যোসেফ গোয়েবলস

***

নাৎসিদের এই দুঃসময়ে, তাদের ত্রানকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন লেফটেন্যান্ট জেনারেল কার্ট ভন স্লাইশার(Kurt von Schleicher)। স্লাইশার ততকালীন জার্মান ডিফেন্স মিনিস্টার উইলহেম গ্রোনারের(Wilhelm Groener) অধীনে কাজ করতেন। তিনি ছিলেন মারাত্মক প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং গভীর জলের মাছ। প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের ছেলে অস্কার ভন হিন্ডেনবার্গের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্র ধরে স্বয়ং প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল।

স্লাইশার ছিলেন প্রচন্ড উচ্চাভিলাষী। কুচক্রী এই জেনারেল অনেক আগে থেকেই জার্মানির চ্যান্সেলর হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।

হিটলারের সাথে বন্ধুত্ব পাতানো ছিল তার চ্যান্সেলর হওয়ার পরিকল্পনারই একটা অংশ মাত্র।

স্লাইশার

***

নির্বাচনের অল্প কয়েকদিন পরে, হিটলারের সাথে স্লাইশারের বৈঠক হয়। সেখানে স্লাইশার তার প্রতি মিত্রতার হাত বাড়িয়ে দেন। তিনি হিটলারকে কথা দেন, যে কোনো মূল্যে S.A এর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করবেন। বিনিময়ে হিটলারকে স্লাইশারের সাথে একটি জোট সরকার গঠনের ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করতে হবে।

হিটলারের কোন উপায় ছিল না। তিনি স্লাইশারের প্রস্তাব মেনে নেন।

এরপর দুজনের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা চলে। স্লাইশার হিটলারকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, যেহেতু তারা একই পথের পথিক, সেহেতু তাদের শত্রু এক ও অভিন্ন। স্লাইশার দুজন শত্রুকে চিহ্নিত করেন। একজন হল ডিফেন্স মিনিস্টার উইলহেম গ্রোনার(Wilhelm Groener)। আরেকজন চ্যান্সেলর হেইনরিখ ব্রুনিং(Heinreich Bruening)।

স্লাইশার হিটলারকে আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, শীঘ্রই তিনি এই শত্রুদের অপসারণ করবেন। বিনিময়ে তিনি হিটলারের আনুগত্য কামনা করছেন।

****

শিয়ালের ন্যায় ধুর্ত স্লাইশার এবার তার প্রভাব খাটানো শুরু করেন। তার কূটচালের ফাঁদে পড়ে প্রথমে নিজের পদ থেকে সরে দাড়ান ডিফেন্স মিনিস্টার উইলহেম গ্রোনার(Wilhelm Groener)। ডিফেন্স মিনিস্টারকে শেষ করার পর স্লাইশার চ্যান্সেলর হেইনরিখ ব্রুনিং(Heinreich Bruening)কে ধ্বংস করার কাজে হাত দেন।

***

১৯৩০ সালে যখন ব্রুনিং চ্যান্সেলর পদে নিযুক্ত হন, তখন জার্মানি বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত ছিল। চরম বৈরী পরিস্থিতিতে তিনি দেশের হাল ধরেছিলেন। ১৯৩০ সালের ওয়াল স্ট্রীট অর্থনৈতিক ধস, জার্মান অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছিল। ব্রুনিং নিজ হাতে দেশের এই নাজুক পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন। এছাড়া ভারসাই চুক্তি অনুসারে, জার্মানিকে প্রতি বছর একটি বিরাট অঙ্কের অর্থ, ১ম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে হত। ব্রুনিং এর আমলে, এই বাৎসরিক ক্ষতিপূরণ মোটামুটি প্রদানযোগ্য পরিমানে নেমে আসে।

কিন্তু জার্মানির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলেও, ব্রুনিং জার্মান বেকারত্ব দূর করতে পারেননি। ব্রুনিং এর আমলে জার্মানিতে প্রায় ৬০লাখ মানুষ বেকার ছিলেন।

