কবি নজরুল শান্তিনিকেতনে থাকতেন না। কিন্তু ওখানে তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। যেতে ইচ্ছা করল আর সঙ্গে সঙ্গে চলে যেতেন। উদ্দেশ্য তো ওই রবীন্দ্রনাথই। গিয়ে এমন ভাব করতেন যেন এসেছেন নিজের বাড়িতে আর রবীন্দ্রনাথ তার নিজের লোক। অবশ্য এই ভাবনায় ঘি ঢেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। নজরুল তো যেখানে যেতেন সে জায়গাই মাথায় তুলে লাফাতেন। তাঁর এই পাগলামো রবীন্দ্রনাথ উপভোগ করতেন। রবীন্দ্রনাথের অধিক স্নেহ আর লাই পেয়ে পেয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত অদ্ভূত কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলতেন নজরুল।
নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী ছিলেন বাঙলার বিপ্লব-আন্দোলনের একনিষ্ঠ একজন কর্মী। জেলে থাকতে নজরুলের সময় কাটানো, কথাবার্তা-আড্ডা এসব নরেন্দ্রনারায়ণ চলত।
একদিন নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তীকে নজরুল বললেন, শোনো না কি হয়েছে, বলতে শুরু করলেন তিনি —
একবার শান্তিনিকেতনে গেছেন নজরুল। সেখানে থাকলেনও কয়েকদিন। তো দেহলীর বারান্দায় পিঠ উঁচু একটা চেয়ার আছে। দুপুরের পর রবীন্দ্রনাথ এসে বসলেন ওই চেয়ারে। নজরুল কোনো শব্দ না করে রবীন্দ্রনাথের পায়ের কাছে মেঝেতে বসে রবীন্দ্রনাথের একটা পা টেনে নিলেন কোলের ওপর। ইচ্ছেটা হলো একটু টিপে দেবেন।
ওমা! তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ! 'ওরে, ছাড়্ ছাড়্! হাড়গোড় আমার ভেঙে গেল যে!'
নজরুল অবস্থা তো তখন অপ্রস্তুতের চূড়ান্ত। কিছুটা অপ্রস্তুত কিছুটা মনখারাপ নিয়ে নিশ্চুপে সরে গিয়ে বসলেন নজরুল।
রবীন্দ্রনাথ তখন নজরুলের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলেন। তাঁর চোখ পিটপিট করছে, মুখে মিটমিটে হাসি। ভাবটা 'কেমন জব্দ?
তারপর কপট গাম্ভীর্যে বললেন, ক’খানা গান লিখলে আজ? নাকি খালি চ্যাঁচালেই?
তখনও নজরুলের মুখটা ভার হয়ে আছে। একটু চুপ করে থেকে মাথা নিচু করেই বললেন, মাঝে মাঝে কী মনে হয়, জানেন?
কী? কৌতূহলী গলায় বললেন রবীন্দ্রনাথ।
নজরুল বললেন, আপনার মাথায় একটা লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরে আপনাকে শেষ করে দিই—
সেকি! কেন? রবীন্দ্রনাথের গলায় অপার বিস্ময়!
নজরুল তখন বল্কলেন, কেন? তাহলে আপনার পাশাপাশি চিরকাল লোকে আমার নাম করবে। আর আমার ছবিও আপনার ছবির পাশে ছাপা হবে।
এবারে রবীন্দ্রনাথ আঁতকে ওঠেন, কী সর্বনাশ! ওরে কে আছিস, শিগগিরিই আয়। এ পাগলের তো অসাধ্য কিছু নেই!
রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠ একটু উঁচুই হয়েছিল, কয়েকজন এসেও পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তাদেরকে সবিস্তারে নজরুলের মনোবাসনা বলে দিলেন।
অথচ ছাত্রছাত্রীদের গান শেখানোর জন্য নজরুলকে শান্তিনিকেতনে গিয়ে স্থায়ীভাবে থাকতে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু হৈচৈ, কোলাহল নজরুল কলকাতা ছেড়ে শান্তিনিকেতনের উদার, শান্ত তপোবনে থাকতে রাজি হন নি। তবে রবীন্দ্রনাথের ডাকে সাড়া না দিলেও তাঁর প্রতি নজরুলের ছিল প্রগাঢ় শ্রদ্ধাবোধ। আমৃত্যু এই শ্রদ্ধাবোধ অটুট ছিল।
জেলের মধ্যে কথা প্রসঙ্গে নজরুল নরেন্দ্রনারায়ণকে বলেছিলেন, ‘ভারতবর্ষ কোনো দিনও কবির কাঙ্গাল নয়, ছিলেন বাল্মীকি, ব্যাস, কালিদাস-রবীন্দ্রনাথের সমতুল্য কেউ নন।’
কাজী মোতাহার হোসেনকে ১৯২৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নজরুল লিখেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ আমাকে প্রায়ই বলতেন, দেখ উন্মাদ, তোর জীবনে শেলির মতো, কিটসের মতো খুব বড় একটা ট্রাজেডি আছে, তুই প্রস্তুত হ।’ বস্তুতপক্ষে এই দুই ইংরেজ কবির মতো নজরুলের পরিণতি ও বিষাদময় পরিণামের কথা ভেবে দার্শনিক কবি রবীন্দ্রনাথ এই ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের এই সাবধান বাণীটিকেও নজরুল মাথায় তুলে রেখেছেন। "যদি আর বাঁশি না বাজে" শিরোনামে এক অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথের এই উক্তিটি নজরুল তুলে দিয়েছিলেন। তুলে দেওয়ার একটি উদ্দেশ্য ছিল। নজরুল জানালেন, রবীন্দ্রনাথ ভুল বলেন নি। সেদিন নজরুলের ছেলে মারা গিয়েছিল। একজন পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ হলো পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি বস্তু। এই ট্র্যাজেডির কাছে শেলি কিংবা কিটসের ট্র্যাজেডিও কিছুই নয়।
আজ আমার ছোট কলিগ কাজী নজরুলের ইসলামের জন্মদিন। রবীন্দ্রনাথের মতো আমিও তাকে ভালোবাসি।
হেপ্পি বাড্ডে কলিগ।
.
আমার বলাবলি শেষ। নিচে সেই বিখ্যাত ও আমার খুব প্রিয় 'যদি আর বাঁশি না বাজে' দেওয়া হলো। পড়তে ইচ্ছা করলে পড়বেন। ইচ্ছা না করলে এড়িয়ে যেতেই পারেন।
.
যদি আর বাঁশী না বাজে
কাজী নজরুল ইসলাম
বন্ধুগণ,
আপনারা যে সওগাত আজ হাতে তুলে দিলেন তা আমি মাথায় তুলে নিলুম। আমার সকল তনুমন প্রাণ আজ বীণার মতো বেজে উঠেছে, তাতে শুধু একটি মাত্র সুর ধ্বনিত হয়ে উঠেছে — আমি ধন্য হলুম, আমি ধন্য হলুম। আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেইদিনই করেছেন, যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভাল লেগেছে। বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের যুগে আমি অন্মগ্রহন করেছি। এরই অভিযান সেনাদলের তূর্য বাদকের আমি একজন, এই হোক আমার সবচেয়ে বড় পরিচয়।
আমি এই দেশে এই সমাজে জন্মেছি বলেই আমি এই দেশেরই এই সমাজেরই নই, আমি সকল মানুষের। কবি চায় না দান,কবি চায় অঞ্জলী কবি চায় প্রীতি। সুন্দরের ধ্যান, তার স্তব গানই আমার ধর্ম।তবু বলছি আমি শুধু সুন্দরের হাতে বীণা পায়ে পদ্মফুলই দেখিনি,তার চোখে চোখ ভারা জলও দেখেছি। শ্মশানের পথে, গোরস্থানের পথে ক্ষুধা দীর্ন মুর্তিতে ব্যথিত পায়ে তাকে চলে যেতে দেখেছি, যুদ্ধভূমিতে তাকে দেখেছি,কারাগারের অন্ধকূপে তাকে দেখেছি,ফাঁসির মঞ্চে তাকে দেখেছি।
