somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসঃ স্বপ্নের থার্ড রাইখ(৩য় পর্ব) the night of the long knives

০৪ ঠা জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১৯৩৩ সালের ২৩শে মার্চ, হিটলার তার দীর্ঘদিনের অধরা "enabling act" আইনটি বিনা বেগে পাশ করাতে সক্ষম হন। এটি এমন এক আইন, যার মাধ্যমে জার্মানির সম্পূর্ণ সংবিধান পরিবর্তন করা যাবে। এছাড়া এর মাধ্যমে নতুন আইন পাশ এবং পুরাতন সকল আইনের পরিবর্তন এবং পরিবর্ধন করা সম্ভব। এই আইন অনুযায়ী জার্মানির সমস্ত দায় দায়িত্ব হিটলারের উপর বর্তালেও, আইনের একটি বিশেষ অনুচ্ছেদে, জার্মানির প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বলবৎ রাখার কথা বলা হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে জার্মানির প্রেসিডেন্ট ছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জার্মান সেনানায়ক মার্শাল পল ভন হিন্ডেনবার্গ। হিটলার "enabling act" এর মাধ্যমে জার্মানির সকল ক্ষমতা নিজের কাছে কুক্ষিগত করতে সক্ষম হলেও, প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ চাইলেই সামরিক আইন জারি করে হিটলারের শাসনের অবসান ঘটাতে পারবেন।

কিন্তু, প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গকে হিটলার আগেই ঠাণ্ডা করে রেখেছিলেন। রাইখস্টাগ অধিবেশন শুরু হবার দুই দিন আগে, জার্মানির পটস্‌ডাম শহরের এক চোখ ধাঁধানো অনুষ্ঠানে, হিটলার, প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গসহ জার্মানির অভিজাত শ্রেণী এবং সেই সাথে জার্মান সেনাবাহিনীর সকলেরই মন জয় করতে সক্ষম হন। পুরো বিশ্ব ঐদিন হিটলারের নতুন শক্তির সাথে, জার্মানির অতীত ঐতিহ্যের শুভ মিলন প্রত্যক্ষ করে। আর এই কারণেই দুই দিন পর, বার্লিনের ক্রল অপেরা হাউসে রাইখস্টাগের প্রথম অধিবেশনে, ক্ষমতা লাভের ব্যপারে এক আত্মবিশ্বাসী হিটলারের আগমন ঘটে।

অধিবেশনের শুরুতেই নাৎসিদের পক্ষ থেকে, "enabling act" পাশের জন্যে সাংসদদের ভোট গ্রহণের দাবি উঠে। কিন্তু ভোট গ্রহণের আগেই জার্মানির "সোশিয়াল ডেমোক্র্যাট" দলের নেতা প্রতিবাদ করে উঠেন। তিনি সাহসী কন্ঠে বলে উঠেন, "এই ঐতিহাসিক মুহুর্তে আমরা জার্মান সোশিয়াল ডেমোক্রেটগণ, নিজেদেরকে মানবতা, মুক্তি , ন্যায়বিচার এবং সমাজতন্ত্রের জন্যে সঁপে দিচ্ছি। কোনো "enabling act"ই আমাদের চিন্তাধারা এবং আদর্শকে ধ্বংস করতে পারবে না। কেননা এগুলো চিরস্থায়ী, অবিনশ্বর।"

এর জবাবে রাগান্বিত হিটলার বজ্রকন্ঠে বলে উঠেন, "শেষ পর্যন্ত তোমরা এসেছ! কিন্তু হায় বড় দেড়ি করে ফেলেছ তোমরা। জার্মানির কাছে তোমাদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। তোমাদের কোনো দরকার নেই। তোমাদের বিদায় ঘন্টা বাজছে। কোনো দরকার নেই তোমাদের ভোটের। জার্মানি মুক্তি লাভ করবে, কিন্তু তোমাদের মাধ্যমে নয়।"

হিটলার কথা শেষ করার সাথে সাথে, আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে, ভবনের বাহির থেকে হিটলারকে ক্ষমতা প্রদানের জন্যে অগণিত S.A সৈন্য চিৎকার করে উঠে, "Full power or else....." "Full power or else....."

