somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি

২৪ শে জুলাই, ২০১০ সন্ধ্যা ৭:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি
ঝধযধনধ-ব শবৎধস রং ঃযব ংঃধহফধৎফ ড়ভ ঃৎঁঃয

সংকলনে : মুহিউদ্দীন হাতিয়ূভী
উস্তাজুল হাদীস : আল-জামিয়াতুল্ ইসলামিয়া মাইজদী, নোয়াখালী।


প্রাক কথা : ‘সাহাবা’ ওইসব ভাগ্যবান মনীষী, যাঁরা ঈমানের সাথে রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাাৎলাভে ধন্য হয়েছেন এবং ঈমানের সাথে ইন্তেকালের সৌভাগ্য লাভ করেছেন। সাাৎ মানে স্বচে রাসূলকে দেখা বা রাসূল তাঁদেরকে দেখা। অতএব ওইসব অন্ধ ঈমানদারও সাহাবীদের অন্তর্ভূক্ত, যাঁরা স্বচে রাসূলকে দেখার সৌভাগ্য হয় নি; কিন্তু রাসূল সা. স্বচে তাঁদেরকে দেখেছেন। যেমন হ. আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাক্তুম রাঃ। (শরহেনুখবা, ৮১-৮২পৃঃ) ‘মাপকাঠি’ অর্থ পরিমাণ করার দণ্ড বা মানদণ্ড, যাকে ইংরেজীতে বলা হয় ংঃধহফধৎফ। (ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ৯৭৭পৃঃ) আর ‘সত্য’ বলে ঈমান-আক্বীদাসহ শরীয়তের যাবতীয় বিধি-বিধানকে বোঝানো হয়েছে। সবটা মিলে ‘সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি’ (ঝধযধনধ-ব শবৎধস রং ঃযব ংঃধহফধৎফ ড়ভ ঃৎঁঃয) -কথাটার অর্থ দাঁড়ায়, গোটা দ্বীনকে বোঝা ও তা আমলে পরিণত করার জন্য সাহাবায়ে কেরাম হচ্ছেন মানদণ্ড বা মাপকাঠি।
আহ্লে সুন্নাত ওয়াল্ জামাতের আক্বীদামতে সাহাবায়ে কেরাম সম্বন্ধে নিম্নবর্ণিত আক্বীদা বিশ্বাস সকল মুসলমানের অন্তরে বদ্ধমূল থাকা আবশ্যক।
১. সাহাবায়ে কেরাম উম্মতে মুহাম্মদীর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও শ্রেষ্ঠতম নেককার মানুষ।
২. তাঁরা নবীদের মতো মাসূম নন; বরং তাঁরা সকলেই মাগফূর তথা তাঁদের মধ্যে কারও থেকে কোনো সময় সাধারণ ভুলচুক হয়ে গেলেও তাঁরা বিলম্ব না করে তাৎণিক তওবা ইস্তেগফারের মাধ্যমে নিজকে পবিত্র করে নিয়েছেন।
৩. মহান আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন সাহাবীদের প্রতি চির সন্তুষ্টির ঘোষণা দিয়েছেন।
৪. তাঁরা মুসলিম মিল্লাতের জন্য মি’য়ারে হক (معيار حق) বা সত্যের মাপকাঠি।
৫. তাঁদের দোষত্র“টি খোঁজাখুঁজি করা, তাঁদের সমালোচনা করা, তাঁদেরকে খাট বা তুচ্ছ নজরে দেখা এবং তাঁদের প্রতি যথাযথ সম্মান ও ভক্তি প্রদর্শন না করা মারাত্মক গুনাহ ও আল্লাহর লা’নতের কারণ।

