somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহাজাতক কে?

২৪ শে মার্চ, ২০২৩ দুপুর ১:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এবং কোয়ান্টাম মেথড মেডিটেশন বর্তমানে খুবই পরিচিত শব্দ। দীর্ঘদিন যারা এই প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন, তাদের পর্যবেক্ষন ও অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান গুরুজি শহীদ আল বোখারী মহাজাতকের প্রকৃত পরিচয় এবং স্বরূপ তুলে ধরা হল–

আশির দশকের লম্বা বাবরি চুল, বড় মোচ ও কালো আলখেল্লা পরিহিত অকাল্ট সাধক, জ্যোতিষী ও গণক এবং বর্তমানে নেপালি টুপি ও সাদা আলখেল্লা পরিহিত যুগসংস্কারক ও আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে প্রচারিত শহীদ আল বোখারী মহাজাতক হলেন রং বদলানো গিরগিটির ন্যায় একজন ব্যক্তিত্ব। সম্রাট আকবরের দ্বীন-এ এলাহীর আদলে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সকল ধর্মের লোকজন একত্রিত করে তিনি শুরু করেছেন ধ্যান ও ধর্ম ব্যবসা। তাঁর প্রকৃত নাম শহীদুল আলম সিকদার এবং ডাকনাম দুলু। কোনো এক রহস্যময় কারণে তিনি মিথ্যা নাম ব্যবহার করে সমাজে চলাফেরা করেন এবং নিজের জন্ম, শিক্ষাজীবন ও বংশপরিচয় খুব সচেতনভাবে গোপন রাখেন। তাঁর শৈশব, কৈশোর এবং বংশপরিচয় সম্পর্কে ভক্তরা অন্ধকারে এবং অন্ধের মতোই অনুসরণ করে চলে তাঁকে। মানুষের নিকট হতে কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নেয়াই প্রতারক শহীদুল আলম সিকদার দুলু তথা মহাজাতকের মূল উদ্দেশ্য। এমনভাবে তিনি তাঁর কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন নামক প্রতিষ্ঠানটি বাহ্যিকভাবে পরিচালনা করেন যেনো ঘুনাক্ষরেও কেউ তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে না পারে এবং তাকে নির্লোভ, পরোপকারী, পীর, উলিল আমর, যুগসংস্কারক ইত্যাদি মনে করে। তবে, আভ্যন্তরীন পরিমন্ডলে প্রায়ই তাঁর মহামানবীয় মুখোশটি খসে পড়ে। ফলে, কর্মীরা বিভিন্ন সময়ে তাঁকে আবিষ্কার করেন লোভী, স্বার্থপর, ধূর্ত এবং কুটিল চরিত্রের একজন মানুষ হিসেবে। চলুন, সাদা আলখেল্লার অন্তরালে আত্মগোপনে থাকা কালো হৃদয়ের মহাজাতকের পরিচয় জেনে নিই।

শহীদ আল বোখারী মহাজাতক নামে পরিচিত কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন-এর চেয়ারম্যান শহীদুল আলম সিকদার দুলু’র পিতার নাম মরহুম আব্দুল মান্নান সিকদার এবং মাতার নাম মরহুম ফিরোজা বেগম। তাঁর আদি নিবাস মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়িতে। পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে বসতভিটা হারিয়ে তাঁর পিতামহ শরীয়তপুরে নতুন করে বসতি স্থাপন করেন। তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরা বর্তমানে শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলায় বসবাস করেন। জ্যোতিষচর্চার কারনে মহাজাতকের সাথে ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনেরা কোনো সম্পর্ক রাখেন না। কেবল অনুজ সহোদর এবিএম মাহবুবুল আলমের সাথেই তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। এবিএম মাহবুবুল আলম পেশায় ছিলেন ব্যাংকার। তিনি ২০১৯ সালে ক্যানসারে মৃত্যুবরণ করেন। মহাজাতকের অন্য ভাইরা ঢাকার মিরপুরে থাকেন।