বাহিরে S.A সৈন্যদের গগনবিদারী শ্লোগানের মাঝেই ভোট গ্রহণ শুরু হয়। দেখা গেল যে, হিটলারকে "enabling act" প্রদানের পক্ষে ভোট পড়েছে ৪৪১টি, অপর দিকে বিপক্ষে ভোট পড়েছে ৮২টি(সবগুলো সোশিয়াল ডেমোক্রেটদের ভোট)। কিন্তু এতে কিছু যায় আসে না। পার্লামেন্টের দুই তৃতীয়াংশ সদস্য "enabling act" এর পক্ষে ভোট দিয়ে ফেলেছেন। তারা স্পষ্টতই হিটলারকে সর্বাধিনায়করূপে দেখতে চান। আর এভাবেই ১৯৩৩ সালের ২৩ মার্চ, হিটলারের হাতে জার্মানির ভাগ্য সঁপে দেওয়া হয়।

****

১৯৩৩ সালের ২৩ শে মার্চ, "enabling act" লাভের পর হিটলার বিদ্যুৎ গতিতে তার শত্রু নিধন করা শুরু করেন। তাকে আটকানোর সাধ্য কারো ছিল না। হিটলার "enabling act" লাভ করেছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাংসদদের ভোটে। এই কারণে তিনি ভোট গ্রহণের আগে এসব রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার আশ্বাস প্রদান করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে "enabling act" লাভের পর, তিনি তাদের ধ্বংস করার কাজে হাত দেন। শত্রু নিধনের পরিকল্পনা হিসেবে একের পর এক রাজনৈতিক দলকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। তাও খুব অল্প সময়ের মধ্যে। যেখানে যে অবস্থায় পাওয়া যায়, সেই অবস্থাতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের ঠাই হয় কারাগারে নতুবা নব্য নির্মিত কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে। এই ধরপাকড় অবস্থা কয়েক মাস ধরে চলতে থাকে। এরপর দেখা গেল যে, এক ন্যাশনাল সোশিয়ালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি(নাৎসি পার্টি) বাদে জার্মানিতে আর কোনো রাজনৈতিক দল নেই। তখন ফুয়েরারের পক্ষ থেকে নতুন আইন জারি করা হয়।

"ন্যাশনাল সোশিয়ালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি(নাৎসি পার্টি)ই হল জার্মানির একমাত্র বৈধ রাজনৈতিক দল। কোনো ধরণের রাজনৈতিক দল গঠন এবং রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হবে।.............. আজ থেকে গোটা জার্মানি ন্যাশনাল সোশিয়ালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টি(নাৎসি পার্টি)কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে.........."

এই নতুন আইন জারির মাধ্যমে হিটলার জার্মানির সর্বেসর্বা বনে যান। কিন্তু তিনি ক্ষমতা কুক্ষিগত করেই বসে থাকেননি। অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উদ্ধারের কাজে ঝাপিয়ে পড়েন তিনি। জনগণের কাছে বেকারত্ব নির্মুলের ওয়াদা তিনি করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির করা হয়। সেই সাথে গোটা জার্মানিজুড়ে অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা(Autobahn network) গড়ে তোলার কাজ হাতে নেওয়া হয়।

****

"enabling act" লাভের পর থেকে, ১৯৩৩ সালের বাকি সময়টুকু হিটলারের জন্যে ঝামেলাবিহীন ভাবে কেটে যায়। কিন্তু ১৯৩৪ সাল নতুন সমস্যা নিয়ে আবির্ভূত হয়। আর এই সমস্যা সৃষ্টি করে তার অতি প্রিয় S.A বাহিনী। S.A বাহিনীর নেতা ছিলেন এর্ন্‌স্ট রোহ্‌ম(Ernst Rohm)। তিনি ছিলেন হিটলারের খুব কাছের বন্ধু এবং হিটলারের মতই ১ম বিশ্বযুদ্ধের এক পোর খাওয়া সেনা। আজীবন হিটলারের আজ্ঞাবহ রোহ্‌ম হিটলারেরও আগে নাৎসি পার্টিতে যোগদান করেছিলেন। ১৯২০ সালে, তিনি যখন S.A এর হাল ধরেন তখন এর সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ২০০। কিন্তু ১৯৩৪ সালে S.A এর সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সদস্য সংখ্যা ২৫ লাখে গিয়ে ঠেকে।