কোন্ গুণে সাহাবায়ে কেরাম সত্যের মাপকাঠি?
বিষয়টি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর বাণী দিয়েই শুরু করা যাক।
عن عبد الله بن مسعود رضي الله تعالى عنه قال من كان مستنا فليستن بمن قد مات فإن الحي لا تؤمن عليه الفتنة، أولئك أصحاب محمد صلى الله عليه وسلم كانوا أفضل هذه الأمة أبرها قلوبا وأعمقها علما وأقلها تكلفا، اختارهم الله لصحبة نبيه ولإقامة دينه، فاعرفوا لهم فضلا واتبعوهم على أثرهم وتمسكوا بما استطعتم من أخلاقهم وسيرهم فإنهم كانوا على الهدى المستقيم- رواه رزين -مشكواة- ৩২
অর্থাৎ, হ.আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, যে ব্যক্তি কারও তরীকা অনুসরণ করতে চায়, সে যেন তাঁদের তরীকা অনুসরণ করে, যাঁরা দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। কেননা জীবিত ব্যক্তি ফিতনা থেকে নিরাপদ নয়। (হয়ত বাকী জীবনে কোনো দ্বীনি ফিতনায় পড়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে পারে।) তাঁরা হচ্ছেন হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম- এর সাহাবীগণ, যাঁরা এ উম্মতের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ছিলেন, স্বচ্ছ অন্তঃকরণ ও সুগভীর জ্ঞান হিসেবে এবং স্বল্পতম ছিলেন কৃত্রিমতার দিক থেকে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে তাঁর নবীর সাহচর্য ও স্বীয় দ্বীনকে দুনিয়ার বুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মনোনীত করেছেন। সুতরাং তোমরা তাঁদের ফযীলত ও মর্যাদা উপলব্ধি কর, তাঁদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে চল এবং যথাসাধ্য তাঁদের আখলাক ও চরিত্রকে আঁকড়ে ধর। কেননা তাঁরা সরল-সঠিক পথে ছিলেন। Ñরাযীন, মিশকাত-৩২ পৃঃ (মাও. নূর মুহাম্মদ আ’জমী রহ. -এর অনুবাদ অবলম্বনে)
কঠিন পরীায় চূড়ান্ত সাফল্যার্জন : হ.আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, সাহাবীগণ ছিলেন নবী মুহাম্মদ সা.- এর উম্মতদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও শ্র্ষ্ঠেতম নেককার ব্যক্তি। অর্থাৎ তাঁদের অন্তরাত্মা ছিল ঈমান ও ইসলামের আলোতে আলোকিত। এখ্লাস ও দ্বীনদারীর উপর অটলতার গুণে ছিল গুণান্বিত। চূড়ান্ত পর্যায়ের পূর্ণ ঈমানের মতো মহা সম্পদে ছিলেন তাঁরা ধন্য। দুনিয়াবিমুখতা, আত্মিক পবিত্রতা ও মহান আল্লাহর ভয়ভীতিতে তাঁদের পুরো জীবন ছিল সমৃদ্ধ। তাঁরাই ছিলেন সেই পুন্যাত্মা দল, যাঁরা সর্বপ্রথম রাসূল সা.- এর ডাকে সাড়া দিয়ে দ্বীন প্রচারের েেত্র তাঁর সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। দ্বীনের প্রচার ও প্রসার এবং দ্বীনকে দুনিয়ার বুকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাঁরা যে কঠোর ত্যাগ-তিতিা, যুলুম-নির্যাতন ও অবর্ণনীয় যাতনার সম্মুখীন হয়েছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। মানবজীবনের এমন কোনো কষ্ট নেই, যার শিকার তাঁরা হন নি। এমন কোনো পরীা ছিল না, যা তাঁদেরকে করা হয় নি।
মূলত এসব কিছু প্রজ্ঞাময় আল্লাহ তা‘আলার ইশারায় হয়েছিল, যার একমাত্র ল্য ছিল সাহাবীগণকে এ বিষয়ে যাচাই করা যে, তাঁদেরকে যেই গুরুত্বপূর্ণ মিশন পরিচালনা ও রাসূল সা.- এর সাহচর্যের মতো যেই সম্মানজনক পদে অধিষ্ঠিত করার জন্য নির্বাচন করা হয়েছে, সে জন্য তাঁরা চিন্তা-চেতনা, মন-মগজ ও ধ্যান-ধারণার দিক থেকে যোগ্যতাসম্পন্ন কি না? তাঁদের অন্তরসমূহ কঠিন থেকে কঠিন বিপদাপদে ধৈর্য ধারণ ও আল্লাহর শোকর আদায়ে সম কি না?
দেখা গেল তাঁরা সেসব পরীায় উত্তীর্ণ হয়েছেন একশ’ একশ’ নম্বরে। সুতরাং যখন তাঁদেরকে ধৈর্য ও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টির ব্যাপারে পরীা করা হয়েছে, তখন তাতে তাঁরা সুকঠিন ইস্পাততুল্য ধৈর্যের পাহাড় হয়ে মহান আল্লাহর অধিক পরিমাণে শোকর আদায়ে মশগুল হয়েছেন এক মুখকে হাজার মুখ বানিয়ে। স্পর্ষকাতর পরিস্থিতিতে ভয়াবহ বিপদাপদের পিচ্ছিল পথেও তাঁদের পদযুগল স্খলনের পরিবর্তে লাভ করেছে সুদৃঢ়তা ও অটলতা। অন্তরে পূর্ণ ঈমান নিয়ে অটল পায়ে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা পরিপূর্ণ দ্বীনের উপর। দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন অবিশ্বাস্য ধৈর্যের এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের চিরস্মরণীয় অকৃত্রিম প্রেম-ভালোবাসার। তাঁদের মূল্যবান এ গুণের ব্যাপারে কোরআন শরীফে খোদ্ আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনÑ أولئك الذين امتحن الله قلوبهم للتقوى অর্থাৎ, আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের অন্তরকে শিষ্টাচারের জন্য শোধিত করেছেন। Ñসূরা- হুজুরাত- ৩