মহাজাতকের পিতা মরহুম আব্দুল মান্নান সিকদার ঢাকা জি.পি.ও.-তে পোষ্ট অপারেটর পদে চাকরি করতেন এবং মতিঝিল সরকারি টিএন্ডটি কলোনিতে পাঁচ ছেলে এবং তিন মেয়েসহ দশ সদস্যবিশিষ্ট বিশাল পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। শেষ বয়সে ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি পান এবং অবসর গ্রহণ করেন। সেসময় বড় ছেলে শহীদুল আলম (মহাজাতক) দুইবারের চেষ্টায় এসএসসি পাস করেছেন কেবল। অবসরপ্রাপ্ত আব্দুল মান্নান পরিবারের হাল ধরতে মহাজাতকের জন্য পোষ্ট অফিসে অস্থায়ীভাবে দৈনিক হাজিরাভিত্তিতে চাকরির ব্যবস্থা করেন।

এসএসসি সনদ অনুযায়ী মহাজাতকের জন্ম তারিখ ১৫ই জানুয়ারি ১৯৪৯ এবং নাম এ.বি.এম শহীদুল আলম। কিন্তু, এনআইডি কার্ড ও পাসপোর্ট অনুযায়ী জন্ম তারিখ ১লা জানুয়ারি ১৯৪৯ এবং নাম শহীদ আল বোখারী। তিনি ১৯৬৩ সালে ঢাকার কাপ্তান বাজার এলাকায় অবস্থিত নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে প্রথমবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে গণিতে ২৩ নম্বর পেয়ে অকৃতকার্য হয়েছিলেন। দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় ১৯৬৪ সালে তৃতীয় বিভাগে এসএসসি পাস করেন। এরপর আর পড়াশোনা করেননি। অথচ, প্রচলিত আছে যে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাষ্টার্স সম্পন্ন করেছেন।

কয়েকবছর পোস্ট অফিসে চাকরি করার পর ১৯৬৮ সালে মুসলিম লীগের মুখপাত্র দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রথমে প্রুফ রিডার এবং পরবর্তীতে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের আভ্যন্তরিন বিভিন্ন বৈঠকে মহাজাতক প্রায়ই সদম্ভে বলেন যে, আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, গভর্ণর মোনায়েম খানসহ ঐ সময়ের বড় বড় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যক্তিদের বিভিন্ন নিউজ কভারেজ করতেন তিনি এবং তাদের সাক্ষাৎকারও নিতেন। তবে তাঁর এই দাবির সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, তাঁর বর্তমান বয়স (২০২৩ সাল) প্রায় ৭৪ বছর, তাহলে ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল প্রায় ২২ বছর। ঐ সময়ের একজন ২২ বছরের তরুণ সাংবাদিককে যদি ১৯৬৯/ ১৯৭০/ ১৯৭১ সালের রাজনৈতিক ঘটনাবলীসহ তৎকালীন বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিউজ কভারেজ এবং সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্যে পাঠানো হয়ে থাকে, তাহলে ঐ সময়ের খ্যাতিমান সাংবাদিক হিসেবে যাদেরকে আমরা চিনি, যেমন- সাংবাদিক মানিক মিয়া, ইফতেখার আহমেদ, দরবারে জহুর, আবদুস সালাম- এরা কি করতেন!



