হাসলাম। আবারো সেই কষ্টের মধ্যে কলিজা খিঁচড়ে দেয়া হাসি হাসতে বাধ্য হলাম। কারন বলছি,
বিডি নিউজ ২৪ এ ভারতীয় চলচিত্র প্রদর্শনের পক্ষে বলতে যেয়ে মাননীয় বানিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, "ভারতীয় চলচ্চিত্রের উপর এই নিষেধাজ্ঞা আমরা প্রত্যাহার করেছি আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পকে আরো বেশি বেগবান করার লক্ষ্যেই।" আমাকে কি কেউ বোঝাবেন ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শন করলে আমাদের চলচ্চিত্র কিভাবে বেগবান হবে? এখানে তো কোন বিনিময় চুক্তি হয়নি। হয়নি এমন চুক্তি যে আমরা ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শন করলে ভারতীয়রা বাংলা চলচ্চিত্র প্রদর্শন করবে। বা এমন চুক্তিও হয়নি যে, আমরা যদি ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সুযোগ করে দেই তাহলে ভারত আমাদের চলচ্চিত্র ইন্সটিটিউট বা প্রযুক্তিগত কোন সাহায্য করবে। তাহলে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প কিভাবে বেগবান হচ্ছে?
এরপরই নিউজটাতে আরেকটা বলদ এর দেখা পাইলাম। এই চিড়িয়ার কথা শুনেন, "নতুন এই ঘোষণার ফলে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর চলচ্চিত্র স্থানীয় হলগুলোতে প্রদর্শন করা যাবে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই ছবিগুলোতে ইংরেজী সাবটাইটেল থাকতে হবে।" কথাটা বলেছেন আমাদের ফিল্ম সেন্সর বোর্ডের প্রধান সুরত কুমার সরকার।
হায়রে বলদ! আরো কবে যে তোর শিক্ষা হবে!! বছরের পর বছর ভারতীয় চ্যানেল দেখাচ্ছি আমরা। তাতে কি লাভ দিয়েছে আমাদের ভারত সরকার? আমাদের চ্যানেল কি ভারতে প্রদর্শিত হতে পারে? আর তিনি আশা করছেন ভারতীয় সরকার বাংলা ছবি প্রদর্শনের সুযোগ করে দেবেন? আর অন্য কোন দেশ দিলেও তারা বাংলাদেশী সিনেমা দেখবেন কোন দুঃখে? আপনি বাংলা ছবি দেখেন? আপনিই আপনার দেশের ছবি দেখেন না তার নিম্নমানের জন্য, তারা দেখবে কোন দুঃখে? নাকি আমাদের ময়ূরী, পপি সমৃদ্ধ বাংলা সিনেমা ক্যাটরিনা, ঐশ্বরিয়ার ছবির চাইতে কোন দিক দিয়ে উন্নত হয়? আজিব!!
ফাও প্যাচাল অনেক হল। কাজের কথায় আসি। আসলে আমাদের সমস্যাটা কোথায়? আসুন আগে হল মালিকদের কথা শুনি। মধুমিতা সিনেমা লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ এর কথাই আগে বলি। উনি বলেছেন, "রাজধানীর প্রেক্ষাগৃহগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শুনলাম আনন্দ, ছন্দ প্রেক্ষাগৃহও বিক্রি হয়ে গেছে। শ্যামলী বন্ধ। মধুমিতা ভেঙে এখানে বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য বলা হচ্ছে বারবার। কিন্তু আমরা একটা ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাই। কিন্তু কী করে করব? গত বছর মোট ৪৫টি বাণিজ্যিক ছবি মুক্তি পেয়েছে। এর মধ্যে আমি পেয়েছি ২২টি আর অভিসার পেয়েছে ২৩টি চলচ্চিত্র। ৫২ সপ্তাহে আমি ২২টি ছবি দিয়ে প্রেক্ষাগৃহ চালাতে পারব?"
