সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগির ইস্তানবুলের সৌদি কনস্যুলেট ভবন থেকে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনা গেলো কিছুদিন ধরে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
বিষয়টা শুধু মাত্র একজন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ড হলে হয়তো এতো আলোড়ন হতো না। কিন্তু খাশোগি সৌদি সরকারের বিশেষ করে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের কট্টর সমালোচক ছিলেন এবং ওয়াশিংটন পোস্ট এ কলাম লিখতেন। আরো একটা পরিচয় হচ্ছে তিনি সৌদির সম্ভ্রান্ত বংশের ছেলে এবং রাজ পরিবারে বিন সালমান বিরোধী অন্য প্রিন্সদের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ক্রাউন প্রিন্স সালমান তার পিতার কাছ থেকে ক্ষমতা পাকা পোক্ত করার পরপরই খাশোগি যুক্তরাষ্ট্রে স্ব-নির্বাসনে যান।
খাশোগি গেলমাসে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে তুরস্কে আসেন এবং বিয়ে সপর্কিত কিছু কাগজপত্র সংগ্রহের জন্য সৌদি আরবের ইস্তানবুল কনস্যুলেট অফিসে যান। কনস্যুলেট অফিস থেকে তাকে এক সপ্তাহ পরে আবার যেতে বলা হয়। তিনি ২ অক্টোবর দুপুর ১ টা ১৫ মিনিট এ কনস্যুলেট এ ঢুকেন কিন্তু আর বের হননি।
এর কয়েকঘন্টার মধ্যে ঘটনাটি জানাজানি হয়ে যায় এবং খাশোগিকে কনস্যুলেটের ভেতরেই হত্যা করা হয়েছে বলে সংবাদ প্রচার হতে শুরু করে। এমনকি তাকে হত্যা করার পর তার দেহটাকে ১৫ টুকরা করা হয়েছে বলে তুরস্কের গোয়েন্দা সূত্রের বরাত দিয়ে পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম ফলাও করে খবর প্রচার করতে থাকে।
তুরস্কের পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তাকে হত্যার ভিডিও ফুটেজ এবং অডিও রেকর্ড আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ঘটনাটা তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ প্ৰশাসন, সরকারি কর্মকর্তা এবং সংবাদ মাধ্যম এমন কৌশলে বিশ্বের কাছে তুলে ধরেছে যার সামনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও বেশিক্ষণ ঢাল হয়ে থাকতে পারেন নি।
প্রথম দিকে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে জামাল খাশোগির কনস্যুলেট অফিস থেকে বের হয়ে যাওয়া এবং তার নিখোঁজের ব্যাপারে সৌদি সরকার কোনো কিছু জানে না বলে দাবি করে আসছিল। কিন্তু যখন তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে যখন খাশোগির কনস্যুলেটে ঢুকার ভিডিও ছেড়ে দেয়া হলো তখন স্বাভাবিকভাবেই প্ৰশ্ন উঠলো সৌদি সরকার কেন তার বের হয়ে যাওয়ার ভিডিও ফুটেজ দেখাচ্ছে না।
সৌদি কনস্যুলেটের পক্ষ থেকে বলা হলো যেম কনস্যুলেট ভবন ভেতরে এবং বাইরে থেকে সিসি ক্যামেরা দিয়ে ঘেরা থাকলেও ওইদিন কোনো ভিডিও রেকর্ড হয়নি। পরে আবার বলা হলো যে কনস্যুলেটের সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো কখনোই ভিডিও রেকর্ড করেন শুধুমাত্র টিভি স্ক্রিনে কিছু আগে থেকে রেকর্ড করা ভিডিও চালানো হয়। বিষয়টা এতই ছেলেমানুষি ছিল যে, সারা বিশ্বের সন্দেহের তীর সৌদির দিকে আরো বেশি গেল।
সৌদি আস্তে আস্তে এতো বেশি চাপের মধ্যে পড়লো যে তড়িঘড়ি করে ট্রাম্প এর শরণাপন্ন হলেন সৌদি বাদশাহহ সালমান এবং তার ছেলে দেশটির ডিফ্যাক্টো লিডার হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ বিন সালমান। দুজনই ট্রাম্পকে ফোনে বুঝালেন যে, এ ঘটনার সঙ্গে তাদের বা তাদের কনস্যুলেটের কোনো সম্পর্ক নাই। ট্রাম্পও শুরু করলেন তাদের সাফাই গাওয়া। কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ, কিভাবে হত্যা করা হয়েছে, হত্যা করার সময় কী কথপোকথন হয়েছে, হত্যার পিছনে সৌদির উচ্চপদস্থ কোন কোন কর্মকর্তা ছিলেন এগুলো বের হয়ে আসছে।
