অকপট বলে নেওয়া ভালো, কথাগুলো যাঁকে নিয়ে, তাঁকে নিয়ে আমার কথা বলার যোগ্যতা বা সক্ষমতা একেবারেই নেই। বরং নেহাত কাকতালীয়ভাবে কিছু অভিজ্ঞতার কল্যাণে এই শ্রদ্ধাঞ্জলি।
মিহির সেনগুপ্তের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আর এটা সত্যি যে তখন উনি কে, তা আমার জানা ছিল না। নামটা তো আরও–ই না। তবে ট্রেন থেকে নামার পর, আমাকে নিতে এসেছিলেন যিনি, তিনিই বিশাল আগ্রহ ভরে নিয়ে গিয়েছিলেন মিহির সাহেবের বাড়িতে।
ভদ্রেশ্বরের ছোট্ট মলিন স্টেশনে যখন নেমেছিলাম, তখন সন্ধ্যা রাত। খানিক বাদেই সুনসান — ভয় ভয়ভাব আমার মনে। কোথায় যে এলাম! চিনি না, জানি না এই মফস্বলে কোথায় যাব! আমাকে বলা হয়েছিল, নিতে আসবেন কেউ।
এদিক–ওদিক দেখতে দেখতেই সাইকেলসমেত এক ভদ্রলোক আমার নাম ধরেই ডাকলেন। অবাক হলাম না। এখানে আমি না হয়ে বাংলাদেশের যে কেউ হলেও তাঁকে চেনা যেত। এ তল্লাটে অপরিচিত মানুষ এ সময় আসে বলে মনে হয়নি আমার। তাই অনিশ্চয়তা কেটে যেতেই তাঁর কথামতো মিহির সেনের বাড়ির দিকে রওনা হলাম সাইকেল চেপে।
আমার কাছে তখন নতুন একটা জায়গা দেখার আবেদন ঢের। তার ওপর ওপার বাংলার মানুষেরা কীভাবে থাকে, কী খায় — সেটা নিয়ে বিস্তর আগ্রহ আরও আগে থেকেই। তাই আশফাকুজ্জামান উজ্জ্বল — উজ্জ্বল ভাইয়ের মারফত আমাকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল ‘ভ্রমণ আড্ডা’তে। ভদ্রেশ্বরের এই ভ্রমণ আড্ডা বসে বছরে একবার। বাঙালিদের মিলনমেলার মতন। আমার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা এতটা ছিল না যে ওপার থেকে আমাকে খুঁজে পয়গাম পাঠাবেন। উজ্জ্বল ভাই আসতে না পারায় উনিই বলেছিলেন, ‘যাও। ভালো হবে। ওনাদেরও বাংলাদেশকে জানা দরকার, আর তুমিও দেখে এলে।’
সেই দেখতে এসেই মিহির সেনগুপ্তের বাড়িতে যাওয়া। সাহিত্যের ‘স’ও আমার মধ্যে নেই বা ছিল না। যা ছিল তা হলো, ঘুরে বেড়ান এমন কিছু মানুষের সামনে বাংলাদেশের ছবি দেখানো।
মিহির সেনগুপ্ত হবেন প্রধান অতিথি। কেউকেটা কেউ না হলে যে প্রধান অতিথি হওয়া যায় না, সেটায় ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। তাই ধরেই নিলাম, তিনি বড় কেউ। বলা হলো, কী একটা বইয়ের জন্য আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন। ভ্রমণবিষয়ক বই যেহেতু নয়, তাই আমারও তেমন আগ্রহ নেই। রতন লাল বিশ্বাস সাহেব আসবেন, আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে তাঁর অপেক্ষায় আছি। ওনার অনেক বই আমার পড়া। সব বই–ই ঘোরাঘুরির।
মিহির সেনগুপ্তও বোধ করি আমার অন্তরাত্মা দেখে ফেলেছিলেন একলহমায়। সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডী ছাড়িয়ে আসা ব্যাকপ্যাক নেওয়া ছোকরার সঙ্গে তেমন কথা হলো না। কীই–বা বলার আছে?
ফিলামেন্ট বাল্বের আলোয় মোটা চশমা পরা মানুষটাকে চোখের দেখা দেখলাম। এই-ই। আর তার পরদিন ভ্রমণ আড্ডার ইতি টানা হবে আমার স্লাইড শোয়ে। পুরোনো দালানের বড় হলঘরের মঞ্চে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের সাদা পর্দায় জ্বলে আছে বাংলাদেশের হাওরের একটা ছবি।
হুট করেই হুল্লোড় উঠল, ‘বাতি জ্বালিয়ে দাও, দেখি বাংলাদেশ থেকে কে এল? তাকে দেখতে হবে।’ ঠাসঠাস করে শব্দ হলো সুইচের।
এতক্ষণ অন্ধকার ছিল বলে বাতিগুলো আরও বাড়তি মনে হলো। তাঁরা আমার কী দেখলেন জানি না, দর্শকদের দিকে তাকিয়ে আমি আঁতকে উঠলাম। সবাইকে আমার মিহির সেনগুপ্তের মতন মনে হলো — প্রৌঢ়, পোড় খাওয়া। বৃদ্ধগোছের মানুষগুলো আমার দিকে মাছের চোখের মতন করে তাকিয়ে আছেন! নিষ্পলক! হায় খোদা, আমি কোথায় এসে পড়লাম! এঁদের আমি বাংলাদেশ দেখাই কী করে? আমার বয়সের চেয়ে ঢের বেশি দিন এঁরা হয়তো বাংলাদেশে থেকেছেন। তখনো এর নাম বাংলাদেশই তো ছিল, শুধু একটা পতাকা ছিল না। পতাকা জাতীয়তা পাল্টায়, তবে জাতিসত্তা কতটুকু বদলায়, তা বের করার দায় সমাজবিজ্ঞানীর!
