somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জাহাজী জীবনের গল্প: আটলান্টিক ঘুরে নাইজেরিয়া, কালো মেয়ের রূপকথা (1)

২২ শে অক্টোবর, ২০০৬ ভোর ৫:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পেরিয়াসে সপ্তাখানেক কাটলো জাহাজে ছোটখাট মেরামতের কাজে। এবার আমাদের যাত্রা বেশ দুরে। নাইজেরিয়ার ওয়ারি পোর্টে। কোন এক সকালে বন্দর ছাড়লো জাহাজ। ঘুমিয়ে ছিলাম ভোর চারটের ডিউটি শেষে, জেগে দেখি মাঝ সমুদ্রে জাহাজ। সমুদ্র সামান্য উত্তাল। এবার জিব্রাল্টার পেরুবো, দেখব ভুমধ্যসাগর আর আটলান্টিকের সঙ্গমস্থল, ভাবতেই উত্তেজনা অনুভব করলাম। জাহাজের অন্য নাবিকদের ভেতরেও সে উত্তেজনা টের পেলাম।

চার দিনরাত্রি একটানা চলার পর পৌছলাম সকাল দশটার দিকে জিব্রাল্টারের সীমানায়। ডানপাশে স্পেন, বা পাশে মরক্কোর উপকুল। মরক্কোর কিছুটা অংশ আবার স্পেনের দখলে। সেদিন শান্ত ভুমধ্যসাগর, শান্ত আটলান্টিক, অথচ দুই সাগরের মিলনমেলায় ফেনিল উম্মত্ত ঢেউ। জাহাজের খোলের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সে ঢেউএর পাহাড়। কেবিন ছেড়ে বাইরে আসার কোন সুযোগ নেই। ঢেউ এর চাবুক আছড়ে ফেলবে মুহুর্তেই সমুদ্রে। তারপরও এ ঢেউ ছন্দিত, জাহাজ এর মাঝেই এগিয়ে চললো ঢেউ কেটে কেটে। ডান দিকে বন্দর, প্রাসাদ আর জনপদ, বা্থদিকে নিরবিচ্ছিন্ন সমুদ্রতট আর ধু ধু মরুভুমি।

জিব্রাল্টার প্রনালী পেরিয়ে পড়লাম আটলান্টিকে। সমুদ্র শান্ত হয়ে এলো ধীরে ধীরে। আমরা বামে দিকপরিবর্তন করে আফ্রিকার উপকুলকে বায়ে রেখে দক্ষিনে এগিয়ে চললাম। নাইজেরিয়ার পথে রসদ নেবার জন্যে আমাদেরকে থামতে হবে সিরিয়ালিওন এর রাজধানী ও বন্দর ফ্রিটাউনে, প্রায় দশদিনের পথ। ততদিন অবধি এ সময়টুকু শুধু চলা আর চলা। এরই মাঝে একবার বিকল হলো জেনারেটর। বিদ্যুত বন্ধ, তো বন্ধ সবই। মেরামতে সময় গেলো বারো ঘন্টা। জাহাজ বল্গাহীন হয়ে ভেসে বেড়ালো সমুদ্রে। আবহাওয়া ভাল থাকায় কোন বিপদের মুখোমুখি হতে হলো না। আটলান্টিক তখন ছোট্ট এক নদীর মতোই শান্ত। এতটা শান্ত কেউ আশা করে নি।