***

১৯৩০ সালে চ্যান্সেলর হওয়ার পর থেকে, ব্রুনিং অসংখ্যবার সংবিধানের ৪৮নং ধারার আশ্রয় নিয়েছিলেন। এর ফলে ব্রুনিং এর ভাবমুর্তিতে যথেষ্ট নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল। সংবিধানের ৪৮ নং ধারা অনুযায়ী, দেশের সংকট নিরসনের লক্ষ্যে, একজন চ্যান্সেলর নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে তার প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিবলে শাসন কার্য চালাতে পারবেন। নিজ বিবেচনায় বিভিন্ন আইন পাশ করার জন্যে ব্রুনিং বারবার এই ধারা জারি করতেন। এমনকি S.A এর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্যে তিনি এই ধারার আশ্রয় নিয়েছিলেন। এই ধারাকে এক প্রকার সৈরাচারতন্ত্রই বলা চলে।

***

ততকালীন জার্মানির বিভিন্ন অঞ্চলে, জমিদার প্রথা বর্তমান ছিল। চ্যান্সেলর ব্রুনিং, ব্যাঙ্ক কর্তৃক দেউলিয়া ঘোষিত জমিদার পরিবারের জমিগুলোকে বাজেয়াপ্ত করে, গরীব কৃষক শ্রেনীর মাঝে বন্টন করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে, ব্রুনিং জার্মানির অভিজাত প্রুশিয়ান শ্রেনীর চক্ষুশূল হন। তারা তাকে কমিউনিস্ট আখ্যা দেয়। অভিজাতেরা, প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের কাছে ব্রুনিং এর পদত্যাগের জন্যে ক্রমাগত চাপ দিতে থাকে।

এমনই এক সময়ে, অভিজাতদের সাহায্য করার জন্যে এবং সেই সাথে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্যে, ব্রুনিং এর বিরুদ্ধে মাঠে নামেন কার্ট ভন স্লাইশার।

স্লাইশার বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গকে বুঝাতে সক্ষম হন যে, ব্রুনিং চ্যান্সেলর হিসেবে থাকলে, জার্মানিতে কখনো শান্তি নেমে আসবে না। কেননা ব্রুনিং এর সাথে হিটলারের সাপে নেউলে সম্পর্ক। হিটলারকে শান্ত করতে হলে, ব্রুনিংকে অবশ্যই সরে যেতে হবে। তাছাড়া চ্যান্সেলর হিসেবে ব্রুনিং এর বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকান্ড তো আছেই।

অল্প কয়েকদিন পড়ে, ব্রুনিং পুনরায় ৪৮ নং ধারা জারি করার জন্যে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের অনুমতি প্রার্থনা করেন। এতে প্রেসিডেন্টের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়। তিনি অনুমতি প্রদানে অস্বীকৃতি জানান। প্রেসিডেন্টের এরূপ ব্যবহারে আহত ব্রুনিং সেই দিনেই তার পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বেরিয়ে আসেন।

ব্রুনিং এর পদত্যাগে জার্মান গণতন্ত্র আক্ষরিক অর্থেই শেষ হয়ে যায়।

***

ব্রুনিং এর পদত্যাগের পর, জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে নিযুক্ত হন ফ্রাঞ্জ ভন পাপেন নামক অভিজাত শ্রেনীর একজন লোক। এখানে বলে রাখা ভাল যে, পাপেন নিযুক্ত হয়েছিলেন স্লাইশারের সরাসরি পছন্দে। এছাড়া প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের সাথে প্রথম বৈঠকে, পাপেন তার মার্জিত ব্যবহারের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের সুনজরে আসতে সক্ষম হন।

পাপেন

এর অল্প কয়েকদিন পরে হিটলারের সাথে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের বৈঠক হয়। হিন্ডেনবার্গ হিটলারের কাছে জানতে চান যে, পাপেনকে চ্যান্সেলর হিসেবে মেনে নিতে তার কোনো আপত্তি আছে কিনা। মেনে নিলে S.A এর উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে এবং সেই সাথে নতুন চ্যান্সেলরের অধীনে জাতীয় নির্বাচন ডাকা হবে। হিটলার বিনা বাক্যব্যয়ে প্রেসিডেন্টের সব কথা মেনে নেন।