সুনসান নীরবতায় একে একে আমি দেখিয়ে গেলাম বাংলাদেশের ছবি। আর দর্শকদের চাহনিতে আটকে গেল আমার দৃষ্টি, মন, চিন্তা! অর্বাচীন আমার বিদ্যাবুদ্ধির শান এতটা না হলেও কী বিশাল একটা তৃপ্তির পরশ হলজুড়ে। মনে হলো, তাঁরা অনেক দিন বাদে সুধা পান করছেন। এটা একান্তই আমার ধারণা। বিশাল করতালিতে আমার সেই ধারণা প্রকট হলো — আরও।
মিহির সেনগুপ্তের সঙ্গে আর কথা বলা হলো না।
এরপরের ঘটনা আরও অনেক পরে। প্রায় দেড় যুগ। আমিও বড় হলাম এর মধ্যে। সময়ে পাল্টে যায় সবকিছু। তার মাঝখানে এই করোনা অতিমারিতে আমাদের মতো ছুটে চলা প্রাণীদের থিতু হতে হলো। সঙ্গী হলো বই। তাই মিহির সেনগুপ্তের ‘বিষাদবৃক্ষ’ বইটা ধরলাম। হাতে অনেক সময়!
এত দিনে বুঝে গেছি, আনন্দ পুরস্কার কী, মিহির সেনগুপ্ত কে। তাঁর ওপর অনুজের ইচ্ছাকে সম্মান জানাতেই ‘বিষাদবৃক্ষ’–এর মতো বই পড়া।
এই বইয়ের সৌন্দর্য কিংবা সৌরভ কোনোটাই আমার ব্যাখ্যার ধার ধারে না। আমি এই বইকে ভালো বা খারাপ বললেও তাতে কিছু যায় আসবে না। কিন্তু যদি না পড়া হয়ে থাকে বা এটা বলা ভালো, যদি না পড়া হতো, তবে আমি আমার দেড় যুগ আগের স্লাইড শোয়ে দেখা প্রৌঢ় মানুষগুলোর চোখের ভাষায় আসলে কী ছিল, তা বুঝতে পারতাম না।
তাঁদের ফেলে আসা বাড়ি, উঠোন, পাড়া, প্রতিবেশী, ইস্কুল, মন্দির, মসজিদ — এখনো যে তাদের কাঁদায়, সেটা অবুঝও বুঝতে পারবে। এই বইয়ে মিহির সেনগুপ্ত যা বলেছেন, তা অনেকটা টাইম ট্রাভেলের মতো। দেশভাগ, দেশভাগের মর্মান্তিক গল্পের দেশে বাস্তব চিত্রের প্রতিফলন উঠে এসেছে অস্বাভাবিক রকম নির্ভেজাল বর্ণনায়। একটুখানির জন্যও মনে হয়নি, একপেশে, একতরফা করে এগিয়ে দিয়েছেন কাউকে, কাউকে দোষারোপ করতে চেয়েছেন।
বিংশ শতাব্দীর বুকে ধর্মের ঝনঝনানি তরবারির চেয়ে প্রখর। ধর্ম যে মানুষের কল্যাণের জন্য, তা ভুলে যাওয়া হয়েছে শুধু রাজনৈতিক কারণে। যেখানে খেটে খাওয়া সাধারণ জনসাধারণের হাতে কিছু থাকে না। কে মুসলিম, কে হিন্দু — আজ থেকে সত্তর–আশি বছর আগে এই পলিমাটির বদ্বীপে কোনো ফারাক রেখেছিল না, যা ধীরে ধীরে হয়েছে রাজার নীতির কারণে। সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন, মানবিক পরিস্থিতি এমন কোন পর্যায়ে যেতে পারে, যখন নিজ ঘর, দেশ ছেড়ে দিতে হয়! ছেড়ে দিতে হয় অভ্যাস, অনুষঙ্গ আর ভালোবাসার নিয়ামকগুলো!
তখন ধারাবাহিকতায় অন্যকে দোষারোপের অনলে না জ্বালিয়ে কৃত্রিমতাবির্বজিত বিশ্লেষণে জীবন নামক নদীর যে বহতার কথা উনি বলেছেন — অসাধারণ। দোষারোপে নিজের দোষ ঢাকবার তাড়না ছিল না বলেই হয়তো তাঁকে ব্যক্তিজীবনে দ্বিরাষ্ট্রসত্তার চাপাকলে পিষ্ট হতে হয়েছে!