আমাদের মুল উদ্দেশ্য, কিছুটা টাকাকড়ি জমিয়ে উচ্চশিক্ষা। তা ভুললে চলবে কি করে। তাই ফ্রিটাউনে একদিন ছুটি নিয়ে বন্ধুর ফরাসী সাথে দুতাবাসে গেলাম স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে খোজখবর করার জন্যে। ফরাসী দুতাবাস হতাশ করলো। মন খারাপ করে আমরা ফিরে এলাম বন্দরে। হাতে সময় ছিল। বন্দরেই সমুদ্রের পাড়ে খোলা জায়গায় একটি বেদির উপরে বসলাম দু্থজনে। চোখের সামনে তখনো অজানা ভবিস্যতের কালো মেঘ। আমাদেরকে অবাক করে আটোসাটো পোষাক পড়া এক আফ্রিকান সুন্দরী এসে দাড়ালো সামনে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকালাম।
- আমার সাথে শুতে চাও?
একেবারে সরাসরি প্রস্তাব ! আর আমার জীবনে এ ধরনের প্রস্তাব এই ই প্রথম। ভড়কে গেলাম ভীষন, তাই কোন কথা জোগালো না মুখে। কিন্তু আমার বন্ধু একটু হেসে উত্তর দিল
- না
তারপরো মেয়েটি বসলো এসে আমাদের পাশে। প্রমাদ গুনলাম। এবার হয়তো জোরজারি শুরু করবে।
- তোমাদের দেশ কোথায়?
- বাংলাদেশ।
- বাংলাদেশ কোথায় ? ইন্ডিয়ার কাছে ?
- হ্যা, পাকিস্তান ও ইন্ডিয়ার মাঝামাঝি।
উত্তর শুনেই পাল্টে গেল মেয়েটির চেহারা। মনে হলো কোন এক সপনপুরী জেগে উঠেছে তার চোখের সামনে। অনেকটা সপ্নের ঘোরেই যেন বললো
- তেমন কিছুই জানিনা তোমাদের দেশের কথা, ভারতের কথা। তবে আমাদের কাছে এ যেন এক রূপকথার রহস্যপুরীর মতো। আমাদের যতকিছু অজানা, সব যেন লুকিয়ে আছে তোমাদের ওখানেই। তেমাদের কামরুপ, কামাখ্যার কাহিনী আমরা অনেক শুনেছি।

আরো অনেক কিছু বললো মেয়েটি। এমনকি বলিউড সিনেমার কথাও। তার প্রভাবে ভারত আফ্রিকাতেও বেশ পরিচিত। আফ্রিকান ইংরেজীর উচ্চারণে অনেককিছুই অবোধ্য রয়ে গেল। জাহাজী আমরা, কঠিন প্রতিটি দিন, প্রায় কুড়ি দিন একটানা কাটিয়েছি জলের উপর। তারপরেও আফ্রিকার এক বারবনিতার আশা সপ্নের শুনে এক নরম অনুভুতি নিয়ে ফিরে এলাম জাহাজে।

একটানা দশদিন জলের উপর কাটানোর পর ওয়ারী পোর্ট থেকে ৫২ কিলোমিটার দুরে এক সমুদ্র নদীর মোহনায় এসে পৌঁছলাম আমরা। এই পথ নদীপথে পেরিয়ে বন্দরে পৌঁছাব। মোহনা পেরিয়ে নদীর ভেতর ঢুকতেই মাটির মিষ্টি এক গন্ধ পেলাম। এ গন্ধ সমুদ্রে নেই, মাটি আর মানুষের যেখানে বাস, এ গন্ধের স্থান সেখানেই। এ গন্ধ যেন নিজেরই মাটির গন্ধ। দেশের জন্য আনচান করে উঠলো বুকের ভেতর। নদীর ঘোলা জল, নৌকা, দুই পারে বসতি মনে করিয়ে দিল, আমরা ঘুধুমাত্রই জাহাজী নই, আমরা স্থলেরই মানুষ। নদীর দুই পারে আমাদের দেশের মতোই গ্রাম আর গ্রাম। ছোট ছোট বাড়ী, অনেকটা আমাদের দেশেরই কুড়েঘরের মতো।

