somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলাদেশের জন্মঃ এক মহাকাব্যিক ইতিবৃত্ত

০৮ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ‘India Wins Freedom’ বইয়ের তথ্য পর্যালোচনা করে পাকিস্তান সৃষ্টি সম্পর্কে আকবর আলী খান মন্তব্য করেছেন, “একজন অতি আকর্ষণীয় মহিলার ছলাকলা, কতিপয় মুসলিম আমলার কূটচাল ও অতিথিবৎসলদের দেশে এক রাজনৈতিক নেতার হাড়কিপটেমি- এ ধরণের কতিপয় কাকতালীয় ঘটনার ফলে পাকিস্তানের জন্ম”

আকবর আলী খানের কথার মর্মাথ বুঝতে হলে ইতিহাসের খেরোখাতায় আমাদের দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে হবে। ১৯৪৬ সালের ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব ছিল ৩ টি শাসনতান্ত্রিক অঞ্চল সৃষ্টি করে অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতা প্রদান। মুসলিম লীগ এই দাবি মেনে নিলেও নেহেরুর বিরোধিতায় এই প্রস্তাব ভেস্তে যায়। এর পর লর্ড মাউন্টব্যান্টেনের স্ত্রী এডউইনার সাথে নেহেরুর বুদ্ধিভিত্তিক প্রেম তাপ নেহেরুর বিরোধিতার মোমকে গলিয়ে ফেলে।

১৯৩০ সালে চৌধুরী রহমত আলী কর্তৃক প্রকাশিত “ Now or Never” শীর্ষক ক্রোড়পত্রে সর্বপ্রথম পাকিস্তান শব্দের ব্যবহার করা হয়। এখানে পাকিস্তান এর সাথে বাংলার সংযুক্ততার কোন কথা উল্লেখ ছিল না। অন্যদিকে ১৯৪০ সালে শেরে বাংলার প্রস্তাবিত লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের প্রস্তাব করা হয় নি বরং মুসলমানদের নিয়ে আলাদা দুইটি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব ছিল।

কলকাতার বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অনীহা ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক সংশোধিত লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতেই ধর্মকে পুঁজি করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়। এজন্যই গবেষকরা বলে থাকেন পাকিস্তানের সৃষ্টি ছিল কাকতালীয় ও ইতিহাসের মূলধারা থেকে বিচ্যুতি। বাংলাদেশের জন্ম এই ইতিহাস বিচ্যুতির প্রয়োজনীয় সংশোধন, যার জন্মপ্রক্রিয়া ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গর্ভেই স্থিতি লাভ করেছিল।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয়দফা, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচন এবং ১৯৭১ –এসব বাঙালির পরম আধরের ধন, গর্বের তেজদীপ্ত সুর। যে সুরের রাগিণী বঙ্কিমের আহবানকে ফুলে-ফলে সুশোভিত করেছে। কেননা বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদর্শন পত্রিকায় “ বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে কয়েকটি কথা” শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “বাঙ্গালার ইতিহাস চাই। নইলে বাঙ্গালি কখনও মানুষ হইবে না”।

বাঙ্গালির ইতিহাস রচিত হলেও সময়ের পরিক্রমায় তা যে এক মহাকাব্যিক উপাখ্যান হয়ে উঠবে তা কেউ আন্দাজ করতে পারে নাই। সাবেক বিচারপতি হাবিবুর রহমান এর মতে, “১৯৪৭ থেকে ১৯৭১-এর ১ মার্চ পর্যন্ত ঘটনা-দুর্ঘটনা পাকিস্তানে যা হয়েছে তার সঙ্গে পূর্ব-বাংলার স্বাধীনতার কোন সংযোগই ছিল না”। ২রা মার্চ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়েই জোরে শোরে ৬ দফা ও ১১ দফার সম্মিলিত স্বায়ত্তসাশনের সুর পূর্ণাঙ্গ গান গাইতে শুরু করে।

এজন্যই বাংলাদেশের অভূতপূর্ব ইতিহাসের যাত্রাপথে মার্চ মাসের তাৎপর্য ও গুরত্ব অপরিসীম। এই মাস একদিকে যেমন আনন্দের বার্তাবাহক, অন্যদিকে বেদনাবিধুর কালো রাতের স্মৃতিবাহক। ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণের উদাত্ত আহবান বাঙ্গালি জাতিকে এক অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল যা নিঃসন্দেহে পরাধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করার আনন্দগান গীত করেছিল।

অন্যদিকে ২৫ মার্চ রাতের “অপারেশন সার্চলাইট” মানব ইতিহাসের জাতিগত নিধনের এক কালজয়ী রক্তাত দলিল। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইনের তথ্য মতে এই দিনে শুধু ঢাকাতেই ৩০০০০ লোক হত্যা করা হয়েছে। অমানবিক নৃশংসতার হৃদয় বিদারক বর্ণনার তথ্য পেতে মেজর সিদ্দিক সালিক রচিত “ Witness to Surrender” বইটি অবশ্যই পাঠ করা উচিত। শুধু মাত্র ক্ষমতার লোভ কিছু মানুষের মৌলিক মানবীয় গুণাবলীকে কিভাবে ধবংস করে দেয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়ন।

রবার্ট পেইনের “ম্যসাকার” বইয়ের তথ্য অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই বাঙ্গালি নিধনের এই মহাপরিকল্পনা করেছিলেন রক্তপিপাসু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার খান। এক বৈঠকে জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজাকে তিনি নির্দেশ দেন “Kill three million of them, and the rest will eat out of our hands.”

অপারেশন সার্চলাইট এর মূল পরিকল্পনা ও এর বিস্তারিত বিবরণ জানতে পারা যায় এই মিশন বাস্তবায়নকারী মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা রচিত আত্নজীবনী “A Stranger in my Own Country” গ্রন্থে। ২৫ মার্চের পর গণহত্যা শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না এর বিস্তৃতি ছিল দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে বাংলাদেশের গণহত্যাকে অন্যতম ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেছেন সমাজবিজ্ঞানী আর জে রুমেল।

২৫ মার্চ রাতে একইসাথে আরেকটি অপারেশন পরিচালিত হয় যার নাম ছিল“অপারেশন বিগবার্ড”। এর মাধ্যমে গ্রেফতার করা হয় বাঙালি জাতির মুক্তির অগ্রসেনানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গ্রেফতারের পূর্ব মূহুর্তে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের প্রচ্ছন্ন ভাবের পূর্ণতা দেন “From today Bangladesh is Independent” এই ঘোষণায়।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণা কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে মেজর জিয়ার কণ্ঠে প্রচারিত হলে বাঙ্গালির মুক্তিসংগ্রাম এক অনন্য গতি লাভ করে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী এক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা পাই লাল সবুজের রঙ ছড়ানো একটি ভূখন্ড- প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ।

পৃথিবীর প্রাণের ভাবনায়, ভাবের গভীরতায়, রাজনীতির প্রখরতায় বাঙ্গালির এই সংগ্রাম সর্বদাই উজ্জ্বল আলোক হয়ে দীপ্তিমান থাকবে- এতে কোন সন্দেহ নেই। যুদ্ধকালীন নানা বর্বরতা ও বাঙ্গালির রণকৌশল এর কাহিনী নিয়ে কোন মহাকাব্য রচিত হলে তা অন্য সকল মহাকাব্যের অগ্রজ হবে বলে রম্য লেখক মুজতবা আলী যে মতামত দিয়েছিলেন তা যথার্থই প্রাসঙ্গিক, এ রায় দেয়াই যায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১১:১৫
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×