দরজার কাছাকাছি পৌঁছেই মনে হলো, কোন এক খাবারের গন্ধই তাকে টেনেছে ওখানে। সত্যি সত্যিই একটা দুধের বাটি সেখানে। সাদা রুটির ছোট ছোট টুকরো ভাসছে সে দুধের উপর। সকালে চেয়েও অনেক বেশী ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর গ্রেগর, তাই আনন্দে হাসতে ইচ্ছে হলো তার। মাথা নুইয়ে প্রায় চোখ অবধি ডুবিয়ে দিল দুধে। কিন্তু সাথে সাথেই বেজার হয়ে মুখ উঠিয়ে নিতে হল তার। কারন এটা নয় যে, বা' দিকের ব্যাথার কারণে সমস্ত শরীরের পেশীশিক্ততে টেনে দুধ খেতে অসুবিধা হচ্ছে । দুধ তার খুবই প্রিয়, সেটা জেনেই হয়তো তার বোন বাটিটি রেখেছে ওখানে। কিন্তু মুখে একেবারেই রুচি হলোনা তার। বিরক্তিতে বাটিটি ছেড়ে ঘরের মাঝে ফিরে এলো সে।
দরজার ফাঁক দিয়ে বসার ঘরে বাতি জ্বলতে দেখতে পেল গ্রেগর। সাধারনত: এসময়ে ওঘরে বসে বাবা মা ও বোনকে বিকেলের পত্রিকা থেকে কোন খবর জোর গলায় পড়ে শোনাতেন, আজ সেরকম কোন শব্দই শোনা গেল না। এটা তার বোন তাকে অনেক বার বলেছে, এমনকি লিখেও জানিয়েছে। হয়তো এ চর্চাটি কোন কারণে ক্থদিন থেকে বাদই দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারপরও চারপাশ এত বেশী নি:স্তব্ধ, অথচ জানা কথা বাড়িটি খালি নয়। 'কি এক নিবিড়, শান্ত জীবন পালন করে এই পরিবার'! সেই তো তার বাবা মা ও বোনের জন্যে এমন একটি সুন্দর বাড়ীতে এমনি এক সাজানো জীবনের কারিগর। অসহায় অবস্থায় নিজে অন্ধকারে পড়ে, তারপরও একথা ভেবে খুব গর্বিত হলো গ্রেগর। কিন্তু এই প্রচুর্য, এই শান্তির, হঠাৎই এমনি এক ভয়াল পরিসমাপ্তি ঘটবে? এই ভাবনায় ডুবে অস্থির হয়ে নিজেকে না হারানোর চেষ্টায় গ্রেগর তার ঘরের মাঝেই কিলবিল করে নড়াচড়া শুরু করলো।
টানা পুরোটা সন্ধ্যায় একবার একটি দরজা ও আরেকবার আরেকটি দরজা অল্প একটু ফাঁক করে একবার খুলে দ্রুত আবার বন্ধ করে দেয়া হলো। কারো হয়তো ভেতরে আসার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সাহস হয়নি। গ্রেগর বসার ঘরের দরজার সামনে অগেক্ষায় রইল, যাতে কেউ আসতে চাইলে তাকে ভেতরে ডেকে আনতে পারে। তার সমস্ত অধীর অপেক্ষা ব্যার্থতায় পর্যবসিত হলো। যখন দরজা বন্ধ ছিল সকালে, সবাই আসতে চাইল এই ঘরে। এখন একটি দরজা খোলা ও আরেকটি সারাদিনে খোলা হয়েছে অবশ্যই। কিন্তু কেউই ভেতরে আসতে চাইছে না। চাবিও বাইরে থেকে আটকানো।
গভীর রাতে বসার ঘরের আলো নেভানো হলো। বোঝা গেল, বাবা, মা আর বোন জেগেই ছিল এতক্ষন। স্পষ্ট শোনা গেল, তারা পা টিপে টিপে ফিরছে নিজেদের ঘরে। জানা কথা কাল সকাল অবধি কারো আসার সম্ভাবনাই আর নেই। গ্রেগর অবসর পেলো তার তার সামনের জীবনকে নতুন করে সাজানোর পথ খোঁজার। এই উঁচু একটি ঘরে লম্বা হয়ে মাটিতে পড়ে থাকতে তার ভয় হলো খুব। অথচ গত পাঁচটি বছর ধরে তার এই ঘরেই বাস। স্বতস্ফুর্তভাবেই একটি সোফার নীচে স্থান খুঁজে পেল সে। পিঠ একটু ঠেকছে উপরে, মাথাও পুরোটা তুলতে পারছে না। তারপরও এই জায়গাটিই তার কাছে সবচেয়ে বেশী নির্ভরযেগ্য বলে মনে হলো। একটু হতাশ হলো এই ভেবে যে, তার চওড়া শরীর সোফার পরিসরে পুরোটা ঢেকে থাকল না।
সারাটি রাত সে আধোঘুমে ওখানেই কাটালো। মাঝে মাঝে জেগে উঠলো ক্ষুধায়, কখনো দুর্ভাবনায় কখনো বা নতুন কোন আশার হাতছনিতে। প্রতিবারই একই সিদ্ধান্তে উপনিত হলো, নিজে শান্ত থেকে পরিবারকে সবরকম যন্ত্রণা থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে। আজ সকালে যে পরিস্থিতি তৈরী করতে বাধ্য হয়েছে, এর পূনরাবৃত্তি যাতে আর না হয়।