ভোর চারটায় ডিউটি শেষ করে ঘুমোতে গিয়েছিলাম। দশটায় ঘুম থেকে জেগে দেখি নদীর কোন এক চড়ায় আটকে আছে জাহাজ। জোয়ার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। জাহাজের চারপাশে সারি সারি ডিঙ্গি নৌকা। নৌকায় আশে পাশের গ্রামের গরীব শিশু। সবাই জাহাজ থেকে কিছু পাওয়ার আশায় এসেছে। আর আমাদের মায়রা (জাহাজের বাবুর্চী) খেলছে এক মজার খেলা। জাহাজে পুরোনো হয়ে যাওয়া কিছু সাবানের প্যাকেট ছিল। সে তা থেকে একটি একটি করে নদীতে ছুড়ে ফেলছে। শিশুগুলো ভাল সাতারু, নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে মুহুর্তেই তুলে আনছে তা। তৃতীয় বিশ্বের মানুষ আমি। এমন নির্দয় খেলা আমারই দেশের মতো আরেক দেশের গরীব শিশুদের সাথে। রক্ত চড়ে উঠলো মাথায়। আগের পর্বে কোথাও লিখেছিলাম, মায়রা জাহাজে কাজ করলেও সাঁতার জানে না, তাই জলে তার ভয় ভীষন। চেপে ধরলাম গিয়ে তাকে। ঝাকুনি দিয়ে বললাম,

- সাবানগুলো যে ভাবে ফেলছিস, আমিও তোকে এবার পানিতে ফেলব। ভয় নাই, মরবি না তুই। দেখছিস না ওরা ভাল সাতারু। তোকে ঠিকই তুলে আনবে।

ভয়ংকর ক্ষেপে গেল মায়রা। জাহাজের অন্য নাবিকরা না থাকলে দুজনের ভালো একটা মারামারি বেঁধে জাহাজে। তবে মায়রা তার খেলা বন্ধ করল। নাবিকদের বস এসে বিলিয়ে দিল সাবান শিশুদের মাঝে। মায়রা ক্ষিপ্ত আমার উপর, তাই দুপুরের খাবার ভাল জুটলো না। আমার নিজেরও বিষন্ন ও বিক্ষিগ্ত ছিল মন। তাই দুপুরে কিছু না খেয়েই এককাপ কফি হাতে জাহাজের খোলে ডিউটিতে ঢুকলাম।

চলবে....
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০০৬ রাত ৮:২৪
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদের উচ্চ কক্ষের নির্বাচন আগে দিয়ে দেখতে দিন কে বাঘ কে বিড়াল?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪৬



সব দলের অংশগ্রহণে পিআর পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদের উচ্চ কক্ষের নির্বাচন আগে দিন। কোন দলকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে কি করেনি সেইটাও জাতিকে দেখতে দিন। পিআর পদ্ধতির জাতীয় সংসদের উচ্চ... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রকৌশলী এবং অসততা

লিখেছেন ফাহমিদা বারী, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১১:৫৭


যখন নব্বইয়ের দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং পছন্দ করলাম পুরকৌশল, তখন পরিচিত অপরিচিত অনেকেই অনেকরকম জ্ঞান দিলেন। জানেন তো, বাঙালির ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ডাক্তারিতে পিএইচডি করা আছে। জেনারেল পিএইচডি। সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:১৫

আমি ভারতকে যাহা দিয়াছি, ভারত উহা সারা জীবন মনে রাখিবে… :) =p~

ছবি, এআই জেনারেটেড।

ইহা আর মানিয়া নেওয়া যাইতেছে না। একের পর এক মামলায় তাহাকে সাজা দেওয়া... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের কবিতাঃ আমি বীরাঙ্গনা বলছি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১৫


এখনো রক্তের দাগ লেগে আছে আমার অত্যাচারিত সারা শরীরে।
এখনো চামড়া পোড়া কটু গন্ধের ক্ষতে মাছিরা বসে মাঝে মাঝে।

এখনো চামড়ার বেল্টের বিভৎস কারুকাজ খচিত দাগ
আমার তীব্র কষ্টের দিনগুলোর কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×