এর্ন্‌স্ট রোহ্‌ম

হিটলারের উত্থানে S.A এর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। হিটলার কাজ করতেন মঞ্চে, বৈঠকে, সেমিনারে। কিন্তু হিটলারের হয়ে রাস্তার সমস্ত নোংড়া কাজগুলো করত S.A বাহিনী। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ক্যাডার বাহিনীকে শায়েস্তা করা, গুপ্ত হত্যার মাধ্যমে শত্রু নিধন করা , প্রয়োজনে জনগণের মনে ত্রাস সৃষ্টি করা, আবার নির্বাচনের সময় ভোট আদায়ের জন্যে দুর্বার প্রচারনা চালানো, এমন কোন কাজ নেই যা S.A রা করেনি। আর এসব কিছুই তারা করেছে শুধুমাত্র তাদের ফুয়েরারের জন্যে তাদের প্রিয় নেতা এর্ন্‌স্ট রোহ্‌মের নির্দেশে।

কিন্তু ১৯৩৪ সালে S.A এর প্রয়োজন ফুরিয়ে এল। ততদিনে হিটলার জার্মানির অবিসংবাদিত নেতা বনে গেছেন। দেশের অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলকে দমন করা গেছে। রাস্তায় S.A এর কোনো প্রতিপক্ষও নেই। এছাড়া, ইতিমধ্যে গোপন জার্মান এলিট পুলিশ বাহিনী "দ্য গেস্টাপো(Gestapo)" গঠন করা হয়ে গিয়েছে। অন্য দিকে হিটলারের সিকিরিউটি বাহিনীর দায়িত্বে আছে S.Aএরই আরেকটি শাখা The S.S।

"এমন একদিন আসবে যেদিন নাৎসিদের কাছে S.A এর আর কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।" এই কথাটি S.A প্রধান এর্ন্‌স্ট রোহ্‌ম ভালো করে জানতেন। এই কারণে, ১৯৩২ সালে, অর্থাৎ হিটলারের ক্ষমতা গ্রহণের অনেক আগে থেকেই, রোহ্‌ম হিটলারকে ক্ষমতা লাভের পর S.Aকে জার্মান সেনাবাহিনী স্থলাভিষিক্ত করার অনুরোধ করে আসছিলেন। ফরাসি রাজা নেপোলিয়ন ক্ষমতা গ্রহণের পর তার নিজস্ব বাহিনীকে ফরাসি বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত করেন। রোহ্‌মও ঠিক তাই করতে চান।

তৎকালীন সময়ে, জার্মানির এককালীন ভীতি জাগানিয়া সেনাবাহিনীর অবস্থা ছিল বেশ নাজুক। অন্যায় ভার্সাই চুক্তির কারণে সৈন্য সংখ্যা এক লাখের বেশী রাখা যাবে না। অথচ সেই সময় আমেরিকা, রাশিয়া এবং ব্রিটেনের দমকল বাহিনীর সদস্য সংখ্যা এক লাখের বেশী ছিল। কিন্তু হিটলারের রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই লক্ষ্য ছিল, অন্যায় ভার্সাই চুক্তিকে অগ্রাহ্য করে জার্মান আর্মিকে সম্প্রসারিত করা এবং সেই সাথে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করা। কিন্তু S.A এর দাবি মানলে জার্মান আর্মিকে ভেঙ্গে দিতে হবে। আর জার্মান আর্মিকে ভাঙলে নিঃসন্দেহে সমস্ত ঝড় ঝাপটা হিটলারের উপর দিয়েই যে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হিটলার যদি S.Aকে খুশি করতে গিয়ে আর্মিকে ধ্বংস করেন, তাহলে তিনি আর্মির পাশাপাশি জার্মানির কয়েকশ বছরের ঐতিহ্যকেও ধ্বংস করবেন। কেননা আর্মির জেনারেল স্টাফে এমন অনেক হর্তা কর্তা ছিলেন যাদের পূর্বপুরুষরা কয়েক শত বছর ধরে আর্মির সাথে সম্পর্কিত ছিলেন। এছাড়া আর্মিকে ধ্বংস করলে অবধারিতভাবে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গ মারাত্মক নাখোশ হবেন। আর তখন যদি তিনি আর্মিকে বাঁচানোর জন্যে মার্শাল ল জারি করে দেন তাহলে সব শেষ।