যাই হোক, পূর্ন-যৌবনপ্রাপ্ত মহাজাতক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন না-করে বিজয়ের ঠিক পূর্বমুহুর্তে ডিসেম্বর মাসে বর্ডার ক্রস করে মিয়ানমারে চলে যান। সেখানে থাকা-খাওয়ার সুবিধার্তে তিনি বৌদ্ধধর্মের গুরুদের সাথে কিয়াং-এ অবস্থান করেন এবং তাদের প্রচলিত মেডিটেশন সম্পর্কে জানেন ও বৌদ্ধধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। অতঃপর তিনি বৌদ্ধ ভান্তেদের তত্ত্বাবধানে ধ্যানচর্চা করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের শেষের দিকে বর্ডার ক্রস করে সঙ্গোপনে দেশে ফিরে আসেন তিনি এবং ১৯৭৩ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় পুনরায় যোগদান করেন। পাশাপাশি, অকাল্ট ও অতীন্দ্রিয় বিষয়ে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন মাসিক ঢাকা ডাইজেস্টে। ইএসপি ও টেলিপ্যথি সম্পর্কে তাঁর লেখাগুলো ১৯৭৫ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের অকাল্ট অনুরাগীদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ সৃষ্টি হয়। আর এ যোগাযোগের ফলে ১৯৭৬ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ ফেডারেশন অভ এস্ট্রলজার্স এবং শহীদ আল বোখারী মহাজাতক ফেডারেশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালে তিনি দৈনিক আজাদ পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবে পদোন্নতি পান। তৎকালীন সময়ে দৈনিক আজাদ পত্রিকা মুসলিমলীগের মুখপাত্র হিসেবে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের চরম বিরোধীতা করেছিল। আর মহাজাতক এই দৈনিক আজাদের একজন নিষ্ঠাবান, দায়িত্বশীল সাংবাদিক ছিলেন। স্বাধীনতাবিরোধী মুসলিমলীগের মুখপাত্র দৈনিক আজাদের একসময়ের বার্তা-সম্পাদক মহাজাতক আজ ভোল পাল্টে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোক বনে গেছেন। সুতরাং, তাঁর স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা গোপন করতেই তিনি ‘শহীদ আল বোখারী’ নাম ধারণ করেন- এমন ধারণা অমূলক নয়। তিনি জ্যোতিষী হিসেবে ‘মহাজাতক’ ছদ্মনামটিও যুক্ত করেন। আর এই দুই নামের সংযোজনে অতীতের শহীদুল আলম সিকদার ওরফে দুলু হয়ে ওঠেন আজকের ডিজিটাল গুরু, নবীজি (স.) এর ধারা পরম্পরা প্রতিনিধি, উলিল আমর শহীদ আল বোখারী মহাজাতক।

তিনি ১৯৮২ সালে যোগ ফাউন্ডেশন নামে একটা প্রাইভেট কোম্পানি খুলে ব্যবসা শুরু করেন। পাশাপাশি, শান্তিনগরের অফিসে অকাল্ট বিদ্যা ও জ্যোতিষচর্চাও অব্যাহত রাখেন। সেখানে দেয়ালে শোভা পেতো বৌদ্ধ ভান্তের আদলে গেরুয়া বসন ও মাথার চুল ফেলে দেয়া তাঁর একটি ছবি। তাঁর স্ত্রী নাহার আল বোখারী ঘরে বসে নারীদের রান্না ও সৌন্দর্য্য চর্চার কোর্স চালু করেন। ভালোই চলছিল জ্যোতিষী মহাজাতকের হস্ত গননার ব্যবসা। কিন্তু বাদ সাধলো মাসিক গণস্বাস্থ্য ম্যাগাজিন। ১৯৯১ সালের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ম্যাগাজিনটি ঢাকার ডজনখানেক জ্যোতিষীর লোকঠকানো ব্যবসার বিস্তারিত তুলে ধরে। সেখানে মহাজাতকের নাম ছিল এক নাম্বারে। এক পর্যায়ে মহাজাতককে প্রধান আসামী করে মামলা দায়ের করা হল। হাত গণনার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেল জ্যোতিষী মহাজাতকের। অর্থকষ্টে পতিত হন তিনি। ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন প্রোগ্রামে তিনি নিজেই স্বীকার করেন যে, তিনি এতোটাই অর্থাভাবে পড়েছিলেন যে, মোড়ের মুদি দোকানদার তাকে বাকিতে এক কেজি আলু দিতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।

