বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তিগত কাজে বা চাকরীসুত্রে আমাকে প্রচুর ভ্রমণ করতে হয়েছে। আমি এই কাজটি আনন্দ নিয়ে করতাম, ভ্রমণ করতে আমার খুব একটা খারাপ লাগে না। এই চলার পথে আমার অনেক মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে, অনেক অঞ্চলের মানুষের সাথে মিশেছি, ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি, রীতি রেওয়াজ, আতিথেয়তা দেখেছি। অধিকাংশই আমার কাছে খুব উপভোগ্য ছিলো। এর মধ্যে সবচেয়ে দাগ কেটেছে মানুষের আতিথেয়তা। আমাদের বাঙালিদের আতিথেয়তা গল্প নতুন করে বলার কিছু নেই, বিরুপ পরিস্থিতিতেও আমি এমন সব আতিথেয়তা মুখোমুখি হয়েছিলাম, যা বুঝি শুধুমাত্র বাংলাদেশেই সম্ভব। আমার এই ধরনের কিছু অভিজ্ঞতা নিয়েই এই সিরিজ।
আমার জন্ম হয়েছিলো আমার নানা বাড়িতে। আমার নানা বাড়ির স্থানীয় নাম দারোগা বাড়ি। আমার নানার বাবা বৃটিশ আমলে পুলিশে যোগদান করেন। বৃটিশ আমলের শেষ দিকে তিনি যোগ্যতা অনুযায়ী পদন্নোতি পেয়ে ইন্সপেক্টর হন। ফলে তখন তিনি প্রায় পাঁচ একর জায়গার উপর একটি বিশাল বাড়ি নির্মান করেন। এই বাড়িটি আমার কাছে একটি স্বপ্নের বাড়ি বলে মনে হতো। বাড়ির সম্মুখে একটি বিশাল পুকুর, ভেতরে মহিলাদের ব্যবহারের জন্য আরেকটি ছোট পুকুর, সেই পুকুরের পাড় ধরে জলপাই গাছের বাগান ও বিভিন্ন জাতের পেয়ারা ও আমের গাছ লাগানো হয়েছিলো। বাড়ির ভেতরে এবং পেছনে ছিলো সুপারি বাগান, আনারস বাগান। আর উঠোনের বিভিন্ন স্থানে ছিলো ডালিম গাছ, কদবেল গাছ এবং আরো অনেক নানা প্রজাতির ফলের গাছ। বাড়ির সীমানা বরাবর খাল খনন করে সেখানে প্রায় দুইশ নারিকেল গাছ লাগানো হয় যা দুর থেকে দেখতে অদ্ভুত সুন্দর লাগত।
আমার নানা এই বাড়ির মায়ায় পড়েছিলেন। ফলে আমার নানার ভাই ও বোনেরা যখন ঢাকায় বিভিন্ন স্থানে ঘর বাড়ি করে প্রতিষ্ঠিত, তখন তিনি তাঁর বাবাকে অনুরোধ করে সেই গ্রামেই থেকে গিয়েছিলেন। আমার নানা ছিলেন একজন সরকারী ডাক্তার। অনেক মানুষ তাঁকে চিনতেন। আমরা শহর থেকে গ্রামে গেলে যখন বাজারে যেতাম, তখন বলা হতো ডাক্তার সাহেবের নাতি। তখন সবাই খুব বাড়তি আদর যত্ন করতেন। আমার এই নানা আমাকে কেন যেন অদ্ভুতরকম ভালোবাসতেন, স্নেহ করতেন। আমি এটার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারব না।
আমি ছুটি পেলেই গ্রামে চলে যেতাম। নানার সাথে মাছ ধরতাম, পুকুরে সাঁতার কাটতাম, সাইকেল চালাতাম। চোখ বন্ধ করলে আমি এখনও দেখতে পাই, আমাকে পিছনে বসিয়ে নানা বাতাস কেটে সাই সাই করে প্যাডেল মেরে এগিয়ে যাচ্ছেন আর আমি তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছি। আমি সাইকেল চালানো শিখেছিলাম তাঁর কাছ থেকে। আমার জীবনের অন্যতম সেরা স্মৃতি - আমি সাইকেলে কিছুটা নড়বড় অবস্থায় প্যাডেল দিচ্ছি, নানা আমাকে পেছন থেকে ধরে রেখে ধীরে ধীরে ধাক্কা দিচ্ছেন। একসময় আমি ব্যালেন্স শিখে ফেললাম, সাইকেল চালাতে শুরু করলাম। নানা আমার পিছনে পিছনে দৌড়াচ্ছেন আর উত্তেজনায় চিৎকার করছেন। সেদিন সেই সাইকেল নানা আমাকে উপহার দিয়েছিলেন, আমি প্রচন্ড খুশিতে কেঁদে ফেলেছিলাম। নানাভাই হাসছিলেন। আমার জীবনের সব সুন্দর মুহুর্তগুলো বিকেল বেলায়ই ঘটেছে, সেদিনও একটা অদ্ভুত সুন্দর বিকেল ছিলো।
