শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে নিয়ে এই লেখাটি একই শিরোনামে ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন আজকের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
লেখাটি লিখেছেন নীলিমা ইব্রাহিম বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক। আমি চেষ্টা করেছি লেখাটি হুবুহু তুলে দেওয়ার জন্য। ভুলভ্রান্তি থাকলে তা ধরিয়ে দিয়ে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার জন্য অনুরোধ রইল।
জাহানারা আজ তুমি দৃষ্টির সামনে নেই, মুখ লুকিয়েছো আমার বুকের সামনে। তুমি আজ ইতিহাসের রূপালী পাতায় সোনার অক্ষরে নিজের ঠাঁই করে নিয়েছো। তুমি আজ একটি নাম, এক মহান আদর্শ, এক সংঘাত, এক অগ্নিগর্ভ সংগ্রাম! তুমি চেয়েছিলে ধর্মান্ধ ভ্রাতৃঘাতী, ভগ্নি ধর্ষণকারীদের শাস্তি দিতে। ঘাতক হয়ে ভাইয়ের লাশ, ভগ্নির অনাবৃত দেহের উপর বসে যারা আনন্দে অট্টহাস্যে বিভোর। কিন্তু একি করলে তুমি। তুমি তো সারা জীবনে আরব্ধ কাজ কখনও অসমাপ্ত রাখোনি। আজ কেন জোয়ান অব আর্কের মতো অগ্নি মশাল জ্বেলে দিয়েই নিঃশব্দে মরে গেলে। এ তুমি ঠিক করলে না জাহানারা।
তুমি আমার সন্তান তুল্য। তোমার কর্মশক্তিকে, নেতৃত্বকে শ্রদ্ধা করেছি, কখনও বা মাতৃস্নেহে দৌড়ে গিয়েছি তোমার কাছে। আঘাত প্রাপ্ত জননীর বিষ নীল বেদনার যন্ত্রণা তুমি জানো, সে যন্ত্রণা আমাকেও প্রতিক্ষণে দগ্ধ করছে। তুমি আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছো। কিন্তু তুমি নতুন করে দ্বিগুণ তেজে সেই আগুন আমার বুকে জ্বালিয়ে দিয়ে গেলে। কিন্তু আমি কি করবো? আমি আজ নিঃস্ব রিক্ত। এ আগুন সবখানে ছড়িয়ে দেবার শক্তি এবং ক্ষমতা তো আমার নেই। আবারও প্রতীক্ষা, আসবে কি কোন জননী নরঘাতকের কবল থেকে আদম সন্তানকে উদ্ধার করবার জন্য। জানি আসবে, কারণ তোমার সাধনা, তোমার ত্যাগ, তোমার আত্মোৎসর্গ কখনও বৃথা যাবে না, যেতে পারে না। কিন্তু সে কবে? আমার সময় যে বড় সংক্ষিপ্ত, বড়ই সীমিত।
মনে পড়ে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিক। তোমার সঙ্গে রাস্তায় ঘুরছি হঠাৎ দেখি শহীদ মিনারে কিছু সৈনিকের ভিড়। পথের অপর পাশে দাঁড়ালাম দু’জনে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছেন। আমাকে দেখে দ্রুত রাস্তা পার হয়ে এলেন। বল্লাম- জেনারেল দেশের মুক্তি সংগ্রামে স্বামী সন্তান উৎসর্গ করেছেন এ বীর নারী জাহানারা ইমাম। সর্বাধিনায়ক তোমাকে কেমন করে সামরিক কায়দায় স্যালুট করেছিলেন, ওর কঠোর সংগ্রামী দুই চোখ ছিল অশ্রুসিক্ত। মনে পড়ে আজ রাষ্ট্রীয় সম্মান তো তুমি সেদিনই অর্জন করেছিলে যেদিন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক প্রকাশ্যে তোমাকে স্যালুট দিয়েছিলেন!
আজ মনে পড়ে তোমার কতো কথা। তুমি ছিলে দেশবরেণ্য নেত্রী। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক। তোমার আহ্বানে লক্ষাধিক বাঙালি সমবেত হয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। তুমি বিচার করেছিলে- গোলাম আযমের ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলে। শহীদ জননী, তোমার রায় বহাল রইল। হেরে গেল বাংলাদেশ সরকার, তোমার বিরুদ্ধে আনীত মামলার রায় দিতে পারলো না। এমন মহাপরাক্রমশালী প্রধানমন্ত্রীর একি লজ্জা! এখন তো কিছু দরকার নেই। এটর্নি জেনারেল বলেছেন মৃতের বিরুদ্ধে মামলা হয় না। কিন্তু তোমার দেওয়া রায় রয়ে গেছে, আর তা কার্যকর করবে তোমার সোনার ছেলেমেয়েরা যারা তোমার স্পর্শ পেয়ে উদ্দীপ্ত হয়েছে!
