প্রিয় ব্লগার, সকলকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা। বছর ঘুরে আবারও এলো ভাষার মাস ফেব্রুয়ারী। প্রতিবারের মত এবারও ভাষার মাসকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে বাঙালির প্রাণের মেলা, অমর একুশে গ্রন্থমেলা। প্রতি বছরের মত এই বছরও সামহোয়্যারইন ব্লগের অনেক ব্লগারের বই প্রকাশিত হয়েছে। এই বইমেলা, যে সকল ব্লগারদের বই প্রকাশিত হয়েছে এবং এর সাথে যারা সংশ্লিষ্ট আছেন তাদের নিয়ে আমরা একটি সাক্ষাতকার অনুষ্ঠান আয়োজন করতে যাচ্ছি। সময় স্বল্পতার কারনে প্রাথমিকভাবে আমরা কিছু সাক্ষাতকার শুধুমাত্র লিখিতআকারে ব্লগে প্রকাশ করব। পরবর্তীতে এই সাক্ষাতকারগুলোর ভিডিও আমাদের ফেসবুক পেইজে আপলোড করা হবে।
ব্লগারদের কাছে আমরা মুলত বর্তমান বাজার, নতুন লেখক, পাঠক, প্রকাশকদের দায়িত্ব বা পেশাদারিত্ব এবং বইয়ের মান নিয়ে জানতে চাওয়ার পাশাপাশি অনেক অপ্রিয় প্রশ্নও করা হতে পারে যা অবশ্য কেউ চাইলে জবাব নাও দিতে পারেন।
আমাদের এইবারের পর্বের ব্লগার প্রিয় সুরঞ্জনা মায়া। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি ছিলেন সদ্য কিশোরী। সেই সময় তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা, বাস্তবতা এবং সামাজিক ও আঞ্চলিক অনেক ঘটনা। এই বিষয়ে তিনি সামহোয়্যারইন ব্লগে ইতিপুর্বে অল্প বিস্তর লিখেছিলেন এবং অনেকেই দাবি জানিয়েছিলেন লেখাগুলোকে বই আকারে প্রকাশের জন্য। কিন্তু তিনি দীর্ঘ অনেক বছর সময় নিয়েছেন, নিজের লেখাকে শানিত করেছেন, মান সম্মত লেখার জন্য পরিশ্রম করেছেন। অবশেষে ২০২০ এ এসে প্রকাশ করেছেন তার বহুল আলোচিত স্মৃতিচারনমুলক বই - কিশোরীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ।
চলুন যাওয়া যাক লিখিত সাক্ষাতকারে। বিস্তারিত সাক্ষাতকার পরে প্রকাশিত হবে।
(আপাকে অনুরোধ করায় এই ছবিটি তিনি আমাদের সাথে শেয়ার করেছেন)
সাক্ষাতকারঃ এই পর্বের অতিথী - ব্লগার সুরঞ্জনা মায়া।
সুরঞ্জনা মায়া আপাকে যখন ফোন দিলাম, তখন মাত্র সন্ধ্যা পেরিয়েছে। নিজেই পরিচয় দিতেই আপা অত্যন্ত আন্তরিকভাবে সম্ভাষন জানালেন। আপার অনেক লেখা পড়েছি, একটা সময় ব্লগে সিলেটি ব্লগারদের একটা বিশাল গ্রুপ ছিলো, আপা ছিলেন সেই গ্রুপের অন্যতম প্রাণভোমরা। কিছুটা উত্তেজনা কাজ করছিলো আপার সাথে প্রথমবারের মত কথা বলতে গিয়ে।
আপা আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?
- ওয়ালাইকুম আসসালাম। এই ভাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
জী আপা, আমিও ভালো আছি। প্রথমেই আপনাকে ধন্যবাদ আমার আহবানে সাড়া দেয়ার জন্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে চেয়েছিলাম, আপনার ইন্টারভিউ দিয়ে আমাদের এই আয়োজনের শুরু করতে। সেটা সফল হচ্ছে দেখে আমি আনন্দিত।
- তোমাকে অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
তো আপা প্রথমেই জানতে চাইছি, লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত কিভাবে হলেন? শুরুটা কিভাবে হলো?
- বই পড়ার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ থেকেই লেখালেখির প্রতি ঝোঁক। শুরুটা কবিতা দিয়ে শুরু, ৮০/৯০ এর দশকে সিলেটের বিভিন্ন পত্রিকায় কবিতা দিয়েই শুরু হয়েছিলো।
এটাই কি আপনার প্রথম বই?
- হ্যাঁ, এটা আমার প্রথম একক বই। যদিও এর আগে বেশ সংকলনে আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
এই বইটিতে আপনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়কে তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে আপনার অভিজ্ঞতায় মুক্তিযুদ্ধের যে গল্প উঠে এসেছে সেখানে কি এমন কিছু আছে যা প্রচলিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বাইরেও নতুন কিছু আমাদেরকে জানার সুযোগ করে দিবে?