আমি গ্রামে গেলে ফিরে আসতে চাইতাম না। বায়না ধরেছিলাম আমাকে যেন গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হোক। কিন্তু আম্মা আব্বার চোখের কড়া শাসন আর বকুনিতে আমাকে শহরে ফিরে আসতেই হতো। শহরে ফেরত আসার দিনে, আমাকে ট্রেনে উঠিয়ে তিনি জানালা দিয়ে আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। ট্রেন চলতে শুরু করলেও তিনি আমার হাত ছাড়তেন না, হাটতে থাকতেন। ট্রেনের গতি বেড়ে গেলে তিনি দৌড়াতেন। একদম প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় এসে হাত ছেড়ে দিতেন। আমি সারা জীবনই এই সময়টায় নানাভাই নানাভাই বলে কান্না করতাম। ট্রেনের মানুষজন অবাক হয়ে আমাকে দেখত। ঢাকায় ফেরত আসার পর কিছুদিন আমার কোন কিছুই ভালো লাগত না। খালি কান্না পেতো। আজ এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন আমার চোখে পানি। লিখতে যাচ্ছিলাম, বাঙালির আতিথিয়তার গল্প কিন্তু কি যে লিখছি আমি তা জানি না।
আমার নানা মারা যান ২০০৭ সালের আগষ্ট মাসে। সবাই কান্না করছিলো, আমি কেন যেন কাঁদতে পারছিলাম না। আমার নানাকে আমি নিজ হাতে কবরে শুইয়ে দিয়েছিলাম। চারিদিকে প্রচুর মানুষ। কয়েকশ লোক তাঁর জানাজায় এসেছেন। তাদের প্রিয় ডাক্তার আর নেই। এমন কি আমি নানাকে কবর দিয়েই ঢাকায় চলে আসি। যখন ট্রেন ছাড়ছিলো, তখন আমার সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। আমার মনে হলো, হায় হায় আমার হাত ধরার মানুষটা তো চলে গেলো। বার বার মনে হচ্ছিলো, প্লীজ কেউ আমার হাতটা ধরুক। আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। ট্রেনের মানুষজন অবাক হয়ে আমাকে দেখতে লাগলো। আমি কাঁদতে কাঁদতে ঢাকায় আসলাম।
এরপর থেকে কেন যেন, আমার আর নানাবাড়ি যেতে মন চায় না, গেলেও আগের মত আনন্দ পাই না। একটা অদ্ভুত শূন্যতা আমাকে ঘিরে ধরে। আমার এই নানা বাড়িতে এখনও আমার নানী একাই বসবাস করেন। বিশাল একটা বাড়িতে আমার বৃদ্ধ নানী, তার বৃদ্ধ এক সহকর্মী আর দুই একজন কাজের মানুষ নিয়ে বসবাস করেন। আমার নানা বেঁচে থাকতে নানীকে বলেছিলেন- আমি মারা গেলে তুমি টেনশন করবা না, কারো কাছে থাকবা না, আমার নাতির কাছে থাকবা। তাই আমি সুযোগ পেলেই আমার নানীর কাছে যাই। আমরা দুইজন মিলে নানার স্মৃতিচারন করি, গল্প করি। নানা হয়ত আমাদের পাশে নেই, কিন্তু আমাদের অন্তরেই আছেন।
আমি তখন চট্রগ্রামে কর্মরত। কয়েকদিন ছুটি পেলাম। ছুটিতে হঠাৎ মনে হলো, গ্রামের বাড়ি যাই, নানীকে সারপ্রাইজ দেই। গ্রামের বাড়ি যখন পৌছালাম, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। পুরো বাড়ি শুনশান। কুকুরের ডাকাডাকিতে বাড়ির কাজের লোক বের হয়ে আসলো। আগে বলে আসি নাই দেখে নানী কপট অভিমান করলেন। বললেন কি খাওয়াই বলো তো দেখি!
