somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ শুক্র শনির পানি উপাখ্যান

১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তারিখটা ছিল ৩১ মে।২০১২ সাল।ঢাকায় এলাম।তবে ফেরার উদ্দেশ্যে নয়। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ।ভর্তি কোচিং এর উদ্দেশ্যেই ধোঁয়া-কাদা-যানজটের এই ‘প্রাচ্যের রহস্যনগরী’-তে আমার আগমন। ঠাঁই হল জিগাতলার এক মেসে। হাজারীবাগের একদম কাছাকাছি।মানে আর মিটার পাঁচশ এগোলেই ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’-র ম্যাকলিওড স্ট্রিটতুল্য (ট্যানারি-বহুল) এলাকা।‘রোগা-পটকা’ হলেও ঐ জাতীয় কোন স্থানে যাবার খায়েশ ছিল না।
কলেজ-বন্ধু ও মেস-রুমমেট পিয়াস আমার ২ দিন আগেই এসেছে মেসে। সে আমাকে ‘আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য’ গুলি জানাল এবং পানির বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করল। আগে ঢাকা মহানগরীর ‘জলাভাব’ সম্বন্ধে বিস্তর পড়া ও শোনা থাকলেও কখনো তা অনুভব হয় নি। বইয়ে ও খবরের কাগজে উত্তরবঙ্গে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া,দক্ষিণবঙ্গে পানিতে লবণাক্ততা দেখা দেওয়া ইত্যাদি সম্পর্কে জেনেছি সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময়। পুরো বিষয়টি ঠিক না বুঝলেও এতটুকু বুঝতাম ব্যাপারটা মোটেই পানির মত সরল নয়। আর মা বোঝাতেন,“আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা এগুলো থেকে নিরাপদ আছি”। কুষ্টিয়ার গ্রামাঞ্চলে কাটানো শৈশবে কিংবা ক্যাডেট কলেজে কাটানো মাধ্যমিক জীবনে একটিবারের জন্যও পানীয় বা ব্যবহার্য জলের অভাব অনুভব করি নি। বরং শীতে ‘কুসুম গরম’ এবং গ্রীষ্মে ‘লবণ পানি’র সুব্যবস্থা ছিল।
মেসে অবস্থানের সময়কাল ২৪ ঘণ্টা পার হবার আগেই পিয়াসের কথার তাৎপর্য অনুভূত হল। জীবনে প্রথম মনে হল পানি আসলেই দামি জিনিস।তবে দামটা যে ঠিক কত তা বুঝতে আরো ক’দিন লেগে যায়।
মেসের পরিচালক মোহাম্মদ ভাই সদাশয় ব্যক্তি। আমাদের নিয়মিত খোঁজখবর রাখতেন। পড়াশোনার যাতে বিঘ্ন না ঘটে সেদিকে ছিল তার সজাগ দৃষ্টি। আমদের খাবার পানির জন্য পানি ফুটিয়ে নিতে হত। পরিচারক মীযান ভাইয়ের প্রতি নির্দেশনা ছিল সবসময় যাতে কলস ভর্তি পানি ফুটিয়ে ড্রাম পরিপূর্ণ রাখা হয়। অনেক সময় আমরাও কলস ভরে চুলায় দিয়ে আসতাম। আমরা ড্রামের পানি ঠাণ্ডা হলে বোতলে ভরে রুমে নিয়ে আসতাম। প্রত্যেকেই চেষ্টা করত রুমের সবচেয়ে বড় পাত্রটা ভরে আগামী একদিনের জন্য নিশ্চিন্ত হতে। পাত্র খালি হওয়ার সাথে সাথেই তা দ্বিতীয়বার ভরে রাখতে একদণ্ড দেরি হত না কারো। আমার মত দু-একজন গোবেচারার কথা আলাদা।পানীয় জলের ব্যবস্থা এভাবেই হচ্ছিল। আর ব্যবহার্য পানির জন্য আমাদের সব-সময় নির্ভর করতে হত ওয়াসার সরবরাহের ওপর।
চাহিদা-যোগানের কার্যকারণ সম্বন্ধ যে ধ্রুবসত্যি সেটা বোঝার জন্য অর্থনীতির ছাত্র হওয়া আবশ্যক নয়। আমরা মেসে থাকতাম পনের জন। বাথরুম ছিল দুটো। বলাই বাহুল্য,খাবার পানির মত এখানেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিরাজ করত। এক্ষেত্রে পানির সরবরাহের সাথে বাথরুমের সংখ্যার বিষয়টিও গুরুত্ব রাখতো।
জ্যৈষ্ঠের কোন এক শুক্রবারে ভাবলাম আজ সুন্দরমত গোসল করে পাঞ্জাবি-পাজামা পরে আতর মেখে সকাল সকাল জুমার নামাযে যাব। তবে দীর্ঘদিনের অভ্যাস আর আলস্যের কারণে গোসলের আয়োজন করতে করতে ১২টা বেজে গেল। বাথরুমে তখন ‘সিরিয়াল’ নেই।কারণ, সবাই জানে যে কিছুক্ষণ পরই পানির ধারা ক্ষীণ হয়ে আসবেতাই আগেই তারা প্রয়োজন সেরেছে। আমি অবশ্য এই ক্ষীণধারায়ই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। গোসলখানায় ঢুকলাম। গোসল শুরুর কয়েক মিনিট পর লক্ষ্য করলাম পানির গতি আস্তে আস্তে আরো কমে আসছে।অন্যান্য শুক্রবার তো এমন হয় না! একটু খটকাই লাগল। মিনিট খানেকের মধ্যে পানি একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। অভিজ্ঞজনেরা জানালেন যা পানি আবার আসতে কমসে কম ঘণ্টা দুই তো লাগবেই।আমি তখন সাবান -শ্যাম্পুতে একাকার।তাহলে এখন উপায়?