- যারা মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন বা মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছেন তাদের সবার অভিজ্ঞতা হুবহু এক নয়। আমার কিশোরী চোখে যা দেখেছি, শুনেছি আমি তাই তুলে ধরেছি। আমার দেখা রাজাকার যুদ্ধশেষে ১ বছর কারাভোগ করে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বহাল তবিয়তে বেঁচে ছিলেন। এমনকি মৃত্যুর আগে বিশিষ্ট সমাজসেবকের পুরস্কারও হাতে নিয়েছেন। এসব কথা কি ইতিহাসে এসেছে?
আমরা দুইজনেই এই পর্যায়ে একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নির্মম বাস্তবতায় আমি কিছুক্ষন নীরব ছিলাম। পরের প্রশ্ন ছিলোঃ
শাহবাগের আজীজ সুপার মার্কেট এক সময় বইয়ের মার্কেট বলে সুপরিচিত ছিলো। লেখক, কবি সাহিত্যিকদের আড্ডায় মুখরিত থাকত এই মার্কেটটি। কিন্তু বর্তমানে সেখানে গজিয়ে উঠেছে নতুন সব ফ্যাশন হাউজ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। অল্প কিছু বইয়ের দোকান এখনও সেখানে টিকে আছে। আপা আপনার মতে এই পিছনে মুল কারন কি ?
- হ্যাঁ জাদিদ। আজীজ সুপার মার্কেটের দশা আসলেই দুঃখজনক। নিউমার্কেটে আগে অনেক বইয়ের দোকান ছিলো। এখন সেগুলো টিকে আছে কিনা জানিনা। মূল কারন আমার কাছে মনে হয় দুটোই। বানিজ্যিক, আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারনে বইয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ অনেকাংশে কমে গেছে। মানুষ এখন বই পড়তে চাইলে অনলাইনে পিডিএফ পেয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা, আপু প্রতি বছর বই মেলা আসলে আমরা দেখি প্রচুর নতুন লেখক নিজের পয়সা খরচ করে বই প্রকাশ করছেন। এদের মধ্যে কত পারসেন্ট সত্যিকারভাবে লেখক হিসেবে প্রস্তুত বা একটা মানদন্ডে পৌছেছে?
- অংকের হিসেবে যাবোনা। শুধু বলবো বই প্রকাশ করলেই লেখক হওয়া যায়না। যারা নিজের গাটের পয়সা খরচ করে বই প্রকাশ করেছেন তারা নিজেদের অবশ্যই লেখক বলে দাবী করেন। এবং কেউ সেটা না করলেও ক্রুদ্ধ হন। কিন্তু একজন লেখক তখনই লেখক হন, যখন পাঠকেরা তাকে লেখকের স্বীকৃতি দেন। এটা সম্পুর্ন পাঠকের উপর নির্ভর করে। এক বছরে ১০/২০ টা বই প্রকাশ করে যেমন লেখক হওয়া যায়না তেমনি একটি বই প্রকাশ করে পাঠকের মন জয় করে লেখকের মালা গলায় পরা যায়। আমার সামান্য জ্ঞান বুদ্ধিতে এটাই বুঝি।
আপু আপনার বইটি কি কোন প্রকাশনীর নিজ উদ্যোগে প্রকাশ হয়েছে নাকি আপনি নিজের উদ্যোগে প্রকাশ করেছেন?
- আমার বইটি প্রকাশের সম্পুর্ন কৃতিত্ব এক রঙা এক ঘুড়ি প্রকাশনীর। নীল সাধু ভাই আমাকে উৎসাহিত করেছেন লেখাটি বড় করতে, একটা বইয়ের জন্য যা যা প্রয়োজন সবই নীল ভাই বলেছেন। আমি নীল সাধু ভাই ও এক রঙা এক ঘুড়ির কাছে কৃতজ্ঞ।
আপা আমরা পাঠক বাড়াতে পারছি না কিন্তু লেখক বেড়ে যাচ্ছে। এটা কি ইতিবাচক না নেতিবাচক?
- অবশ্যই নেতিবাচক। আগে পড়তে হবে। প্রচুর পড়তে হবে।
আপনার বই সম্পর্কে বলুন?