শেষ পর্যন্ত সৌদি বাদশাহ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগানকে ফোন দিলেন এবং ঘটনার তদন্তের ক্ষেত্রে তুরস্ককে সহযোগিতার কথা ঘোষণা দিলেন। ঘটনার প্রায় দেড় সপ্তাহ পরে সৌদি সরকার তুরস্কের তদন্ত কর্মকর্তাদেরকে কনস্যুলেট অফিসে ঢুকে তল্লাশি করার অনুমতি দেয়। ধারণা করা হচ্ছে, ইতিমদ্ধে সৌদি কর্তৃপক্ষ ঘটনার অনেক আলামত সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছে।
যাইহোক এখন পর্যন্ত তদন্তের আনুষ্ঠানিক কোনো ফলাফল ঘোষণা হয়নি। কিন্তু এটা এখন নিশ্চিত যে জামাল খাশোগিকে কনস্যুলেট অফিসের মধ্যেই হত্যা করা হয়েছে। ট্রাম্পও এই বিষয়ে তার সুর পাল্টিয়েছেন।
তারমতে, খুব সম্ভব সৌদি সাংবাদিক খাশোগি আর বেঁচে নেই। একই সঙ্গে এবং তিনি এর পরিণাম খুব ভয়াবহ হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। আমেরিকার সিনেটরদের একটা বড় অংশ সৌদি আরবের সঙ্গে ১১০ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি বাতিল করার জন্য ট্রাম্প সরকারকে চাপ দিচ্ছে।
ঘটনাটা এমন এক সময় ঘটলো যখন বিশ্বের অনেক বোরো অর্থনীতিবিদ, কোম্পানি এবং রাষ্ট্রের রাজস্বর সঙ্গে সম্পৃক্ত মন্ত্রীরা সৌদি রাজধানী রিয়াদে ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট ইনিসিয়াটিভ যেটাকে ‘মরুভূরমির দাভোস’ নাম আখ্যায়িত করা হয়, সেখানে যোগদানের শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
পূর্ব ঘোষিত ২৩ অক্টোবরের গুরুত্বপূর্ণ ওই অনুষ্ঠানে এখন আমেরিকা এবং ইউরোপের অনেক বড়বড় কোম্পানির সিইও এবং সরকারি কর্মকর্তারা যোগদান না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আমেরিকাও সরকারি কর্মকর্তা না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সৌদি আরব যখন এই ঘটনার ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত তখন তুরস্ক এই বিষয়টিকে ইস্যু করে বিশ্ব জনমতকে সৌদি বিরোধী করতে উঠেপড়ে লেগেছে।
সৌদি- তুরস্ক সম্পর্ক কেমন?
সৌদি- তুরস্ক সম্পর্ক প্রয়াত বাদশাহ ফয়সালের মৃত্যুর পর বাদশাহ সালমানের সময়ও খুব ভালোই ছিল বলা যায়। কিন্তু প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতার কলকাঠি হাতে নেয়ার পরেই দুই দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরা শুরু করে।
সৌদি আরবের ইয়েমেনের যুদ্ধে সারাসরি জড়িয়ে যাওয়া, কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ, মুসলিম ব্রাদারহুডকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে ঘোষণা, ইরানের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক, ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন এবং ইসরালের বিরুদ্ধে কোনো কথা না বলা এই সবগুলোই সৌদির সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কে টানাপোড়েনের পিছনের কারণ।
এমনকি তুরস্ক ধারণা করছে, প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে উৎখাতের জন্য ২০১৬ সালে যে সামরিক অভ্যুথানের প্রচেষ্টা তার পেছনে সৌদি আরবের সমর্থনে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশরের সরাসির হাত ছিল।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, খাশোগি হত্যাকাণ্ড যদি সৌদি সরকারের পূর্বপরিকল্পিত একটা ঘটনা হয়ে থাকে তাহলে কেন তাকে যুক্তরাষ্ট্রে হত্যা না করে তুরস্কে এনে হত্যা করা হলো?