পরদিন খুব ভোরেই, বাইরে যখন অনেকটাই অন্ধকার, তখন তার গতরাতের সিদ্ধান্তের দৃঢ়তা প্রমাণের সুযোগ পেলো গ্রেগর। তার বোন দিনের পোষাক গায়ে বসার ঘরের দরজাটি একটু ফাঁক করে উত্তেজনায় টান টান হয়ে ভেতরের দিকে তাকালো। শুরুতে গ্রেগরকে সে দেখতে পেলনা। হায় খোদা! কোথায় সে! উড়ে তো যায়নি? পরমূহুর্তেই সোফার নীচে চোখ গেল তার। এত বেশী ভয় পেলো যে, নিজেকে সামলাতে না পেরে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল। পরমূহুর্তে মনে হলো নিজের কাছে নিজেই লজ্জা পেলো সে। তাই সাথেই আবার দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। কিন্তু এমন সাবধানে ঢুকলো, যে মনে হলো এটা কোন মরণাপন্ন রোগী বা অপরিচিত কোন লোকের ঘর। গ্রেগর তার মাথা সোফার প্রান্তে এনে বোনকে লক্ষ্য করলো। দুধ পড়ে আছে তা যে কোন অবস্থাতেই গ্রেগরের ক্ষিদে না থাকার কারণে নয়, বুঝবে কি বোন? সে কি এমন কোন খাবার আনবে, যাতে তার রুচি হতে পারে? বোনকে এ বিষয়ে কিছু বলার চেয়ে ক্ষিদেয় মরে যাওয়াই ভাল। তারপরও তার অদম্য ইচ্ছে হলো, সোফার নীচ থেকে বেরিয়ে বোনের পায়ে পড়ার ও তাকে ভাল খাবার আনার অনুরোধ করার। কিন্তু বোন প্রায় সাথে সাথেই অবাক চোখে পরিপূর্ণ বাটিটার দিকে তাকাল। সামান্য দুধ পড়ে আছে বাটির চারপাশে। একটি ন্যাকড়ায় ধরে ওটাকে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল সে। কি হাতে বোন আবার ফিরে আসে, এ নিয়ে নানা ভাবনার ছক কাটলো গ্রেগর। কিন্তু কোন কুলকিনারা পেল না। একটি পুরোনো কাগজে নতুন কিছু খাবার নিয়ে এল বোন, হয়তো গ্রেগরের রচি পরীক্ষার উদ্দেশ্যেই। একটুকরো আধপঁচা সবজী, গত রাতের খাবারের উচ্ছিষ্ট হাড়গোড়, গায়ে যার ঠান্ডা শক্ত ঝোল লেগে। কয়েক টুকরো কিসমিস আর কাজুবাদাম, এক টুকরো পনির, যা দু্থদিন আগে গ্রেগরই অখাদ্য বলে খেতে চায়নি। সেই সাথে আনলো এক এক টুকরো করে শুকনো রুটি, মাখন লাগানো রুটি ও মাখন লাগানো নোনতা রুটি। আর দয়াপরবশ: হয়েই হয়তো, খাবারগুলো রেখেই সে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। ভাবলো গ্রেগর তার উপিস্থতিতে হয়তো খেতে চাইবে না। বাইরে থেকে তালা বন্ধ করলো, যাতে গ্রেগর কোনরকম সংকোচ করতে বাধ্য না হয়। খাবারের কাছে যাবার সময় দূর্বলতায় পা গুলো কেঁপে উঠলো তার। কিন্তু যে সব ক্ষতস্থান শরীরে ছিল, সেগুলো আর নেই, কোন ব্যথাও টের পেল না। গ্রেগর অবাক হলো খুব। এক মাসেরও বেশী আগে ছুড়ির খোঁচায় আঙ্গুল কেটেছিল সামান্য। গত পরশু অবধিও টের পেয়েছে সে যন্ত্রণা। 'আমার অনুভুতি কি ভোতা হয়ে গেল'? ভেবেই লোভীর মতো পনিরে মুখ দিল সে। এই পনিরের টুকরোটিই সমস্ত খাবারের মাঝে সবচেয়ে আকর্ষনীয় মনে হলো তার। খাবার আনন্দে চোখে জল এলো । পনির, সবজী ও ঝোলের পুরোটাই সে খেয়ে ফেললো, অথচ তাজা খাবার খাওয়ার কোন রুচিই তার হলোনা, এমনকি সেগুলোর গন্ধও তার সহ্য হলোনা। তার পছন্দের খাবারগুলো তাজা খাবার থেকে দুরে সরিয়ে আনলো। দ্রুত খাওয়া শেষ করে আলস্যে একই জায়গায় পড়ে রইল সে। বোন ধীরে ধীরে চাবি ঘুরিয়ে ভেতরে আসার ইঙ্গিত দেওয়ায় চমকে উঠলো গ্রেগর। টলতে টলতে হলেও তাড়াতাড়ি আবার সোফার তলায় জায়গা নিল সে। যেটুকু সামান্য সময় বোন ঘরে ছিল, সে সময় সোফার নিচে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল তার। অতিরিক্ত খাবারে শরীর কিছুটা ফেঁপে ওঠায় সোফার নীচের সংকীর্ন জায়গায় নি:শ্বাস নেয়া সহজ ছিল না। এই শ্বাসকষ্টের মাঝে বড় বড় চোখে দেখলো সে, শুধুমাত্র ইতস্তত: ছড়ানো খাবারই নয়, যে খাবার গ্রেগর ছোঁয় নি, সেগুলোও ঝাট দিয়ে দ্রুত একটি বালতিতে পুরলো বোন। তারপর একটি ঢাকনায় বালতিটি ঢেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বোন চরে যাবার পরমূহুর্তেই সোফার নীচ থেকে বেরিয়ে এল গেগর। নিজের শরীন টান টান ও প্রসারিত করলো।
অসমাপ্ত ....
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