কথা ঠিক। ৫২ সপ্তাহে ২২টি ছবি দিয়ে প্রেক্ষাগৃহ চালানো সম্ভব না। কারন একটি পেক্ষাগৃহ যে পরিমান জায়গা দখল করে আর তার যে ব্যায় তা এই পরিমানে সিনেমা প্রদর্শন করে চালানো সম্ভব না। বিশেষত মার্কেটিং এর এই যুগে এইভাবে জায়গা অযথা ফেলে রাখার যৌক্তিকতাও নেই। অলরেডি ঢাকার ঐতিহ্যের অংশ আনন্দ,ছন্দা, শ্যামলী বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে থাবা পড়েছে কর্পোরেটপ্রতিষ্ঠানগুলোর।
এটা কি খুব বেশী অযৌক্তিক? মালিক তো লাভই আগে দেখবেন। আর এটাই স্বাভাবিক। আমি আপনিও তাই করতাম। আজ আমি আপনি "সব শেষ", "সব গেল" বলে যতই রোল তুলি, জায়গাটা আপনার হলে কি আপনি শুধু ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে কোটি টাকা লাভকে দূরে সরিয়ে কোটি কোটি টাকার লোকসান, মুখ বুজে মেনে নিতেন বছর এর পর বছর? সুতরাং সিনেমাহল মালিকদের কথা ফেলে দেয়া যাবে না কোনভাবেই। তাদেরকে একটা পথ তো খুজে পেতে হবে। খুঁজে দিতে হবে।
কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। যে কোন সমস্যা সমাধান এর পথ নিশ্চয়ই ঠাস করে কিছু করে ফেলা নয়। অনেকদিক ভেবে অনেক কাজ করতে হয়। সমাধান দেয়া হল এটা করে যে, আমাদের দেশের হলমালিকরা ভারতীয় সিনেমা প্রদর্শন করতে পারবেন।
এভাবেই সমাধান শেষ? আমাদের বোধশক্তি এতটা কমে গেল কিভাবে? নির্দিষ্ট কোন নীতিমালা নাই, কিছু নাই। এটা কেমন ডিসিশন?
এমনিতেই ভারতীয় সাংস্কৃতির একটা জোয়ার আমাদের দেশের মধ্যে প্রচন্ডভাবে বিরাজমান। তার প্রভাব এতটাই প্রকট যে হিন্দি চ্যানেল এর সামনে সব সময় পড়ে থাকি আমরা। তাদের ছোট ছোট নাটক বা রিয়েলিটি শো গুলোর কাছে পরিস্কারভাবে পরাজিত আমাদের দেশীয় চ্যানেলগুলো। তার প্রমান আমাদের বাসায় সন্ধ্যা হলেই আমরা পপ্রতিদিন ই পাই।
তাই বলে আমি ভিন্ন সাংস্কৃতি এর বিরুদ্ধে না। দেখা যেতেই পারে। ইভেন ভিন্ন সাংস্কৃতির ভালো দিক আমাদের সাংস্কৃতিতে ঢুকতেও পারে। কৃষ্টি-কালচার এর কোন সীমারেখা নাই। কিন্তু তাই বলে নিজেদের কালচারকে বিকিয়ে দিয়ে?
এই যে পহেলা বৈশাখ। আমরা পান্তা-ইলিশ খেয়ে, শাড়ি পড়ে, শঙ্খ বাজিয়ে মাত্র ১০দিন আগে আমাদের সাংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ততা দেখালাম, তা আজ কৈ? আজ আপনি কি খাচ্ছেন? কি পড়ছেন? কি দেখছেন? আমরাই কি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মৃত্যু ডেকে আনছি না?
ভারত কেন আমাদের চ্যানেল প্রদর্শন করে না? কারন আমাদের অনুষ্ঠানের মান তাদের চাইতে ভালো? আমাদের দেশের অনুষ্ঠান দেখালে তারা ছোট হয়ে যাবে? কখনোই তা না। তাদের মানও আমাদের চাইতে কোন অংশে খারাপ না। তারপরও তারা দেয় না কারন সামান্য হলেও তো তাদের বাংলা চ্যানেল এর দর্শক কমে যাবে আমাদের চ্যানেল এর জন্য। সুতরাং তারা আমাদের চ্যানেল প্রদর্শন করতে দিচ্ছে না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে আপনি কি একে ভুল বলতে পারবেন? কখনোই না। আগে দেশ। সবার উপরে নিজের ঐতিহ্য। যে কোন আত্নসম্মানবোধ জাতির ক্ষেত্রেই এটা ঠিক।
আর আমরা? মাথাব্যাথার ওষুধ পেলাম মাথাটাকেই কেটে ফেলার। আজ কেন পেক্ষাগৃহে দর্শক নেই? কারন ভালো সিনেমা কম হয়।
কেন ভালো সিনেমা কম হয়? কারন টা কি টাকা? কখনোই না। তার উপর এখন তো অর্থনৈতিক অবস্থার সাংস্কৃতি ৮০ এর দশক এর চাইতে বেটার। কিন্তু তখন অত দর্শক ছিল এখন নাই কেন? কারন কি শুধুই ভালো সিনেমার অভাব?
আমরা পাইরেটেড সিডির এই বিশাল বাজার, যেখানে চাইলেই দেশী-বিদেশী যে কোন মুভি পাওয়া সম্ভব, যেখানে কম্পিউটার এখন দেশের ঘরে ঘরে, সেখানে আমরা কিভাবে দর্শককে সিনেমাহলে টেনে আনবো?