শিা-দীা : তাঁদের মধ্যে এক একজন সাহাবী শিা-দীা, মান-মর্যাদা, জ্ঞান-বুদ্ধি, চিন্তা-চেতনা ও বিবেক-বিবেচনায় এমন নূরের মিনার (আলোর সুউচ্চ স্তম্ভস্বরূপ) ছিলেন, যার আলো দ্বারা সারা দুনিয়া যুলুম ও মুর্খতার অন্ধকার দূর করতঃ শিা-সততা, শিষ্টাচার, ভদ্রতা ও মনুষ্যত্ববোধের রশ্মী হাসিল করেছিল। তাই তো দেখা যায়, তাঁদের মধ্যে কেউ হাদীস ও তাফসীরে ছিলেন সুদতাসম্পন্ন, কেউবা আবার ফিক্ব্হ ও ক্বিরাতের ইমাম ছিলেন। কারও মধ্যে তাসাওউফ ও ফারায়েজের ইল্ম ছিল পরিপূর্ণ। আবার কারও মধ্যে আদব আখলাক ও শিষ্টাচারের পরিধি ছিল সাগরসম ব্যাপৃত। মোট কথা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গায় ইল্মের দিক থেকে ছিলেন যোগ্যতাসম্পন্ন ও পারঙ্গম। এমনটা শুধু পুরুষ সাহাবীগণই ছিলেন না; বরং মহিলা সাহাবীগণও আপন আপন জায়গায় ইল্ম ও মা’রিফাতের দীপ্ত সূর্য ছিলেন। ইহা একমাত্র রাসূল সা. এর মোবারক সংস্রবের অনিবার্য ফলশ্র“তি এবং তাঁর মমতাপূর্ণ দৃষ্টির বরকত ছাড়া অন্য কিছু নয়।
আচার আচরণে সরলতা : সাহাবায়ে কেরাম রূহানী লাইনে মর্যাদার উচ্চাসনে সমাসীন হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের জীবনাচারে ছিল না কোনো ধরনের বৈচিত্র্য ও লৌকিকতা। অবশ্য, দুনিয়াবি লাইনে কেউ কেউ ধন-সম্পদের অধিকারী কিংবা মতা ও নেতৃত্বের মসনদে অধিষ্ঠিত ছিলেন বটে; কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের মাঝে পরিলতি হয় নি কোনো ধরনের বিশেষত্বভাব; বরং তাঁদের চলাফেরা, ওঠা-বসা, কথাবার্তা, ভরণ-পোষণ সবই ছিল সাধারণ লোকের মতো স্বাভাবিক ও সাদামাঠা। (যেমন তাঁরা) না নগ্নপদে চলাফেরা করতে লজ্জাবোধ করতেন; না খালি মাটিতে নামায পড়তে বা শুতে বসতে সঙ্কোচবোধ করতেন। না মাটি বা কাঠের তৈরি প্লেটে খানা খেতে ইতস্তত করতেন; না অন্যের উচ্ছিষ্ট পানি বা খাবার খেতে ঘৃণাবোধ করতেন।
কথাবার্তায় শিষ্টাচার : কথাবার্তায় তাঁদের শিষ্টাচার ছিল এমন যে, প্রত্যেক সাহাবীর নিজ নিজ আলাপ আলোচনায় কোনো সময় ভদ্রতা ও শালীনতা হাতছাড়া হয় নি। তাঁরা অহেতুক ও অনর্থক কথাবার্তা এবং অনাহূত আলাপ আলোচনা থেকে সম্পূর্ণ বিরত ছিলেন। তাঁরা কথা বললে ওই সব কথাই বলতেন, যা নিতান্ত দরকারী বা উদ্দেশ্যসম্বলিত ও অর্থবহ। কোনো মাস্আলার সমাধান নিজের জানা না থাকলে, পরিষ্কার বলে দিতেনÑ এ সম্পর্কে আমার জানা নেই। এদিক সেদিক ঘুরিয়ে নিজ থেকে বানিয়ে বলার চেষ্টা করতেন না; বরং জিজ্ঞাসাকারীকে তাঁর চেয়ে বেশী জানেন এমন একজনের প্রতি দিক নির্দেশনা দিয়ে বলতেনÑ অমুককে জিজ্ঞাসা করুন। এভাবে ইল্ম অর্জনের েেত্র তাঁরা ছিলেন এমন যে, যাকে নিজের চেয়ে অধিক ইল্মের অধিকারী বলে জানতেন, চাই তিনি বয়সের দিক থেকে নিজের থেকে ছোটও হোন না কেন, তার কাছে গিয়ে কিছু শিখতে মোটেও লজ্জাবোধ বা কুণ্ঠাবোধ করতেন না ।
জীবন যাপনের উপায়-উপকরণ : তাঁদের জীবন যাপনের উপায়-উপকরণ এবং তার নিয়মনীতিতেও ছিল না কোনো ধরনের কৃত্রিমতা বা লৌকিকতা। খাদ্য-খাবার ও পোশাক-পরিচ্ছদ যখন যা কিছুর ব্যবস্থা হত, তখন তা-ই অবলম্বন করতেন। অর্থাৎ যখন যে ধরনের খাবার সামনে আসত, তখন তা-ই খেতেন। পোশাক পরিচ্ছদের মধ্যে যখন যা মিলত, তখন তা-ই ব্যবহার করতেন। মোটাসোটা হলেও পরিধান করতেন। আবার ভালো হলেও তা পরিধান করতেন। এমন নয় যে, লোকসমাজে নিজেদের বুযুর্গি ও দুনিয়াবিমুখতার সুনাম কুড়ানো বা খ্যাতি অর্জনের উদ্দেশ্যে শুধু মোটাসোটা পোশাককেই অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন। খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে মজাদার বা সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা হলে, তা মহান আল্লাহর নে’মত মনে করে আগ্রহের সাথে খেতেন। আবার সাধারণ থেকে সাধারণ খাবারের ব্যবস্থা হলে, তা অত্যন্ত সবর-শোকরের সাথে খেতেন। সাহাবীগণের ইবাদত বন্দেগি, লেনদেন, আখলাক ও ‘আদত তথা স্বভাব চরিত্র, জীবনোপায় ও জীবন-যাপনরীতি এক কথায় তাঁদের জীবনের প্রতিটি অংশজুড়ে ছিল এখলাস ও অকৃত্রিমতা।
সবচেয়ে বড় গুণ রাসূলের সাহচর্য : পূর্বেই বলা হয়েছে যে, সাহাবীগণের এই শিষ্টাচার ও আদর্শ একমাত্র রাসূল সা. -এর মোবারক সাহচর্যেই অর্জিত হয়েছিল। আর রাসূল সা. শিষ্টাচার লাভ করেছেন স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা থেকে। এমর্মে নবীজী সা. ইরশাদ করেন,أدّبني ربي فأحسن تأديبي “আমার রব আমাকে শিষ্টাচার শিা দিয়েছেন এবং তা সুন্দরভাবে শিা দিয়েছেন।”
এটা অবশ্যই সর্বজনস্বীকৃত যে, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো হক্কানী পীরের হাতে বয়আত গ্রহণ করে (আর আত্মশুদ্ধির পথে দিন দিন এগুতে থাকে) তবে দেখা যায়, অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ওই ব্যক্তি পূর্বে যেমনই থাকুক না কেন, পীরের খেদমত ও তার আনুগত্যের সুবাদে সে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়ে যায়। তাহলে এটা কেন অসম্ভব হবে যে, যখন সাহাবীগণ নিজেদের পুরো জীবনকে রাসূল সা.- এর খেদমতে সোপর্দ করতঃ তাঁর প্রতিটি কথা ও কাজকে অরে অরে পালন করেছেন, তবুও তাঁরা উম্মতের মাঝে সর্বোচ্চ মর্যাদার উচ্চাসনে আধিষ্ঠিত হবেন না; উম্মতের জন্য অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হবেন না? এ ব্যাপারে কারও দ্বি-মত থাকার তো কথা নয়। Ñমাযাহেরে হক (উর্দূ)-১ম খণ্ড, ২২৬Ñ২২৮পৃঃ

