somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন

২০ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৩:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯ অক্টোবর ২০১৪ রবিবার বিকেল ৫:২৮ ৩৫, প্লামরোজ টরন্টো, কানাডা

বাবা-মা হলেন বিশাল শিল্পপতি-দম্পতি। তাদের ৪/৫ জন সন্তান-সন্ততি রয়েছেন। সবাই বিবাহিত এবং প্রতিষ্ঠিত। বাবা হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি সব দায়িত্ব থেকে ইস্তফা দিবেন। যেই সিদ্ধান্ত, সেই কাজ। শুধু ইস্তফাই নয়, সকল সম্পদ সন্তানদের মাঝে সমানভাবে লিখে দিলেন। কোম্পানির ম্যানেজারের পরামর্শ সত্ত্বেও নিজের বা স্ত্রীর নামে কোনো সম্পদ রাখেননি। সন্তানদের উপর তাদের ছিল অবিচল আস্থা। সোনার টুকরো একেকটা সন্তান তাদের অবসরময় জীবনটা আনন্দে ভরিয়ে দিবে--- এই ছিল তাদের বিশ্বাস।
এদিকে এত সম্পদ পেয়ে সন্তানরা এবং তাদের জীবনসঙ্গীরা ভীষণভাবে পুলকিত। আনন্দে আত্মহারা! বাবা-মা ভাবছিলেন তাদেরকে রাখার জন্য নিশ্চয়ই সন্তানদের মধ্যে দাঙ্গা বেঁধে যাবে। অথচ নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো কোনো সন্তানই বাবা-মার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত নয়। একেকজন একেক অজুহাতে দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো বাবা-মা পৃথকভাবে থাকবেন, বাবা এক সন্তানের কাছে, আর মা আরেক সন্তানের কাছে। এভাবে পালাক্রমে নির্দিষ্ট মেয়াদে সব সন্তানের বাসায় থাকবেন। যখন বাবা-মা সন্তানদের সিদ্ধান্ত জানতে পারলেন, তাদের হৃদয় ভেঙে গেলো! হাস্যেজ্জ্বল মুখটি মলিন হয়ে গেলো! তারপরও নিরুপায় তারা সন্তানদের বাসায় পৃথকভাবে থাকতে লাগলেন। এক পর্যায়ে তারা সন্তানদের বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন। বাবা একটি বই লিখে বিখ্যাত হয়ে যান। তখন ঠিকই সন্তানরা আবার বাবা-মার কাছে চলে আসে। কিন্তু বাবা তখন আর সন্তানদের গ্রহণ করেননি বরং এক সময়ের পালকপুত্রকে কাছে টেনে নেন যিনি কিনা দু:সময়ে তাদের পাশে দাড়িয়েছিলেন।
গল্পটি পরিচিত লাগছে? ঠিকই ধরেছেন। 'বাগবান' ফিল্মের গল্প। আজকের লেখার সাথে ফিল্মটির প্রাসঙ্গিকতা ভীষণ। গল্পটি শুধু ফিল্মের গল্প হলেই ভালো হতো; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো বাস্তবেও এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। আমাদের বনখেকো ওসমান গণির কথা মনে আছে তো? যার বাসার বালিশ থেকে টাকা উদ্ধার করা হয়েছিল; অথচ বৃদ্ধ মা প্রত্যন্ত গ্রামের এক কুঁড়েঘরে বাস করতেন! এরকম অসংখ্য মানুষরূপী জানোয়ারের খোঁজ পাওয়া যাবে যাদের সকল সুযোগ-সুবিধা থাকতেও বাবা-মার ন্যূনতম খোঁজ-খবরটুকু রাখেন না।

অন্যদিকে, আরেক বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় যৌথ পরিবারের আকর্ষণ কমে গেছে; একক পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে, কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। মানুষ দিনদিন যান্ত্রিক হচ্ছে। কারো খোঁজখবর নেয়ার ফুসরতটুকু নেই। এমনকি অনেকে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আত্মীয়স্বজনদের ন্যূনতম খোঁজও রাখতে পারেন না (ক্ষেত্রমতে, বাবা-মারও রাখেন না)। নচিকেতার গানে বৃদ্ধাশ্রমকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখানো হলেও পাশ্চাত্যের অনুসরণে বাংলাদেশেও এখন বৃদ্ধাশ্রম খোলা হয়েছে। শুনেছি ফিবছর জনপ্রিয়তা বাড়ছে বৈ কমছে না। বৃদ্ধাশ্রম ভালো নাকি মন্দ, সেটি ভিন্ন আলোচনা। তবে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় বৃদ্ধাশ্রমকে নেতিবাচকভাবেই দেখা হয়। হয়তো শিল্পোন্নয়নের সাথে-সাথে এর ইতিবাচকতা নিয়ে মানুষ ভাবতে শুরু করবে। তবে যেটি এতদিন শুধু নৈতিকভাবে ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ ছিল, অর্থাৎ পিতা-মাতার কোনো প্রকার দেখ-ভালের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া, সেটি এখন আইনগতভাবেও দণ্ডনীয় করা হয়েছে। বাংলাদেশের সমসাময়িক সামাজিক প্রেক্ষাপটে 'পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ আইন, ২০১৩' নি:সন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। সরকার সেজন্য ধন্যবাদ পাবে সন্দেহ নেই।

