সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল বিশ্ববিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক। সক্রেটিসের ছাত্র ছিলেন প্লেটো এবং প্লেটোরছাত্র ছিলেন এরিস্টটল। এ হিসেবে প্রাচীন গ্রিসের সবচেয়ে প্রভাবশালী তিনজন দার্শনিকের মধ্যে প্রথম সক্রেটিস।
সক্রেটিস
সক্রেটিস নির্দোষ, মৃত্যুর ২৪১৫ বছর পরে রায় দিল আদালত
সক্রেটিস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৭০ - খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯) প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক। এই মহান দার্শনিকের সম্পর্কে তথ্য লিখিতভাবে পাওয়া যায় কেবল মাত্র তাঁর শিষ্য প্লেটো-র ডায়ালগ এবং সৈনিক জেনোফন এর রচনা থেকে। তৎকালীন শাসকদের কোপানলে পড়ে তাঁকে হেমলক বিষ পানে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। তাকে পশ্চিমা দর্শনের ভিত্তি স্থাপনকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তিনি এমন এক দার্শনিক চিন্তাধারা জন্ম দিয়েছেন যা দীর্ঘ ২০০০ বছর ধরে পশ্চিমা সংস্কৃতি, দর্শন ও সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছে। সক্রেটিস ছিলেন এক মহান সাধারণ শিক্ষক, যিনি কেবল শিষ্য গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদানে বিশ্বাসী ছিলেন না। তার কোন নির্দিষ্ট শিক্ষায়তন ছিল না। যেখানেই যাকে পেতেন তাকেই মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর বোঝানোর চেষ্টা করতেন। তিনি মানব চেতনায় আমোদের ইচ্ছাকে নিন্দা করেছেন, কিন্তু সৌন্দর্য্য দ্বারা নিজেও আনন্দিত হয়েছেন।
এরিস্টোফেনিসের বর্ণনায় দেখা যায় সক্রেটিস শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ নিতেন এবং গ্রিসের চেরিফোনে একটি সোফিস্ট বিদ্যালয়ও পরিচালনা করতেন। তার দ্য ক্লাউডস্ রচনায় এই ভাষ্য পাওয়া গেছে। আবার প্লেটোর অ্যাপোলজি এবং জেনোফোনের সিম্পোজিয়ামে দেখা যায় সক্রেটিস কখনই শিক্ষার বিনিময়ে অর্থ নেননি। বরঞ্চ তিনি তার দরিদ্রতার দিকে নির্দেশ করেই প্রমাণ দিতেন যে, তিনি কোন পেশাদার শিক্ষক নন। তাকে বলতে শোনা যায়:
নিজেকে অন্যের মধ্যে বিলিয়ে দেয়াই আমার অভ্যাস; আর এজন্যই এমনিতে না পেলে পয়সাকড়ি দিয়েও আমি দার্শনিক আলোচনার সাথী সংগ্রহ করতাম।
প্লেটোর অ্যাপোলজি গ্রন্থের ভাষ্যমতে, সক্রেটিসের বন্ধু চেরিফোন একদিন ডেলফির ওরাক্লের কাছে যেয়ে প্রশ্নে করে যে, সক্রেটিসের চেয়ে প্রাজ্ঞ কেউ আছে কি-না। উত্তরে ওরাক্ল জানায় সক্রেটিসের চেয়ে প্রাজ্ঞ কেউ নেই। এর পর থেকেই সক্রেটিসকে সমাজের চোখে একজন রাষ্ট্রীয় অপরাধী ও সরকারের জন্য বিষফোঁড় হিসেবে দেখা হতে থাকে। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন ওরাক্লের কথাটি ছিল নিছক হেঁয়ালি। কারণ ওরাক্ল কখনও কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে জ্ঞান অর্জনের কারণে প্রশংসা করেনা। এটি আদৌ হেঁয়ালি ছিল কি-না তা পরীক্ষা করার জন্য সক্রেটিস সাধারণ এথেনীয়রা যে লোকদের জ্ঞানী বিবেচনা করতো তাদের কাছে গিয়ে কিছু প্রশ্ন করতে শুরু করেন। তিনি এথেন্সের মানুষদেরকে উত্তম, সৌন্দর্য্য এবং গুণ নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তর শেনো তিনি বুঝতে পারেন এদের কেউই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানে না কিন্তু মনে করে যে তারা সব জানে। এ থেকে তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হন এই দৃষ্টিভঙ্গিতে সক্রেটিস সবচেয়ে প্রাজ্ঞ ও জ্ঞানী যে, সে যা জানে না তা জানে বলে কখনও মনে করেনা। তার এ ধরনের হেঁয়ালিসূচক প্রজ্ঞা ও জ্ঞান তখনকার সনামধন্য এথেনীয়দের বিব্রত অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। সক্রেটিসের সামনে গেলে তাদের মুখ শুকিয়ে যেতে শুরু করে। কারণ তারা কোন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারতোনা। এ থেকেই সবাই তার বিরোধিতা শুরু করে।
