somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টকশোতে আমজনতা কই?

০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ বিকাল ৩:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমরা যদি খেয়াল নাও করি, তার পরেও একটা বিষয় খুব সহজেই চোখে পড়ে, তা হলো আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে যে সব আলোচনা অনুষ্ঠান বা টকশো হয় বা হয়ে আসছে, তাতে বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারীরা হয় কেউকেটা কেউ, কেউবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ঘাগু রাজনীতিবিদ, ঝানু ব্যবসায়ী, স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব, আলেম-ওলামা, কবি-সাহিত্যিক, অভিনেতা-অভিনেত্রী, সাহসী সাংবাদিক কিংবা নিদেনপক্ষে সোশাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট। মাঝে মাঝে এর ব্যত্যয় যে ঘটে না - তাও আবার নয়। তবে মোটা দাগে যাদের দেখতে পাওয়া যায়, তারা এতদিনে বেশ পরিচিত মুখ। তাদের বিচার-বিশ্লেষণের কৌশল, বাচনভঙ্গি, তথ্যের উপস্থাপন, শব্দের প্রয়োগ থেকে শুরু করে তাদের নিজেদের বিশেষ বিষয়ের পারদর্শিতার একটা ধারণা হয়ে যাওয়াটা অমূলক নয়। তাই এনাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যাদের কথা আমরা বেশি আগ্রহ নিয়ে শুনি কিংবা অপেক্ষা করে থাকি কখন কোথায় তাদের আলোচনা শুনতে পাওয়া যাবে। এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। সবাইকে সবার ভালো লাগবে, তা হতে পারে না

কিন্তু একটা বিষয় না বলে উপায় থাকছে না, এখানে আমজনতার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো কম। আমার ভুল হতে পারে। কেননা বর্তমানে বাংলাদেশে ৩৬টি বেসরকারি টিভি চ্যানেল আছে। ধরে নেওয়া যেতে পারে, তার সবকটিতেই দিনে কম করে একটা করে আলোচনা অনুষ্ঠান বা টকশো জাতীয় অনুষ্ঠান হয় বা হতে পারে। তাই সবগুলো দেখার বা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এটা বলা কঠিন যে কোথায় কোন অতিথি কথা বলতে আসবেন। আবার ওয়েব ভিত্তিক অনুষ্ঠানগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয়। অনেকাংশে টিভির অনুষ্ঠানের সম বা অধিক পরিমাণে জনপ্রিয়তা আছে। তাই চ্যানেলের সংখ্যা কেবল ৩৬ বলাও পুরো সত্য নয়। টকশোর সংখ্যা আরও বেশি হবে। সরকারি টিভির কথা যদি উহ্য রাখা হয়।

আম জনতার উপস্থিতি বলতে কোনো আলোচনায় একদম আনাড়ি, অপরিচিত, ‘ক্ষ্যাত’, ভালো করে কথা বলতে না-পারা মানুষ, বাজারের মুটে, টোকাই, বাসের কন্ডাক্টর, ড্রাইভার, রংচটে যাওয়া ইউনিফর্মের ট্রাফিক পুলিশ, মহিলা কনস্টেবল, ময়লাওয়ালা, রিকশাচালক, কৃষক, জেলে, ফেরিওয়ালা, পৌরসভার যে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা সকালে রাস্তা পরিষ্কারের চেষ্টা করেন, টাকা দিয়ে যারা বিয়েবাড়ির উচ্ছিষ্ট খাবার কিনে খান, এমন কত কত মানুষ। যাদের শ্রেণি আলাদা। এনাদের কোথাও দেখা যায় না। এনাদের কেউ ডেকে আর্টিস্টিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্টুডিওর নরম সোফায় বসায় না। কেন বসায় না, তা অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু চিন্তার চিতা জ্বালিয়ে হয়তো অনুমান করা যায়, এদের কথা কে শুনবে? এদের কথার গুরুত্বের তাত্ত্বিক তত্ত্ব তালাশ করলে হয়তো কোনো “পিয়ার রিভিউড পেপার” পাওয়া যাবে না। এরা তো উচ্চশিক্ষিত নন। অনেকেই হয়তো লিখতে পারেন না। কিন্তু আমরা এটা ভুলে যাই, এরাই বাংলাদেশের আপামর জনতা। আম, আমজনতা। এনারা এভাবেই টিকে আছেন যুগের পর যুগ ধরে। শুনে আসছেন, দেখে আসছেন টিভির পর্দার কেউকেটা কাউকে। এনারাই দর্শক-শ্রোতা। মাস পপুলেশন। যদি তাই হয় তবে পাঠক, আপনার কি মনে হয় না, কোথাও কোনো কিন্তু থেকে যাচ্ছে? সরাসরি অভিজ্ঞতা আর দেখে-শুনে-পড়ে অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের জ্ঞানভাণ্ডারের প্রাচুর্যতা কতটা আপডেটেড, সেখানে কি প্রশ্ন রাখার অবকাশ থাকে না? থাকার তো কথা। কেন না এত এত সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়, সমাধানের রাস্তা বাতলানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কই? সমাধান তো ঠিক আসে না। দেখতে দেখতে অনেক বছর অনেক কিছু হয়ে গেল। অর্ধ শতাব্দী। পৃথিবীর ইতিহাসে সংখ্যাটা নিছকই সংখ্যা, কিন্তু নতুন একটা দেশের জন্যে সংখ্যাটা একদম ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এতদিনে আমাদের জাতীয় চরিত্র কিছুটা হলেও শক্তপোক্ত হবার কথা।