সৌদির পরিকল্পনা কী ছিল?
ধারণা করা হচ্ছে, সৌদি সরকার অনেকদিন ধরেই খাশোগিকে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করে আসছে কিন্তু সফল হয়নি। এক্ষেত্রে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএয়ের সঙ্গেও অনেক আলাপালোচনা হয়েছে। কিন্তু আমেরিকা থেকে ফিরিয়ে নেয়া অনেক রিস্কি একটা বিষয়। আর বিশ্ব জনমত, মিডিয়া এর সামনে এরকমটা করলে অনেক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হবে। তার চেয়ে বরং তুরস্কে তাকে গুম করে দিয়ে সৌদি সরকার এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিল।
১. খাসোগিকে সরিয়ে দেয়া।
২. ইস্তানবুলে নিখোঁজ হয়ে গেলে তুরস্কের সরকারের ওপর চাপ দেয়া। কারণ, সাংবাদিক খাশোগি অনেক লেখায় এরদোগান সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। সেই লেখাগুলোকে সামনে এনে তার নিখোঁজ হওয়ার দোষ পুরোটাই তুরস্কের সরকারের ওপরে চাপানো।
৩. তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ করে আরব বিশ্বের সরকার-সমালোচকদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল। খাশোগিকে নিরাপদে সরিয়ে দিয়ে আরব বিশ্বের সরকার-সমালোচকদেরকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছিল সৌদি আরব যে তুরস্ক আর তোমাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় নয়। আমি চাইলে তোমাদেরকে তুরস্কের মাটিতেও নিশ্চিহ্ন করতে পারি।
কিন্তু জামাল খাশোগি শেষবার যখন কনস্যুলেটে যান তখন তার বাগদত্তা বধূকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। তাকে কনস্যুলেট ভবনের বাইরে রেখে যান এবং সতর্ক করে দেন যে যদি তার আসতে দেরি হয় বা বিকাল ৫টার মধ্যে বের না হন তবে যেন তুরস্কের তার কয়েকজন বন্ধুকে বিষয়টা জানান। তার এই বন্ধুদের মধ্যে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের একজন উপদেষ্টা এবং তুরস্ক-আরব মিডিয়া সংগঠনের প্রধানও ছিলেন। তাদের মাধ্যমেই তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশ দ্রুত পদক্ষেপ নেয়।
তুরস্ক কী করতে চাচ্ছে?
তুরস্ক শুরু থেকেই বিষয়টাতে অনেকটা প্ল্যান করেই এগুচ্ছে। ঘটনাটাকে প্রথম ইউরোপ এবং আমেরিকার সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ফাঁস করে দেয়া। পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার বেনামী উৎস থেকে ঘটনাগুলোকে ফাঁস করে দেয়া। এগুলোর আসল উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার সরকার এবং সৌদি রাজপরিবারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করা। আবার সরকারি বা আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না দেওয়ায় সৌদি সরকারের জন্য আলোচনার দরজা খোলাও রাখছে তুরস্ক।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর সৌদি ও তুরস্ক সফর ত্রিপক্ষীয় সমঝোতারই একটা অংশ বলে মনে করা হয়। আমেরিকা হয়তো সৌদির সঙ্গে আরো কিছু অস্ত্র বিক্রি করার চুক্তি করবে। আর তুরস্ক নতুন সরকার বিনিয়োগ বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের নতুন বিনিয়োগের চুক্তি করবে।
এক্ষেত্রে ব্লুম্বার্গের একটা লেখার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়, খাশোগি হত্যাকাণ্ডে বিন সালমানের সবচেয়ে বড় ভুল হলো, তুরস্কের গোয়েন্দা সংস্থাকে এখনো সাধারণ একটা মধ্যপ্রাচের দেশের গোয়েন্দা বিভাগের মতো মনে করা। আর তুরস্কের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবকাঠামোকে অনেক ভঙ্গুর মনে করা।
লেখক: সারওয়ার আলম, ডেপুটি চিফ রিপোর্টার-নিউজ পাবলিশার, আনাদলু এজেন্সি, তুরস্ক
খবরের লিংক
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০১৮ দুপুর ১:০৯