সকল সাহাবী জান্নাতী ও আল্লাহর সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত।

কুরআন ও সুন্নাহর দৃষ্টিতে আহ্লে সুন্নাত ওয়াল্ জামাতের আক্বীদা হচ্ছেÑ সাহাবীগণ গুনাহ করতে পারেন; কিন্তু এমন কোনো সাহাবী নেই, যিনি গুনাহ থেকে তওবা করে পবিত্র হন নি। তাঁদের দ্বারা কোনো পদস্খলন বা ভ্রান্তিমূলক কিছু হয়ে থাকলেও তা ছিল অধিকাংশ েেত্র ইজ্তিহাদী ভুল। তাই সেগুলোকে গুনাহের মধ্যে গণ্য করা যায় না; বরং হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী তদ্দ¡ারা তাঁরা একটি সওয়াবের অধিকারী। আর বাস্তবে যদি কোনো গুনাহ্ হয়েই যায়, তবে প্রথমত তা তাঁদের সারা জীবনের সৎকর্ম এবং রাসূল সা. ও ইসলামের সাহায্য ও সহযোগিতার মোকাবিলায় শূন্যের কোঠায় থাকে। দ্বিতীয়ত তাঁরা ছিলেন অসাধারণ আল্লাহভীরু। সামান্য গুনাহের কারণেও তাঁদের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠতো। তাৎণিকভাবে তওবা করতেন এবং নিজের উপর গুনাহের শাস্তি প্রয়োগ করতে সচেষ্ট হতেন। এছাড়া তাঁদের নেক এত বেশি ছিল যে, নেক দ্বারা তাঁদের গুনাহের কাফ্ফারা হয়ে যেতে পারে। সর্বোপরি আল্লাহ তা‘আলা তাঁদের মাগফিরাতের ব্যাপক ঘোষণা দিয়েছেন বিভিন্ন আয়াতে। শুধু মাগফিরাতই নয়; বরং رضي الله عنهم বলে তাঁর চির সন্তুষ্টির আশ্বাসও দান করেছেন। অতএব সাহাবায়ে কেরামের পারস্পরিক বাদানুবাদ ও মতবিরোধের ঘটনাকে সামনে রেখে তাঁদের কাউকে মন্দ বলা বা সমালোচনার পাত্র বানানো নিশ্চিতরূপে হারাম এবং রাসূল সা. এর ভাষ্য অনুযায়ী অভিশপ্ত হওয়ার কারণ এবং নিজের ঈমানকে বিপন্ন করার শামিল।
والسبقون الأولون من المهجرين و الأنصار و الذين اتبعوهم بإحسان رضي الله عنهم و رضوا عنه أعدالله لهم جنت تجري تحتها الأنهر ذالك الفوز العظيم
অর্থাৎ, প্রথম পর্যায়ের অগ্রবর্তী মুসলমান মুহাজির ও আনসার (অর্থাৎ সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম) এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে পরিপূর্ণভাবে (অর্থাৎ তাবেয়ীন) আল্লাহ সে সমস্ত লোকের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। মহান আল্লাহ তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন এমন জান্নাত, যার তলদেশে প্রবাহিত প্রস্রবণসমূহ। সেখানে থাকবে তারা চিরকাল। এটাই হল মহান কৃতকার্যতা। Ñসূরা তওবা-১০০
এই আয়াতে সাহাবায়ে কেরাম সম্পর্কে শর্তহীনভাবে رضي الله عنهم বলা হয়েছে। অবশ্য তাবেয়ীনদের ব্যাপারে সাহাবীদের ইত্তেবা তথা পরিপূর্ণভাবে অনুসরণের শর্তারোপ করা হয়েছে। এতে প্রতীয়মান হয় যে, সাহাবায়ে কেরাম সবাই কোনো রকম শর্ত ছাড়াই মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভে ধন্য। এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, গুনাহ মা করা ছাড়া আল্লাহর সন্তুষ্টি হয় না। কাযী আবু ইয়ালা রহ. বলেন আল্লাহ তা‘আলা ঔইসব লোকের জন্যই সন্তুষ্টি ঘোষণা করেন, যাদের সম্পর্কে জানেন যে, সন্তুষ্টির কারণাদির উপরই তাদের ইন্তেকাল হবে। সূরা নিসার ৯৫নং ও সূরা হাদীদের ১০নং আয়াতে সাহাবায়ে কেরামের পারস্পরিক তারতম্য উল্লেখ করে শেষে বলা হয়েছে, وكلا وعد الله الحسنى অর্থাৎ, তাদের (মধ্যে পারস্পরিক তারতম্য থাকা সত্ত্বেও) সবাইকে আল্লাহ তা‘আলা হুসনা তথা উত্তম পরিণতির (জান্নাত ও মাগফিরাতের) ওয়াদা দিয়েছেন। এর পর সূরা আম্বিয়ার ১০১নং আয়াতে হুসনাপ্রাপ্তদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, إن الذين سبقت لهم منا الحسنى أولئك عنها مبعدون অর্থাৎ, যাদের জন্য আমার প থেকে পূর্বেই হুসনার ওয়াদা হয়ে গেছে, তাদেরকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে।