কিন্তু এদিক দিয়ে চিরবিশ্বাসী রোহ্‌মকেও হিটলার না করতে পারছিলেন না। তিনি মারাত্মক দোটানায় পড়ে যান।

****

১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, হিটলার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। ফেব্রুয়ারীর শেষ দিকে তিনি, রোহ্‌ম এবং ফিল্ড মার্শাল ভার্নার ভন ব্লমবার্গ, যিনি একাধারে জার্মানির ডিফেন্স মিনিস্টার এবং জার্মান আর্মির সর্বাধিনায়ক ছিলেন, তার সাথে একটি বৈঠকে বসেন। সেখানে তিনি রোহ্‌মকে সাফ জানিয়ে দেন যে, S.A কে কখনোই সামরিক বাহিনীর স্থলাভিষিক্ত করা হবে না।

রোহ্‌ম হিটলারের সাথে বিরোধিতা না করে তার কথা চুপচাপ শুনে যান, এমন কি ব্লমবার্গের সাথে একটি মধ্যস্থতা স্থাপনকারী চুক্তিতেও স্বাক্ষর করেন। কিন্তু হিটলার এবং ব্লমবার্গ প্রস্থানের পরপরই তার আসল রূপ বেরিয়ে পড়ে। তিনি রাগে ফেটে পড়েন। রোহ্‌ম তার ডেপুটিকে বলেন, "ঐ বেকুব বোহেমিয়ান কর্পোরালের(হিটলার) বলা কথাতে আমাদের কিছুই যায় আসে না। অনেক হয়েছে, আর নয়। এই চুক্তির শর্তগুলো মানার ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাটুকু নেই। হিটলার একজন বিশ্বাসঘাতক। ঐ বেকুবটা যদি আমাদের সাথে থাকে তাহলে ভালোই। কিন্তু সে যদি আমাদের সাথে না থাকে তাহলে তাকে ছাড়াই আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌছুবো।"

রোহ্‌মের এই মন্তব্য কিন্তু গোপন থাকেনি। S.A এর শাখা S.S, যা হিটলারের বডিগার্ড বাহিনী হিসেবে কাজ করত, তার প্রধান হাইনরিখ হিমলারের কাছে রোহ্‌মের পাগলামির খবর চলে আসে। হিমলার রোহ্‌মের অধীনে কাজ করলেও, তিনি গোপনে গোপনে রোহ্‌মের প্রতি শত্রুতা পোষণ করতেন। এখানে বলে রাখা ভালো যে, রোহ্‌ম ২৫ লাখ সৈন্যের একটি বিশাল বাহিনী পরিচালনা করতেন। অনেকেই এই কারণে তাকে ঈর্ষা করতেন। এছাড়া সিনিয়র নাৎসি হিসেবে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা তো ছিলই। যার কারনে তার শত্রুর অভাব ছিল না। কিন্তু এত দিন হিটলারের ছায়াতলে থাকা রোহ্‌মের সাথে শত্রুতা করার সাহস কেউ পেত না। কিন্তু রোহ্‌মের সাথে হিটলারের সম্পর্কের অবনতি হওয়াতে, তার শত্রুরা পুনরায় তার বিরুদ্ধে একজোট হয়ে নামে।

