প্রয়োজন একটি সমতাপূর্ণ সমাজকাঠামো নির্মাণ
সুদূর কানাডায় বসে আমার বান্ধবী একটি কবিতা লিখেছে - নারীর শরীরের ধর্ম বড় বিচিত্র/ ধরে বেঁধে কবুল বলালেই/ শরীর কবুল বলে না।/ শরীর কবুলের জন্য চাই মনের চাহিদামাফিক স্পেসিফিক রিএকট্যান্ট/ সাথে থাকা চাই পারফেক্ট ভৌত পরিবেশ/ এবং কখনো কখনো/ নির্দিষ্ট কিছু অনুঘটকও লাগতে পারে-/ নাহলে প্রাণীকুলের স্বাভাবিক নিয়ম মেনে/ নতুন বংশ বিস্তার ঘটায় বটে/ তবে সময় সময় অনুকুল পরিবেশ পেলে/ কবুলের ‘খ্যাতা’ চুলায় দিয়ে/ ফুকনিতে ফুঁ দিতে দিতে/ অনায়াসে খুঁজে নিতে পারে/ স্পেসিফিক রিএকট্যান্টের ঠিকানা।
কবিতাটি পড়ে আমি শিহরিত হই। বাংলাদেশে বসে এই সত্য উচ্চারনের সাহস তার হয়তো হতোনা। এই কবিতা লেখার পরদিনই তাকে হয়তো মুরতাদ ঘোষণা করা হতো, তার কল্লার দাম ধরা হতো ল কোটি টাকা। সমাজচ্যূত, সংসারচ্যূত হতে হতো তাকে। নারী তার শরীরের কথা ভাববে, শরীরের সিদ্ধান্ত নেবে এ কারোরই সহ্য হয়না। এমনই আমাদের সমাজ। নারীবাদের একশত বছর পার হয়ে গেলেও নারীর অবস্থা এখনো একই রয়েছে বরং অনেক েেত্রই অবনতি হয়েছে। নারী আগে কেবল হাতে মার খেতো কিন্তু এখন ভাতেও মরছে। আগে সে লড়েছে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে এখন পিতৃতন্ত্র আর পুরুষতন্ত্র একসাথে তার ঘাড় কামড়ে ধরেছে। পিতৃতন্ত্র মানুষ হিসেবে তার অধিকার খর্ব করে, তার স্বাধীন মতামতকে স্বীকার করেনা, তার সিদ্ধান্তকে উপো করে। পিতৃতন্ত্রের প্ররোচনায় এখন পর্যন্ত মেয়েরা চ্যালেজ্ঞিং কাজের প্রতি উৎসাহিত হচ্ছেনা এখন পর্যন্ত তারা উচ্চশিতি হওয়ার চেয়ে বিয়েকে নিরাপদ ভাবতে শিখছে। কিন্তু পুরুষতন্ত্র প্রবল আক্রোশে তার অস্তি¡ত্বকেই বিনাশ করতে চায়। আজ নারীকে তাই এসিডে জ্বলতে হয়, আগুনে পুড়তে হয়, খুন হতে হয় অথবা শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে নি®কৃতি দিতে ও পেতে হয়। এসিড থেকে আগ্নেয়াস্ত্র পর্যন্ত সব কিছুই প্রয়োগ হচ্ছে নারীর শারীরিক নির্যাতনের কাজে। আর নারীর মানসিক নির্যাতন কত রকমের হতে পারে তা বলে শেষ করার নয়।
একসময় বলা হতো শিাই পারে নারীকে এই অবস্থা থেকে রা করতে। কিন্তু আজ শিতি নারীদেরকেও যৌতুকের বলি হতে দেখে, স্বামী ও স্বামীর বাড়ির অন্যান্যদের হাতে অত্যাচারিত হতে দেখে, প্রেমিকের কাছে নিষ্ঠুরভাবে প্রতারিত, নিগৃহীত এমনকি ধর্ষিত হতে দেখে, সমাজের প্রতিটি জায়গায় তাকে বৈষম্যের শিকার হতে দেখে আমাদের সেই ভুল ভেঙেছে। এরপর বলা হলো না শুধু শিা নয় অর্থনৈতিক মুক্তিই নারীকে স্বাধীন করবে। কিন্তু সে আশায়ও গুড়েবালি। বরং অর্থ উপার্জনের প্রতিটি েেত্র নারীকে পণ্য করে তোলা হয়েছে অথবা করার চেষ্টা করা হয়েছে। অপরদিকে নারী হয়েছে দ্বৈত শোষনের শিকার। বাইরে কাজ করার কারনে সংসারের কাজ থেকে সে রেহাই পায়নি। কষ্টার্জিত অর্থ নিজের ইচ্ছে বা প্রয়োজনমতো খরচ করার স্বাধীনতা পায়নি বরং উপার্জনটি স্বামীর বা তার পরিবারের হাতে তুলে দিয়েই সে চাকরি করার অনুমোদন পায়। আবার নিজ যোগ্যতাবলে চাকরি করতে যেয়েও তাদেরকে প্রতিনিয়ত বৈষম্যমূলক আচরণ, যৌন হয়রানি, সহিংসতা ইত্যাদি