আমি হাত মুখ ধুতে পুকুরে গেলাম। হাত মুখ ধুয়ে বাড়ির কাজের লোকের সাথে গল্প করতে করতে ঘরে ঢুকে দেখি, নানী খাবারের আয়োজন করে ফেলেছেন। কই মাছ দিয়ে আলু মটরশুটির দোপেয়াজা, হাঁসের ডিম দিয়ে নারিকেলের ঝোল, পেঁয়াজ কলি দিয়ে আলু ভাজি আর জলপাইয়ের চাটনি। হা ভাতের মত কত যে ভাত খেলাম তার ইয়াত্তা নেই। খাওয়া শেষে নানীর জোরাজুরিতে গরুর দুধ দিয়ে ভাত খেলাম। নানী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার নানাভাই বেঁচে থাকলে আমার সাথে খুব রাগ করত, তোমার জন্য মুরগী জবাই করি নাই দেখে।
আমিও দীর্ঘশ্বাস ফেলে নানীকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলাম। তারপর অনেক রাত পর্যন্ত দুইজন মিলে গল্প করলাম। আমার পরিচিত কয়েকটা মেয়ের ছবি দেখালাম। জিজ্ঞেস করলাম, কোনটাকে পছন্দ হয়েছে কি না। নানী বললেন, একটাকে পছন্দ হয়েছে, তবে আরো দেখা উচিত। তারপর আরো কিছুক্ষন দুইজন মিলে দুস্টামি করে ঘুমাতে গেলাম। কোন একটা অদ্ভুত কারনে গ্রামে গেলে আমার খুব ভালো ঘুম হয়। এক ঘুমে রাত পার।
তারপর দিন ঠিক করলাম, নানীকে নিয়ে বেড়াতে যাবো। কোথায় যাওয়া যায় ভাবতে ভাবতে ঠিক হলো, নানীর এক দুর সম্পর্কের বোন আছে তাঁর বাসায় বেড়াতে যাবো। আমরা নানী আর নাতি মিলে খুব সেজে গুজে, কিছু মিষ্টি আর ফলমুল কিনে ঐ বাড়ীতে গেলাম। গিয়ে দেখি বাড়ীতে কেউ নেই, উনারা ঢাকায় গিয়েছেন। আমি আর নানী দুইজনই বেশ হতাশ এবং কিছুটা বিরক্ত। কারন এখন আবার এই সব জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ীতে ফিরে যেতে হবে। কারো জন্য উপহার কিনে সেটা বাড়ি বয়ে নেয়া খুবই যন্ত্রনাদায়ক একটি ব্যাপার। আমরা যখন ফেরত আসব, তখন পাশের বাড়ি থেকে একজন আমার নানীকে দেখে ডাকলেন। বললেন, আন্নে শেফালী আফা নঞ? ও বাবুরে কত্তদিন হরে আন্নেরে ছাইয়ের!
নানীও তাঁকে দেখে চিনলেন। বললেন, ও মাগো! জোৎস্নানিরে! কিয়ারে বাবুরে! তুই তো ছাই বুড়া হই গেছস, চুল হাকি গেসেগৈ।
দুইজন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আবেগে আপ্লুত হলেন। যা বুঝলাম, আমার নানী আর এই নানীর বাপের বাড়ি পাশাপাশি। ছোটকালে এক সাথে খেলাধুলা, স্কুলে গিয়েছিলেন। বিবাহ সুত্রে তিনি আবার নানীর এই বোনের প্রতিবেশি হয়েছেন। নানী আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি সালাম দিলাম। বললেন, তুঈ, তুহিনের হোলা নি! তারপর নানীর দিকে তাকিয়ে বললেন, হুরাই তো ডাক্তার সাহেবের জোয়ান কাল। তারপর হেসে আমার গাল টেনে দিলেন।
আমরা যখন চলে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তিনি চিৎকার দিয়ে বললেন, ছলি যানের মানে? হাগল হৈ গেছেন নি কোন! আন্নে নাতিরে লই আইছেন হপইল্লা বার, আর হুদা ছলি যাইবেন? এরই হুইঞ্চতি!! ইগো বুউজা, অ্যাঁর বাড়িত বুঝি দুগা ভাত নাই? কেমনও?
