জ্যোৎস্না রাতের সাথে পাগলামির একটা ভরপুর সম্পর্ক আছে ।
আর তা না হলে আমার মতো সংসারী মানুষ ১০ মিনিটের নোটিসে সুনামগঞ্জের বাসে উঠে পড়ে কিভাবে ?
১৪ তারিখ সুপার মুন ছিল , সেদিন পাগলামি উঠেনি , পাগলামি উঠলো ঠিক তার পরেরদিন ।
এনা পরিবহনের যে বাসে আমি উঠলাম , পলাশ পার হবার পরই
বুঝে গেলাম, ড্রাইভার সাহেব আমার চাইতে বেশী আওলা । ইনি আগের জন্মে প্লেন চালাতেন ।ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া পার হতেই বেজে গেলো সন্ধ্যা ৬ টা , বিপদজনক মোড় ঘুরতেই , গাড়ী হয়তো ইঞ্চি দুয়েকের জন্য খাদে পড়া থেকে বেঁচে গেলো
আমার মনে পড়ে গেলো আজ ১৫ই নভেম্বর , বছর কয়েক আগে যেদিন মোমিনুল মউজুদ্দীন সপরিবারে এই দিনেই ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়াতেই গাড়ী এক্সিডেন্টে নির্মমভাবে মারা গিয়েছিলেন । হাসন রাজার এই প্রপৌত্র, যিনি শুধু অসাধারণ একজন মানুষই ছিলেননা, তিনি একাধারে একজন সু প্রশাসকও ছিলেন , আর ছিলেন খুব মানবীয় মূল্যবোধ সম্পন্ন একজন অজাতশত্রু কবি ।
আমি বাসের জানালা অর্ধেক খুলে ঠান্ডা বাতাসে গলা ভেজাতে ভেজাতে স্মরণ করি ,সুনামগঞ্জের পৌর কর্তা নির্বাচিত হওয়ার পরে কোন একজন কবি তাকে শুভেচ্ছা বাণী পাঠিয়েছিলেন , প্রত্যত্তরে মউজ উদ্দীন তাকে লিখেছিলেন ''একদিন দেখবেন সুনামগঞ্জ পৌরসভা কবিসভায় পরিণত হয়েছে। সেই সভা স্বচক্ষে দেখে যাবার জন্য আপনাকে অগ্রিম আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।''
সেই সুনাম গঞ্জ আর কবি সভায় পরিণত হয়নি , মউজ উদ্দীন লিখেছিলেন ''এ শহর ছেড়ে আমি পালাবো কোথায়'' , এ শহর ছেড়ে পালাতে গিয়ে ,আবার এ শহরে তাকে ফিরে আসতেই হয়েছিলো , আর সেই ফেরার পথেই তিনি মারা যান ।
জোস্নালোকিত রাত্রে সুনামগঞ্জে পৌরসভায় কোন বাতি জ্বলতো না , তিনি নিয়ম করে গেছিলেন এ শহরে সেই জোস্নালোকিত সন্ধ্যা আর রাত গুলিতে নিয়নের আলো জ্বলবে না , আর চাইলে কবি আর আমার মতোন চির পুরাতন ভব ঘুরেরা খালি পায়ে সারা শহরময় হেটে ঘুরে বেড়াতে পারবে বিলক্ষণ ।
১৫ নভেম্বরের বিশাল চাঁদের নিচে পৌরভার নিয়নের আলোর ভেতরে আমি যখন বাস থেকে নেমে সুনাম গঞ্জ শহরে পা রাখলাম ,
মনে হচ্ছিলো এ শহরে এখন আর হাসন রাজার কোন গান বাজে না ।
এলোমেলো ভাবে এ শহরের আনাচে কানাচে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়িয়ে , আদ্দেক রাত পর্যন্ত হাওরের গা শীতল করা বাতাসের মাঝে বসে থাকলাম , একা এবং নিঃসংগ ।
হোটেলে আধা ঘুম দিয়ে ,পর দিন সকাল এগারটা বিশের বাসে উঠে বসলাম, আমাকে ফিরতে হয় একটি প্রাণহীন শহরে , যান্ত্রিক কিছু অণুভূতির মাঝে আমাকে যে ফিরতেই হয়।
ফেরার পথে সেই মন হু হু করা অণুভূতি , বাইরের ঠান্ডা বাতাস , বাতাসে ভেসে আসা নাম না জানা বুনো ফুলের তীব্র মৌতাত ।
এর মাঝেই কড়া ব্রেক কষে বাস বেমক্কাভাবে দাঁড়িয়ে গেলো ।
কারণ টা খুবই সিম্পল । রাস্তার বা পাশে শীতের অভিবাসী তেল চকচকে বালি হাঁস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভেন্ডররা আর এনা'র এই বাসের আমি বাদে বাকী সবাই সেই মাংশল মাংশের লোভী খদ্দের ।
আমি হয়তো একটু টাল আছি , আমার হয়তো দু ধরনের দিল আছে , আমি হয়তো মাঝে মাঝে এক দু পিস চিকেন কাটলেট খাই -- তবুও অভিবাসী এই পাখিদের টলটল চোখের দিকে আমি তাকাতে পারলুম না ।
এই বাসে আমি এক অনাহুত নাগরিক ,আমি খেয়াল করে দেখলাম আমি ছাড়া এই বাসের সবাই সুস্থ ,
খুব দামাদামি করে কোন এক পরিবার ছখানা হাস কিনেই ফেললো আর সারা বাস জুড়ে তাদের করুণ আর্ত্নাদ আমার কান জুড়ে ঘাই দিতে থাকলো , ঢাকা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত ।
মমিনুল মউজ উদ্দীন আপনি বালি হাঁস খুব ভালোবাসতেন , হাওরের পানির দাপাদাপিতে হাসের জলে কেলি আপনাকে কাঁদাতো, ভাসাতো ------হাসন রাজার গানের মাঝে শাহ আব্দুল করীমের দর্শন আপনি মিলিয়ে মিশিয়ে দিতে পারতেন ---
আপনি কি কখনো জানবেন , চাঁদের এই অতিন্দ্রীয় আলোতে আপনার শহরে আমি খালি পায়ে হাটতে গিয়েও হাটতে পারিনি--সভ্যতার কঙ্কর যে পায়ে বিধঁছিলো বড় !
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১১:৫১