এছাড়াও সক্রেটিসকে তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে চরিত্রহীনতা ও দুর্নীতি প্রবেশ করানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। সব অভিযোগ বিবেচনায় এনে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। মৃত্যুর মাধ্যম নির্দিষ্ট হয় হেমলক বিষ পান। প্লেটোর ফিডো গ্রন্থের শেষে সক্রেটিসের মৃত্যুর পর্বের বর্ণনা উদ্ধৃত আছে। কারাগার থেকে পালানোর উদ্দেশ্যে সক্রেটিস turned down the pleas of Crito। বিষ পানের পর সক্রেটিসকে হাটতে আদেশ করা হয় যতক্ষণ না তার পদযুগল ভারী মনে হয়। শুয়ে পরার পর যে লোকটি সক্রেটিসের হাতে বিষ তুলে দিয়েছিল সে তার পায়ে পাতায় চিমটি কাটে। সক্রেটিস সে চিমটি অনুভব করতে পারেননি। তার দেহ বেয়ে অবশতা নেমে আসে। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। মৃত্যুর পূর্বে তার বলা শেষ বাক্য ছিল: "ক্রিটো, অ্যাসক্লেপিয়াস আমাদের কাছে একটি মোরগ পায়, তার ঋণ পরিশোধ করতে ভুলো না যেন।" অ্যাসক্লেপিয়াস হচ্ছে গ্রিকদের আরোগ্য লাভের দেবতা। সক্রেটিসের শেষ কথা থেকে বোঝা যায়, তিনি বুঝাতে চেয়েছিলেন মৃত্যু হল আরোগ্য এবং দেহ থেকে আত্মার মুক্তি। রোমান দার্শনিক সেনেকা তার মৃত্যুর সময় সক্রেটিসের নকল করার চেষ্টা করেছিলেন। সেনেকাও সম্রাট নিরোর আদেশে আত্মহত্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
দার্শনিক সক্রেটিসের কিছু উক্তি
Ѫ টাকার বিনিময়ে শিক্ষা অর্জনের চেয়ে অশিক্ষিত থাকা ভাল।
Ѫ অপরীক্ষিত জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা গ্লানিকর।
Ѫ পোষাক হলো বাইরের আবরণ, মানুষের আসল সৌন্দর্য হচ্ছে তার জ্ঞান।
Ѫ নিজেকে জানো।
Ѫ জ্ঞানের শিক্ষকের কাজ হচ্ছে কোনো ব্যক্তিকে প্রশ্ন করে তার কাছ থেকে উত্তর জেনে দেখানো যে জ্ঞানটা তার মধ্যেই ছিল।
Ѫ পৃথিবীতে শুধুমাত্র একটি-ই ভাল আছে, জ্ঞান। আর একটি-ই খারাপ আছে, অজ্ঞতা।
Ѫ আমি কাউকে কিছু শিক্ষা দিতে পারব না, আমি শুধু তাদের চিন্তা করাতে পারব।
বিস্ময় হল জ্ঞানের শুরু।
Ѫ জ্ঞানের শিক্ষকের কাজ হচ্ছে কোনো ব্যক্তিকে প্রশ্ন করে তার কাছ থেকে উত্তর জেনে দেখানো যে জ্ঞানটা তার মধ্যেই ছিল।
Ѫ বন্ধু হচ্ছে দুটি হৃদয়ের একটি অভিন্ন মন।
Ѫ প্রকৃত জ্ঞান নিজেকে জানার মধ্যে, অন্য কিছু জানার মধ্যে নয়।
Ѫ তুমি কিছুই জান না এটা জানা-ই জ্ঞানের আসল মানে।
Ѫ যাই হোক বিয়ে কর। তোমার স্ত্রী ভাল হলে তুমি হবে সুখী, আর খারাপ হলে হবে দার্শনিক।
Ѫ ব্যস্ত জীবনের অনুর্বরতা সম্পর্কে সতর্ক থাকুন।
Ѫ আমাদের প্রার্থনা হওয়া উচিত সাধারণের ভালোর জন্য। শুধু ঈশ্বরই জানেন কিসে আমাদের ভাল।
Ѫ সত্যিকারের জ্ঞান আমাদের সবার কাছেই আসে, যখন আমরা বুঝতে পারি যে আমরা আমাদের জীবন, আমাদের নিজেদের সম্পর্কে এবং আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তার সম্পর্কে কত কম জানি।
Ѫ সেই সাহসী যে পালিয়ে না গিয়ে তার দায়িত্বে থাকে এবং শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
Ѫ নিজেকে উন্নয়নের জন্য অন্য মানুষের লেখালেখিতে কাজে লাগাও এই জন্য যে অন্য মানুষ কিসের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে তা তুমি যাতে সহজেই বুঝতে পার।
Ѫ সুখ্যাতি অর্জনের উপায় হল তুমি কি হিসেবে আবির্ভূত হতে চাও তার উপক্রম হওয়া।
Ѫ তুমি যা হতে চাও তা-ই হও।
Ѫ কঠিন যুদ্ধেও সবার প্রতি দয়ালু হও।
Ѫ শক্ত মন আলোচনা করে ধারনা নিয়ে, গড়পড়তা মন আলোচনা করে ঘটনা নিয়ে, দুর্বল মন মানুষ নিয়ে আলোচনা করে।
Ѫ বন্ধুত্ব কর ধীরে ধীরে, কিন্তু যখন বন্ধুত্ব হবে এটা দৃঢ় কর এবং স্থায়ী কর।
Ѫ মৃত্যুই হল মানুষের সর্বাপেক্ষা বড় আশীর্বাদ।
সূত্রঃ উইকিপিডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুন, ২০২২ রাত ৮:৪৩