somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চর্যাপদ আবিষ্কার এবং এর নামকরণ (চর্যাপদ নিয়ে জেনারেলাইজড আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব)

১৭ ই জুন, ২০১২ বিকাল ৩:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যারা আগের কিস্তিটি পড়েছেন, তাদের জন্যে কোন ভূমিকা ছাড়াই শুরু করছি, যারা আগের কিস্তিটি পড়েননি, আশা করি পড়ে নেবেন, নিচে লিঙ্ক দিয়ে দিচ্ছি...

চর্যাপদ কী, কেন এবং আমাদের ইতিহাসে এর গুরুত্ব (একটি জেনারেলাইজড আলোচনা)
এখন, চর্যাপদ আবিষ্কারের কাহিনি শোনার আগে আবিষ্কারের পটভূমি জানা দরকার।

যখন বাংলায় স্কুলগুলোতে বাংলা পড়ানো শুরু হলো, পড়ানোর জন্য তখন সম্বল কেবল বিদ্যাসাগর; তার রচিত বর্ণ পরিচয়, বোধোদয়, চরিতাবলী, কথামালা, এইসব। তখনো চর্যাপদ কিংবা অন্য কোন প্রাচীন বাংলা সাহিত্যই আবিষ্কৃত হয়নি। কেবল বিদ্যাসাগর, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের অনুবাদ গ্রন্থ, কিছু ইংরেজি হতে অনুবাদ- এগুলোই তখন বাংলা সাহিত্য। পরে রামগতি ন্যায়রত্ন প্রথম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের উপর একটি বই লিখলেন। জানা গেল, বাংলা সাহিত্যে আরো উপাদান আছে; কাশীরাম দাস, কৃত্তিবাস, কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম, এমনি অনেক প্রাচীন সাহিত্যিক বাংলায় লিখেছেন। সেগুলো প্রায় ৩শ বছরেরও বেশি পুরাতন। তবে সেগুলোরও বেশিরভাগই অনুবাদ; মূলত সংস্কৃতের অনুবাদ।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে কোলকাতার শিক্ষিত বাঙালি সমাজের এমন ধারণা ছিল উনিশ শতকের শেষার্ধ পর্যন্তও। কিন্তু সেই সময়টা বাঙালির বিকাশের যুগ। বাঙালি তখন ইংরেজি শিক্ষিত হয়েছে, নানা কৌতূহল, জীবন-জিজ্ঞাসা তাকে পেয়ে বসেছে। সে তার অতীত ইতিহাসের নানা কিছু অনুসন্ধান করতে শুরু করেছে। এই অনুসন্ধানের অংশ হিসেবেই শুরু হয় বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস ও সাহিত্য সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান।

বাংলার বৌদ্ধরা হিন্দুরাজার আবির্ভাবে বাংলা থেকে পালিয়ে মূলত নেপালে আর তিব্বতে গিয়েছিল। আর তাই বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস ও সাহিত্যের অনুসন্ধানও শুরু হল নেপাল থেকেই। এই উদ্দেশ্যে প্রথম নেপালে যান রাজা রাজেন্দ্র লাল মিত্র। তিনি নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত অনেকগুলি বৌদ্ধ ধর্ম ও সাহিত্যের পুঁথি খুঁজে পান। ১৮৮২ সালে তিনি Sanskrit Buddhist Literature in Nepal নামে তার আবিষ্কৃত পুঁথিগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করেন।

কিছুদিন পরেই রাজেন্দ্র লাল মিত্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তার ধারণা ছিল, ভারতেই জন্ম নেয়া ও বেড়ে ওঠা বৌদ্ধধর্ম কোন না কোনভাবে এখনো হিন্দু ধর্মের ভেতর থেকে গেছে। বিশেষ করে, তার ধারণা ছিল হিন্দুদের ধর্মঠাকুর এসেছে বৌদ্ধধর্ম থেকেই। (ধর্মঠাকুরের কোন মূর্তি নেই, বদলে তার মন্দিরে একখণ্ড পাথর থাকে)

এই উদ্দেশ্যে তিনি ১৮৯৭-৯৮ সালে দুইবার, আর ১৯০৭ সালে একবার নেপালে যান। সেখানে তার উদ্দেশ্য কতোটা সিদ্ধ হয়েছে জানি না, তবে শেষ নেপাল যাত্রায় বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল উপকার হয়ে যায়। তিনি নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থাগার বা লাইব্রেরি থেকে চারটি প্রাচীন পুঁথি আবিষ্কার করেন, যার একটি পুঁথিই হলো চর্যাপদ। (যতোদূর শুনেছি, বর্তমানে এই লাইব্রেরিটি নেপালের ন্যাশনাল লাইব্রেরি)

তিনি যেই চারটি পুঁথি আবিষ্কার করেছিলেন, সেগুলো হল-
চর্যাপদ
সরোজবজের দোহাকোষ
কৃষ্ণাচার্যের দোহাকোষ
ডাকার্ণব

চর্যাপদ আবিষ্কার সম্পর্কে তিনি বলেন- '১৯০৭ সালে আবার নেপালে গিয়া আমি কয়েকখানি পুঁথি দেখিতে পাইলাম। একখানির নাম চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়, উহাতে কতকগুলি কীর্ত্তনের গান আছে ও তাহার সংস্কৃত টীকা আছে। গানগুলি বৈষ্ণবদের কীর্ত্তনের মত, গানের নাম চর্যাপদ।'

১৯১৬ সালে তিনি এই চারটি পুঁথি বই আকারে প্রকাশ করেন, 'হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা' নামে, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ থেকে।

