somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মনসামঙ্গলকাব্যঃ বেহুলা-লখিন্দর কালজয়ী কাহিনী

২৬ শে অক্টোবর, ২০১৩ বিকাল ৫:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মনসামঙ্গল কাব্যের রচয়ীতা অনেক জন আর কাহিনিতেও ভিন্নতা আছে প্রচুর। কবিদের মধ্যে কানা হরিদত্ত, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাই, দ্বিজ বংশীদাস, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ প্রমুখ মনসামঙ্গল কাব্য রচনা করেছেন।

মনসা-মঙ্গলের কাহিনীঃ
মনসা-মঙ্গল লোকচেতনার ভেতর ধারণ করেছে পৌরাণিক চরিত্রসমূহ। এর কাহিনীতে দুটি ভাগ দেখা যায়। দেবলীলা এবং নরলীলা। কাহিনীর প্রধান চরিত্র হল- চাঁদ সওদাগর, বেহুলা ও লখিন্দর।


শিবের সাথে পার্বতী


পার্বতী ছাড়া কারো প্রতি শিবের কাম হয় না। প্রেমে মগ্ন শিব একদিন পার্বতীর কথা চিন্তা করে কাম চেতনায় বীর্য বের করে দেন। সেই বীর্য পদ্ম পাতার ওপরে রাখেন। বীর্য পদ্মের নল বেয়ে পাতালে চলে যায়। সেখানে সেই বীর্য থেকেই মনসার জন্ম। বাসুকীর কাছে বড় হয় মনসা। বাসুকী তার কাছে গচ্ছিত শিবের ১৪ তোলা বিষ মনসাকে দেন। যুবতী মনসা পিতার কাছে ফিরে এসে তার পরিচয় দেয়। আবদার করে কৈলাসে বাপের বাড়ি যাবার। শিব তার স্ত্রী পার্বতীর ভয়ে কন্যাকে নিতে চান না। পরে মন্দিরে ফুলের ডালিতে লুকিয়ে রাখেন। কিন্তু পার্বতী মনসাকে দেখে ফেলে। মনসাকে সতীন মনে করে এক চোখ অন্ধ করে দেয়। মনসা পার্বতীকে দংশন করে, শিবের অনুরোধে পার্বতীকে আবার জীবিত করে তোলে। পার্বতীর রোষে মনসাকে বনবাসে দেয়া হয়। এরমধ্যে ব্রহ্মর বীর্য ধারণ করে মনসা উনকোটি নাগ জন্ম দেন। এরপর মনসা সর্পদেবী আকারে হাজির হন। বনবাস থেকে ফিরে মনসা নিজের পূজা প্রচলনের আবদার প্রকাশ করে পিতার কাছে। শিব বলেন, যদি চাঁদ সওদাগর মনসার পূজা দিতে রাজী হয়, তবে দুনিয়ায় মনসার পূজার প্রচলন হবে।


শিব ও তার কন্যা মনসা


শিব ভক্ত চাঁদ সওদাগর তুচ্ছ নারীকে পূজা দিতে রাজী হন না। উল্টা মনসাকে লাঠি নিয়ে তাড়া করে। যেকারণে মনসার রোষে চাঁদের চম্পকনগরে সাপের উপদ্রুব শুরু হয়। একে একে চাঁদের ছয় সন্তান মারা যায়। বাণিজ্যের নৌকা ডুবে গেলে চাঁদ সব হারিয়ে সর্বশান্ত হয়। তারপরও মনসার পূজাতে রাজী হয় না সে। অন্যদিকে চাঁদের বউ সনকা মনসার ভক্ত। মনসার বরে সে এক পুত্র জন্ম দেয়। নাম লখিন্দর। যদি চাঁদ মনসার পূজা না দেয় তবে লখিন্দর বাসর ঘরে সাপের কামড়ে মারা যাবে। এসব জেনেও চাঁদ লখিন্দরের সাথে উজানীনগরে বেহুলার বিয়ে ঠিক করে। চাঁদ সওদাগর অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে এমন বাসর ঘর তৈরি করেন যা সাপের পক্ষে ছিদ্র করা সম্ভব নয়।