এরপরের দিন, S.A এর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয় এবং সেই সাথে সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে পুনরায় জাতীয় নির্বাচন ডাকা হয়।

***

নাৎসিদের জন্যে এটি ছিল এক বছরের মধ্যে তৃতীয় নির্বাচন। এর আগের দুটো ছিল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তাতে তারা হেরে যায়। কিন্তু ৩য় এই নির্বাচনটি হল জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্যে নাৎসিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। হিটলার দিনে ৪-৫টি স্থানে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। এবার প্রতিটি জনসভায় লাখের উপর লোক সমাগম হচ্ছিল।

কিন্তু নাৎসিদের নির্বাচনী কার্যক্রম সব ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ ছিল না। S.A এর কমান্ডার এর্‌ন্‌স্ট রোমের নেতৃত্বে, S.A বাহিনী জার্মানির রাস্তায় রাস্তায় ত্রাসের সৃষ্টি করে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ক্যাডার বাহিনীগুলোর সাথে S.A এর সৈন্যদের প্রতিদিন সংঘর্ষ হত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুনাখুনি হয়ে যেত।

S.A

রাস্তায় মিছিল করার সময়ে S.A রা গাইত,
"Blut muss fliessen, Blut muss fliessen!
Blut muss fliessen Knuppelhageldick!
Haut'se doch zusammen, haut'se doch zusammen!
Diese gotverdammte Juden Republik!"

ইংরেজিতে যার অর্থ ছিল,
"Blood must flow, blood must flow!
Blood must flow as cudgel thick as hail!
Let's smash it up, let's smash it up!
That goddamned Jewish republic!"

১৯৩২ সালের ১৯শে জুলাই, S.Aএর একটি বিশাল বাহিনী, বার্লিনের কমিউনিস্ট অধ্যুষিত এলাকায় মিছিল করে। মিছিলটি ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং উসকানিমূলক। ফলে, অবধারিতভাবে S.A এর সাথে কমিউনিস্টদের সংঘর্ষ বাঁধে। পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এই সংঘর্ষে ১৯ জন নিহত হয় এবং উভয় পক্ষের শতাধিক লোক আহত হয়। দিনটি ছিল রবিবার। ইতিহাসে এই দিন "Bloody Sunday" নামে আখ্যায়িত।

***

১৯৩২ সালের এই ৩য় নির্বাচনে, নাৎসিরা বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়। হিটলারের নাৎসি পার্টি মোট ১,৩৭,৪৫,০০০টি ভোট পায়। এটি মোট ভোটারের ৩৭%। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই যে, বিরাট জয় পেলেও তারা সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। যার কারণে হিটলারের সামনে দুটি পথ খোলা থাকে। একটি হল, দ্বিতীয় কোনো পক্ষের সাথে জোট সরকার গঠন করা। অপরটি হল, পুনরায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা।

এমতাবস্থায় হিটলার স্লাইশারের সাথে জরুরি বৈঠকে বসেন। তিনি স্লাইশারকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত কিছু দাবি পেশ করেন। তিনি বলেন যে, তিনি জোট সরকার গঠন করতে রাজি আছেন, তবে অবশ্যই তাতে তাকে চ্যান্সেলর পদ দিতে হবে। শুধু তাই নয়, ব্রুনিং আর পাপেনের মত তাকেও সংবিধানের ৪৮ নং ধারার আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এছাড়া, নাৎসিদেরকে কমপক্ষে তিনটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। সেই সাথে প্রোপ্যাগান্ডা মন্ত্রনালয় নামক একটি নতুন মন্ত্রনালয় খুলতে হবে, এবং তার দায়িত্ব দিতে হবে যোসেফ গোয়েবলসকে।

স্লাইশার হিটলারের কথা চুপচাপ শুনে যান। দাবিগুলোর ব্যপারে তিনি ভেবে দেখবেন, এই বলে তিনি বেরিয়ে আসেন।