কেন আনকোড়া নতুন বা আমজনতার উপস্থিতি দেখা যায় না? প্রশ্নটি যদিও অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের জন্যেই প্রযোজ্য, তদুপরি এটা ধরে নেওয়া যায় বক্তাদের সামাজিক অবস্থান এবং তাদের গ্রহণযোগ্যতা। খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেনতেন কাউকে তো টিভিতে আনা যায় না। আবার এটাও ধরা যায়, তাদের উপস্থিতিতে চ্যানেলের টিআরপি (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট বা টার্গেট রেটিং পয়েন্ট) বাড়ে। এই বাড়া মানে হলো, ঐ অনুষ্ঠানটি বেশি দর্শক দেখেন। হিসাবের ক্যালকুলাসে না গিয়ে মোটাদাগে এভাবেই ধরে নেওয়া যেতে পারে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জন্যে এই টিআরপি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এর সাথে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের মূল্য নির্ধারিত হয় বা হতে পারে। তাই প্রাইমটাইম বলে একটা ব্যাপার আছে। যে সময় দর্শক সংখ্যা সবথেকে বেশি থাকে, তার গুরুত্ব তত বেশি হয়। বিজ্ঞাপন দাতাদের খরচও বেশি হয়। চ্যানেলের জনপ্রিয়তাও একটা বড় অনুঘটক এখানে। আবার কে অতিথি হয়ে আসছেন, তাও সেই অনুষ্ঠানকে যেমন মহিমান্বিত করে, একইভাবে সেই চ্যানেলকেও জনপ্রিয় করে তোলে। অতিথিদের নিজেদের পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার থাকে বা থাকতে পারে। যেমন আমরা শুনি, উনি ঐ চ্যানেলে যান বা ঐ চ্যানেল আমাকে ডাকে না। এখানে পুল বা পরিমণ্ডল তৈরি হয় বা হবার ব্যাপক সম্ভাবনা থাকে।
একইভাবে আমরা যদি সব চ্যানেলের সব অনুষ্ঠানে যদি একটি বড় সংখ্যার অতিথিরা পর্যায়ক্রমে অতিথি হয়ে আসতে থাকেন, তবে এখানেও একটি গেস্ট পুল বা স্পিকার্স পুল বা পরিমণ্ডলের আবির্ভাব হয় বা হতে পারে। উপরের কথাগুলো যদি সরাসরি এক লাইনে বলা যায়, তা হলো, এই পুলে আমজনতার অংশগ্রহণ খুবই কম বা নেই বললেই চলে।
তার মানে দাঁড়ায় আমরা একটা পুলকেন্দ্রিক বক্তা এবং তাদের অভিজ্ঞতায় আটকে পড়ছি বা সম্ভাবনা থাকে। এবং এক ব্যক্তির সকল বিষয়ে পারদর্শিতার উদাহরণ টকশোগুলো দেখলে বোঝার অবকাশ থাকে না। অনেকে বলে থাকবেন বক্তার অভাব। কথা হয়তো ঠিক। যারা বিদ্যান বা কোনো আলোচনায় অবদান রাখতে পারেন, তাদের সময় নাও হতে পারে কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার। এটা অবশ্যই মানতে হবে, বছরের পর বছর ধরে কোনো আলোচনা অনুষ্ঠান বা টকশো চালিয়ে যাওয়া সোজা কথা নয়। তার ওপর বাংলাদেশের জন্য এটা অবশ্যই আরো কঠিন। তাই এই বক্তার দুর্ভিক্ষে আমজনতার অংশগ্রহণ দারুণ কিছু হতে পারে। ভাবা যায়, যদি একটা রিকশাচালককে (উদাহরণ মাত্র) চ্যানেলের সোফায় বসিয়ে তার কথা শোনা হয়, তবে তার কাছ থেকে কত কত নতুন তথ্য আমরা পেতে পারি? একদম রাস্তা থেকে উঠে আসবে তথ্যগুলো। গাড়ির গ্লাসের ভেতর থেকে শহর যেমন দেখায়, চালকের সিট থেকে তেমন দেখবার কথা নয়। ঠিক যেমন ড্রোন থেকে ঢাকা শহর দেখার মতো। কী দারুণ লাগে। কিন্তু বাস্তবতা কী, সেটা আমরাই বলতে পারি। তার ওপর অতিথিদের সম্মানী দেওয়া হয়। অংকটা কম-বেশি হয় ব্যক্তি বিশেষে। কম করে যদি এক হাজার টাকা হয়, আর ঐ রিকশাচালক বা বাসের হেলপার যদি আলোচক হিসেবে আসেন এবং এই সম্মানীটা পান, এটা তার সারা দিনের উপার্জনের সমান প্রায়। অর্থনীতিও একটা ব্যাপার তো।