অনেকে বলেন এখন তো মান সম্পন্ন সিনেমা তৈরী হয় না। এটা আমি কখনোই মানি না। এখনো মানসম্পন্ন সিনেমা তৈরী হয়। কিন্তু বাসায় বসে বসে বিভিন্ন দেশী-বিদেশী চ্যানেল সার্ফ আর কম্পিউটার-ডিভিডি এর পিছনে আমরা আমাদের জন্য নির্ধারিত দৈনন্দিন বিনোদনের সময় টা দিয়ে দেই। ফলে আমরা অনেক সময় জানিই না ভালো সিনেমা হল কিনা। চ্যানেল আই জাতীয় কিছু টিভি মিডিয়ার কল্যানে তাদের নির্মিত কিছু মুভির আকর্ষনীয় ট্রেলার আমরা দেখতে পাই বলে আমরা ভাবি "থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার" বছরে একটাই হয়। এমন একাধিক ভালো সিনেমা বা এর চাইতে ভালো সিনেমা প্রচারনার অভাবে যে আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায় তা আমি হলপ করে বলতে পারি।
প্রমান চান? "দি সার্চ" মুভি। প্রথম আলোতে রিপোর্টার তাদের বিনোদন সংখ্যাতে ঘোষনা দিলেন যে, আসছে একটা মুভি। এটা হেন এটা তেন। যারা আমার মত দুর্ভাগা(মানে যারা মুভিটি দেখেছেন) তারাই জানেন এটা কতটা নিম্নমানের একটা মুভি। তাও নাকি এই মুভি হিট। কেনো? কারন মিডিয়ার প্রচার। মানুষের মনে সংগত কারনেই একটা আগ্রহ তৈরী হয়েছে।
এই আমরাই একটা ভালো মুভি যথাযথভাবে মিডিয়ার মাধ্যমে আমাদের সামনে এলে আমরা কি দেখবো না? আমরা যে, এত্তো এত্তো হিন্দি মুভির নাম জানি, দেখি, ক্যামনে? স্বপ্নে আইসা পরিচালক জানান দিয়ে যায়? জ্বি না। এখানেও কারন ওই স্টার প্লাস, সনি টিভি বা প্রচারনা।
সুতরাং সিনেমা হলে দর্শক টানতে হলে মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে এই সব আজাইড়া ডিসিশন দিয়ে কোন লাভ নাই। সত্যিকারের সমাধান করতে হলে সত্যিকারের সমস্যা আগে চিহ্নিত করতে হবে। সেই অনুযায়ী এগুনো যেতে পারে।
মাননীয় সাংস্কৃতি মন্ত্রী, আপনি ভালো সিনেমা বানানোর জন্য কর্মী বানান।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, আপনি ভালো অভিনয়কুশলী বানানোর জন্য ইন্সটিটিউশন বানান।
মাননীয় অর্থমন্ত্রী, আপনি ভালো সিনমা যন্ত্রাংশের উপর হতে শুল্ক কমান।
মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আপনি আপনার আইনশৃঙ্খলাবাহিনী ব্যবহার করে পাইরেটেড সিডির বিরুদ্ধে এফেকটিভ অভিযান চালান।
তারপর এর এর এসোসিয়েট হিসেবে বানিজ্যমন্ত্রী আপনি আরো কম্পিটিশন করার জন্য একটা নির্দিষ্ট নীতিমালার মধ্যে ভিন্ন দেশীয় সিনেমা প্রদর্শনের সুযোগ দিলেও দিতে পারেন।
বাট আগে নিজের দেশের সমস্যাগুলোর দিকে তো আলোকপাত করতে হবে, নাকি?
আর আমরা কি করলাম? মাথা ব্যাথার কারন জেনে বুঝে, তার জন্য প্রয়োজনীয় কার্যকর পদক্ষেপগুলোকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, মাথাই কেটে ফেললাম।
ভালোই। আত্নহত্যা করতে চাইলে হয়তো মানুষ এভাবেই আত্মহত্যা করে। হয়তো আমরা আমাদের সাংস্কৃতির আত্মহত্যাই চাইছি।
এটা একটা অরন্যে রোদন না। আমার মত আরো অনেকেই এই ব্যাপারে সেম বিষয়বস্তুতে আরো পোস্ট দিয়েছেন। তাও হয়তো এগুলো বন্ধ করা যাবে না। তবে মানুষ ঠিকই সচেতন হবে। হচ্ছে। আর আমরা সাধারন জনগন জানি জবাব কখন দিতে হয়। কিভাবে দিতে হয়। সুতরাং হতাশ হয়ে পড়া কিছু নাই। যেটা সত্য সেটা সব সময়ই সত্য। যেটা ন্যায় সেটা সব সময়ই ন্যায়।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০১০ দুপুর ২:৫১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।