কিন্তু সকল সাবধানতা স্বত্ত্বেও মনসা তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সমর্থ হয়। তার পাঠানো একটি সাপ লক্ষিন্দরকে হত্যা করে। প্রচলিত প্রথা অনুসারে যারা সাপের দংশনে নিহত হত তাদের স‌ৎকার প্রচলিত পদ্ধতিতে না করে তাদের মৃতদেহ ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হত এ আশায় যে ব্যক্তিটি হয়ত কোন অলৌকিক পদ্ধতিতে ফিরে আসবে। বেহুলা সবার বাঁধা অগ্রাহ্য করে তার মৃত স্বামীর সাথে ভেলায় চড়ে বসে। তারা ছয় মাস ধরে যাত্রা করে এবং গ্রামের পর গ্রাম পাড়ি দিতে থাকে। এই অবস্থায় মৃতদেহ পঁচে যেতে শুরু করে এবং গ্রামবাসীরা তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন মনে করতে থাকে। বেহুলা মনসার কাছে প্রার্থনা অব্যাহত রাখে। তবে মনসা ভেলাটিকেই কেবল ভাসিয়ে রাখতে সাহায্য করে।



ভাসতে ভাসতে ভেলা এসে পৌছালো এক ঘাটে, যেখানে প্রতিদিন স্বর্গের ধোপানি কাপড় ধোয়। বেহুলা সেখানে এক অবাক কাণ্ড দেখলো। ধোপানি কাপড় ধুতে এসেছে একটি ছোট শিশুকে নিয়ে। শিশুটি দুরন্ত, সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে। ধোপানি এক সময় শিশুটিকে একটি আঘাত ক'রে মেরে ফেললো। পরে যখন কাপড় কাচা হয়ে গেলো, তখন আবার সে তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে চ'লে গেলো। বেহুলা বুঝতে পারলো, এ মানুষ বাঁচাতে জানে। পরদিন বেহুলা গিয়ে তার পদতলে পড়লো। তার স্বামীকে বাঁচিয়ে দিতে অনুরোধ করলো। ওই ধোপানির নাম নেতাই। সে বললো, "একে আমি বাঁচাতে পারবো না, একে মেরেছে মনসা। তুমি স্বর্গে যাও, দেবতাদের সামনে উপস্থিত হও। দেবতারা ভালোবাসে নাচ দেখতে। তুমি যদি তোমার নাচ দেখিয়ে তাদের মুগ্ধ করতে পারো, তাহলে তারা তোমার স্বামীকে বাঁচিয়ে দেবে।"

আশার মোম জ্বলে উঠলো বেহুলার চোখে, মনে, সারা চেতনায়। সে স্বর্গে গেলো। দেবতারা ব'সে আছে; তাদের সামনে বেজে উঠলো বেহুলা, বেজে উঠলো তার পায়ের নূপুর। বেহুলার নাচে চঞ্চল হয়ে উঠলো চারদিক, তার নূপুরের ধ্বনিতে ভ'রে গেলো স্বর্গলোক। বেহুলার নৃত্যে এক অসাধারণ ছন্দ। মুগ্ধ হল দেবতারা। তারা বেহুলাকে বর প্রার্থনা করতে বললো। সে তার স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা করলো। মহাদেব রাজি হলো তাতে।

মনসা এসে বললো, 'আমি লখিন্দরকে ফিরিয়ে দিতে পারি, যদি চাঁদ আমার পুজো করে।' বেহুলা তাতে রাজি হল, এবং বললো, তাহলে তোমাকে ফিরিয়ে দিতে হবে আমার শ্বশুরের সব কিছু। ফিরিয়ে দিতে হবে তাঁর পুত্রদের, তাঁর সমস্ত বাণিজ্যতরী। রাজি হলো মনসা।