সাহাবীদের মর্যাদা কুরআন হাদীস দ্বারা জানতে হয়; ঐতিহাসিক বর্ণনা দ্বারা নয়।

সাহাবায়ে কেরাম সাধারণ উম্মতের মতো নন। তাঁরা রাসূল সা. ও তাঁর উম্মতের মাঝে আল্লাহর তৈরি সেতু। তাঁদের মাধ্যম ব্যতীত উম্মতের কাছে কুরআন ও হাদীস এবং রাসূলের শিা পৌঁছার কোনো পথ নেই। তাই ইসলামে তাঁদের বিশেষ একটি মর্যাদা রয়েছে। তাঁদের এই মর্যাদা ইতিহাসগ্রন্থের সত্যমিথ্যা মিশ্রিত বর্ণনা দ্বারা নয়; বরং কুরআন ও হাদীসের চিরসত্য বর্ণনা দ্বারা জানা যায়। এমর্মে এখানে কতিপয় আয়াত ও হাদীস উল্লেখ করা হল।
إنما المؤمنون الذين امنوا بالله و رسوله ثم لم يرتابوا و جهدوا بأموالهم و أنفسهم في سبيل اللهط أولئك هم الصدقون
অর্থাৎ, তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে জান ও মাল দ্বারা জিহাদ করে। তারাই (সাহাবীগণ) সত্যনিষ্ঠ (বা সত্যবাদী)। Ñসূরা হুজুরাত-১৫
ولكن الله حبب إليكم الإيمان و زينه في قلوبكم و كره إليكم الكفر و الفسوق و العصيانط أولئك هم الراشدون
অর্থাৎ, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের অন্তরে ঈমানের মহব্বত সৃষ্টি করে দিয়েছেন। পান্তরে কুফর, শিরক, পাপাচার ও নাফরমানির প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। তারাই (সাহাবীগণ) সৎপথ অবলম্বনকারী। Ñসূরা হুজুরাত-৮
وألزمهم كلمة التقوى وكانوا أحق بها
অর্থাৎ, (আল্লাহ তা‘আলা) তাদের (অর্থাৎ সাহাবীদের) জন্য কালিমায়ে তাক্বওয়া তথা সংযমের দায়িত্ব অপরিহার্য করে দিলেন। বস্তুতঃ তারাই ছিল এর অধিকতর যোগ্য ও উপযুক্ত। (সূরা ফাত্হ-২৬) ‘কালিমায়ে তাক্বওয়া’ মানে তাওহীদ ও রিসালতের কালিমা। সাহাবায়ে কেরাম এই কালিমার অধিকতর যোগ্য ও উপযুক্ত আখ্যা দিয়ে সেসব লোকের লাঞ্ছনা প্রকাশ করে দিয়েছেন, যারা তাঁদের প্রতি কুফর ও নিফাকের দোষ আরোপ করে।
أولئك هم المؤمنون حقا ط لهم درجت عند ربهم و مغفرة و رزق كريم
অর্থাৎ, এমন সব লোকই (সাহাবীরা) সত্যিকারের মুমিন (যাদের ভেতর ও বাহির এক রকম এবং মুখ ও অন্তর ঐক্যবদ্ধ)। তাদের জন্য রয়েছে স্বীয় পরওয়ারদিগারের নিকট সুউচ্চ মর্যাদা ও মাগফিরাত এবং সম্মানজনক রিয্ক। Ñসূরা আনফাল-৪
عن أبي سعيد الخدريرض قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لا تسبوا أصحابي فلوا أن أحدكم أنفق مثل أحد ذهبا ما بلغ مد أحدهم و لا نصيفه (بخاري ص ৫১৮ و مسلم ص৩১০)
হ. আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেনÑ তোমরা আমার সাহাবীগণকে গাল-মন্দ করো না। কেননা (তারা এমন শক্তিশালী ঈমান ও সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী যে,) তোমাদের কেউ যদি ওহুদ পাহাড় পরিমাণ সোনাও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাদের এক মুদ (৩ ছটাক প্রায়) কিংবা অর্ধমুদ (যব খরচ) এর সমান সওয়াবে পৌঁছুতে পারে না। Ñবুখারী-১খ./৫১৮পৃ., হাদীস নং-৩৩৯৭; মুসলিম-২খ./৩১০পৃ., হাদীস নং-৪৬১০; আবুদাউদ-২খ./৬৪০পৃ.; তিরমিযী-২খ./২২৫পৃ.; মিশকাত-৫৫৩পৃঃ
বায্যায সূত্রে মুফতী শফী’ রহ. মাআ’রিফুল ক্বুরআনে উল্লেখ করেছেনÑ হযরত জাবির রা. এর এক হাদীসে রাসূল সা. ইরশাদ করেন- আল্লাহ তা‘আলা সারা জাহান থেকে আমার সাহাবীগণকে পছন্দ করেছেন।
عن جابررض عن النبي قال لا تمس النار مسلما راني أو راى من راني (ترمذي ص২২৫)
হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. ইরশাদ করেন, জাহান্নামের আগুন সে মুসলমানকে স্পর্ষ করতে পারে না, যে আমাকে দেখেছে (অর্থাৎ আমার সাহাবীরা) কিংবা আমাকে যারা দেখেছে তাদেরকে দেখেছে (অর্থাৎ তাবেয়ীরা)।
Ñতিরমিযী-২খ./২২৫পৃ., হাদীস নং-৩৮০১; মিশকাত-৫৯১পৃ.
عن عبد الله بن مغفلرض قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم .........من آذاهم فقد آذاني و من آذاني فقد آذى الله و من آذى الله فيوشك أن يأخذه (ترمذي ص২২৫)
হ. আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফ্ফাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেনÑ...... যে আমার সাহাবীদেরকে কষ্ট দিল সে যেন আমাকে কষ্ট দিল; যে আমাকে কষ্ট দিল সে যেন আল্লাহকে কষ্ট দিল; যে আল্লাহকে কষ্ট দিল অচিরেই আল্লাহ তাকে পাকড়াও করবেন। -তিরমিযী-২খ./২২৫পৃ.; হাদীস নং-৩৭৯৭; মুসনাদে আহ্মদ- হাদীস নং-১৯৬৬৯ও১৯৬৪১;মিশকাত-৫৫৪পৃঃ

