বান্ধবীরা কত করে বলছে, বিয়ে কর। শরীফা বিয়ে করছে না। 'এখন তোমার বয়স হয়েছে। দেখো, সময়ে 'হ্যাঁ' না করলে পরে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। অসময়ে মশাল দিয়ে খুঁজলেও স্বামী পাওয়া যায় না। তাছাড়া, জাহেদ ছেলেটা তো ভালই।'
সব জানে শরীফা। তবু বলে, 'না'।
শরীফা চাকরি করে। সকাল ন’টায় বাসা থেকে বেরোয়; ফিরে রাত আটটায়। লম্বা ডিউটি। বাপের চিকিৎসা আর ছোটভাইটার পড়ালেখার খরচ সামলাতে অনেক টাকার প্রয়োজন।
এটা তার দ্বিতীয় চাকরি। আগেরটায় যা পেত, তাতে ভাইয়েরই খরচ চুকানো মুশকিল হত। নতুন চাকরিতে যা পায়, তাতে ভাইয়ের প্রাইভেট, বাড়িভাড়া, বাপের এলাজ, বাপ-ভাইয়ের এটা-ওটা চাওয়া- সব খরচের পরও টাকা বাঁচে। আপাতত অভাব নেই; জৌলুস করে চলতে পারে।
বাসায় শরীফারা তিনজন। মাসুদ, শরীফা, আফজাল চৌধুরী। আফজাল চৌধুরীও মেয়ের বিয়ের কথা তোলে। আমতা আমতা করে বলে; জোরে বলে না। এ-সময়ে মেয়ের উপার্জনের ওপর নির্ভর না করে তার উপায় নেই। মাসুদ ক্লাস নাইন-এ ওঠেছে। সে বিএ পাশ করবে, ছোটখাট একটা চাকরি করবে, সংসারের হাল ধরবে। এ-তো পাঁচ-ছয় বছর পর। শরীফা কি তখন বিয়ে করবে!
শরীফা ছয় বছর পর বিয়ে করবে। জাহেদ ছয় বছর অপেক্ষা করবে শরীফার জন্য।
শরীফার মত একটা মেয়ে মেলা মুশকিল। সুন্দরী। আইএ পাশ। কর্মঠ। সারাদিন চাকরি করে সে ক্লান্ত হয়ে খাটে শুয়ে থাকে না। অসুস্থ বাপের দেখভাল করে। ভাইকে ক্লাসের সবক তৈরি করিয়ে দেয়।
শরীফার আরও পড়ার ইচ্ছে ছিল। মায়ের মৃত্যুর পর আর পারেনি। মা হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা গেলে সংসারটা এলোমেলো হয়ে যায়। কিশোরী শরীফা একাই টেনে তুলে আনে সংসারকে।
দিনের ব্যস্ততাটা সকাল সাতটায় শুরু হয় শরীফার। অফিসে যাওয়ার আগে গোসল করে। তারপর সারা দেহে খুশবো মাখে। খোপা বাঁধে না। বেনিও কাটে না। স্প্রে করে চুলগুলোকে ফুলিয়ে রাখে। ঠোঁটে আলতো করে গোলাপী স্টিকের পরশ দেয়। এমননিতেই ফর্সা সে। তার ওপর মুখে স্নো-পাউডারের প্রলেপ পড়লে অদ্ভুত দেখায়। একসেট কাপড় দু'দিন পরে না। সবগুলোই একরঙা কাপড়। টুকটুকে লাল, গাঢ় নীল, উজ্জ্বল হলদে। এইসব রঙের মধ্যখানে শরীফার চেহারাটা গোলগাল একটা চাঁদের মত মনে হয়। মেয়ের এই ফুটফুটে চেহারাটা আফজাল চৌধুরী সইতে পারে না; চোখদু'টোতে জল টলটল করে। আসমার কথা মনে পড়ে। মেয়েটার সবকিছুই মায়ের মত হয়েছে।
আসমাও সুন্দরী ছিল। আফজাল চৌধুরী অফিস থেকে ফিরেই সোফায় গা-টা এলিয়ে দিত। আসমা জুতো-মোজা খুলে দিত। প্রতিদিনই নববধূর মত সেজেগোজে থাকত সে। সারাদিনের ক্লান্তির পর স্ত্রীর চেহারা দেখলে আফজালের গায়ে নয়াযৌবন জাগত। ঘর্মাক্ত চেহারাটা আসমার মুখে মেখে দিত। ছেলেমেয়ের অগোচরে শব্দহীন একটা চুম্বন করে স্ত্রীকে পাশে বসাত। তারপর টিভিটা অন করত। প্রায় প্রতিদিন বিছানায় যাওয়ার জন্য তাড়া দিত স্বামীকে। আসমা বেডরুমে ঢুকলে ম ম খুশবো বেরুত।
শরীফা অসুস্থ। স্বাভাবিক মেয়েলি অসুখ। পাঁচদিন ধরে অফিসে যাচ্ছে না। এই অসুস্থতায় অফিস থেকে ছুটি পাওয়া যায়- আফজাল চৌধুরী আগে শোনেনি। আগেও দু'-একবার এমন হয়েছে। বাপ জিজ্ঞেস করেনি। মেয়েটাই একমাত্র অবলম্বন। বিষয়টা জানার তাগাদা অনুভব করে সে।
'অফিসে যাচ্ছ না মা?'
