এক লোক কদিন আগে দেশের গণমাধ্যমের কাছে বলেছে, 'ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে কেউ মুক্তিযুদ্ধ করে নি।'
কি ভয়াবহ স্পর্ধা!
ভয়াবহ স্পর্ধা দেখিয়ে ফেলা এই লোকটার নাম মামুনুল হক। নব্বই ভাগ মুসলমানের এই দেশে কিছু লোক হঠাৎ করে একদিন ঘোষণা দিল ইসলাম এখানে বিপদে আছে। তারা বিপদে থাকা ইসলামকে হেফাজত করতে একটা সংগঠন বানিয়ে ফেলল। সংগঠনের নাম হেফাজতে ইসলাম। মামুনুল হক নামের এই লোক এই হেফাজতে ইসলামের নেতা।
কাল রাত ১২টা বেজে যাওয়ার আগে থেকেই পাড়ায় পাড়ায় পটকা ফুটতে শুরু করেছিল। ১২টা বেজে যাবার পরও অনেকক্ষণ ধরে চলেছে। আমরা বুঝতে পেরে গেছিলাম বিজয় দিবস উদযাপন চলছে।
বিজয়টা কোথায়?
আমাদের 'বিজয়'টা এখন 'উন্নয়ন'এর মতো হয়ে গেছে। স্থাপত্য নির্মাণকে যেমন উন্নয়ন বলি, তেমনি একটা ভুখন্ড পাওয়াকেই বিজয় বলছি।
আচ্ছা, স্পর্ধা বলি কেন। এমনই কি হওয়ার কথা ছিল না?
আজকের দুটা ঘটনা বলি।
লন্ডনে থাকা এক বন্ধু একটা ছবি দিয়েছে। ছবিতে বন্ধুটি একটা কাগজ হাতে হাসি হাসি মুখ করে সটান দাঁড়িয়ে আছে। ওই কাগজটি বড় কাঙ্ক্ষিত। বড় পরিশ্রমের। বন্ধুটি আজ তার বাঙালি পরিচয় হারিয়েছে। আজকে সে ব্রিটেনের নাগরিক হয়ে গেছে। ব্রিটেনের নাগরিকত্ব পাওয়া কাগজটি হাতে হাসি হাসি মুখ করে সটান দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুটির মুখভঙ্গীতে গর্বিত ভাব আছে। আছে অহংকার। সে আর তৃতীয় বিশ্বর বাংলাদেশটার নাগরিক নয়। এখন থেকে বন্ধুটি প্রথম বিশ্বর উন্নত দেশ দ্য গ্রেট ব্রিটেনের লোক। কাজ করে ব্রিটিশ পত্রিকায়।
এই এত এত গর্ব আর অহংকারে আত্মপরিচয় বিসর্জন দেয়ার দায়টা আসলে কার?
এই আজকেই বিজয় দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে গিয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে দু দল মারামারি করেছে। যে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মারামারির কথা শুনলে আমরা ভাবতে শুরু করি ছাত্ররা করেছে। আজকের মারামারিটা ছাত্ররা করে নি। এই মারামারি করা লোকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাগণ। পত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেল লাঠিসোটা হাতে কর্মকর্তাগণ প্রতিপক্ষকে খুঁজছেন। পেয়েছেন কিনা জানি না। পেয়ে থাকলে প্রতিপক্ষর কপাল খারাপ ধরে নিতে হবে। ছবির ভঙ্গী বলে দেয়, পেয়ে গেলে মাথা না ফাটিয়ে ছাড়বেন বলে মনে হয় না।
এরা 'ভয়াবহ'রকম শিক্ষিত। এবং এরা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটির কর্মকর্তা।
দুদিন আগে বুদ্ধিজীবী দিবসে স্মৃতিসৌধেও ঝামেলা হয়েছিল। মারামারি হয় নি অবশ্য।
মাস কয় আগে আমার এক প্রাক্তন সহকর্মী, তিনি পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। সম্প্রতি পরিবার পরিজন নিয়ে আমেরিকা চলে গেছেন। তিনিও খুব গর্বিত আর অহংকারে সে দেশের নাগরিক হয়ে গেছেন। দেশে সরকারি চাকুরে ছিলেন। আমেরিকায় গিয়ে মুদি দোকানে (গ্রোসারি শপে) কাজ নিয়েছেন।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরি নাকি সোনার হরিণ। এই সোনার হরিণ ফেলে বগল বাজাতে বাজাতে এই যে লোকেরা দেশছাড়া হয়ে যায়, এর দায় কি তাকে একলা দেয়া যাবে? দিয়ে ফেললে কাজটা কি ঠিক হবে?