ঈমান যাচায়ের কষ্টিপাথর সাহাবায়ে কেরাম।

সাহাবায়ে কেরাম প্রিয় নবী মুহাম্মদ সা. এর সংস্রব ও সাহচর্যের মাধ্যমে বিশ্বজনীন খ্যাতনামা ও মানবতাবোধসম্পন্ন উন্নত জাতিতে পরিণত হলেন। শুধু তাই নয়; বরং বিশ্বমানবতার জন্য চির অনুসরণযোগ্য এবং উম্মতের ঈমান-আমলের সত্যতা ও শুদ্ধাশুদ্ধি যাচায়ের জন্য মাপকাঠির সনদ লাভ করেছেন মহান আল্লাহর প থেকে।
আল্লাহর বাষায় : সাহাবায়ে কেরামের ঈমানকে অন্যদের ঈমান যাচায়ের কষ্টিপাথর সাব্যস্ত করে আল্লাহ তা‘আলা তাঁদেরকে সম্বোধন করে ইরশাদ করেন,
فإن امنوا بمثل ما امنتم به فقد اهتدوا و إن تولوا فإنما هم في شقاق
অর্থাৎ, যদি তারা ঈমান আনে, যেরূপ তোমরা ঈমান এনেছ, তবে তারা হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে। আর যদি তারা (এত্থেকে) মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারা হঠকারিতায় রয়েছে। Ñসূরা বাক্বারা-১৩৭
এই আয়াতে সাহাবীদের ঈমানকে আদর্শ ঈমানের মাপকাঠি সাব্যস্ত করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, মহান আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য ও স্বীকৃত ঈমান সেরকম ঈমান, যা রাসূলের সাহাবীগণ অবলম্বন করেছেন। যে ঈমান ও বিশ্বাস এত্থেকে চুল পরিমাণও ভিন্ন, তা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য নয়।
অপর আয়াতে মুনাফিকদের হঠকারিতার বিষয় উল্লেখ করে ইরশাদ করেন,
و إذا قيل لهم امنوا كما امن الناس قالوا أنؤمن كما امن السفهاء ألا إنهم هم السفهاء و لكن لا يعلمون
অর্থাৎ, যখন তাদেরকে বলা হয়, মানুষরা অর্থাৎ সাহাবীরা যেভাবে ঈমান এনেছে তোমরাও সেভাবে ঈমান আন। তখন তারা বলে আমরাও কি বোকাদের মতো ঈমান আনব? মনে রেখো প্রকৃতপে তারাই বোকা; কিন্তু তারা তা বোঝে না।Ñসূরা বাক্বারা-১৩
এই আয়াতেও একই কথা বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তা‘আলার দরবারে সাহাবীগণের ঈমানই গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ যে বিষয়ে তাঁরা যেভাবে ঈমান এনেছিলেন অনুরূপ ঈমান যদি অন্যরা আনে, তবেই তাকে ঈমান বলা হয়; অন্যথায় তাকে ঈমান বলা চলে না। এতে বোঝা গেল যে, সাহাবীগণের ঈমানই ঈমানের কষ্টিপাথর, যার নিরিখে ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট সকল উম্মতের ঈমান পরীা করা হয়। এ কষ্টিপাথরের পরীায় যে ঈমান সঠিক বলে প্রমাণিত না হয়, তাকে ঈমান বলা যায় না এবং অনুরূপ ঈমানদারকে মুমিন বলা চলে না। এর বিপরীতে যত ভালো কাজ বা কথা হোক না কেন, আর তা যত নেক নিয়তেই হোক না কেন, আল্লাহর নিকট তা ঈমানরূপে স্বীকৃতি পায় না; বরং তা মুর্খতা ও বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।
রাসূলের ভাষায় : রাসূলুল্লাহ সা.ও পরবর্তী উম্মতদেরকে সাহাবীদের অনুকরণ ও অনুসরণ করে নিজেদের জীবনকে হেদায়াতের আলোতে আলোকিত করার জন্য গুরুত্বারোপ করেছেন। এমর্মে বহু হাদীস রয়েছে। তম্মধ্যে এখানে একটি হাদীস উল্লেখ করা হল।
عن عمر بن الخطابرض قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم أصحابي كالنجوم فبأيهم اقتديتم اهتديتم –
رزين (مشكاة ৫৫৪)
হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেন, আমার সাহাবীরা আকাশের তারকাতুল্য। তোমরা তাদের যে কোনো একজনের অনুসরণ করবে, হিদায়াতপ্রাপ্ত হবে।Ñরাযীন,মিশকাত-৫৫৪ পৃঃ
বিশিষ্ট সাহাবী হ.আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রা.-এর ভাষায় :
عن عبد الله بن مسعودرض قال من كان مستنا فليستن بمن قد مات ....... واتبعوهم على أثرهم وتمسكوا بما استطعتم من أخلاقهم وسيرهم فإنهم كانوا على الهدى المستقيم- رزين (مشكواة ৩২১)
হযরত আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসঊদ রা. উম্মতে মুহাম্মদীকে উদ্দেশ্য করে বলেন (যার মর্মার্থ এমন) যে, তোমরা যদি হেদায়াতের পথ চাও, সফলতা অর্জনে আগ্রহী হও, মহান আল্লাহর পরিচয় ও রাসূল সা.- এর প্রেম-ভালোবাসার উচ্চ শিখরে পৌঁছুতে আবেগমান হও, তবে তোমরা পূণ্যাত্মা সাহাবায়ে কেরামের পথ ধরে চল। তাঁদের আখলাক ও আদর্শকে নিজেদের জন্য গন্তব্যে পৌঁছার একমাত্র তরিকা স্থির করে নাও। তাঁদের অনুকরণ ও অনুসরণকে নিজেদের জন্য চূড়ান্ত সফলতার মাধ্যম মনে কর এবং তাঁদের প্রতি অগাধ মায়া-মহব্বত ও গভীর ভক্তি-শ্রদ্ধার বিনিময়ে নিজেদের জীবনের প্রতিটি অংশকে নূরান্বিত করতে সচেষ্ট হও। কেননা তাঁরা সরল-সঠিক পথে ছিলেন। Ñরাযীন, মিশকাত- ৩২ পৃঃ

সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা করলে কিংবা তাঁদেরকে সত্যের মাপকাঠি না মানলে সমস্যা কী?

সত্যিকারের আহ্লে সুন্নাত ওয়াল্ জামাতপন্থীদের জন্য অনেক সমস্যা; যদিও পরিপন্থীদের জন্য কোনো সমস্যা নেই। এখানে কয়েকটি সমস্যার কথা উল্লেখ করা হল।
১. কুরআনের উপর অনাস্থা ঃ একথা চিরসত্য যে, সরাসরি রাসূল সা. এর পবিত্র যুবান থেকে কুরআন শরীফের এক একটি আয়াত সহী-শুদ্ধভাবে শিখেছেন এবং তা সংরণ করতঃ পরবর্তী উম্মত পর্যন্ত নিখুঁতভাবে পৌঁছে দিয়েছেন যাঁরা, তাঁরা হলেন রাসূল সা. এর আস্থাভাজন সাহাবায়ে কেরাম। সাহাবীগণ যখনই কোনো আয়াত রাসূলের যুবানে শোনতেন, তাৎণিক তা লিখে নিতেন বা মুখস্থ করে নিতেন। আবার বিশেষভাবে কয়েকজন সাহাবী রাসূল সা. এর প থেকে ওহী লিখার দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে হযরত মু‘আবিয়া রা. বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাসূল সা. ইহজগৎ ত্যাগ করার পর হযরত উমর রা.- এর পরামর্শক্রমে মুসলিমজাহানের প্রথম খলীফা হ. আবুবকর রা.- এর তত্ত্বাবধানে কুরআনের বিপ্তি আয়াতকে সংকলন করতঃ পর্যায়ক্রমে তাকে এডিশনে রূপায়ণের কাজও আঞ্জাম দিয়েছেন নবীজীর সৌভাগ্যবান সাহাবীরা। তাঁদের মধ্যে হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রা. বিশেষভাবে উলেখযোগ্য। এরপর দুরদর্শী সাহাবী হযরত হুযায়ফা রা. এর পরামর্শক্রমে হযরত উসমান রা. ২৫হিজরী সনে পঞ্চাশ হাজার সাহাবীর বিশাল সম্মেলন ডেকে সকলের সম্মতিক্রমে কুরাইশী ভাষায় কুরআনের নতুন এডিশন তৈরির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেজন্যে তিনি চার সদস্যবিশিষ্ট পরিষদ তথা হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রা., আব্দুলাহ ইবনে যুবায়র রা., সাঈদ ইবনে ‘আস রা. ও আব্দুলাহ ইবনে হারিস রা.কে দায়িত্ব দেন। তাঁরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অত্যন্ত সততা, দতা ও নিষ্ঠার সাথে নিখুঁতভাবে এই মহতী কাজের আঞ্জাম দেন। তৈরী হয় ক্বুরআনের নতুন এডিশন, যার অবিকল অনুুলিপি আজ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের হাতে রয়েছে।
-মিশকাত-১৯৩পৃ.; মিরক্বাত-৫খ./২৮পৃ.; মাও. নূর মুহাম্মদ ‘আজমী রহ. অনুদিত ‘মিশকাত শরীফ’-৫খ./৪১পৃ.
নবীজীর সাহাবীগণ যদি অকান্ত পরিশ্রম ও অপূর্ব সাধনার বিনিময়ে কুরআনের সংরণ ও সংকলনের কাজ আঞ্জাম না দিতেন, তাহলে পরবর্তী উম্মত চিরদিনের জন্য কুরআনের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত থেকে যেত। অতএব যাঁদের মাধ্যমে আমরা কুরআন পেয়েছি, তাঁদেরকে সত্যের মাপকাঠি না মানা; তাঁদেরকে সমালোচনার উর্ধ্বে মনে না করা; এক কথায় তাঁদের প্রতি অনাস্থাভাব পোষণ করা এবং তাঁদেরকে কোনো না কোনোভাবে কদর্য করাÑ পরোভাবে কুরআনকে কদর্য করা এবং কুরআনের প্রতি অনাস্থাভাব পোষণ করা। যেহেতু বর্ণনার উপর নির্ভরতা বর্ণনাকারীর উপর নির্ভর করে। বর্ণনাকারী গ্রহণযোগ্য হলে, তার বর্ণিত বিষয় গ্রহণযোগ্য; আর বর্ণনাকারী অনির্ভরযোগ্য হলে, তার বর্ণিত বিষয় অনির্ভরযোগ্য; বর্ণনাকারী বিতর্কিত সমালোচিত হলে, তার বর্ণিত বিষয় বিতর্কিত সমালোচিত হয়ে যায়Ñ এটাইতো সর্বজন স্বীকৃত কথা।
২. হাদীস শরীফের উপর অনাস্থা ঃ কুরআনের সংরণ করেছেন যেমন সাহাবায়ে কেরাম, নবীজীর হাদীসভাণ্ডারের সংরণও করেছেন তাঁরা। তাঁদের থেকেই পর্যায়ক্রমে তা আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। অতএব সাহাবীগণকে যদি সমালোচনার পাত্র বানানো হয়, তবে তাঁদের সংরতি হাদীসভাণ্ডারও নির্ভরযোগ্য থাকে না। তাহলে দ্বীন-শরীয়ত বলতে আর কী থাকে?
৩. রাসূলের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা ঃ বহু হাদীসে রাসূল সা. সাহাবীদের সমালোচনা করতে এবং তাঁদেরকে তুচ্ছ নজরে দেখতে নিষেধ করেছেন। এমর্মে এখানে একটি হাদীস উল্লেখ করা হল,
عن عبد الله بن مغفلرض قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الله الله في أصحابي لا تتخذوهم غرضا من بعدي الخ
হ. আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফ্ফাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেনÑ আমার সাহাবীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহকে ভয় কর। তাদেরকে (সমালোচনার) ল্যবস্তু স্থির করো না।
তিরমিযী-২খ./২২৫পৃ.; হাদীস নং-৩৭৯৭; মুসনাদে আহ্মদ- হাদীস নং-১৯৬৬৯ ও ১৯৬৪১;মিশকাত-৫৫৪পৃঃ
এই হাদীসের আলোকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, সাহাবীদের সমালোচনা করলে, নিশ্চিত রাসূল সা. এর নিষেধাজ্ঞা অমান্য হয়।
৪. রাসূলের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ ঃ সাহাবীদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করলে, তা স্বয়ং নবীজীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণের নামান্তর। নিম্নবর্ণিত হাদীসাংশ তা-ই বলে।
عن عبد الله بن مغفلرض قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم .......... فمن أحبهم فحبي أحبهم و من أبغضهم فبغضي أبغضهم (مشكاة ৫৫৪)
হ. আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফ্ফাল রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেন, ...........যারা (আমার) সাহাবাকে ভালোবাসল, তারা আমার ভালোবাসায় তাদেরকে ভালোবাসল এবং যারা তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করল, তারা আমার প্রতি বিদ্বেষের কারণে তাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করল।
-তিরমিযী-২খ./২২৫পৃ.; হাদীস নং-৩৭৯৭; মুসনাদে আহ্মদ- হাদীস নং-১৯৬৬৯ ও ১৯৬৪১;মিশকাত-৫৫৪পৃঃ
৫. সাহাবীদেরকে কদর্য করা রাসূল সা.কে কদর্য করার নামান্তর ঃ সাহাবায়ে কেরামের সম্পূর্ণ শিা ও শিষ্টাচার রাসূল সা. থেকে অর্জিত। তাঁদের নম্রতা-ভদ্রতা ও ঈমানী-আমলী ত্যাজদীপ্ততা রাসূল সা. এর মহত্বের প্রতিনিধিত্ব করে। যেমন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে চন্দ্র, সূর্য থেকে আলো গ্রহণ করতঃ সূর্যের ঔজ্জ্বল্যের প্রতিনিধিত্ব করে। এমর্মে কবি যথার্থ বলেছেন,