আমাকে বিদ্রোহী বলে খামাখা লোকের মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছেন কেউ কেউ। এই নীরিহ জাতটাকে আছড়ে-কামড়ে তেড়ে নিয়ে বেড়াবার ইচ্ছা আমার কোনদিনই নেই। আমি বিদ্রোহ করেছি বিদ্রোহের গান গেয়েছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে অত্যাচারের বিরুদ্ধে। জাতিতে জাতিতে বিদ্বেষ যুদ্ধ বিগ্রহ, মানুষের জীবনের একদিকে কঠোর দারিদ্র-ঋণ-অভাব, অন্যদিকে লোভী অসুরের যক্ষের ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা পাষান স্তুপের মত জমা হয়ে আছে। এই অসম ভেদ জ্ঞানকে দূর করতেই আমি এসেছিলাম। আমার কাব্য, সংগীতে কর্মজীবনে অভেদ সুন্দর সাম্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। আমি যশ চাইনা খ্যাতি চাইনা প্রতিষ্ঠা চাইনা নেতৃত্ব চাইনা। জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক আনন্দের গান,বেদনার গান গেয়ে যাব আমি। দিয়ে যাবো নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে, সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে। এই আমার ব্রত এই আমার সাধনা এই আমার তপস্যা।
রবীন্দ্রনাথ আমায় প্রায়ই বলতেন, “দেখ উন্মাদ তোর জীবনে শেলীর মত,কীট্সের মত খুব বড় একটা ট্র্যাজেডি আছে — তুই প্রস্তুত হ”। কিন্তু জীবনের সেই ট্র্যাজেডি দেখবার জন্য কতদিন অকারণে অন্যের জীবনকে অশ্রুর বর্ষায় আচ্ছন্ন করে দিয়েছি। কিন্তু আমার জীবন রয়ে গেল বিশুদ্ধ মরুভূমির মত তপ্ত। আমার বেশ মনে পড়ছে একদিনের আমার জীবনের মহা অনুভূতির কথা— আমার ছেলে মারা গেছে, আমার মন যখন তীব্র পুত্রশোকে ভেঙ্গে পড়েছে ঠিক সেই দিনে সেই সময়ে আমার বাড়িতে হাস্নাহেনা ফুটেছে। আমি প্রাণভরে সেই হাস্নাহেনার গন্ধ উপভোগ করেছিলাম। আমার কাব্য আমার গান আমার জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে। যদি কোনদিন আপনাদের প্রেমের প্রবল টানে আমাকে আমার একাকীত্বের পরম শুন্য হতে অসময়ে নামতে হয় তাহলে সেদিন আমায় মনে করবেন না আমি সেই নজরুল; সেই নজরুল অনেকদিন আগে মৃত্যুর খিড়কি দুয়ার দিয়ে পালিয়ে গেছে। মনে করবেন পূন্যার্থের তৃষা নিয়ে যে একটি অশান্ত তরুণ এই ধরায় এসেছিল অপূর্ণতার বেদনায় তারই বিগত আত্না যেন স্বপ্নে আমাদের মাঝে কেঁদে গেল।
যদি আর বাঁশি না বাজে — আমি কবি বলে বলছিনা, আপনাদের ভালবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি-আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি,আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম। সেই প্রেম পেলামনা বলে আমি এই প্রেমহীন নীরব পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম। যেদিন আমি চলে যাব সেদিন হয়তো বা বড় বড় সভা হবে, কত প্রশংসা কত কবিতা হয়ত বেরুবে আমার নামে,দেশপ্রেমিক —ত্যাগী বীর —বিদ্রোহী বিশেষণের পর বিশেষণ, টেবিল ভেঙ্গে ফেলবে থাপ্পর মেরে,বক্তার পর বক্তা এই অসুন্দরের শ্রদ্ধা নিবেদনের শ্রাদ্ধ দিনে — বন্ধু তুমি যেন যেওনা। যদি পার চুপটি করে বসে আমার অলিখিত জীবনের কোন একটি কথা স্মরণ করো, তোমার আঙ্গিনায় বা আশেপাশে যদি একটা ঝরা পায়ে পেষা ফুল পাও সেইটিকে বুকে চেপে বলো, বন্ধু আমি তোমায় পেয়েছি—
“তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিবনা
কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙ্গিবনা
নিশ্চুল-নিশ্চুপ আপনার মনে পুড়িব একাকী
গন্ধ বিধুর ধূপ।।”
১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০২৩ রাত ৩:৩৩