কাল সারারাত তুমি আমার কাছাকাছি ছিলে। নববর্ষে রমনার বটমূলে ফুলের সাজি হাতে দাঁড়িয়ে আছ। হাসিমুখে একটি ফুল এগিয়ে দিয়েছো। প্রজাপতির মতো সমস্ত কানন আনন্দে উল্লাসে ঘুরে বেরিয়েছো। বেহেশ্তী উদ্যানে কি তুমি রমনা বটমূলের স্বাদ পাবে? – না, রমনা যে মানুষের জন্য তৈরি আর তুমি তো মানুষকে ভালবেসেছিলে। হুরপরীরা তো তোমার কর্মক্ষেত্র কেন, তোমার কল্পনা রাজ্যেরও বাইরে ছিল। তোমার জীবনের ইতিহাসে রয়ে যাবে রমনা তোমাকে ঘিরে।
মনে পড়ে পিকনিক শেষে ফিরবার পথে বাস খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমর সঙ্গে কুড়িজন ছেলে আর একমাত্র পবিত্র আমানত কন্যা সন্তানটি তুমি। মিরপুর ব্রিজের উপর এসে গাড়ি গড়িয়ে নামলো। ব্যাটারী ডাউন। ত্রিশ বছর আগের মিরপুর। ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছি। হাত তুলে চেঁচামেচি করছি কেউ থামে না। শেষ পর্যন্ত এক কয়লাবাহী ট্রাক ড্রাইভারের করুণা জাগলো। অর্থের বিনিময়ে সে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে এলো। নিচে নেমে দেখি কেউ কাউকে চিনি না। সারা পথ বাতাসে কয়লার গুঁড়ো মেখে সব ভূত হয়ে গেছি। তোমাদের সেকি হাসি। বাড়ি থেকে গাই এসেছে ওই দেহ মূর্তি নিয়ে সেখানেও বসতে সংকোচ। পরে এ নিয়ে কত হাসাহাসি, আজও আমার এ্যালবামে বন্দি হয়ে আছ তুমি আমার স্বামী কন্যাদের সাথে। আমি বেদনামাখা অলস মধ্যাহ্নে পাতা উল্টাবো, তোমার মুখে হাত বোলাবো।
তোমার বাড়িতে পরিপাটি করে রান্না করে আমাদের খাইয়েছো। মনে হয় এই তো সেদিন দুপুর বেলা। চাইনিজের হল্লা মনে পড়ে। আমার মেয়েরা তোমাকে ডাকতো মামী, তারা তো মামীর রূপমুগ্ধ ভক্ত ছিল। যতো দিন ডেকেছে তোমাকে ওই নামেই ডেকেছে। ওখানে একজন অপেক্ষারত আছে মামীকে দু’হাত বাড়িয়ে গ্রহণ করার জন্য।
আমরা তোমাকে সুখ দিতে পারিনি, আনন্দ দিতে পারিনি, কোনও দিকে কোনও পূর্ণতা দিতে পারিনি। তবে আজ চেয়ে দেখো জমজমের পানির চেয়েও পবিত্র অশ্রুধারা আজ আমরা সবাই তোমার উদ্দেশ্যে ঢেলে দিচ্ছি তুমি প্রশান্ত হও। সে অনন্তধামে শান্তি ছাড়া অন্য কোনও অনুভূতি নেই, আজ তুমি সেই জান্নাতবাসিনী। এটুকুই আমার সান্ত্বনা, আমাদের তৃপ্তি।
শহীদ জননী, তুমি শোন, যে মশাল তুমি জ্বেলেছো তার নির্বাণ নেই। একটি মাত্র রাজাকার আলবদর জীবিত থাকতে আজকের মুক্তিযোদ্ধারা থামবে না। থামতে পারে না। আজ তারা মাতৃশোকের আগুনে দীপ্তমান, বলীয়ান। শুনে যাও আজ দিকে দিকে তোমার আহ্বানের প্রতিধ্বনি। স্বাধীনতার শক্তি এক হও। বঙ্গবন্ধু দেশকে স্বাধীন করে গেছেন আজ তোমার আহ্বান এ ভূমিকে মুক্ত করবে। সকল অনাচার, অবিচার, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, জালিয়াতী, জোয়াচুরি, দলীয় প্রশাসন, আত্মীয় তোষণ, গণতন্ত্রের নামে স্বৈরাচার সকল পাপ অপরাধ থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করবে তোমার সন্তানেরা। তুমি মরদেহে ওদের সামনে নেই কিন্তু আজ তুমি এক মহান আদর্শ হয়ে পরিব্যাপ্ত হয়ে গেছ ওদের দেহের অণু পরমাণুতে। বন্দিনী জননীকে ওরা মুক্ত করে আনবে বর্তমানের পাপের আইন আদালতের শৃঙ্খল থেকে। এর বেশি তোমাকে আর কিছুই দেবার নেই।
-নীলিমা ইব্রাহিম
আজকের কাগজ: ২৮ জুন ১৯৯৪।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মারকগ্রন্থ থেকে সংগৃহীত।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