***

হিটলার স্লাইশারের কাছ থেকে সুসংবাদ আশা করছিলেন। কিন্তু তার কাছ থেকে দুঃসংবাদ আসে। বেশ কিছুদিন পর স্লাইশার হিটলারের সাথে দেখা করেন। তার সাথে পাপেনও ছিল। স্লাইশার হিটলারকে জানান যে তারা হিটলারের প্রস্তাবগুলো ভেবে দেখেছেন। কিন্তু দেশের স্বার্থে তারা হিটলারের দাবিগুলো মেনে নিতে পারছেন না। তারা বড়জোর হিটলারকে ভাইস চ্যান্সেলর পদ প্রদান করতে পারেন।

স্লাইশারের কথায় হিটলার মারাত্মক রেগে যান। তিনি প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের কাছে নালিশ করার হুমকি দেন। কিন্তু স্লাইশার এবং পাপেন নির্লিপ্ত থাকেন। পাপেন বলে উঠেন যে, হিন্ডেনবার্গের কাছে নালিশ করতে যাওয়াটা বোকামি হবে। প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ হিটলারের উপর মারাত্মক নাখোশ। S.A এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্যে তিনি মারাত্মক রেগে আছেন।

পাপেনের এই কথায় হিটলারের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। উদ্ভ্রান্তের মত তিনি বলে উঠেন যে, তার দলকে থামানো যাবে না। প্রয়োজনে তিনি সর্বশক্তি প্রয়োগ করবেন। S.A কে লেলিয়ে দিবেন। তার দল ক্ষমতায় আসবেই।

এই ঘটনার কয়েকদিন পরে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ হিটলারকে তলব করেন। প্রেসিডেন্ট এতটাই রাগান্বিত ছিলেন যে তিনি হিটলারকে চেয়ারে বসার অনুমতি পর্যন্ত দেননি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হিটলারকে প্রেসিডেন্টের গালিগালাজ হজম করতে হয়।

প্রেসিডেন্টের কক্ষ থেকে বেরিয়ে হিটলার বলেন, "আমি শুধুমাত্র চ্যান্সেলরের পদ এবং সেই সাথে কয়েকটি মন্ত্রনালয় চেয়েছিলাম। একনায়কতন্ত্র কায়েম করতে তো আমি চাইনি।"

***

হিটলারের একরোখা নীতির কারণে, কোন জোট সরকারই গঠন করা গেল না। এ কারণে চ্যান্সেলর পাপেন পুনরায় নির্বাচন ডাক দেন।

নাৎসিদের জন্যে সেপ্টেম্বরের এই নির্বাচন ছিল এক বছরের মধ্যে টানা চতুর্থ নির্বাচন। অবসাদ তাদের অবধারিতভাবে পেয়ে বসে। এত বেশী নির্বাচনের কারণে সকলেই হাপিয়ে উঠেছিল। আগের সেই উদ্দাম উদ্দীপনা ছিল না।

এছাড়া একটি বড় সমস্যা দেখা দেয়। তা হল অর্থাভাব। এক বছরের মধ্যে এতগুলো নির্বাচনের কারণে নাৎসিদের কোষাগার শূন্য হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে, S.A এর তান্ডবের কারণে, ভোটের পরিমাণ কমে যাওয়ার আশঙ্কাও অনেকে করতে থাকেন।

নাৎসিদের প্রোপ্যাগান্ডা চীফ গোয়েবলস তার ডায়েরীতে লিখেন, "আবারো নির্বাচন! আমরা এবার নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবো.........। পরিস্থিতি সব দিক দিয়ে খারাপ। আমাদের কাছে তেমন অর্থ নেই। শিল্প গোষ্ঠীগুলোর ধৈর্যচ্যুতি হয়েছে বোধহয়। ফলে অনুদানও তেমন আসছে না।এভাবে একটা দল চালানো যায় না।"