রোহ্‌মের সবচেয়ে বড় দুজন শত্রু হলেন S.S প্রধান হাইনরিখ হিমলার(heinrich himmler) এবং হেরমান গোয়েরিং। তৎকালীন সময়ে গোয়েরিং একাধারে জার্মানির বিমান মন্ত্রী এবং প্রাশিয়া অঞ্চলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। রোহ্‌মকে ধ্বংস করার জন্যে, তারা রোহ্‌মের ব্যাপারে হিটলারের মন বিষিয়ে তুলতে শুরু করেন।

হাইনরিখ হিমলার।

হেরমান গোয়েরিং

এর ফলশ্রুতিতে, ১৯৩৪ সালের ৪ জুন, হিটলার রোহ্‌মের সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন। বৈঠকটি ৫ ঘন্টা স্থায়ী ছিল। হিটলারের অনুরোধে রোহ্‌ম ঘোষণা দেন যে, তিনি "ব্যক্তিগত অসুস্থতা" কারণ দেখিয়ে এক মাসের জন্যে ছুটিতে মিউনিখ যাচ্ছেন। কিন্তু যাওয়ার আগে, রোহ্‌ম, হিটলারকে জুনের ৩০ তারিখ পুনরায় তার সাথে বৈঠকে বসার জন্যে অনুরোধ করেন। ৩০ তারিখ ঠিকই হিটলার রোহ্‌মের সাথে দেখা করেন। আর ঐ দিনটিই ছিল রোহ্‌মের জীবনের শেষ দিন।

****

৫ জুন রোহ্‌ম ছুটিতে চলে যান। কিন্তু এদিকে ঘোলাটে পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করার জন্যে হিটলারের ভাইস চ্যান্সেলর ফ্রাঞ্জ ভন পাপেন, একটি কান্ড করে বসেন। হিটলার যে সরকার গঠন করেছিলেন, তা ছিল ন্যাশনালিস্ট পার্টির সাথে গঠিত একটি কোয়ালিশন সরকার। পাপেন ছিলেন ন্যাশনালিস্ট দলের নেতা। "Enabling Act" পাওয়ার পরে হিটলার ন্যাশনালিস্ট দলকে পুরো নিশ্চিহ্ন করে দিলেও পাপেনকে ভাইস চ্যান্সেলর পদে বলবৎ রাখেন। কেননা পাপেনের সাথে প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের দহরম মহরম ছিল। হিটলারের ক্ষমতায় আসবার ক্ষেত্রে পাপেনের যথেষ্ট ভূমিকা থাকলেও, পরবর্তীতে হিটলারের দমন নীতির কারণে, তিনি হিটলারকে অপছন্দ করা শুরু করেন।

১৯৩৪ সালের জুনের ১৭তারিখ, পাপেন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে, কঠোর ভাষায় নাৎসি সরকারের কঠোর দমন নীতি এবং বাঁক স্বাধীনতার উপর নিষেধাজ্ঞার নিন্দা জানান। সেই সাথে S.A কে ঘিরে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তার দ্রুত এবং কার্যকরী সমাধানের দাবি জানান তিনি।

পাপেনের এই বক্তৃতা সেনাবাহিনীকে তীব্রভাবে নাড়া দেয়। চারিদিকে একটি চাপা অস্থিরতা বিরাজ করতে শুরু করে। এমতাবস্থায় ১৯৩৪ সালের ২১ জুন, হিটলার প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গের সাথে দেখা করেন। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে হিটলারের সাথে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক ভার্নার ভন ব্লমবার্গের দেখা হয়। সর্বাধিনায়ক হিটলারকে পছন্দ করতেন এবং সর্বদা আনুগত্যের সুরে কথা বলতেন। কিন্তু সেদিন তিনি ছিলেন মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর এবং মেজাজী। প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গও হিটলারকে একটি শীতল অভ্যর্থনা জানান। তিনি সাফ জানিয়ে দেন যে, যদি হিটলার S.A এর সাথে এই বিরোধে, সেনাবাহিনীর পক্ষ না নেন তবে তিনি সেনাবাহিনীকে বাঁচাতে মার্শাল ল জারি করে দিবেন। এতে নিঃসন্দেহে জার্মানিতে নাৎসি শাসনের ইতি ঘটবে।