অর্থাৎ, যেই চাঁদ (রাসূল সা.) বত্হা তথা মক্কা নগরির দিগন্তজুড়ে আভা ছড়িয়ে উদ্ভাসিত হল, সেই চাঁদের উজ্জ্বল নত্র হলেন সাহাবায়ে কেরাম।
অতএব, সাহাবায়ে কেরামের জীবনকে কলুষযুক্ত করে দেখা, স্বয়ং রাসূলের জীবনকে কলুষযুক্ত করে দেখার নামান্তর।
৬. সুন্নতের বরকত থেকে বঞ্চিত হওয়া ঃ এটা স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, বিদ্যুতের পাওয়ার হাউজ থেকে স্বচ্ছ বিদ্যুৎ লাভ করার জন্য নিখুঁত তারের মাধ্যম গ্রহণ করা আবশ্যক। তবেই বিদ্যুৎ দ্বারা উপকৃত হওয়ার আশা করা যায়। পান্তরে ত্র“টিযুক্ত তারের মাধ্যম গ্রহণ করলে উপকৃত হওয়ার বিপরীতে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। ঠিক তেমনিভাবে যারা রাসূলে করীম সা. এর স্বচ্ছ সোনালী আদর্শের পাওয়ার হাউজ থেকে আলো গ্রহণ করতঃ নিজেদের জীবনকে আলোকিত করতে চায়, তবে তারা অবশ্যই সাহাবায়ে কেরামকে মাপকাঠি মেনে তাঁদেরকে নিখুঁত মাধ্যমরূপে গ্রহণ করা আবশ্যক। পান্তরে যারা এই নিখুঁত মাধ্যমকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো ত্র“টিযুক্ত মাধ্যম গ্রহণ করবে, তারা নিশ্চয় সুন্নতে রাসূলের বরকত থেকে আজীবন বঞ্চিতই থাকবে। ইহকাল ও পরকালে তাদের বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
৭. আল্লাহর লা’নতের পাত্র হওয়া ঃ যারা সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা করে, তাদের উপর আল্লাহর অভিশাপ পতিত হয়। নিম্নবর্ণিত হাদীস একথার সাী।
عن عبد الله بن عمررض قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا رأيتم الذين يسبون أصحابي فقولوا لعنة الله على شركم (ترمذي ص২২৫)
হ. আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেনÑ যখন তোমরা ওইসব ব্যক্তিকে দেখবে, যারা আমার সাহাবাকে গাল-মন্দ করে, তখন তোমরা বলে দাও, তোমাদের এই মন্দ আচরণের কারণে তোমাদের উপর আল্লাহর লা’নত।
Ñতিরমিযী-২খ./২২৫পৃ.; মিশকাত-৫৫৪পৃ.

---০---


(সংকলনকাল : রবীউস্সানী -১৪৩১হিজরী)


৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×