'আমি অসুস্থ; ছুটি নিয়েছি বাবা।'
'চাকরির ক্ষতি হবে না তো?'
'না, এ-নিয়ে ভাবতে হবে না।'
'ডাক্তার দেখাতে হবে?'
'দেখিয়েছি।'
আফজাল চৌধুরী থেমে যায়। তার মেয়ে অন্য দশটা মেয়ের মত অলস-দায়িত্বহীন নয়। এই পরিবারের জন্য তাকে সুস্থ থাকতে হবে- বোধটা সবচে' বেশি লালন করে শরীফা।
বয়সের সঙ্গে হরেক চিন্তা এসে ভীড় করে আফজাল চৌধুরীর ভেতর। ছেলের অসুখ, মেয়ের অসুখ, নিজের অসুখ- কোনও না কোনওটা লেগেই আছে সংসারে। মেয়ে ঢের টাকা কামায়। কোন দিক দিয়ে এই টাকা আসে, কোন দিক দিয়ে যায়, টের পাওয়া যায় না। এর ভেতর যদি মেয়েটা অন্য ঘরে যায়, কী হবে! জর্জর হয়ে যায় আফজাল চৌধুরী। মেয়েকে নিয়ে নতুন চিন্তা আসে তার মাথায়।
'জাহেদকে আমাদের ঘরে রাখলে কি ভাল হয় না!'
'শুধু শুধু ও-সব ভাবতে যাচ্ছেন কেন? অসুখ বাড়বে বাবা।'
'শোন মা, কোনও বাবাই চায় না, মেয়ের সংসারজীবন আটকে থাক। তোমার বয়স হয়েছে। যে সেকেন্ডটা যাচ্ছে, সেটা তো আর ফিরবে না। তোমার ওপর নির্ভর করতে না হলে অন্য কোথাও বিয়ের কথা বলতাম। সংসারটাই তো চালাচ্ছ। ঘরের সদস্য আরেকজন বাড়বে- অসুবিধা কি! দেখ মা, সময়েই সব করা ভাল। অসময়ে অনেক হবার-কাজও হয় না। জাহেদ চতুর ছেলে। যোগ্য। তোমার জন্য সে তার জীবন থেকে ছয় বছর নষ্ট করবে কেন!'
শরীফা বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়ে- 'বাবা, কথাটা ছয় বছরের মধ্যে আর কখনও না বললে আমি খুশি হব'।
শরীফা চাকরিতে যায়। চাকরি থেকে ফেরে। শুক্রবার সবই বন্ধ থাকে। শরীফার চাকরি বন্ধ থাকে না। মাসে একটানা পাঁচ-ছয়দিন ছুটি কাটায়। চাকরি যায় না। শরীফার আয় অনেক। আয়ে বরকত নেই! সব আয়ই কেমন করে উবে যায়, তার চেহারায় কসমেটিকের প্রলেপের মত।
অফিসে যাওয়ার পথে বাসার সামনে শরীফার সঙ্গে কদাচ দেখা হয় জাহেদের। জাহেদ শরীফার দিকে তাকিয়ে হাসে। চেষ্টা করে, প্রেমের আন্দোলনকে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করতে। প্রত্যুত্তরে শরীফাও হাসে। কিন্তু, সেই হাসিতে নদির তরঙ্গ আচড়ে পড়ে না; থাকে গাঙের কলকলানি। জাহেদের মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে না শরীফা। মন খুলে হাসতে পারে না। প্রেমের আলিঙ্গনে জাহিদকে উত্তপ্ত করতে পারে না।
প্রথমটা জাহিদ একটু হাসিতে গলত। এখন গলে না। জাহিদের মনে আরও পাওয়ার বাসনা। সময়ান্তরে সেই বাসনা উদগ্র হয়। হওক না ছয় বছর পর বিয়ে, দু'জনে মধ্যে ভালবাসা লেনাদেনায় বাধা কোথায়! দু’জন তো এখন সময়ের নৌকায় চড়ছে, এখন থেকে নিজেদের স্বামী-স্ত্রী ভাবলে ক্ষতি কী!