না, হবে না। দায় আমাদের। দায় আপনাদের। আপনারা যারা দেশ আর দেশের মানুষের ভাগ্য ঠিকঠাক করে দেন, তাদের।
দুদিন আগে আমেরিকা থেকে যুবলীগের একটা প্রেস রিলিজ এল। সেখানকার যুবলীগের এক নেতার নামের বানান পড়া যাচ্ছিল না। নামটি জানতে একটু খোঁজখবর করতে আমাকে স্থবির হতে হলো। জানা গেল ও নাম দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকাভুক্ত। কেউ কেউ জানালেন দেশের বড় নেতারাই নাকি তাকে নিরাপদে আমেরিকা পাঠিয়ে দিয়েছেন। সেকারণে আমেরিকায় যাওয়ার পরও, এখনও যুবলীগের নেতা হয়ে আছে। আমি অবশ্য বিশ্বাস করি নি। নিন্দুকেরা অনেক কথাই বলে। সেসব কানে তুলতে নেই।
তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অস্বীকারের এই স্পর্ধা তো একদিনে তৈরি হয় নি। একটু একটু করে হয়েছে। আমাদের চোখের সামনেই এরা গোকুলে বেড়েছে। আমরা উদাস নয়নে আখের গোছাতে ব্যস্ত থেকেছি।
পাকিস্তানিরা পক্ষপাতমূলক অন্যায় আচরণ করছিল। বাঙালিরা অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন আর শোষণের স্বীকার হচ্ছিল। মানুষ তার নিজভুমিতেই অধিকারহারা হয়ে পড়েছিল। বাঙালিদেরকে সবদিক থেকে কোণঠাসা করে ফেলে বঞ্চিত করা হচ্ছিল। সামাজিক থেকে মানবিক- সকল ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছিল বাঙালিদের।
ফলে আমাদের মানুষেরা নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ভাবতে শুরু করেছিল। এই বৈষম্যর অবসান ঘটাতে, পক্ষপাতমূলক অন্যায় আচরণ, অবিচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ থেকে মুক্তি পেতেই এ দেশের মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদ- এই চারটি আদর্শর ওপর দাঁড়িয়ে সংঘটিত হয়েছিল মুক্তির যুদ্ধ। কেননা পূর্ব পাকিস্তানের অভিজ্ঞতায় এদেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে জেনে গেছে এই চারটিই মানুষে মানুষে বৈষম্য তৈরি করে।
এই চারটি আদর্শই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
বিজয় দিবসে শূন্য ঘণ্টা আসবার আগে থেকেই পাড়ায় পাড়ায় বাজি পটকা ফুটতে শুরু করল। চলল অনেকক্ষণ ধরে। আমরা বুঝে গেলাম বিজয় দিবস উদযাপন চলছে।
কিন্তু বিজয়টা কোথায়?
আমাদের 'বিজয়'টা এখন 'উন্নয়ন'এর মতো হয়ে গেছে। স্থাপত্য নির্মাণ বলতে যেমন উন্নয়ন বুঝি, তেমনি একটা ভুখন্ড পাওয়াকেই বিজয় বলছি। স্বাধীনতা বলতে বুঝি স্বেচ্ছাচারীতা। আর গণতন্ত্র মানে গায়ের জোর।
'আদর্শ আদর্শ' বলে চেঁচিয়ে গলার রগ ফুলিয়ে ফেলেছি। মানুষ তৈরি করি নাই। আমরা একলা না। আমাদের পিতারাও তৈরি করেন নাই। যাদেরকে প্রগতিশীল বলে জেনেছিলাম, পরে দেখি তারা 'প্রগতিশীলতার ব্যবসা' করত আসলে। ফলে আদর্শটা বইয়ের পাতাতেই রয়ে গেল। মানুষের ধারণ ক্ষমতায় জায়গা পেল না তেমনভাবে। সে জায়গা দখল করেছে প্রতিক্রিয়াশীলরা। আমরা এখন চুপ করে তাদের আস্ফালন দেখি।
অযোগ্য লোকজন অনেক কথাই বলে। তাদের সেসব কথা ধরতে নেই। ফলে মূলধারার বাইরের লোক মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীর সুহৃদরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অস্বীকার করে আজকে একজন হুংকার দিয়ে বলছে, 'ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে কেউ মুক্তিযুদ্ধ করে নি।'
কিন্তু মূলধারার লোকেরা কই? কাউকে তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী বক্তব্যর বিরোধিতা করতে দেখা গেল না।
আমরাও সেকথা গায়ে মাখছি না। আমরা পটকা-বাজি ফুটিয়ে বিজয় দিবস উদযাপন করছি।
১৬.১২.২০
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২০ রাত ২:০৯