অত্যন্ত বাকপটু ও ধূর্ত এই জ্যোতিষী ১৯৯২ সালে গুরু মাহী কাজীর কাছ থেকে সিলভা মেথড মেডিটেশন কোর্স সম্পন্ন করেন। ঠিক পরের বছর, ১৯৯৩ সালের ১লা জানুয়ারি হোটেল সোনারগাঁও-এ তিনি কোয়ান্টাম মেথড নামে নিজস্ব মেডিটেশন কোর্স উদ্বোধন করেন। বলা বাহুল্য, সিলভা মেথড মেডিটেশন কোর্স হুবহু নকল করে মহাজাতক সেটার নাম দেন কোয়ান্টাম মেথড মেডিটেশন কোর্স। তাঁর মেথড একটি চুরিকৃত মেথড হলেও ধুরন্ধর জ্যোতিষী মহাজাতক নিজেকে বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক মেডিটেশন চর্চার পথিকৃৎ বলে প্রচার করেন এবং বলেন যে, তিনি দীর্ঘ পনেরো বছর গবেষনা করে এই মেথড উদ্ভাবন করেন।



কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের শিশুগুলো হচ্ছে তাঁর কাছে সোনার ডিমপাড়া হাঁস। এই শিশুদের দেখিয়ে দেশ-বিদেশ থেকে তিনি প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে থাকেন। কিন্তু সামান্য অর্থই এদের ভরণ-পোষনে ব্যয় করা হয়। বাকি অর্থ কোথায় যাচ্ছে তার নেই কোনো জবাবদিহিতা, নেই কোনো অডিট। ভক্তদের নিকট থেকে দান-সদকা, যাকাত, ফিতরা আদায়ে নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করে থাকেন তিনি। ১৯৯৬ সালে ‘কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন’ নামে সমাজকল্যাণ অধিদপ্তর থেকে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধন করিয়ে পুরোদমে চালু করেন ব্যবসা। যোগ ফাউন্ডেশন মহাজাতকের প্রাইভেট কোম্পানী এবং ট্যাক্স, ভ্যাট পরিশোধ করতে হয়। তাই তিনি যোগ ফাউন্ডেশনকে আড়ালে নিয়ে গেলেন এবং সবার সামনে মূলা হিসেবে ঝোলালেন ‘কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন’ নামক তথাকথিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। কোয়ান্টাম মেথডসহ নানা কোর্স ও অন্যান্য কার্যক্রম শুরু করলেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের ব্যানারে। অথচ, কার্যক্রম পরিচালনা করেন যোগ ফাউন্ডেশন থেকে এবং টাকাও চলে যায় যোগ ফাউন্ডেশনের ফান্ডে। এভাবেই ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন দুই যুগেরও অধিক সময় ধরে। সরকারের চোখ ফাঁকি দিতে বান্দরবানের প্রত্যন্ত এলাকা লামাতে পর্যায়ক্রমে স্কুল, মসজিদ, কলেজ, হেফজখানা স্থাপন করেন। তবে, এসবই করা হয়েছে স্থানীয়দের জমি দখল করে বা কৌশলে অল্প টাকায় ক্রয় করে। এলাকাবাসীর সাথে কথা বললেই তা যে কেউ জানতে পারবেন। স্থানীয়দের জমি ছলে-বলে-কৌশলে দখল করে এ পর্যন্ত নয় হাজার একর জমির মালিক হয়েছেন মহাজাতক।

মহাজাতক নিজের নামের পাশাপাশি তাঁর স্ত্রীর নামও পরিবর্তন করে ফেলেছেন। নাহার আল বোখারি নামে পরিচিত মহাজাতকের সহধর্মিনীর প্রকৃত নাম আফতাবুন্নেছা এবং ডাকনাম অরুনা। নাহার আল বোখারী তথা আফতাবুন্নেছা অরুনার পৈত্রিক নিবাস পটুয়াখালির কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী গ্রামে। বেশ কয়েকবছর পূর্বে মহাজাতক সেখানে বিশাল জায়গাজুড়ে প্রায় ছয় কোটি টাকা ব্যয়ে মৃত শশুরের নামে মাজার শরীফ ও বাগান বাড়ী তৈরি করেছেন। আত্মীয়-স্বজনের জমি দখল করে সেখানে এই মাজার তৈরি করা হয়েছে। বছরান্তে ওরসের আয়োজনও করা হয়। অথচ, এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, তাঁর শশুর গ্রামের একজন সাধারণ মানুষ এবং স্বচ্ছল গৃহস্থ ছিলেন। জীবদ্দশায় তাকে কেউ পীর হিসেবে চিনতো না।