জাহেদের মনটা বন্ধুদের কাছে ছোট। শরীফাকে বন্ধুরা অনেকবার দেখতে চেয়েছে। দেখাতে পারেনি। কীভাবে দেখাবে! শরীফা অফিসের ঠিকানা দেয় না।
জাহেদের অপেক্ষার, কঠিন অপেক্ষার, সময় কাটে- এক বছর, দুই বছর, তিন বছর।
অপেক্ষার তিক্ততা জাহেদের মধ্যে বাজে কিছু অভ্যাসের জন্ম দেয়। একটু একটু করে সে এখন মদে পুরাদস্তুর আসক্ত। রাতের নিঃসঙ্গতার কষ্টটা সে মদের তীব্র নেশায় চাপা দিতে চায়। বাসায় বন্ধুদের ডেকে এনে সারারাত টুয়েন্টি নাইন খেলে। দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়। পকেটে টাকা থাকলে হোটেলেও যায়। খামখেয়ালিপনায় চাকরিটা হারিয়েছে। বেকার। জমা-জিলাত যা ছিল, তা নিয়েই চলছে। প্রচুর সময় হাতে। সময়টাতে তার মন আড্ডা চায়; তাতেও মন ভরে না। মদ চায়। নারী চায়। এ-সব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। জাহেদ এখন ব্যস্ত-বেকার।
আফজাল চৌধুরী দেখছে, এই ছয় বছরে মেয়ের কিশোরিক দুরন্তপনা হারিয়ে গেছে। এখন তার উত্তুঙ্গ যৌবনের বয়স। কিন্তু, কথায়-চলনে-চিন্তায়-চাওয়ায় সেই যৌবনের ছিটেফোঁটাও নেই।
'মা, এবার তবে বিয়েতে রাজি হও।'
'হ্যাঁ বাবা।'
আফজাল চৌধুরীর কেন জানি মনে হল, অনেকদিন ধরে দরজায় অপেক্ষমান ভাগ্যদেবতা এবার ঘরে পা দেবে। সুখের আলোয় ঘরটা ঝলমলিয়ে ওঠবে। অর্থাভাবের দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার পেছনে একটা যুক্তি থাকে! টাকা আছে, তবু কারণে-অকারণে জানা-অজানা অনেক অশান্তিই ঘরে গিজগিজ করছিল। তার মনটা খুশিতে লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠছে।
আফজাল চৌধুরী জাহেদকে ডাকা পাঠিয়েছে।
এখন নয়, জাহেদ শরীফাদের বাসায় যাবে রাতে। বিকেলে বন্ধুর বাসায় দাওয়াত। মদ হবে; আড্ডা হবে; মেয়েও হবে। ভাড়াটে মেয়ে। যাবে, যাবে না- ইচ্ছার এই সাংঘাতিক বৈপরিত্যের সঙ্গে কুলিয়ে ওঠতে পারছে না সে। আজ তার বিয়ের কথা চলবে। মদ-নারীতে না যাওয়াই সমীচীন। কিন্তু, বন্ধুত্বের কসম! সেটাকে সে কীভাবে উপেক্ষা করবে! জাহেদ মনস্থির করেছে, বন্ধুদের আড্ডায় যাবে, জোরাজুরিতে দু’-এক কাপ মদ হয়তো নেবে। মেয়েকে সে স্পর্শ করবে না।
বন্ধুরা সবাই মদের উত্তাপে গরম হয়ে ওঠেছে। মেয়ে আসার সময় হয়েছে। সুন্দরী। ডাগর চোখ। ঠোঁটদু'টিতে যৌনতা টলমল করে। চামড়ার রঙ লালচে হলুদ, হালকা কুয়াশার ভেতর দিয়ে ছুটে আসা সূর্যের মত! দেখলে চোখ লেগে থাকবে। সবাই মিলে জাহেদকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করছে। বন্ধুদের কথায় জাহেদের চোখ লাল হচ্ছে। শরীরও গরম হয়ে ওঠছে।
কিন্তু অকস্মাৎ জাহেদের দেহটা ঝিম দিয়ে শীতল হয়ে যায়। দৃষ্টি ছেয়ে যায় এক চিলতে অন্ধকারে। সে দেখতে পাচ্ছে, শরীফা চৌকাঠে পা দিয়ে স্থিরচিত্রের মত তার দিকে তাকিয়ে আছে। জাহেদের ঠোঁটদু'টো কেঁপে ওঠে-
'শরীফা!'
'জাহেদ!'
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা ফেব্রুয়ারি, ২০১০ রাত ১২:৫৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




