ছোটবেলায় বৈশাখ মাসের আগমন হৃদয়ে বসন্ত এনে দিত। এর কারণ ছিল এই মাস ছিল উৎসবের। সারা মাসব্যাপী গ্রামে একটা রমরমা অবস্থা বিরাজ করত। আমার নিজ গ্রামে এই মাসে দুইটি মেলা হত। পার্শ্ববর্তীপ্রায় প্রতিটি গ্রামেও বসত মেলার আসর। মেলার দিনে গ্রামে প্রায় প্রত্যেক ঘরেই মেহমানদের আগমন ঘটত। সামাজিক সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের এক অপূর্ব শোভা ঠিকরে ঠিকরে পড়ত পাড়া মহল্লার প্রতিটি ঘরে ঘরে।
প্রখর রৌদ্রের কারনে বিকেল বেলা মেলায় মানুষের ঢল নামত। হরেক রকমের মিষ্টি-মিঠাই, খেলনা ও ভেপু-বাশির সুরে গমগম করত মেলার প্রাঙ্গন। মেলা শেষে সন্ধ্যায় বসত গানের আসর। লোকগীতি, ভাওয়াইয়া ও পালাগানের মোহনীয় সুর সবাইকে আনন্দলোকে ভাসিয়ে নিত। পল্লী প্রকৃতির রূপ-বর্ণনা, গ্রামীন মানুষের জীবনগাথার শাব্দিক প্রকাশ এসব গানের সুরে প্রাণ লাভ করত। চাঁদনী পসর রাতে জোছনার মিতালি এক অপরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করত চারপাশে। রাতের নিস্তদ্ধতা ছেয়ে গানের সুর ভেসে যেত দূর থেকে বহুদূরে। এমন নিটোল সুন্দর দৃশ্যের রূপায়ন এখন আর দেখতে পাই না? কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সব। গ্রাম বাংলার প্রাণ-জুড়ানো এসব গানের কদর দিন দিন কমে যাচ্ছে।
গানের সুর হারিয়ে গেলেও মেলার আসর এখনও জমে আগের মত। তবে গ্রামীণ জীবনের আগের সেই সম্প্রীতি ও মায়া-জড়ানো ভালবাসার চিহ্ন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। গ্রামে আয়োজিত এই মেলাগুলো নিয়ে ছোটবেলায় নানীর মুখে অনেক কল্পকাহিনী শুনেছি। মজার ব্যাপার হল প্রত্যেক মেলার প্রাঙ্গনে একটি করে পীরের কবর রয়েছে। মেলার দিনে অনেকেই এখানে ছিন্নি( পায়েস, পোলাও, মাংস) দেয়। মেলার শেষ সময়ে এই মাজারের খাদেম এগুলো বিতরণ করে। সভ্যাতার অগ্রগতি হলেও এই গ্রামীণ অঞ্চলের এইসব পীরপ্রথার সংস্কৃতি আজও বহাল তবিয়তে রয়ে গিয়েছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু উপন্যাসের মজিদের মত শত শত মজিদ মানুষকে এখনও প্রতিনিয়ত ধোঁকা দিয়েই চলেছে।
আরও অবাক করা বিষয় হল এই মেলার আয়োজনের জন্য কোন প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজন পড়ে না। প্রত্যেক বছরের নির্দিষ্ট দিনে মেলার জন্য নির্ধারিত প্রাঙ্গণ দোকান-পাটে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এর রকম-ফের এখনও তেমন ঘটে নি, আগের নিয়মেই এখনও চলমান রয়েছে সব। তবে দিন দিন মেলাগুলো তার পূর্বের জৌলুস হারিয়ে ফেলছে। কিছু জৌলুস হারালেও মেলায় আয়োজন হয়ত চলতেই থাকবে যুগের পর যুগ.........।।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই এপ্রিল, ২০২০ রাত ১২:২৩