ওপার বাংলায় চলে যাওয়ার পর ‘বিষাদবৃক্ষ’ লেখা। তাও অনেক দিন বাদে লেখা। বইয়ের নাম বিষবৃক্ষও হতে পারত। আদতে তা–ই সমীচীন মনে হয়েছিল আমার। যাদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়; সময়ের সঙ্গে যখন দেশের, নাগরিকত্বের সংজ্ঞা পালটাতে থাকে, তখন ফেলে আসা অতীতে, ভালোবাসায় ভাটা পড়ে। ঘৃণার প্রদাহ মনকে আড়ষ্ট করে। তাই যদি বইটার নাম বিষবৃক্ষ হতো, বর্ণনায় কিছুটা গতানুগতিক বাণিজ্যিক প্রবাহের আলোড়ন আসত, তবে এই বইয়ের পাঠক আরও বেশি হতো। অপরকে ছোট করে নিজে বড় হওয়ার যে প্রবণতা, তা প্রাচীন। তিনি সে পথে এগোতে পারেননি। নিজ ঘরের বর্ণনায় সামন্তবাদী পারিবারিক রীতির যে আবেগহীন লালসার বর্ণনার কথা বলেছেন, তার জন্য বুকের ছাতি বড় হতে হয়। অনেক বড়। যা সমগোত্রীয়রা ভালোভাবে নিতে পারবেন না — বলাই যায়।
বইটাতে ‘জান’ শব্দটা একধরনের খালের বর্ণনায় এলেও আমার কাছে এই ‘জান’ মিহিরবাবুর নিজের জানের মতোই মনে হয়েছে আদ্যোপান্ত। পিছরার খাল হয়তো নিয়ামক ছিলমাত্র। লাজুকভাবে তুলে ধরার সেই চেষ্টাই বলা ভালো।
অনেকেই চলে গেছেন।
প্রথমবার কলকাতা শহরে যেবার গিয়েছিলাম, হলুদ রঙের অ্যাম্বাসেডর ট্যাক্সি ড্রাইভারের বাড়ি মীরপুর, নিম্বুপানি শরবতওয়ালা দিনাজপুর আর মিহিরবাবু বরিশাল। এমন কত কত মানুষ জমেছিলেন, যারা আমাদের প্রতিবেশী, বন্ধু, আত্মীয় ছিলেন। আমার মতন ভ্রমণপিয়াসিদের প্রথম বিদেশ কলকাতা। সেখানে এখানে–ওখানে এত এত দেশি দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম।
হায়! সবার বাড়ি কীভাবে আমার দেশে হয়! জ্ঞানের অপ্রতুলতায় আমি ভেবেই বসেছিলাম, তবে কি এ–ও দেশের বাইরে আমার আরেক দেশ? যেখানে সবাই তার বাড়িতে একটা বিষাদবৃক্ষ পালে? যা আজও বিষবৃক্ষের আকার ধারণ করেনি!
এনাদের বিষাদবৃক্ষের ছায়া মাড়িয়েছি আমি অনেকবার। ট্রেনে পরিচিত হওয়া পিকলুদার আদি বাড়ি পুরান ঢাকা। আমাকে জোর করেই নিয়ে গিয়েছিলেন কলকাতার তিনতলা বাড়িতে। মায়ের সঙ্গে থাকেন। আমাকে দেখলে ‘মা’ খুশি হবেন — এই প্রলোভনে যাওয়া। গেলাম। থুরথুরে বুড়িমা আমায় বুকে জড়িয়ে নিলেন। কী অকারণ ভালোবাসা! জানতে চাইলেন তাঁর শ্বশুরবাড়ির কথা। হায় আমি কী করে বলি! তাঁর উন্মা আমাকে বধির করে দিয়েছিল। এই অকাতর ভালোবাসার কারাগারে আমি তিন দিন ছিলাম। বুড়ি মা নিজে রেঁধে খাইয়েছিলেন পাশে বসে। কেন? আমি জানি না। এই মনে হয় দেশ, এই মনে হয় মাতৃভূমির জ্বালা।
মিহির সাহেব নিজেকে দিয়ে সবার কথা বলে গেছেন। এই বিষাদবৃক্ষটা আসলে কোথায়, তার কথা বলে জাননি।
কিছু বই রেখে দেওয়ার মতন। কিছু লেখা পরম্পরা বোঝার জন্য। কিছু মানুষ, কিছু মানুষের কাছে চিরজীবীর মতো। আপনি তাদের একজন হয়ে থাকবেন। আমার। আফসোস, আপনার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।
এই বাংলায়।
এখন ঢের বুঝতে পারি, ট্রেন থেকে নামার পর আমাকে কেন নিয়ে গিয়েছিলেন মিহির সাহেবের বাড়িতে।
বাংলাদেশ থেকে এসেছি। তাই।
প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৩: ০৪ | প্রথম আলো | view this link