বইটি প্রকাশের পর এর ভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় (এই বিতর্ক নিয়ে গত পর্বে আলোচনা করা হয়েছে)। পাশাপাশি আরেকটা বিতর্ক শুরু হয়, বইটির নাম নিয়ে। বিভিন্ন পণ্ডিত বইটির বিভিন্ন নাম বলেছেন। চর্যাপদের যে সব নাম প্রস্তাবিত হয়েছিল, সেগুলো হল-
চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়
আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়
চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়
চর্য্যাগীতিকোষ

এখন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুঁথিটির নাম ছিল সম্ভবত চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়; কিন্তু সেটি মূল গ্রন্থ ছিল না। সম্ভবত, শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুঁথিটির লিপিকর মূল গ্রন্থ থেকে পদগুলো, আর টীকাকৃত গ্রন্থ থেকে টীকা নকল করেছিলেন; মূল গ্রন্থটির নাম এখানে রক্ষিত হয়নি।

অনেকে বলেছেন, চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয় না, নামটি ছিল চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়; কিন্তু লিপিকরের প্রমাদে তা হয়ে গেছে চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়। কিন্তু চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয় নামের পক্ষে কেউ কোন যুক্তি দেখাতে পারেননি।

আশ্চর্য্যচর্য্যাচয় শব্দটি পুঁথিতে পাওয়া গেলেও গ্রহণযোগ্য নয়। চর্যাচয় মানে চর্যাসমূহ; এর আগে আশ্চর্য বিশেষণ হিসেবে যোগ হয়ে আশ্চর্য্যচর্য্যাচয় শব্দটি গঠিত হয়েছে। একে নাম হিসেবে গ্রহণ করা যুক্তিযুক্ত নয়। সেক্ষেত্রে পুঁথিটির আরো অনেক শব্দকেই নাম হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

অন্যদিকে, চর্যাপদের যেই তিব্বতি অনুবাদ পাওয়া গেছে, এবং তিব্বতি ভাষার অন্যান্য যে সব গ্রন্থে এই বইটির উল্লেখ পাওয়া গেছে, সেখানে গ্রন্থটির নাম পাওয়া গেছে 'চর্যাগীতিকোষ'। সুতরাং, এই নামটিই অপেক্ষাকৃত বেশি গ্রহণযোগ্য। পণ্ডিতরাও বইটির এই নামটিই মেনে নিয়েছেন। তবে বাঙালিদের কাছে বইটি 'চর্যাপদ' নামেই জনপ্রিয়, চর্যাপদ নামেই বইটি বাঙালির হৃদয়ে স্থান পেয়েছে। যে কারণেই প্রচলিত হয়ে থাক, এখন মনে হয় বইটির জন্য এই নামটিও কম যথার্থ নয়।

[গত পর্বে রেফারেন্স বইয়ের নাম দেয়ার সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের নাম দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেই বইটির নাম এই পর্বের রেফারেন্স বইয়ের লিস্টে ১ নম্বরে থাকলো। সাথে থাকলো আরো কিছু রেফারেন্স বইয়ের নাম, যারা আরো বিস্তারিত পড়তে চান, তাদের জন্য।]

১. চর্যাগীতিকা; মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনোয়ার পাশা সম্পাদিত
২. চর্যাগীতি-পদাবলী; সুকুমার সেন
৩. বাঙ্গালায় বৌদ্ধধর্ম; নলিনীনাথ দাশগুপ্ত
৪. চর্যাগীতি পরিচয়; সত্যব্রত দে
৫. Buddhist Mystic Songs; ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ

[কেউ আবার ভেবে বসেন না, সব রেফারেন্স বই-ই আমি পড়েছি; অনেকগুলিই পড়েছি, পাশাপাশি যে বইগুলো রেফার করা যেতে পারে, সেগুলোও রেফার করে দিলাম]
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুন, ২০১২ রাত ৩:২৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেসবুক বিপ্লবে সেভেন সিস্টার্স দখল—গুগল ম্যাপ আপডেট বাকি

লিখেছেন মহিউদ্দিন হায়দার, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩০




কিছু তথাকথিত “বাংলাদেশি বিপ্লবী” নাকি ঘোষণা দিয়েছে—ভারতের সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে! সহযোগী হিসেবে থাকবে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী আর পাকিস্তানি স্বপ্ন।শুনে মনে হয়—ট্যাংক আসবে ইনবক্সে। ড্রোন নামবে লাইভ কমেন্টে। আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গু এনালিস্ট কাম ইন্টারন্যাশনাল সাংবাদিক জুলকার নায়েরের মাস্টারক্লাস অবজারবেশন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:২৬

বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের দম আছে বলতে হয়! নির্বাচন ঠেকানোর প্রকল্পের গতি কিছুটা পিছিয়ে পড়তেই নতুন টার্গেট শনাক্ত করতে দেরি করেনি তারা। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ঘিরে নতুন কর্মসূচি সাজাতে শুরু করেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিবাদ: দিল্লির ছায়া থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ ভোর ৫:৫৭

একটা সত্য আজ স্পষ্ট করে বলা দরকার—
শেখ হাসিনার আর কোনো ক্ষমতা নেই।
বাংলাদেশের মাটিতে সে রাজনৈতিকভাবে পরাজিত।

কিন্তু বিপদ এখানেই শেষ হয়নি।

ক্ষমতা হারিয়ে শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

Grameen Phone স্পষ্ট ভাবেই ভারত প্রেমী হয়ে উঠেছে

লিখেছেন অপলক , ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:৪৯



গত কয়েক মাসে GP বহু বাংলাদেশী অভিজ্ঞ কর্মীদের ছাটায় করেছে। GP র মেইন ব্রাঞ্চে প্রায় ১১৮০জন কর্মচারী আছেন যার ভেতরে ৭১৯ জন ভারতীয়। বলা যায়, GP এখন পুরোদস্তুর ভারতীয়।

কারনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×