কিছুক্ষণ আপন মনে ঢাকা ওয়াসার উদ্দেশ্যে বাক্যবাণ নিক্ষেপ করলাম। শূন্যে গুলি ফোটালে খুব বেশি কিছু হয় না। আমি বাথরুমে বসেই রইলাম। বাকিদের পক্ষে সহানুভূতি জানানো ছাড়া আর কিই বা করার ছিল।সুন্দর করে জুমার নামাযের আশা বাদ দিয়ে আমি তখন জুমার নামায ছুটে যাওয়ার শঙ্কায় পড়ে গেলাম। কাছে ধারে কোন জলাশয় নেই। নিকটবর্তী নদীটির নাম বুড়িগঙ্গা। আর এই ‘ইটের পর ইট-মধ্যে মানুষ কীট’এর মত অ্যাপার্টমেন্ট ভিত্তিক জীবনে গ্রাম-মফস্বলের মত কারো বাড়িতে ঢুকে এক বালতি পানি চাওয়ার সুযোগও নেই তখন। এমন সময় অনেকটা ভোজবাজির মত পাশের রুমের ছোটভাই শাওন এক বালতি পানি হাতে হাজির। কি জানি, হয়তো আধা কি.মি. দূরের কোন ট্যানারি থেকেই আনবে হয়তো। বাহ! ছেলেটা বেশ ভাল দেখছি। আমি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম।জলদি কোন মত গোসল সেরে কাপড়টা আধোয়া রেখেই ছুটলাম মসজিদে। জুমার নামাযের দ্বিতীয় খুৎবা শেষে মুসল্লিরা ততক্ষণে দাঁড়িয়ে গেছেন।
কথায় বলে এক মাঘে শীত যায় না। আমি আবার এমনি এক অভাগা যে যেদিকে চায়,সাগর শুকায়ে যায়।পরদিন শনিবার বেলা দুটোয় কোচিং-এ পৌঁছুতে হবে। যানজটের একঘণ্টা সহ মোট লাগবে দেড় ঘণ্টা। তাই খাওয়া শেষ করতে হবে সাড়ে বারটার আগেই।এগারটার দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে দেখি ১২.০৫ বাজে। কোন মত হাত মুখ ধুয়ে তড়িঘড়ি করে খেতে বসে গেলাম। যা হবার তাই হল। গলায় খাবার গেল আটকে। কিন্তু পানি কৈ? বোতল যে একদম খালি! কি করব এখন? পিয়াস মামাবাড়ি গেছে। মেসের বাকি সাবাইও বাইরে। জামাল ভাই খাবার দিয়ে চলে গেছে। মানে মেসে আমি তখন একাই। বিপদে মানুষের বুদ্ধি লোপ পায়। আমি এক দৌড়ে দোকানে গেলেই সমস্যার সমাধান হত। কিন্তু আমার মাথায় আর সেকথা এলো না। আমি উঠলাম তিন তলায়।সেখানে সপরিবারে বাড়িওয়ালা বসবাস করতেন।আমাদের তাই ওখানে ওঠা বারণ ছিল। তাতে কি? ‘নেসেসিটি নো’স নো ল’। দরজায় করাঘাত করলাম। ভেতর থেকে এক প্রৌঢ়ার কণ্ঠে প্রশ্ন “কে?” আমার গলা দিয়ে যে আর স্বর বেরুচ্ছে না। অস্ফুট আওয়াজে উত্তর দেবার বৃথা চেষ্টায় লাভ হল না। তবে, দরজা খোলা হল। সম্ভবত আর কেউ ছিল না বাসায়।বাড়িওয়ালী আন্টি ভ্রূ কুঞ্চিত করে কর্কশ গলায় বললেন,“কে তুমি? কি চাই?” আমি অস্পষ্ট স্বর আর ইশারা ইঙ্গিতের সাহায্যে তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম। তিনি অন্দরে গেলেন। একটি জগ ও গ্লাস হাতে ফিরলেন। আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন শীতল পানিতে পরিপূর্ণ একটি গ্লাস। আমি ভদ্রতা-শিষ্টাচারকে বুড়ো-আঙুল দেখিয়ে ঢক ঢক করে পানিটুকু শেষ করলাম। গলা থেকে যেনে একতা পাহাড় নেমে গেল। আন্টির অভিব্যক্তি দেখে আর দ্বিতীয় গ্লাস চাওয়ার সাহস করলাম না। অবশ্য মনে ছিল যে, খাবারের বাকি অংশ রুমে রেখে এসেছি । ওটা শেষ করার আগেই আবারো একই ঘটনা ঘটতে পারে। পুরো ঘটনাটির ব্যাপ্তি অবশ্য খুবই অল্প সময় নিয়ে। ধন্যবাদের অপেক্ষা না করে আন্টি খুব দ্রুত কপাট দিলেন। আর দরজা খোলা থেকে বন্ধ করা পর্যন্ত তাঁর মুখে যা ফুটে উঠেছিল তাকে শুধু রাগ বা বিরক্তি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করলে কমই বলা হবে।তবে তাঁর সাথে আর কখনোই বাৎচিত হয় নি বিধায় ঐ অনুভূতির মাত্রা যে কতখানি ছিল তা পরিমাপের সুযোগ হয় নি।
তবে আমার জন্য আরো এক চমক অপেক্ষা করছিল। রুমে এসে দেখি অনিচ্ছায় পালিত মেসের বিড়াল মহাশয় খাবার সাবাড় করে আমার থালাটি পরিষ্কারে ব্যস্ত আছেন।আমার আগমনে তিনি দ্রুত প্রস্থান করলেন।অগত্যা অর্ধাহারে রওনা হলাম কোচিংএর দিকে।
পানির ব্যাপারে আরেকটি অভিজ্ঞতার সুযোগ ছিল ২০১৪তে যেদিন জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় দেখা দেয়।তবে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থাকায় সে সৌভাগ্য(!?) আর হয় নি।
যাই হোক,ঐ শুক্র-শনিবারের পর থেকে ‘পানির দাম’ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করিনি।অন্য কাউকে বলতে শুনলেও বিকল্প বাগধারা ব্যবহারের অনুরোধ করেছি।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩১
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কবিতাঃ হে বলবান