ততক্ষনে বাড়ির ভেতর থেকে উনার ছেলের বউয়েরা আর নাতিরা বের হয়ে চলে আসল। মানা করার কোন সুযোগই ছিলো না। আমি খুশি হলাম যে, অন্তত এই কেনা ফলমুল আর মিষ্টির একটা গতি হলো।
উনারা এই বাড়িতে বেশ কিছু পরিবার এক সাথে বাস করেন। ইতিমধ্যে আমি বাড়ির ছেলেমেয়েদের সাথে আড্ডা দেয়া শুরু করেছি। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, গ্রামের মেয়েরা কিছুটা সহজ সরল যেমন হয়, তেমনি কিছুটা ইচড়ে পাকা স্বভাবেরও হয়। কথা বলার সময় ক্লাস সেভেন এইটে পড়া মেয়েরা কেমন যেন প্রেম প্রেম দৃষ্টিতে তাকায়। আমার শহরের বান্ধুবীদের কথা ভাবলাম। মনে মনে আমার বেশ হাসি পেলো।
আমার ঐ নানীকে দেখলাম তিনি আয়োজন নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আমার জন্য ডাব পাড়ালেন। মুড়ির মোয়া, ডাবের পানি আর ডিমের পিঠা খেতে দিলেন। ডিমের পিঠাটা আমি নিলর্জ্জের মত দুইবার চেয়ে খেলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করতেই নানির বড় ছেলে আসলেন। তিনি স্থানীয় কলেজে শিক্ষক। তিনিও আমার নানীকে চিনতে পেরে আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমাকে একটা লুঙি দিয়ে বললেন, যেন আরাম করে বসি। লুঙ্গি পড়ার যখন সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন ঐ মামাকে ডেকে বললাম, তাহলে পুকুরে সাঁতার কাটব। তিনি হই হই করে আমাকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, খুবই ভালো কথা, তাহলে মাছও ধরা যায়।
আমাকে পানিতে নামতে দেখে বাড়ির আরো কয়েকজন ছেলেপেলে পানিতে নেমে গেলো। মামা হাক দিয়ে বললেন, এই তোরা দুপুরে আমার বাড়িতে খাইস! এখন ভালো করি মাছ ধর! আমরা ঘন্টা দেড়েক দাপাদাপি করে পুকুরের মাছগুলোকে আতংক গ্রস্থ করে দুইটা বিশাল সাইজের কাতলা আর ব্রিগেড মাছ ধরলাম।
তারপর কিভাবে যেন সময় কেটে গেলো। গোসল শেষ করে মসজিদে নামাজ পড়ে আসতেই দেখি খাবার রেডি। খাবারের মেন্যু দেখে আমি আতংকিত হলাম। পোলাউ, সাদা ভাত, মুরগীর সাদা কোরমা, গরুর মাংস, ডিম দিয়ে মাষ কলাইয়ের ডাল, কাতলা মাছের ঝোল, ব্রিগেড মাছ ভাজা আবার ভুনা, সহ আরো বেশ কিছু আইটেম।
আমি খেতে বসে বললাম, নানী আমি নিজে নিয়ে নিবো। কিন্তু এই কথা তিনি বুঝতে ব্যর্থ হলেন। কোন মতে সামান্য পোলাউ খেয়ে উনাকে শান্ত করে ভাতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। পুকুরে দাপাদাপির কারনে বেশ খিদে লেগেছিলো। কাতলা মাছ টমেটো আর সামান্য দুই একটা অদিনের শীম দিয়ে রান্না করা হয়েছিলো, সেটা ঝোল যে কি দুর্দান্ত স্বাদের হয়েছিলো, সেটা লিখে বুঝাতে আমি অক্ষম। আমাদের অঞ্চলে মাংসের তরকারী দিয়ে মাসকলাইয়ের ডাল খায়। অর্থাৎ যদি মাংস খান, তাহলে সাইড ডিস হিসাবে মসুরের ডালের চাইতে মাষ কলাইয়ের ডাল বেশি পছন করে। আর এই ডালে হাঁসের ডিম দেয়া হয়, ফলে একটা অন্যরকম স্বাদ পাওয়া যায়। আমি দুই পিস গরুর মাংসের সাথে একটু কলাইয়ের ডাল আর হাফ ডিম দিয়ে খাওয়া শেষ করলাম। এই প্রতিটা আইটেম আসলে স্বয়ংসম্পূর্ন। অর্থাৎ যে কোন একটি দিয়েই শান্তিমত কয়েক প্লেট ভাত খাওয়া যায়। কিন্তু সবগুলো এক সাথে হলে তখন কষ্ট হয়ে যায়। আমারও অবস্থা হয়েছিলো তেমন। খাওয়া শেষে পাতে দেয়া হয়েছিলো মহিষের দই আর শ্রী মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টি। খাওয়ার পর নড়তে পারছিলাম না।