****

প্রেসিডেন্টের সাথে বৈঠকের পর থেকে হিটলার মাত্রাতিরিক্ত বিমর্ষ হয়ে পড়েন। S.A কে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত তিনি কোনোভাবেই নিতে পারছিলেন না। অপর দিকে গোয়েরিং এবং হিমলার উভয়েই S.Aকে ধ্বংস করার জন্যে হিটলারকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা বলতে লাগলেন যে রোহ্‌ম ছুটিতে গেলেও আসলে গোপনে গোপনে হিটলারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা করছেন। হিটলারকে সরিয়ে রোহ্‌মই জার্মানির সিংহাসনে বসবেন। তাকে অনতিবিলম্বে শেষ করা দরকার। কিন্তু হিটলার তাদের কথা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।

****

ইতিমধ্যে ১৯৩৪ সালের জুনের ২৮ তারিখ, হিটলারের কাছে হিমলার থেকে ফোন আসে। ফোনে হিমলার হিটলারকে বলেন যে, হিটলারের কাছে এটাই সিদ্ধান্ত গ্রহণের শেষ সুযোগ। কেননা গোপন গোয়েন্দা তথ্য মতে(মিথ্যা কথা), হিমলারের কাছে খবর এসেছে যে, S.Aরা দুই একদিনের মধ্যে সামরিক ব্রিদ্রোহ করবে। শুধু তাই নয়, হিটলারকে তিনি আরো জানান যে, প্রেসিডেন্ট হিন্ডেনবার্গও আর্মির চাপে পরিস্থিতির অবনতি সাপেক্ষে, কয়েকদিনের মধ্যেই মার্শাল ল জারি করে দিতে পারেন। হিমলারের কথাই হিটলার মারাত্মক দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। তিনি সর্বস্ব হারানোর আশঙ্কা করতে থাকেন। এই তীব্র চাপ সইতে না পেরে হিটলার, S.S বাহিনীকে প্রস্তুত করার জন্যে হিমলারকে নির্দেশ দেন।

ফিল্ড মারশাল ব্লমবার্গ।

১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তোলা ছবি। ছবিতে একজন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হিটলারকে দেখা যাচ্ছে। ডানে সর্বাধিনায়ক ব্লমবার্গ এবং বামে হিটলারের আমৃত্যু অনুগত প্রোপাগান্ডা মিনিস্টার গোয়েবলস। ১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রোহ্‌মকে নিয়ে পরিস্থিতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল।

****

এর একদিন পর, অর্থাৎ ১৯৩৪ সালের ৩০শে জুন রাত ২টায় হিমলারের কাছ থেকে হিটলার আবারো ফোন পান। এবার হিমলার জানান যে, S.Aসৈন্যরা বিদ্রোহের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা বিদ্রোহ করবে। ফোনের অপর পাশে হিটলার নিশ্চুপ দাড়িয়ে থাকেন। তিনি বুঝতে পারলেন, যা করতে হবে তা আজ রাত থেকেই করা শুরু করতে হবে। যদি বিদ্রোহের ঘটনা সত্য হয়, হিটলার সিদ্ধান্ত নিলেন, তবে রহ্‌মের কপালে মৃত্যু লেখা আছে। আর এই সিদ্ধান্ত থেকে "The night of the long knives" নামটির উৎপত্তি। হিমলারের সাথে ফোনালাপের পর, হিটলার সাথে সাথে বেড়িয়ে পড়েন এবং আকাশ পথে মিউনিখের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।

সকাল ৬টায় হিটলার মিউনিখে পৌঁছান। তার আগমনের কিছুক্ষণ পরেই, মিউনিখের গভর্নর তাকে S.Aএর বিদ্রোহের খবর জানান(মিথ্যা কথা। গভর্নর এই কাজটি হিমলার এবং গোয়েরিং এর মদদপুস্ট হয়ে করেছিলেন।) বিদ্রোহের খবর শুনে হিটলার মারাত্মক রেগে যান। তিনি সাথে সাথে হিমলার এবং তার বাহিনীকে নিয়ে মিউনিখে ছুটিতে থাকা রোহ্‌মকে পাকড়াও করতে যান।