মনসা সব ফিরিয়ে দিলো, বেঁচে উঠলো লখিন্দর, ভেসে উঠলো চোদ্দ ডিঙ্গা। চাঁদ পাগলের মত ছুটে এলো বেহুলার কাছে। কিন্তু এসে যেই শুনলো যে তাকে মনসার পুজো করতে হবে, তখন তার সকল আনন্দ নিভে গেলো, সে দৌড়ে স'রে গেলো সবকিছুর থেকে। বেহুলা গিয়ে কেঁদে পড়লো চাঁদের পায়ে। যে- চাঁদ মনসাকে চিরদিন অপমান করেছে, যে কোনদিন পরাজিত হতে চায় নি, সে- চাঁদ বেহুলার অশ্রুর কাছে পরাজিত হলো। বেহুলা বললো, 'তুমি শুধু বাঁ হাতে একটি ফুল দাও, তাহলেই খুশি হবে মনসা।' চাঁদ বললো, 'আমি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বাঁ হাতে ফুল দেবো।' তাই হলো। মুখ ফিরিয়ে বাঁ হাতে একটি ফুল হেলাভরে ছুঁড়ে দিল চাঁদ। মনসা তারপরও খুশি। আর পৃথিবীতে প্রচারিত হলো মনসার পুজো।


এই হল মনসা-মঙ্গল কাব্যের কাহিনীর সার। এরমধ্যে নানা কবির লেখনীতে কিছু কিছু পার্থক্য আছে। তবে মূল কাহিনীর খুবই কম জায়গাতেই এই ফারাক।

সুত্রঃ
●উইকিপিডিয়া
●লাল নীল দীপাবলি- হুমায়ুন আজাদ
_________________________________________
▓▒░░ বিশেষ আকর্ষনঃ ░░░▒▓
_________________________________________

জহির রায়হান নির্মিত বাংলা চলচিত্রঃ "বেহুলা"



'বেহুলা' ১৯৬৯ সালে নির্মিত বাংলা চলচিত্রে অন্যতম। এ ছবিতে অভিনয় করেছেনঃ
●সুচন্দা (বেহুলা)
●রাজ্জাক (লখিন্দর)
●ফতেহ লোহানী (চাঁদ সওদাগর)
●সুমিতা দেবী (মনসাদেবী)



'বেহুলা' ছবিটি বাংলা ক্লাসিক ছবির ভক্তদের অবশ্যই দেখা উচিৎ।

____________________________________________

মনসামঙ্গলকাব্যের পূর্ণ চিত্র পাওয়া যাবে এই সিনেমায়ঃ বেহুলা-লখিন্দর
●পরিচালকঃ অমল দত্ত
●প্রযোজকঃ দীনেশ চন্দ্র দে


পার্ট-১

পার্ট-২

______________________________________________


স্টার জলসায় প্রচারিত ধারাবাহিক মেগাসিরিয়ালঃ “বেহুলা”



কয়েকটি তুলে ধরা হলঃ

শিবের মুখ থেকে শুনলাম, বেহুলা আর লখিন্দরের আসল নাম যথাক্রমে ঊষা আর অনিরুদ্ধ



- আমি আমার অধিকারটুকু চাই পিতা-



দুই দেবীর মধ্যকার যুদ্ধে বলি হচ্ছেন মর্ত্যের নারী



আরো পর্বগুলো দেখতে চাইলে এই লিঙ্কে যান।

_____________________________________________

সহায়ক লিঙ্কঃ
উইকিপিডিয়া
মনসা মঙ্গলে বাংলার ভাবের হদিস
শহীদ জহির রায়হান পরিচালিত বেহুলা (১৯৬৬) - রাইসুল জুহালা


==========================================
এর সাথে সম্পৃক্ত আমার পূর্ববর্তী পোস্টঃ
চর্যাপদ- বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন
শ্রীকৃষ্ণকীর্তনঃ রাধা-কৃষ্ণের প্রণয়োপখ্যান

===========================================
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ১১:৩৩
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×