আইনটির কলেবর বেশ ছোটো, মাত্র ৯টি ধারা, তবে গুরুত্ব বিশাল। আইনটিতে মাতা-পিতার ভরণ-পোষণের সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। পিতা-মাতার অবর্তমানে দাদা-দাদী, নানা-নানীর ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করা হয়েছে। কোনোভাবেই বাবা-মা'র অমতে তাদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো যাবে না। একাধিক সন্তান হলে যৌথভাবে আলোচনা করে ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে হবে। বাবা-মাকে পৃথক করা যাবে না; দুজনকে একই সাথে বসবাস করার ব্যবস্থা করতে হবে। এমনকি পিতা-মাতার সাথে সাক্ষাৎ, তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ রাখা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবাও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাছাড়া পিতা-মাতা যদি সন্তান ব্যতীত অন্যত্র বসবাস করেন, সেক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তান তাদের আয় থেকে যুক্তিসঙ্গত পরিমাণ অর্থ প্রদান করবে। এখানে সুনির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ধারণ না করে 'যুক্তিসঙ্গত' উল্লেখ করায় একদিক থেকে ভালো হয়েছে। এটা জুডিশিয়াল ইন্টারপ্রেটেশনের উপর থাকুক। আইনটি ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ এক লক্ষ এবং অনাদায়ে তিনমাস কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বোধকরি ভরণ-পোষণসংক্রান্ত উপরিউক্ত আইনগুলো যথেষ্ট যৌক্তিক এবং এসব ক্ষেত্রে দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই বললেই চলে।

এখানে ভরণ-পোষণের সংজ্ঞাটি উল্লেখযোগ্য। “ভরণ-পোষণ” বলতে ''খাওয়া-দাওয়া, বস্ত্র, চিকিৎসা ও বসবাসের সুবিধা এবং সঙ্গ প্রদান''কে বোঝানো হয়েছে। বিশেষ করে সঙ্গ প্রদানকে ভরণ-পোষণের অন্তর্ভুক্ত করাটা চমৎকার। বৃদ্ধ মানুষদের মূলত এটাই প্রধান চাওয়া। আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, 'ভরণ-পোষণ' সংজ্ঞার মধ্যে 'বিনোদন' অন্তর্ভুক্ত করলে আরো যুৎসই হতো। মানুষের জীবনে বিনোদনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। বৃদ্ধ বয়সে মনকে সতেজ রাখার জন্য বিনোদনের বিকল্প নেই।

এবার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির উপর আলোকপাত করা যাক। তা হলো আইনটির বাস্তবায়ন। লেখাটি শুরু করার আগে বাংলাদেশ সরকারের আইন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটটিতে একটু ঢু মেরেছিলাম। অসংখ্য আইন! দেখেই মনটা খুশিতে ভরে গেলো! মোটামুটি এমন কোনো বিষয় নেই যার উপরে আইন প্রণয়ন করা হয়নি। কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো এসব আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয় না; অবাস্তবায়িত থেকে যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আবার ক্ষেত্রমতে প্রয়োগ করা হয় বিশেষ উদ্দেশ্যে।

বর্তমান আইনটির ধারা ৭ (২) নিয়ে আমার আপত্তি আছে। এবং আমার ধারণা, এই আইনের অধীন মামলা হবে না বললেই চলে। ৭ (২) ধারাতে বলা হয়েছে- ''কোন আদালত এই আইনের অধীন সংঘটিত অপরাধ সংশ্লিষ্ট সন্তানের পিতা বা মাতার লিখিত অভিযোগ ব্যতীত আমলে গ্রহণ করিবে না।'' আমাদের আইনপ্রণেতারা আমাদের সমাজব্যব্স্থা সম্পর্কে ভালোই ওয়াকিবহাল। তারপরও কেন তারা অভিযোগ আনার বিষয়টি শুধু পিতা-মাতার লিখিত অভিযোগের উপর ছেড়ে দিচ্ছেন, তা বোধগম্য নয়। আমাদের পিতা-মাতারা শত কষ্টের শিকার হলেও কখনো সন্তানের অমঙ্গল চান না; সেখানে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা তো অনেক পরের কথা। সরকার যদি সত্যিকারার্থেই পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে চায়, তাহলে আইনটির প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য অভিযোগ দায়েরের আওতা বাড়াতে হবে। উন্নতবিশ্বে কেউ একজন ফোন দিয়ে যদি পুলিশকে অভিযোগ করে যে, অমুক বাসায় শিশু সন্তানকে অত্যাচার করা হচ্ছে বা কাউকে মারা হচ্ছে, তৎক্ষণাৎ পুলিশ তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আর আক্রান্ত মানুষটি নিজে ফোন দিয়ে জানালে তো কথাই নেই। বাংলাদেশেও এই বিষয়টি গ্রহণ করার প্রয়োজন রয়েছে। অন্তত পিতা-মাতা রাজী না হলেও যাতে আত্মীয়-স্বজন বা কাছের মানুষরা সন্তানদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

পরিশেষে বলব পিতা-মাতা, নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকার আলাদা তদন্ত সংস্থা ও ট্রাইবুনাল গঠন করতে পারে যাদের কাজের পরিধি হবে এ সংক্রান্ত আইনগুলোর যথার্থ বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করা। আইনটির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য; তবে তা যেন শুধু কাগুজে দলিল হয়েই না থাকে। এর প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জন করতে হলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ৭:১৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×