***

নির্বাচনে এবারও নাৎসিদের হারানো গেল না। কিন্তু সবার আশঙ্কা সত্যি হল। নাৎসিরা এবার জিতেছে ঠিকই, কিন্তু অনেক কম ভোট পেয়ে। পুর্বের নির্বাচনের তুলনায় তারা প্রায় বিশ লাখ ভোট কম পেয়েছে। S.A এর আগ্রাসী কর্মকান্ড এবং নিজেদের প্রচারণার অভাবের কারণেই এমনটি হয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হল না যে, নাৎসিরা সমর্থন হারাচ্ছে। অনেকেই তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

নাৎসিদেরকে এবার জোট গঠন করতেই হবে।

***

চরম এই দুঃসময়ে, নাৎসিরা হঠাৎ অপ্রত্যাশিত সাহায্য পায়। নাৎসিদের পক্ষ নিয়ে, দেশের বড় বড় শিল্পপতিগণ হিন্ডেনবার্গের কাছে একটি পেটিশেন পাঠায়। সেখানে হিটলারকে চ্যান্সেলর পদ প্রদানের জন্যে অনুরোধ করা হয়। শিল্পপতিরা বিশ্বাস করতেন যে, হিটলার ক্ষমতায় আসার পর ব্যবসা বাণিজ্যের ভালো প্রসার ঘটাবেন। এই কারণে তারা এই কাজটি করেন।

***

জার্মানির এরূপ অচলবস্থা কাটাতে, নির্বাচনের কয়েকদিন পর প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ, পাপেন এবং স্লাইশারের সাথে বৈঠকে বসেন। সেখানে পাপেন প্রেসিডেন্টের কাছে একটি কঠিন প্রস্তাব করেন। প্রেসিডেন্টের কাছে তিনি প্রস্তাব করেন যে তাকে জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে বহাল রাখা হোক এবং সেই সাথে ৪৮নং ধারার প্রেসিডেনশিয়াল ডিক্রী তথা নিজের বিচার বুদ্ধি অনুসারে শাসনকার্য চালানোর ব্যবস্থাটি স্থায়ী করা হোক। তখন তিনি আর্মি এবং পুলিশকে ব্যবহার করে সকল গোয়ার রাজনৈতিক দলকে শেষ করে দিবেন। এবং পরে যখন দেশের অচল অবস্থা কেটে যাবে তখন তিনি শাসনক্ষমতা জার্মানির রাজ পরিবারের কাছে অর্পণ করবেন। এর ফলে দেশে এককালের জনপ্রিয় রাজতন্ত্র ফিরে আসবে।

কিন্তু স্লাইশার পাপেনের প্রস্তাব মেনে নিতে পারলেন না। উল্টো তিনি নতুন চাল চালেন। তিনি নিজেকে চ্যান্সেলর বানানোর দাবি জানান। তার কথা শুনে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ তাজ্জব বনে যান। স্লাইশার বলেন যে, নাৎসিরা নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। জোট সরকার করতে হলে তো তাদের সাথেই করতে হবে । স্লাইশার প্রেসিডেন্টকে আরও বলেন যে তিনি নাৎসিদেরকে জোটের আওতায় আনতে পারবেন। তিনি নাৎসিদের মাঝে অন্তঃকোন্দল সৃষ্টি করে তাদের দু ভাগ করে ফেলবেন। এরপর এক পক্ষের সাথে তিনি জোট গঠন করবেন।

প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ স্লাইশারের এইরূপ প্রস্তাব মেনে নেননি। তিনি পাপেনের প্রস্তাবে সম্মতি জানান।

কিন্তু ওই দিন বিকেলবেলা, কুচক্রী স্লাইশার প্রেসিডেন্টের সাথে পুনরায় দেখা করেন। তাকে চ্যান্সেলর না বানালে তার নেতৃত্বে গোটা সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করবে, এই বলে তিনি হুমকি দেন। এই হুমকিতে কাজ হয়। হিন্ডেনবার্গ তার দাবি মেনে নেন।

