হামিম, সুমি ছয় বছরের শিশু! মায়ের সামনে বাস নামক দানবের বিশাল হা'এর ভিতর ঢুকে গেল। নারীছেড়া ধন যখন চোখের সামনে লাশ হয়ে যায় তখন কী হয় মায়ের অবস্থা! কেউ কি জানে, কেউ কি বলতে পারে, কোনভাবেই কি ব্যাখ্যা করা যায় সেই মর্মান্তিক যন্ত্রণা! সম্ভব না, কখনই সম্ভব না তা ভাষায় প্রকাশ করা। ভাষার নেই সে শক্তি!
প্রতিদিনই অনাকাঙ্খিত অসংখ্য মৃত্যু আমাদের শুধু ভীত করে, আপনজনদের জন্য দুশ্চিন্তাগ্রস্থ করে, কাঁদায়, অসহায় করে। আমরা প্রতিদিন একটু একটু করে আরও বেশি অস্থির হই, অসুস্থ হই, আমাদের আবেগ নষ্ট হয় আমরা আত্মকেন্দ্রিক, মৃতবত জীবনযাপন করি।
প্রতিদিন এরকম মৃত্যঝুঁকির মধ্যে দিয়ে পথ চলছে অসংখ্য মানুষ। কিন্তু কোন চেষ্টা নেই সমস্যা সমাধানের। প্রতিটি দুর্ঘটনার পর আমরা আহাজারি করি কিন্তু তা বন্ধের জন্য কোন কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়না। যানজট সম্ভবত এই শহরের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। কি করে তা কমানো যেতে পারে, কি করে মানুষকে খানিকটা স্বস্তি দেয়া যায় এ নিয়ে ১০১টি পদ্বতি আলোচিত নিশ্চয়ই হয়েছে কিন্তু ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ২০০৫ সালে বাস চাপায় মারা গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হ্যাপি। এরপর নিহত হয়েছে মোবারক, রিয়াদসহ আরও অনেক শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ফুটওভারব্রিজ তৈরীও হয়। কিন্তু তা এতটাই দূরে যে কাজে লাগেনা। আবার জায়গা মতো ফুটওভারব্রিজ থাকলেও তা ব্যবহারের কোনো উপায় নেই। পানিতে কুমীর তো ডাঙায় বাঘের মতোই রাস্তায় জীবনের ঝুঁকি তো ওভারব্রিজে নিশ্চিত ছিনতাই। ওভারব্রিজগুলো দিয়ে রাস্তা পারাপারের কোনো পরিবেশই নেই। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়েই প্রতিনিয়ত রাস্তা পার হন হতভাগ্য পথচারীরা।
রমনা থানার অফিসার ইনচার্জ নাকি বলেছেন, মধুমতির এই গাড়িটির বাসচালক ভুয়া লাইসেন্স দিয়ে গাড়ি চালাতো। তো এক্সিডেন্ট করা ছাড়া কি ওইসব ড্রাইভারকে ধরার কোন ব্যবস্থা নেই দেশে? বাসগুলো যত্রতত্র থামে, আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে গাড়ি চালায়, কী করে পায় তারা এতো সাহস? মধ্যবিত্ত মরে মরে শেষ হয়ে যাক কারো কিছু যায় আসেনা। এই ছোট্ট এক শহরে লক্ষ লক্ষ প্রাইভেট গাড়ি রাস্তা অচল করে রাখে। তবু সরকার আরো ছোট গাড়ি আনার অনুমতি দেয় কিন্তু প্রয়োজনীয় সংখ্যক বাস আনেনা বা কোম্পানীগুলোকে বাধ্য করেনা বেশি বাস দিতে। যাদের গাড়ি নেই তারা ইঁদুরের মতো পুরোনো লক্কর ঝক্কর বাসে বোঝাই হয়ে পথ চলে। একেকটি গাড়িতে ধারণক্ষমতার তিনগুন যাত্রী ওঠায়। বাসে উঠতে নামতে প্রতিটি যাত্রীর প্রাণ কাঁপে। বাসের ড্রাইভার হেল্পাররা তাদের মানুষই মনে করেনা তো গায়ের উপর দিয়ে চালাতে বাধবে কেন।
মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার বলেছেন সড়ক দুর্ঘটনায় চালকের দোষ প্রমানিত হলে ২ বছরের(মাত্র!) শাস্তির বিধান নাকি আছে। তবে নিহত ব্যক্তির পরিবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চালকের শাস্তি নিশ্চিত করা যায় না। যার আপনজন চলে যায় সে ড্রাইভারকে দুই বছর জেল খাটাতে আগ্রহ নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাবে এটা কি আশা করা যায় কোনোভাবেই! এমন অদ্ভুত আইন হলো কি করে সেটাই প্রশ্ন! কিন্তু হয় এবং টিকেও থাকে। এ জন্যেই প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় অসংখ্য মানুষ। এদেশে প্রতিবছর গড়ে ১০-১২ হাজার মানুষ মারা যান আহত হন ২০-২৫ হাজার। জানা যায় আইনি দুর্বলতার কারনে এসব দুর্ঘটনার একটিরও বিচার হয়নি।
না সরকার না প্রতিষ্ঠান কারো মাথাব্যাথা নেই। স্কুলগুলো এতো হাজার হাজার টাকা নেয় ছাত্রদের কাছ থেকে ইচ্ছে করলে কি তারা পারেনা ছাত্রদের জন্য সল্পমূল্যে বাসসার্ভিস চালু করতে? পারে কিন্তু করবেনা কারন স্কুল চালু করা যত সহয, বাস সার্ভিস দেয়া তত নয়। এত দায়দায়িত্ব কেউ ঘাড়ে নিতে চায়না। হামিমের মৃত্যুর ঘটনায় উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন। স্কুলের সব শিক্ষক, কর্মচারী, ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছেন। বৈঠকে আনুষ্ঠানিকভাবে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। হামিমের মায়ের দ্রুত সুস্থতা কামনাসহ শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানানো হয়েছে। বিশেষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। অধ্যক্ষ নিহত ছাত্রের প্রতি সমবেদনা জানাতে শোক দিবস পালনসহ প্রভাতী ও দিবা শাখার সব ক্লাস বন্ধ ঘোষণা করেছেন, প্রতিষ্ঠানের পতাকা অর্ধনমিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমরা কেবল এটুকুই করতে পারি। কিন্তু এও আমরা জানি যে যার গেছে হামিমের আপনজনদের কাছে এসব সহানুভুতি কোন সান্ত্বনাই বয়ে আনবেনা। হামিম সুমিদের বাঁচানোর কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




