somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিপ্লবের নিঃশব্দ মূল্য: অর্থনৈতিক বৈষম্য ও বাংলাদেশি ছাত্র আন্দোলন

১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৯:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এ লেখাটি বেশ বড়ো। এখানে ছোট করে দেয়া হল। পুরো লেখাটি যদি কেও পড়তে চান, তবে নীচের লিঙ্ক থেকে পড়তে পারবেন।


সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন পর্যালোচনা চলছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এই আন্দোলনে ৬৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে, তবে আমাদের গণমাধ্যম বলছে সংখ্যাটি ৮১৯। আন্দোলনের সময় আহতদের কেউ কেউ মৃত্যুবরণ করছেন, ফলে সংখ্যা বাড়ছে। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অনলাইনভিত্তিক টালিখাতা তৈরি করেছেন, যার নাম shohid.info, যেখানে ৪১১ জনের নাম, পরিচয় এবং পেশা সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষিত আছে। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগই ছাত্র, আর বাকিরা নিম্ন আয়ের মানুষ।

যদিও আন্দোলনটি ছাত্রদের নেতৃত্বে পরিচালিত, তাতে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য। নিহতদের আর্থিক অবস্থার দিকে তাকালে দেখা যায়, অধিকাংশই নিম্নবিত্ত শ্রেণির। এই বাস্তবতা অর্থনৈতিক কাঠামোয় শ্রেণি বিভাজনের দিকনির্দেশ করে। আমরা যদি দ্য বেল কার্ভ গ্রন্থের সাথে তুলনা করি, এই প্রেক্ষাপট আমাদের বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন উপলব্ধি দেয়। হার্নস্টেইন এবং মারের মতে, সমাজে বুদ্ধিমত্তা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সাফল্যের মূল চালক। তবে সাম্প্রতিক আন্দোলনটি দেখায় যে, শুধুমাত্র বুদ্ধিমত্তা নয়, বরং অর্থনৈতিক অবস্থানও একজন ব্যক্তির ভাগ্য নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে।

আন্দোলনে নিম্ন আয়ের মানুষের মৃত্যু এবং ঝুঁকিপূর্ণতা অর্থনৈতিক স্তরবিন্যাসের বাস্তবতাকে সামনে আনে। ছাত্ররা অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল, ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে রক্ষা পাওয়ার মতো কোনও সম্পদ বা অবস্থান তাদের নেই। অপরদিকে, নিম্ন আয়ের মানুষজন এমন একটি প্রান্তিক অবস্থানে থাকেন, যেখানে তাদের নিজেদের রক্ষা করার মতো সক্ষমতা নেই। এই বাস্তবতায় ছাত্র এবং নিম্ন আয়ের মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়েন। দ্য বেল কার্ভ গ্রন্থে বুদ্ধিমত্তাকে সমাজের শ্রেণি কাঠামোর চালক হিসেবে ধরা হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা মানুষকে আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে।

স্বৈরাচারী শাসন ও বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য শাসকগোষ্ঠী প্রায়ই ভিন্নমতকে দমন করে এবং অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত শ্রেণি তৈরি করে। এই শাসন ব্যবস্থায় বুদ্ধিজীবী শ্রেণির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তারা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে শাসন ব্যবস্থার নীতিগুলোকে সমর্থন করেন যা সামাজিক বৈষম্যকে বাড়িয়ে দেয়। স্বৈরাচারী শাসন অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক মানুষদের শোষণ করে, যাদের দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকে থাকা হয় অবশ্যম্ভাবী। শাসকের স্বার্থ রক্ষা করতে তারা এক ধরণের স্থিতিশীলতা তৈরি করে রাখেন, যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে চাপে থাকায় শাসনের বিরুদ্ধে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে, এই একই জনগোষ্ঠী পরিবর্তনের শক্তি হয়ে ওঠে। যখন তাদের জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় না এবং তাদের উপর অত্যাচার চলে, তখন তারা আন্দোলনের প্রথম সারিতে চলে আসে।

ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে নিম্ন আয়ের মানুষের অংশগ্রহণ ঐতিহাসিক বিপ্লব এবং সামাজিক আন্দোলনগুলোর ক্ষেত্রে নতুন কিছু নয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিজেদের জীবনের উন্নতির জন্য একটি সুযোগ দেখতে পায়। যদিও আন্দোলনটি ছাত্রদের দাবি নিয়ে পরিচালিত, নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠী এটিকে এমন একটি সুযোগ হিসেবে দেখেছে যা তাদের অর্থনৈতিক দুঃখ-কষ্টের অবসান ঘটাতে পারে। সামাজিক আন্দোলনে তারা ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখে যেখানে তাদের দারিদ্র্য মোচনের সুযোগ তৈরি হতে পারে।

এই আন্দোলনের বিশেষ দিক হলো ছাত্র এবং নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য। তারা তাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে একে অপরের পাশে দাঁড়াতে পারে। একজন ছাত্র এবং একজন নিম্ন আয়ের মানুষ উভয়ই আর্থিকভাবে অসচ্ছল, ফলে উভয়েই একই ধরনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। তারা তাদের সম্মিলিতভাবে দাঁড়ালে একটি ভালো ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখতে পায়।

ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষের মৃত্যু আমাদের শ্রেণি কাঠামোর ফাঁকফোকরগুলোকে প্রকাশ করে। সীমিত অর্থনৈতিক সম্পদসম্পন্ন ব্যক্তিরা সরকারি ব্যর্থতা এবং সামাজিক অস্থিরতার প্রধান ভুক্তভোগী হয়। সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময়ে কারা সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগ করবে, তা অনেকাংশে তাদের অর্থনৈতিক শ্রেণির ওপর নির্ভর করে। অর্থনৈতিকভাবে প্রান্তিক মানুষদের জন্য নিজেদের সুরক্ষার কোনও বিকল্প বা সক্ষমতা নেই বললেই চলে। ফলে আন্দোলনের সময় তাদের মৃত্যু বেশি হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে।

দ্য বেল কার্ভ গ্রন্থের ধারণাগুলোকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুনর্মূল্যায়ন করলে দেখা যায়, এখানে বুদ্ধিমত্তার চেয়ে অর্থনৈতিক বাস্তবতা শ্রেণি বিন্যাসকে পরিচালনা করে। অর্থনৈতিক অবস্থানই নির্ধারণ করে কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকবে। ইতিহাসের অন্যান্য আন্দোলনের মতো সাম্প্রতিক আন্দোলনেও অর্থনৈতিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হয়েছে।

এই আন্দোলন আমাদেরকে সামাজিক কাঠামো এবং শ্রেণি ব্যবস্থার দিকে পুনরায় নজর দিতে বাধ্য করে। ছাত্র এবং নিম্ন আয়ের ব্যক্তিদের আত্মত্যাগ আমাদেরকে সামাজিক বৈষম্য এবং শ্রেণি কাঠামো নিয়ে পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানায়। এই সংগ্রাম শুধু নির্দিষ্ট দাবির জন্য নয়, এটি একটি স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে যেখানে সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য এবং প্রান্তিকতাকে ক্রমাগত পোক্ত করা হয়েছিল। ছাত্রদের নেতৃত্বে হওয়া সত্ত্বেও, নিম্ন আয়ের মানুষের অংশগ্রহণ একটি বৃহত্তর ন্যায্যতার জন্য আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে।

এই আন্দোলন এবং তাতে যারা জীবন হারিয়েছেন, তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আমাদেরকে অবশ্যই সমাজের কাঠামোগত বৈষম্য দূর করার জন্য কাজ করতে হবে। এটি শুধু রাজনৈতিক সংস্কারের জন্য নয়, বরং একটি ন্যায্য সামাজিক শৃঙ্খলা তৈরির জন্যও।


Published : 28 Aug 2024, 06:31 PM Updated : 28 Aug 2024, 06:31 PM | bdnews24.com | view this link

সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ৯:২৫
৭টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×