জ্যোতিষী মহাজাতক কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে বেশকিছু জাপানি মিউজিকসহ বিভিন্ন মিউজিক তাঁর মেডিটেশনগুলিতে ব্যবহার করেছেন। একজন জোতিষী হিসেবে তিনি জীবনে প্রচুর মানুষকে ঠকিয়েছেন। সাংবাদিক ও জ্যোতিষী হিসাবে কাজ করা এই ব্যাক্তির সাথে রয়েছে সমাজের বিভিন্ন স্তরের উচ্চবিত্ত ব্যাক্তিদের অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক। নিজের তাগিদে তিনি সমাজের ক্ষমতাবান, বিত্তবান ও জ্ঞানী-গুণীদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করেন। ব্যবসার প্রচার ও প্রসারে তাদের ফেইসভ্যালু ব্যবহার করে থাকেন তিনি।

‘শহীদ আল বোখারী’ যে মহাজাতকের প্রকৃত নাম নয়, সেটা তিনি স্বীকার না-করলেও ‘মহাজাতক’ নামটিকে ছদ্মনাম হিসেবে স্বীকার করেন। যখন রাশি গননা করতেন, তখন বিভিন্ন রাশি’র জাতক-জাতিকা নিয়েই ছিল তার কারবার। সম্ভবত সেখান থেকেই তার মাথায় আসে যে, তিনি নিজেকে মহাজাতক নামে পরিচয় দিবেন। অর্থাৎ, তিনি সব জাতকের উর্ধ্বে– মহামানব। সাধারণ মানুষের মনে নিজেকে শ্রেষ্ঠ জ্যোতিষী হিসেবে গেঁথে দেয়ার জন্যই ওই নামটা ব্যবহার করেছেন তিনি। মহান যে জাতক, তিনিই মহাজাতক! অর্থাৎ, তিনি নিজেকে একজন মহাপুরুষ দাবি করেন। তিনি এই পৃথিবীতে এসেছেন যুগ সংস্কারক হিসেবে মহান দায়িত্ব পালন করতে- এটাই তাঁর দাবি, যা তিনি প্রচার করে থাকেন তাঁর কর্মীবাহিনী ও ভক্তকুল দ্বারা।