আমি লাজ লজ্জা ভুলে প্যান্টের বেল্ট খুলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। সবাই আমাকে দেখে হেসে উঠলো।
বিকালে যখন আমরা বাড়ি ফিরে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন তারা কোনভাবেই আসতে দিবেন না, বরং রাতের বেলা থেকে যেতে বললেন। নানী বহু কষ্টে ব্যাপারটা ম্যানেজ করলেন, আমার কাজের দোহাই দিয়ে। কিন্তু ঐ নানী আসার সময় টিফিন কারীতে করে মুরগীর কোর্মা, গরুর মাংস আর ডাল দিয়ে দিয়েছিলেন। আমাকে দেখিয়ে বলেছিলেন, আমার নাতি খাইতে পারে নাই। এইগুলো রাতে খাবে।
যখন রিকশায় উঠছিলাম, তখন চোখে পানি নিয়ে আমাকে বিদায় দিলেন। বললেন, ভাইরে! আর কখনও আমার বাড়িতে আসবি কি না জানি না। তোরে কত ছোট দেখছিলাম। কি খাইসো না খাইসো জানি না। তারপর আমার পকেটে জোর করে ৫০০ টাকা গুজে দিলেন। বললেন, তুমি কিছু কিনে খাইও।
তারপর আমার নানীকে জড়িয়ে ধরলেন। অশ্রুসজল চোখে একে অন্যকে বিদায় দিলেন। আমরা কিছুটা মন খারাপ করে বাড়ির পথ ধরলাম। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে টিফিনকারী খুলে দেখি, কিসের গরুর মাংস আর ডাল!! ঐ নানী আমার জন্য হাঁসের মাংস আর পিঠা রান্না করে দিয়েছেন।
আমি প্রচন্ড আবেগ আপ্লুত হলাম। মনে মনে ভাবলাম- মানুষের এই ভালোবাসা শহর ধারন করতে অক্ষম। এই শহরে ভালোবাসা বহু আগেই পালিয়ে গেছে। এই শহরে মেহমান মানে বাড়তি যন্ত্রনা, একজন লোক দুপুরে এক্সট্রা খাবে শুনলে ভ্রু কুঁচকে উঠে না এমন পরিবার খুব কমই আছে। কত কিছু হিসাব নিকাশ করে বাসায় আনতে হয়, রক্ষা করতে হয় সোশ্যাল স্ট্যাটাস। আসলে এই শহরে সবাই টানাটানির জীবন, টোনাটুনির সংসার! এমন জীবন কি সত্যি আমরা চাই?
সেবার নানী থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়ার সময় নানী আমার পিছে পিছে বাড়ির শেষ সীমানা পর্যন্ত এসেছিলেন। দুই চোখের জলে তিনি আমাকে বিদায় দিলেন। আমি রিকশায় করে বাস স্ট্যান্ডের দিকে রওনা দিলাম। রাস্তা থেকে আমার নানার কবর দেখা যায়। কবরের কিছু গাছের ফুল ফুটেছে। ফুলগুলো বাতাসে এদিক সেদিক দুলছে। রিকশা চলতে শুরু করার সাথে সাথে মনে হলো ফুলগুলোও দ্রুত দোলা শুরু করেছে। আমার মনে হলো, গ্রাম থেকে শহরে ফেরার সেই ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছে, নানাভাই প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে আর আসতে পারছেন না। আমি চোখের আড়াল পর্যন্ত প্রবল বেগে হাত নাড়িয়ে আমাকে বিদায় দিচ্ছেন।
আমি ও হাত তুললাম, হাত তুলে পাগলের মত নাড়তে থাকলাম আর বলতে লাগলাম, নানাভাই! ও নানা ভাই!! আমি যাই কেমন
বাঙালির আতিথিয়েতার গল্প-১।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:২৭