আমরা মিডিয়ার স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলি। ইনক্লুশন নিয়ে বলি না। যে ইনক্লুশনের জন্যে কত কিছু হয়ে গেল। মিডিয়াতেও ইনক্লুশন দরকার। এটা কোনো দাবি নয়। বাংলাদেশে আমজনতার হাতে মাইক্রোফোন থাকে না। থাকে নেতাদের একটি বিশেষ শ্রেণির হাতে। যাদের অনেকে অনেক সময় আসমান থেকে ঢাকা দেখেন। যাদের অনেকের বাসে ওঠার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। যাদের অনেকের রিকশাভাড়া নিয়ে হাতাহাতি করতে হয় না। কিন্তু যাদের এসব করতে হয়, তাদেরও “ইনক্লুশন” দরকার। তাদের কথা বলার জায়গা দরকার। মাসে একদিন হোক বা তিন মাসে একদিন হোক। হোক। শুরু হোক। দেশের বেশির ভাগ মানুষের কথা শোনার জন্যে তাদেরকে আমন্ত্রণ জানানো কি বাঞ্ছনীয় নয়?

এত কিছু বলার কারণটাও আমার নিজের উপলব্ধি নয়। গত রাতে বাসে করে ফেরার সময় পাশের সিটে বসা মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক মোবাইলে এক পরিচিত আলোচকের আলোচনা শুনছিলেন। বেশিরভাগ মানুষ হেডফোন ব্যবহার করেন। এই ভদ্রলোক করেননি। ধরে নিলাম তাঁর কাছে হেডফোন নেই। আমি কিছুটা বিরক্তও বটে। কিন্তু ঠিক আছে, শুনছেন যখন শুনুক। তবে খানিক বাদে, বাস যখন কানায় কানায় ভরে গেল, দাঁড়িয়ে থাকা একজন বলে বসলেন, “ভাই, বা....টা বন্ধ করেন। অনেক শুনলাম। আর কত?”
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ বিকাল ৩:৩০
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসনাতের বয়ানে সেনাবাহিনীর প্রস্তাব নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি, সেনা সদরের অস্বীকার

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১:০১

হাসনাতের বয়ানে সেনাবাহিনীর প্রস্তাব নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি, সেনা সদরের অস্বীকার

ছবি: অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত।

জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ সম্প্রতি দাবি করেছেন যে, সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগের একটি 'সংশোধিত' অংশকে রাজনৈতিকভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তবু তো ফাল্গুন রাতে এ গানের বেদনাতে আঁখি তব ছলছলো....আমার দুঃখভোলা গানগুলিরে ......

লিখেছেন ইন্দ্রনীলা, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫



মাঝে মাঝে আমার বুকের গহীনে এক ব্যথার নদী উথলে ওঠে। উথাল পাথাল ঢেউগুলো পাড়ে এসে আছড়ে পড়ে। উত্তাল বেগে ধেয়ে এসে ভেঙ্গে খান খান হয়ে পড়ে বুকের মাঝে... ...বাকিটুকু পড়ুন

"বিস্মৃতি"

লিখেছেন দি এমপেরর, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৪:৫৫


সে যে আজ কোথা হারিয়ে গিয়েছে, আঁধার ছেয়েছে ঘনঘোর কালো;
চাঁদ নেই তারকারাজিও উধাও, নেই জ্বলে কোথা টিমটিমে আলো!
সে যে জানে শত হৃদয়ের কথা, মায়াজালে ঘেরা হাজার স্মৃতি!
কত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথা হালকা পোষ্ট!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:০৭

অবিশ্বাস্য হলেও লেকটির অবস্থান খোদ ঢাকায়; কেউ কি এর লোকেশন বলতে পারেন?



কাটা তরমুজের ছবিটা দেবার বিশেষ মাজেজা আছে;
উটিউবে একজন কামেল বুজুর্গান পাকা সূমিষ্ট তরমুজ কেনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এলার্ট : শেখ হাসিনা আজ রাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:৪৭


বাংলাদেশের মানুষ কল্পনা করতে খুব ভালোবাসে। গুজব ও অপতথ্য শেয়ারে বাংলাদেশের মানুষ প্রথমদিকে থাকবে বলে অনেকের বিশ্বাস । দেশের মানুষের পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বইয়ের প্রতি আগ্রহ নেই। আত্নউন্নয়ন মূলক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×