****

হিটলার সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে রোহ্‌মের হোটেলে পৌছান। তিনি রোহ্‌মের রুমের দরজায় ভয়ঙ্কর ভাবে আঘাত করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে একজন ঘুমন্ত এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অনবগত রোহ্‌ম বেড়িয়ে আসেন। বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই তাকে দেশদ্রোহিতার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়। সেদিন হোটেলে ৭ জন S.Aনেতা অবস্থান করছিলেন। রোহ্‌মসহ ৬ জন কে কারাগারে পাঠানো হয়। একজনকে হোটেলেই খুন করা হয়। অন্য ৬ জন S.A নেতাকে হোটেলে নিজ নিজ কক্ষে একাকী পাওয়া গেলেও, ঐ S.A নেতাকে একজন পুরুষ পতিতার সাথে বিছানায় পাওয়া যায়। নেতাটির এই অবস্থা দেখে হিটলার পুরোপুরি রাগে ফেটে পড়েন। তার এমন ভয়াল মূর্তি আগে কখনো কেউ দেখেনি। তিনি ততখানৎ নেতাটিকে হত্যা করার নির্দেশ দেন।

উল্লেখ্য, রোহ্‌মসহ S.A বাহিনীর অধিকাংশ নেতা সমকামী ছিলেন। হিটলার শুধুমাত্র ইহুদীদের অপছন্দ করতেন না। তিনি সমকামী এবং জিপসিদেরও অপছন্দ করতেন। এই কারণে তিনি নির্বিচারে শুধুমাত্র ইহুদী নিধনই করেননি, বরঞ্চ সমকামী এবং জিপসিরাও তার টার্গেটে ছিল।

এখন প্রশ্ন হল, সমকামী হওয়া সত্ত্বেও রোহ্‌ম এবং অন্যান্য S.A নেতাদের হিটলার কেনই বা নিয়োগ দিয়েছিলেন। হিটলার মূলত এটি করেছিলেন সেসব সমকামীদের কর্মক্ষমতার কারণে। যেহেতু, হিটলারের কাছে এক সময়, রোহ্‌ম এবং অন্যান্য S.A নেতাগণের প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশী ছিল, সেহেতু তিনি তাদের এই বদ্গুণ সহ্য করেছিলেন। কিন্তু ১৯৩৪ সালের জুনের ৩০ তারিখ তথা "The night of the long knives" এর সময়কালে রোহ্‌ম এবং অন্যান্য S.A নেতাগণ হিটলারের কাছে ত্যাজ্য হয়ে পড়েছিলেন। ফলে তিনি তাদের দন্ড বিধানে দ্বিধা করেননি।

(চলবে)

পরবর্তী পর্বঃ Operation Hummingbird এবং রোহ্‌মকে হত্যার কাহিনী।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আমার লেখাগুলোর লিঙ্কস

পুনশ্চঃ আমি আমার এই পর্ব এবং এর পরের পর্বটি ব্লগার ইমন জুবায়ের জন্য উৎসর্গ করছি। ব্লগার ইমন জুবায়েরের লেখা পড়ে আমি প্রায় তিন বছর আগে সামুর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। তাকে আমি কোনোদিন কোনো ক্যাচালে জড়াতে দেখিনি। তিনি মন্তব্যের উত্তর দিতেন খুবই সংক্ষিপ্ত আকারে। এই কারণে মাঝে মাঝে তার উপর রাগ লাগতো। কিন্তু তার প্রতিটা লেখায় এত বৈচিত্র্য ছিল যে প্রতিবারই বাধ্য হয়ে পড়তাম। আজ তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। কিন্তু তার স্মৃতি আমাদের মাঝে থেকে যাবে চিরকাল।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১২:১৭
২৪টি মন্তব্য ২৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×