প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ

সেই রাতে হিন্ডেনবার্গ পুনরায় পাপেনকে তলব করেন। পাপেন বিকেলের ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। প্রেসিডেন্ট কক্ষে ঢুকে তিনি হিন্ডেনবার্গের চোখে অশ্রু দেখতে পান। প্রেসিডেন্ট পাপেনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, "প্রিয় পাপেন, আমি জানি যে আমি সিদ্ধান্ত পাল্টালে তুমি কিছু মনে করবে না। কিন্তু কি করার আছে বলো? এই বৃদ্ধ বয়সে একটা গৃহযুদ্ধ সামলানোর মত শক্তি আমার দেহে নেই।"

পাপেন তার কথা মেনে নেন। সেই সাথে, যে কোন মূল্যে স্লাইশারকে ধ্বংস করবেন বলে প্রেসিডেন্টকে তিনি কথা দেন।

পরের দিন সবাইকে অবাক করে দিয়ে কুচক্রী স্লাইশার জার্মানির চ্যান্সেলর হিসেবে শপথ নেন। চ্যান্সেলর হবার তার পরম আরাধ্য স্বপ্ন অবশেষে পূরণ হল।

***

কার্ট ভন স্লাইশার ১৯৩২ সালের ২ ডিসেম্বর চ্যান্সেলর হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গকে কথা দিয়েছিলেন যে নাৎসিদের তিনি বিভক্ত করে ফেলবেন। দেরি না করে তিনি এই কাজে নেমে পড়েন।

সেই সময় নাৎসি পার্টির second in command ছিলেন গ্রেগর স্ট্রাসার(Gregor Strasser) নামের একজন ব্যক্তি। ১৯২০ সাল থেকে তিনি নাৎসিদের সাথে ছিলেন। চমৎকার সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী এই ব্যক্তি অনেকের কাছে হিটলারের চেয়েও জনপ্রিয় ছিলেন। এছাড়া তিনি ছিলেন হিটলারের মতই চমৎকার বক্তা। অনেকেই পার্টির নেতা হিসেবে হিটলারের বদলে তাকে অধিকতর যোগ্য মনে করতেন। স্ট্রাসার হিটলারকে অপছন্দ করতেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, পার্টির স্বার্থে তিনি তাকে মান্য করতেন।

গ্রেগর স্ট্রাসার

অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, স্ট্রাসার ছিলেন প্রকৃত ন্যাশনাল সোশিয়ালিজম ভাবধারার অনুসারী। হিটলার ন্যাশনাল সোশিয়ালিস্ট হিসেবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করলেও পরে একনায়কতন্ত্রের দিকে ঝুঁকে পড়েন।

ধূর্ত স্লাইশার, স্ট্রাসার এবং তার অনুরাগীদের নাৎসিদের থেকে বিচ্যুত করার পরিকল্পনা করেন।

স্লাইশার একদিন স্ট্রাসারের সাথে গোপন বৈঠকে বসেন। তিনি স্ট্রাসারকে ভাইস চ্যান্সেলর পদ প্রস্তাব করেন। যারা যারা তার সাথে নাৎসিদের থেকে ডিফেক্ট করবে, তারাও উচ্চ পদ পাবে বলে স্লাইশার আশ্বাস দেন।

কিন্তু স্ট্রাসার কোনভাবেই স্লাইশারের প্রস্তাবে রাজি হলেন না। তিনি নাৎসিদের একান্ত অনুগত। কিন্তু তিনি স্লাইশারকে কথা দেন যে, স্লাইশারের সাথে জোট গঠনের ব্যপারে তিনি হিটলারকে উদ্বুদ্ধ করবেন।

***

স্লাইশারের সাথে স্ট্রাসারের এই গোপন বৈঠক বেশীদিন গোপন থাকল না। স্ট্রাসার হিটলারের সাথে আলাপ আলোচনা করার আগেই বৈঠকের খবর ফাঁস হয়ে যায়। উল্টো হিটলার স্ট্রাসারকে তলব করে বসেন।

সেদিন হিটলার স্ট্রাসারের সাথে চরম দুর্ব্যবহার করেন। তিনি স্ট্রাসারকে বিশ্বাসঘাতক বলে আখ্যায়িত করেন। স্ট্রাসারও কম যান না। তিনিও হিটলারকে আক্রমণ করেন। হিটলারের গোয়ার্তুমি আর স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণেই দেশে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