নানা রকম প্রতিকুলতার মধ্যে টিকে থাকার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয় বা আপোষের কথা ভাবতে হয়। এ যেন ডাঙায় বাঘ তো জলে কুমির। যেসব নারীরা প্রথমেই অধীনতা স্বীকার করে নেন তারা হয়তো পুরুষেরই সহযোগিতায় (সে বাবা, ভাই, বন্ধু, স্বামী যেই হোক না কেন) একরকমের গ্লামারাস মতা অর্জন করেন। আজকাল প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্র করে এরকম একটি শ্রেণী তৈরী হয়েছে, সেখানে তারা কিছু আলংকরিক ডিরেক্টরের পদ দখল করে। এছাড়া রাজনীতিতে, ব্যবসায়, কর্পোরেট অফিসগুলোতে ব্যাপকভাবে এরকম চর্চা দেখা যায়। এসব নারীরা নারী প্রজাতির হলেও পুরুষতন্ত্রেরই ধারক বাহক। কিন্তু প্রতিভাবান যে নারী, যিনি নিজে সিদ্ধান্ত নিতে চান, সত্য উচ্চারণ করতে চান, মানুষ হিসেবে যেসব অধিকার তার প্রাপ্য তা প্রয়োগ করতে চান তার আর উপায় নেই। তাকে পতিত হতেই হবে, বেছে নিতে হবে নিঃসঙ্গ একাকী জীবন। একটি কথা প্রচলিত আছে যে ‘প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনেই আছেন একজন নারী’ কিন্তু সফল নারীর েেত্র চিত্রটি একেবারে উল্টা। প্রতিভাবান নারী, সফল নারী সব সময়েই একা।
নারীর মতায়ন নিয়ে এখন ব্যাপক কথাবার্তা হচ্ছে। ধরে নেয়া হচ্ছে নারীর মতায়নই নারীকে এই অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করবে। কিন্তু আমাদের দেশে প্রায় দুই দশক ধরে নারী নেতৃত্ব চলছে। এদিক থেকে আমরা ইতিহাস তৈরী করেছি। রাজনীতি, প্রশাসনসহ সবখানেই নারীর অংশগ্রহন
সন্তোষজনক না হলেও আগের চেয়ে তা বেড়েছে। কিন্তু নারী নিরাপদ হয়েছে কি? তার প্রতি সহিংসতা অত্যাচার কমেছে কি? এখনো এই দুবছর আগেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় নারী নীতি পাশ করা সম্ভব হয়নি মৌলবাদীদের বিরোধিতার কারনে। সেই সরকারের পিছনে ছিল সামরিক শক্তি, তারা অনেক মতার চর্চা করেছে, রাঘব বোয়ালদের জেলে পর্যন্ত ঢুকিয়েছে। কিন্তু মৌলবাদের কাছে ঠিকই পরাজিত হয়েছে। নারী নীতি পাশ না করে স্থগিত করেছে, লালন ভাস্কর্যকে রা করতে পারেনি, অপরাধীদের শাস্তির বিধানও করতে পারেনি, মতিঝিলে বিমান অফিসের সামনে পা ভাঙা বলাকাদের গলায় এখনো দড়ির ফাঁস। কাজেই বুঝতে হবে ভুতের বাস আসলে সরিষার ভেতরেই। আগে সরকারকে নারীবান্ধব হতে হবে। উচ্চপর্যায় থেকে পুরুষতান্ত্রিকতার ভুত দূর করতে হবে।
বিচ্ছিন্নভাবে নারীদেরকে চাকরি দিলে বা বৃত্তিমুলক শিা দিলেই নারীর উন্নতি হবেনা, বৈষম্যহীন পরিবেশ তৈরী করতে না পারলে দীর্ঘমেয়াদে তা নারীর জন্য আরো বেশি তির কারন হবে। নারী পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়নে প্রয়োজন যথাযথ শিার মাধ্যমে মানসিক উৎকর্ষ সাধনের। শিতি হলেই নারীকে সম্মান করবে এমন কোন কথা নেই। তথাকথিত শিতি প্রগতিশীল পুরুষদেরকে দেখেছি কী অবলীলায় হাসতে হাসতে সম্মানিত মহিলাদের সম্পর্কে অসম্মানজনক উক্তি করছে অসম্মানজনক শব্দ ব্যবহার করছে। তাই একটি সমতাপূর্ণ সমাজ কাঠামো নির্মাণ করতে হবে, যেখানে পুরুষ বা নারী নয় মানুষের অধিকারের কথা থাকবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