লিখেছেন ইসিয়াক, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৪০

কে আছিস বলবান!
হ্ আগুয়ান।
দে সাড়া দে ত্বরা।
ধরতে হবে হাল,বাইতে হবে তরী, অবস্থা বেসামাল।

জ্বলছে দেখ প্রাণের স্বদেশ
বিপর্যস্ত আমার প্রিয় বাংলাদেশ।
মানবিকতা, মূল্যবোধ, কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতির বাতিঘর।
সর্বত্র আজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

জুলাইয়ের তথাকথিত আন্দোলন পুরোটা ছিল মেটিকিউলাস ডিজাইন

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:১৬

জুলাইয়ের তথাকথিত আন্দোলনের পুরোটা ছিল মেটিকিউলাস ডিজাইন

লালবদর নীলা ইস্রাফিল এখন বলছেন ও স্বীকার করছেন যে—
জুলাইয়ের সবকিছুই ছিল মেটিকিউলাস ডিজাইন।
মুগ্ধের হত্যাও সেই ডিজাইনের অংশ।

অভিনন্দন।
এই বোধোদয় পেতে দেড় বছর লাগলো?

আমরা তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

তারেক ৩০০০ কোটী টাকার লোভেই দেশে ফিরেছে

লিখেছেন জেন একাত্তর, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১০



তারেক এসেছে, বলেছে, I have a plan; তারেকের প্ল্যানটা কি? এই মহুর্তে তার প্ল্যান হতে পারে, নমিনেশন বাণিজ্য করে কমপক্ষে ৩০০০ কোটি টাকা আয়। ৩০০ সীটে গড়ে ১০... ...বাকিটুকু পড়ুন

বই : টক অব দ্য টাউন

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:০৮

বই : টক অব দ্য টাউন



একটি বই হঠাৎ করে এতটা আলোচনায় আসবে আমরা কি ভাবতে পেরেছি ?
বাংলাদেশের মানুষ অতি আবেগপ্রবন , বর্তমান রাজনৈতিক অস্হিরতার মধ্যে ও
বাঙালীর স্বভাবসুলভ অনুসন্ধানী... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকার মানুষের জীবন

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪


ঢাকাতে মানুষ বড় বিচিত্র ভাবে বেঁচে থাকে। নিয়মিত ঢাকার রাস্তার ঘুরে বেড়ানোর কারণে এই রকম অনেক কিছু আমার চোখে পড়ে। সেগুলো দেখে মনে হয় মানুষ কত ভাবেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×