এরপর স্ট্রাসার হিটলারকে স্লাইশারের সাথে জোট বাঁধতে অনুরোধ করেন। স্ট্রাসারের এই কথায় হিটলার রাগে ফেটে পড়েন। চরম গালিগালাজ করেন তিনি। সব শেষে, হিটলার স্ট্রাসারকে আজীবনের জন্যে দূরে সরে যেতে বলেন। সেই রাতেই স্ট্রাসার তার পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে বেরিয়ে আসেন।

ফলে নাৎসিরা একজন সৎ ও মানবতাবাদী নেতাকে হারায়।

স্ট্রাসারের এরূপ আকস্মিক পদত্যাগে নাৎসিদের মাঝে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। সকলেই আফসোস করতে থাকেন। এমনকি হিটলার, যিনি নিজে তাকে রাগের মাথায় বের করে দিয়েছেন, তিনিও বিমর্ষ হয়ে পড়েন। অনেকে বলাবলি করতে থাকেন যে স্ট্রাসার এবার স্লাইশারের সাথে হাত মিলাবেন।

স্ট্রাসারের ব্যাপারে নাৎসিদের মাঝে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে।

কিন্তু স্ট্রাসার স্লাইশারের সাথে জোট বাঁধেননি। তিনি রাজনৈতিক জীবন থেকে ইস্তফা দিয়ে ইটালিতে ছুটি কাটাতে চলে যান।

এতে নাৎসিরা হাপ ছেড়ে বাঁচে।

অন্যদিকে, নাৎসিদের বিভক্ত করার স্লাইশারের পরিকল্পনা নস্যাৎ হয়ে যায়।

***

চলে যাওয়ার আগে স্ট্রাসার রাগে দুঃখে তার অনুরাগীদের বলে যান, "তোমরা জেনে রাখো, আজ থেকে গোটা দেশের ভাগ্য একজন মিথ্যুক "বোহেমিয়ান কর্পোরালের"(হিটলার) হাতে, একজন সমকামী বিকৃত মস্তিষ্কের অধিকারীর(S.A নেতা এর্ন্‌স্ট রোম) হাতে আর একজন খোঁড়ার(প্রোপ্যাগান্ডা চীফ যোসেফ গোয়েবলস) হাতে। এদের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে শেষের জন। সে মানুষ না, সে মানুষরূপী শয়তান।"

***

"The enemy of your enemy is your friend" এই নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে প্রতিশোধপরায়ণ পাপেন, স্লাইশারের বিরুদ্ধে নতুন চাল চালেন। স্লাইশারকে সরাতে তিনি হিটলারের দারস্থ হন।

স্লাইশার ক্ষমতা গ্রহণের ঠিক এক মাস দুই দিন পর, ১৯৩৩ সালের ৪ জানুয়ারি, পাপেন হিটলারের সাথে গোপন বৈঠক করেন। তিনি হিটলারকে জোটের প্রস্তাব দেন। এখানেও হিটলার তার পূর্বের দাবিগুলো করেন। চ্যান্সেলরশীপ আর তিনটা মন্ত্রনালয়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে পাপেন এবার হিটলারের কথায় রাজি হয়ে যান। অথচ কয়েক মাস আগের বৈঠকে, তিনি এবং স্লাইশার কেউই, হিটলারকে ভাইস চ্যান্সেলরশীপ বাদে কিছুই দিতে চাননি।

কিন্তু এই গোপন বৈঠকের কথা স্লাইশার গোয়েন্দা মারফত জেনে ফেলেন। তিনি প্রেসিডেন্টের কাছে দ্রুত অভিযোগ করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট স্লাইশারের কথায় কান না দিয়ে চুপ থাকেন। উল্টো তিনি স্লাইশারকে নাৎসিদেরকে বিভক্ত করতে না পারার জন্যে দোষী সাব্যস্ত করেন।