(আপু যখন বর্ণনা করছিলেন, মনে হচ্চিলো - তিনি চোখের সামনে সব দেখতে পাচ্ছেন )
১৯৭১ কিশোরীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ বইটি আমার অনেক বড় দুর্বলতা। আমার এই লেখাটি প্রথম সামহোয়্যারইন ব্লগেই প্রকাশিত হয়েছিলো। এবং আমার সৌভাগ্য যে সেই লেখাটি প্রচন্ড জনপ্রিয় হয়েছিলো। সহব্লগারদের দাবী ছিলো এটা মলাটবন্দী করার। মলাটবন্দী করতে দীর্ঘ বছর লাগলো। গত বছর বইমেলায় আমি মঞ্জুরুল হক ভাইয়ের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক " আ লিটল ফাইটার স্লিপিং উইথ আর্মস" বইটি পড়ে ভিষন রকম অনুপ্রাণিত হই। মঞ্জুরুল ভাই ১২ বছর বয়সী কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আমি যুদ্ধক্ষেত্রে না গেলেও যুদ্ধ তো দেখেছি। সে নয় মাসের জীবন যুদ্ধের কথাই নাহয় লিখি। তখন থেকে শুরু করেছিলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ১১ এর কিশোরী। সেই কিশোরী চোখে যুদ্ধ, পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন, মানব থেকে দানব হয়ে যাওয়া, উদবাস্তু হয়ে অজানা, অচেনা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছুটে বেড়ানো, পেছনে তাড়া করা মৃত্যুভয়, আগুনের লেলিহান শিখা, চোখের সামনে গুলি খেয়ে লাশ হয়ে মনু নদীর স্রোতে লাশ ভেসে যাওয়া দেখেছি। আমি চেয়েছি যুদ্ধের সেই বিভৎসতা যা আমি দেখেছি তা সবার সামনে তুলে ধরতে। আমরা যারা যুদ্ধ সাক্ষী তাদের সবারই একাজ করা উচিত। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সত্যটা বলা প্রয়োজন। যেখানে ক্রমাগত ইতিহাস বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। ইতিহাস রক্ষায় সামান্য ভূমিকা রাখতে না পারলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি আমাদের ক্ষমা করবে?
চমৎকার বলেছেন আপু। আমি বইটি অবশ্যই সংগ্রহ করার ইচ্ছা রাখি। আপনাদের মত লেখকদের বর্ণনাতেই মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের ইতিহাস জানা যাবে আমার বিশ্বাস। এবারের প্রশ্ন হচ্ছে - আমরা জানি আপনার সত্যিকারের একটি অন্য নাম আছে। কিন্তু আপনি বই প্রকাশ করেছেন ছদ্মনামে। কারনটি কি?
- (মৃদ্যু হেসে) সুন্দর প্রশ্ন। অনেকেই এই প্রশ্ন আমায় করেছেন। এর উত্তর আমি আমার বইয়ের ভূমিকা, পরিচিতিতেও দিয়েছি। সুরঞ্জনার জন্ম সামহোয়্যারইন ব্লগে। ২০০৮ সামহোয়্যারইন এ সুরঞ্জনার জন্ম, জনপ্রিয়তা। জামিলা হাসান নামটি সুরঞ্জনার আড়ালে চাপা পড়ে গেছে। আমি সুরঞ্জনা নামেই পরিচিত। আর তাই থাকতে চাই।
চমৎকার। আসলে ব্লগের প্রতি কতখানি ভালোবাসা থাকলে মানুষ এমনটা বলতে পারে, সেটা আপনাকে না দেখলে বোঝা যাবে না।
- (অট্ট হাসি দিয়ে) জাদিদ, আমি প্রয়োজনে এফিডেভিট করে আমার নাম সুরঞ্জনাই রাখবো।
হাহাহা। ভালো বলেছেন আপু। এবার সামহোয়্যারইন ব্লগের প্রতি আপনার পরামর্শ। এই উদ্যোগ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য পেলে ভালো লাগবে।
- অনেক ভাল উদ্যোগ জাদিদ। এভাবে যারা ব্লগের সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে জড়িত, তাদের লেখার সঙ্গে সবার পরিচিত করিয়ে দেবার মানসিকতা বাংলাদেশে আর কোন ব্লগে আছে কিনা আমার জানা নেই। এ কারনেই সামহোয়্যারইন ব্লগ অন্য সব ব্লগ থেকে আলাদা। অনন্য! পরামর্শ দেবার মত মানুষ এখনও হয়ে উঠিনি। আমার দেখা ব্লগের স্বর্নযুগের মত সব সময় যেন ব্লগের পরিবেশ থাকে, ব্লগ একটি পরিবার, সব ব্লগার সেই পরিবারের সদস্য। এই মন মানসিকতা নিয়ে আমরা সবাই যেন চলি।
এবার একটু ভিন্নধর্মী প্রশ্ন আপু। সামহোয়্যারইন ব্লগ যদি কখনও প্রকাশক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে তাহলে ব্যাপারটিকে আপনি কিভাবে দেখবেন?
- দেখো সামহোয়্যারইন ব্লগ দেশের সবচেয়ে বড় ব্লগ। অনেকের লেখালেখির হাতে খড়ি হয়েছে এই ব্লগে। ব্লগের বানিজ্যিক সুবিধার জন্য যদি কখনও সামহোয়্যারইন ব্লগ প্রকাশক হিসেবে আত্ম প্রকাশ করে তবে প্রকৃত ব্লগাররা অবশ্যই তাতে আস্থা রাখবে বলে আমি মনে করি। কারন সামহোয়্যারইন আমাদের আস্থা, ভরসার জায়গা।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আপু। আমাকে তাৎক্ষনিকভাবে সময় দেয়ার জন্য। আশা করি আপনার বইটি সকলে সংগ্রহ করবেন।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ জাদিদ।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ৮:৪৯