ব্যাক্তিজীবনে তাঁর মাঝে নবির কোনো সুন্নতের প্রতিফলন নেই, নামাজ-রোজার ঠিক নেই, আরবিতে কুরআন শরীফ পড়তে জানেন না। উল্লেখ্য, তিনি নামাজ পড়তে শিখেছেন ১৯৯৬ সালের পর। কারণ, তিনি যখন বায়াত দেয়া শুরু করলেন, তখন প্রশ্নবিদ্ধ হতে শুরু করেছিলেন। তিনি কদাচিৎ নামাজ পড়েন। যাতে অনেকেই সাক্ষী দেয় যে তিনি নামাজ পড়েন। কিন্তু, তাকে জুমার নামাজসহ অন্যান্য নামাজ পড়তে দেখা যায় না বললেই চলে। মেডিটেশন কোর্স চলাকালীন তিনি শুক্রবারে জুমার নামাজের সময় নিজ কক্ষে অবস্থান করেন। অন্যান্য ওয়াক্তেও মসজিদে যান না। অথচ, তিনি নিজেকে নবির ধারা-পরম্পরা প্রতিনিধি বলে প্রচার করেন। এখানেই তিনি ক্ষান্ত হননি। কোরআন বিকৃত করে বাংলা মর্মবানী নাম দিয়ে ভুলভাল ব্যাখ্যা সংযুক্ত করে কামাচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। তিনি নিজেকে উলিল আমর ঘোষনা দিয়ে চালু করেছেন বায়াত বা দীক্ষা কোর্স। বায়াতের পক্ষে বিভিন্ন হাদিস তুলে ধরেন। ইসলামে অমুসলিমকে বায়াত দেয়ার আগে তাকে অবশ্যই ইসলাম গ্রহণ করে নিতে হয়। অথচ, তিনি বায়াত দেন যেকোনো ধর্মের লোককে স্ব-স্ব ধর্মে রেখেই। ইসলাম ব্যবহার করে কত বড় প্রতারণা করছেন তিনি! এখানেই শেষ নয়; বায়াত দিতে তিনি হাতিয়ে নেন মোটা অঙ্কের টাকা। এছাড়াও, বায়াতগ্রহণকারীর কাছ থেকে প্রতিমাসে গ্রহণ করেন আয়ের দুই থেকে তিন শতাংশ অর্থ। এই টাকা না দিলে বায়াত বাতিল হয়ে যায়। তাছাড়া উচ্চমূল্যে মেডিটেশনের কোর্স ও বই বিক্রি, দেশ-বিদেশের ভক্তদের নিকট থেকে নানাবিধ দান-অনুদানের মাধ্যমে প্রতি বছর শত-শত কোটি টাকা আয় করে থাকেন তিনি। কিন্তু এসব টাকার কোনো হিসাব সদস্যরা জানে না। তারা শুধু দিয়েই যায় অন্ধভাবে।

কোয়ান্টামের মেডিটেশন কোর্স করতে ১১,৫০০ টাকা খরচ হয়। অথচ দেশের অন্যান্য জনপ্রিয় ও ফলপ্রসূ মন-নিয়ন্ত্রন কোর্স অর্ধেক বা তারও কম খরচে করা যাচ্ছে। মানুষের উপকার করাই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে কেনো এই ডাবল কোর্স ফি? প্রতি কোর্সে প্রায় ১,৫০০ জন মানুষ অংশগ্রহণ করে। প্রতি কোর্স থেকে কোটি কোটি টাকা আয় করেন মহাজাতক। সারা দেশে প্রতি বছর প্রায় বিশটি কোর্স পরিচালনা করেন মহাজাতক। এত টাকা দিয়ে কী করেন তিনি? মহাজাতকের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ হল তিনি মেডিটেশন শিখানোর নামে মানুষকে হিপনোটাইজ করে দাসে রুপান্তরিত করে ফেলেন। বিশেষ করে, বায়াতের কোর্স করার পর একজন সদস্য মুক্তভাবে চিন্তা করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। মহাজাতক সদস্যদের চাবি দেয়া পুতুলের মতো পরিচালনা করেন। এমনকি, তাঁর মেডিটেশন কোর্স করে অধিকাংশ অংশগ্রহণকারী তেমন ফল পাচ্ছেন না। কিন্তু সাময়িকভাবে মোহগ্রস্ত হয়ে মহাজাতককে মহামানব ভাবতে শুরু করে এবং ফল না-পেলেও এই বলয় থেকে বের হতে পারে না বা এটার অসাড়তা অনুধাবন করতে পারে না। ফল না-পেলেও সবকিছুকে নিজের ব্যর্থতা বলে মনে করে।

মহাজাতকের ভাষ্য অনুযায়ী, কোয়ান্টাম মেথড ইসলামী শরীয়া অনুযায়ী কাজ করে। অথচ, দেশের প্রথম সারির সকল ইসলামী স্কলার কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের বিপক্ষেই বলেছেন। মহাজাতক মানুষের হাত দেখে ভবিষ্যতবাণী করতেন এবং ভাগ্য পরিবর্তনের শিরকি আংটি ও পাথর বিক্রি করে মানুষকে ধোঁকা দিতেন। গণকেরা গায়েব বা অদৃশ্য জ্ঞানের দাবী করে, একারণে তারা মুশরিক। নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোনো গণকের কাছে গিয়ে কোন কিছু জিজ্ঞেস করবে, তার ৪০দিনের সালাত কবুল হবে না।” সহীহ মুসলিম। নবী সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন, “যে ব্যক্তি কোন গণক বা জ্যোতিষীর কাছে যায়, আর তার কথা সত্যি বলে বিশ্বাস করে, সে কুরআনুল কারীমের সাথে কুফুরী করে।” সুনানে আবু দাউদ। গণকের কথা যারা বিশ্বাস করে, মেনে চলে ও তার আহ্বানে সাড়া দেয়, তারাও শিরকে লিপ্ত হয়ে মুশরিক হয়ে যায়।