স্লাইশার তখন প্রেসিডেন্টকে বলেন যে নাৎসিরা পাপেনের সহায়তায় ধরাছোঁয়ার বাহিরে চলে যাচ্ছে। তাদেরকে আটকাতে তিনি প্রেসিডেন্টকে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করার অনুরোধ করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ছিলেন নির্বিকার। তিনি স্লাইশারের কথায় কান দিলেন না। প্রেসিডেন্ট তখন তাচ্ছিল্য ভরে স্লাইশারকে নাৎসিদেরকে বিভক্ত করার ব্যাপারে তার লক্ষ্য অর্জনে কাজ করে যেতে বলেন।

স্লাইশার বুঝতে পারেন যে প্রেসিডেন্ট তাকে খোঁচা দেওয়ার জন্যে এমনটি বলেছেন। তিনি জানেন যে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।

অবশেষে ক্ষমতায় আসার ৫৭ দিন পর প্রেসিডেন্টের সমর্থন হারানো স্লাইশার, ব্যর্থতার দায়ভার মাথায় নিয়ে পদত্যাগ করেন।

***

স্লাইশারের পদত্যাগের ফলে চ্যান্সেলরের পদ খালি হয়ে যায়। ২৮শে জানুয়ারি, পাপেন হিন্ডেনবার্গের কাছে যান এবং হিটলারকে চ্যান্সেলর বানানোর জন্যে অনুরোধ করেন। নিজে ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে তিনি সবসময় হিটলারের উপর চোখ রাখবেন বলে প্রেসিডেন্টকে আশ্বাস দেন।

১৯৩৩ সালের ২৯ শে জানুয়ারি, হঠাৎ করে চারিদিকে ভুয়া গুজব উঠে যে স্লাইশার আর্মিকে নিয়ে বিদ্রোহ করে ক্ষমতা দখলের পায়তারা করছে। এতে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে এবং তিনি হিটলারকে চ্যান্সেলর এবং তাকে নজরে রাখার জন্যে পাপেনকে ভাইস চ্যান্সেলর বানানোর মনস্থির করে ফেলেন।

পরের দিন তিনি নাৎসিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

***

১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি, আনুমানিক সকাল ১১টায়, অ্যাডলফ হিটলার জার্মান চ্যান্সেলর হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

দীর্ঘ ১৩ বছর সংরামের পর এই সাফল্য আসে। এরই মাঝে হিটলার ও তার দলকে পার হতে হয়েছিল অনেক বন্ধুর পথ। বন্ধুরূপে অনেকেই তাদের সাহায্য করেছিল। আবার তাদের ধ্বংস করতে অনেক বন্ধুরূপী শত্রুও দলে ভিড়েছিল।

হিটলার যখন দলের হাল ধরেন তখন দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ৫৫ জন। কোষাগার ছিল শূন্য। একেবারে শূন্য থেকে উঠে এসেছিলেন তিনি।

তবে এ কথা না বললেই নয় যে, শুধু হিটলার নন, সেই সময় নাৎসি পার্টিতে হিটলারের সমসাময়িক অনেক মেধাবী মুখের সমাগম হয়েছিল। তারা নিজেদের কাজে অবাক করা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। হিটলারের প্রতি তাদের অনুগত্য ছিল কিংবদন্তিতুল্য।

এই মেধাবী অনুসারীদের নিয়েই, হিটলার ১৯৩৩ সাল থেকে তার "স্বপ্নের থার্ড রাইখ" গড়ে তুলবার কাজে লেগে পড়েন।

ক্ষমতা গ্রহণের অপেক্ষায়। সোফায় বসা বাম থেকেঃ গোয়েরিং, হিটলার, পাপেন।

প্রেসিডেন্ট অফিস থেকে বেরিয়ে আসার পর চ্যান্সেলর হিটলারের গাড়িকে ঘিরে ধরেছেন অনুরাগী ও ভক্তের দল।
----------------------------------------------------------------------------------

শেষ।

কষ্ট করে পড়ার জন্যে সকলকেই ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
----------------------------------------------------------------------------------
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আমার লেখার লিঙ্কস
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:১০
২৭টি মন্তব্য ২৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×