বর্তমানে ব্যাক্তি জীবনে নিঃসন্তান প্রায় ৭৫ বছর বয়সী শহীদুল আলম সিকদার দুলু তথা শহীদ আল বোখারী মহাজাতকের যোগ ফাউন্ডেশন ও কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের নামে ব্যাংক একাউন্টে জমা আছে আনুমানিক ৫ হাজার কোটি টাকা এবং মহাজাতকের নিজের নামে পার্বত্য চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী, বগুড়া সহ সারা দেশে জমির পরিমান আনুমানিক নয় হাজার একর। প্রতিনিয়ত এই পরিমান বাড়ছে। এছাড়া তাঁর স্ত্রী নাহার আল বোখারীর নামে-বেনামে রয়েছে প্রচুর জমি এবং অর্থ-সম্পদ।

দূর্নীতি, স্বজন-প্রীতি, সাইকো-পলিটিক্স, অবৈধ যৌন কর্মকান্ড, ভন্ডামী, প্রতারণার স্বর্গরাজ্য কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। মহাজাতক কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে দূর্নীতির রাম-রাজত্ব কায়েম করেছেন। মহাজাতক ও তাঁর প্রতিষ্ঠান যোগ ফাউন্ডেশন ও কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সকল আর্থিক আয়-ব্যয় স্বনামধন্য অডিট ফার্ম দ্বারা নিরীক্ষা করা জরুরী। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের অর্থনৈতিক দূর্নীতি খতিয়ে দেখার।

নিঃসন্তান হলেও মহাজাতকের নাম-যশ ও সম্পদের প্রতি রয়েছে প্রচন্ড দূর্বলতা। এই মোহই তাকে আজ ভণ্ডামির এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কারও মেধা, কারও শ্রম, কারও অর্থ শুষে নিয়ে আজ তিনি সেঁজেছেন নবিজীর ধারা পরম্পরা প্রতিনিধি তথা উলিলে আমর।

মহাজাতক হলেন সর্বরোগের মলম বিক্রেতা। এমনকি ক্যান্সার ভালো হয়ে যাওয়ার কথাও প্রচার করা হয়। অথচ, তাঁর নিজের ভাই মারা গেছেন ক্যান্সারে। প্রকৃতপক্ষে, মানুষের মন নিয়ে খেলা করা মহাজাতকের পুরাতন অভ্যাস। মানুষের মনদৈহিক চিকিৎসার নামে মহাজাতক হিপনোটাইজ করে মানসিক বৈকল্য ও দাসত্ব তৈরি করছেন। বাংলাদেশের মনোচিকিৎসকদের উচিত মহাজাতকের কার্যক্রম পর্যবেক্ষন করা এবং বিবৃতি দেয়া, যাতে সাধারন মানুষ এদের প্রতারণার হাত থেকে বাঁচতে পারে। সৎ সাংবাদিকদের উচিৎ, এই মহাপ্রতারকের নানাবিধ অপকর্ম, প্রতারণা ও ভূমি দখল নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করা। দেশের বাহিরে পাচার হয়ে যাওয়ার আগেই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে অবিলম্বে সরকারের জিম্মায় নিয়ে নেয়া উচিৎ। ধর্মীয় বায়াতদান, কোয়ান্টাম মেথড কোর্স, হিলিং, মাটির ব্যাংক, যাকাতের টাকায় ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে যে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে তা তদন্ত করা এখন সময়ের দাবি।
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×